ভবঘুরেকথা
ব্রাহ্মসামাজ

ব্রাহ্মোপসনা প্রচলন ও পদ্ধতি

ব্রাহ্মোপসনার প্রচলন:

বৈদিকযুগের ঋষিদের উপলব্ধজ্ঞান কালে ঢাকা পরে যায়, ব্রহ্মধ্যান-সাধনা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়। ঈশ্বর পূজার নামে, তন্ত্র, মন্ত্র, আচার-অনুষ্ঠানের বেড়াজালে, মানুষের মন আবদ্ধ হয়ে যায়। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষের এক মহাদুর্গতির দিনে রাজা রামমোহন রায় এই হৃত ঐশ্বর্যকে ফিরিয়ে আনেন। ঋষিরা যে ব্রহ্মোপাসনা পর্বতশিখরে বা বনে-নির্জনে করতেন, সেই উপাসনা তিনি লোকালয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলন করেন।

ব্রহ্মোপাসকদের নিয়ে তিনি ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘উপাসনা-সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের লোক এখানে মিলিত হয়ে একমাত্র অদ্বিতীয় পরমেশ্বরের উপাসান করতেন। পরবর্তীকালে, তাঁর উত্তরসাধক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রহ্মোপাসকদের মণ্ডলীবদ্ধ করেন ও কতকগুলি নিয়ম-পালন প্রচলন করেন। ক্রমে তাঁরা ব্রাহ্ম বলে পরিচিত হন। পরে সকল ব্রাহ্ম ও ব্রাহ্মসমাজে পাঠের জন্য এক ধর্মগ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এই গ্রন্থের নাম ‘ব্রাহ্মধর্ম্ম’।

ব্রহ্মোপাসনা

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অসীম আকাশ, তরুলতা, নদী, সমুদ্র, পাহাড় দিয়ে গড়া এ পৃথিবী ও সকল প্রাণী, এ সবের মধ্যেই রয়েছে ব্রহ্মের প্রকাশ। আর তিনি রয়েছেন মানবাত্মার গভীরে। এই দু’ক্ষেত্রে ব্রহ্মর মহিমা উপলব্ধি করাই হল ‘ব্রহ্মোপাসনা’।

প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে (ভোরে, দৈনিক কাজ শুরু করার আগে প্রকৃষ্ট সময়) নীরবে, স্থির হয়ে বসে, ঈশ্বরের স্বরূপ ধ্যান ও চিন্তা করা; মানুষের জীবনধারণের ও মঙ্গল সাধনে আমরা যা কিছু ঈশ্বরের দান পেয়েছি সেজন্য মঙ্গলময় ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো; আপন ও পর সব মানুষের প্রতি প্রেমভাব জাগানো ও মানব-কল্যাণ কাজে নিজেকে নিযুক্ত রাখার প্রতিজ্ঞা করা ও সৎভাবে জীবনযাপন করার জন্য শক্তি প্রার্থনা করা; এভাবে উপাসনা করা যায়।

উপাসনাকালে, মনকে বৈষয়িক চিন্তা থেকে মুক্ত রেখে ঈশ্বরমুখী কারার জন্য গান করা ভালো। এতে মন শান্ত হয়। প্রার্থনা ও আত্মনিবেদন গানের মাধ্যমে করা যায়। ব্রহ্মোপাসক ও ভক্তদের রচিত এই সব গানই হল ‘ব্রহ্মসংগীত’। উপাসনার জন্য স্তোত্র ও স্তবমন্ত্রও আছে।

উপাসনায় প্রাপ্তি

উপাসনাকালে মন কে শান্ত, অন্তর্মুখী ও ঈশ্বরাভিমুখী করা হয়। নিয়মিত ঈশ্বরের মহিমা আরাধনা করা ও মানুষের প্রতি মনে প্রেম জানাগোর চেষ্টা করা, এই অভ্যাসের দ্বারা মন ক্রমশ: শান্ত ও সহিষ্ণু হয়। উপাসনা, সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে মনকে শক্তি দেয় এবং জীবনে যা অনিবার্য তা মেনে নেবার মত অন্ত:দৃষ্টি ও বল দেয়।

উপাসনার পদ্ধতি

ঈশ্বরের উপাসনা একান্ত অন্তরের ব্যাপার। এর জন্য কোনও বাইরের উপকরণের প্রয়োজন হয় না। তবে সুন্দর সুগন্ধযুক্ত ফুল বা ধূপ থাকলে যদি মনে পবিত্রভাব জাগাতে সহায়ক হয় তা’ রাখা ভালো। কিন্তু এই সব বস্তু উপাসনার উপকরণ নয়।

একাকী উপাসনা

একাকী উপাসনার কথা আগেই বলা হয়েছে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে উপাসনায় বসা ভালো। পারলে ব্রহ্মসংগীত করা, এমনকি ঐ সঙ্গীত পাঠ করলেও মন ব্রহ্মচিন্তায় রত হতে সহায়ক হয়। গানের পর ‘প্রণাম’ ও ‘আরাধনা’ (ধ্যান) করার পর, সদ্গ্রন্থ পাঠ ও ‘প্রার্থনা’ করা; এইভাবে কিছুদিন অভ্যাস করলে ক্রমে নিজের মতন করে উপাসনা করা যায়।

মিলিত উপাসনা

মিলিত উপাসনা একটি বিশেল পদ্ধতি অনুসারে করা হয়। প্রথমে মনকে অন্তর্মুখী ও ঈশ্বরচিন্তায় মগ্ন করার জন্য চেষ্টা করা। ‘উদ্বোধন’ সঙ্গীতের পর, আচার্য এই ভাব প্রকাশ করেন, আমরা বিষয়কর্ম থেকে মনকে সরিয়ে এনে, ঈশ্বর আরাধনার জন্য মিলিত হয়েছি। তিনি আমাদের মনকে শান্ত সমাহিত করতে সহায় হোন।

এরপর ‘আরাধনা’। একটি বা দুটি গানের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর মহিমা স্তব করার পর, তাঁর প্রকাশ নানাভাবে চিন্তা করা হয়। মন ক্রমে ঈশ্বরাভিমুখী হয় এবং তাঁর প্রেম ও সৌন্দর্যের উপলব্ধিতে মগ্ন হয়।

ব্রাহ্মরা মূলত: সত্যসন্ধানী। প্রার্থনার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের নিকট যা কিছু সত্য, নিত্য ও আনন্দময় তার সঙ্গে উপাসক যক্তি হতে চান। মিলিত উপাসনায় এ প্রার্থনা সকলে সমস্বরে করা হয়। এরপর আচার্য সদ্গ্রন্থ পাঠ ও নিবেদন করেন এবং সবশেষে সকলে সমস্বরে স্তোত্র পাঠ বা আবৃত্তি করেন ও ব্রহ্মসঙ্গীত করে উপাসনা শেষ হয়।

প্রণাম
ওঁ যো দেবোহগ্নৌ যোহপ্সু
যো বিশ্বম্ ভুবনাবিবেশ
য ওষধিষু যো বনস্পতিষূ-
তস্মৈ দেবায় নমো নম:।।

যে দেবতা অগ্নিতে, যিনি জলেতে, যিনি বিশ্বসংসারে প্রবিষ্ট হইয়া আছেন; যিনি ওষধিতে, যিনি বসস্পতিতে বিরাজমান, সেই দেবতাকে বার বার নমস্কার করি।

ধ্যান
ওঁ সত্যং জ্ঞানমন্তম ব্রহ্ম
আনন্দ রুপমমৃতং যদ্বিভাতি
শান্তং শিবমদ্বৈতম।

যিনি আমাদের স্রষ্টা, পালক ও সর্বসুখদাতা, তিনি সত্য-স্বরূপ, জ্ঞান-স্বরূপ, অনন্ত-স্বরূপ; তিনি আনন্দরূপে, অমৃতরূপে প্রকাশিত হইতেছেন; তিনি শান্ত, মঙ্গল, অদ্বিতীয়। তাঁহার প্রসাদে আমাদের শরীর মন ও আত্মা রক্ষিত হইতেছে এবং আমরা বৃদ্ধি বল জ্ঞান ও ধর্ম লাব করিয়াছি; অনন্যমনা হইয়া প্রীতিসহ নিজ আত্মাকে সেই অদ্বিতীয় মঙ্গলস্বরূপে সমাধান করি।

প্রার্থনা
অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়,
মৃত্যোর্মাহমৃতং গময়। আবিরাবীর্ম এধি।
রুদ্র, যত্তে দক্ষিনং মুখং, তেন মাং পাহি নিত্যম।।

অসৎ হইতে আমাকে সৎস্বরূপে লইয়া যাও, অন্দকার হইতে আমাকে জ্যোতি:স্বরূপে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতস্বরূপে লইয়া যাও।

হে স্বপ্রকাশ! আমার নিকট প্রকাশিত হও। রুদ্র: তোমার যে প্রসন্নমুখ তাহার দ্বারা আমাকে সর্বদা রক্ষা কর।।

ব্রহ্ম কৃপাহি কেবলম্
ওঁ শান্তি: শান্তি: শান্তি:
হরি ওঁ

উপাসনা

(এই আদর্শ উপাসনাটিতে উদ্বোধন, আরাধনা, প্রার্থনা এক সঙ্গে গ্রথিত হয়েছে)
হে মঙ্গলময় দেবতা! আজ আমরা মিলিত হয়েছি শান্ত মনে তোমার ধ্যানে, তোমার মহিমা স্বরণ করে, তোমার অপার করুণাধারায় জীবনকে সিঞ্চিত করব বলে। আলোক-পিয়াসী ফুলের মতন আমাদের মন জেগে উঠুক; সমস্ত মন তোমার পানে চেয়ে থাক্। তোমার মঙ্গলালোকের পরশে মনের জড়তা, মলিনতা, দেহের ক্লান্তি-অবসাদ দূর হয়ে যাক্।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধিপতি! আমাদের হৃদয়াসনে প্রভু হয়ে বসো, আমাদের চালিত করো। বিশ্বনিখিলে তোমার যে বীণা বাজে তারই সুরে আমাদের হৃদয়বাণীণার সুর বেঁধে দাও। সীমার মাঝে আমরা বাস করি, আজ এই শান্ত ক্ষণে, আমরা অসীমের সঙ্গে যুক্ত হই। স্বার্থ-চিন্তার আগল দিয়ে রুদ্ধ হৃদয়-দুয়ার আজ খুলে দিই; আসুক আলো, আসুক হাওয়া; তোমার প্রসন্নতা স্মরণ করে আমরা বিশ্বনিখিলে বহতা আনন্দধারায় অবগাহন করি।

হে ভুবনেশ্বর, অদ্বিতীয় নিত্য ও সর্বব্যাপী ব্রহ্ম, তোমাকে নমস্কার! তোমার মহিমা আমাদের মুখের ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। হৃদয় দি গভীর মননে কিছুটা অনুভব করি। তবু মন চায় কথা দিয়ে আমাদের মনের ভাব নিবেদন করতে তোমার চরণে। তোমার প্রিয়নাম বার বার নানা ছলে বলে আমাদের মন শান্ত তৃপ্ত হয়।

জীবনপথের হে সারথি! আমাদের সৎপথে চালিত করো। আমরা যেন তোমার প্রভুত্বে, তোমার চালনায় মঙ্গলকাজে সদা নিযুক্ত থাকি। ন্যায় কাজে, সত্যকথনে ও মানুষের কল্যাণ কাজে যেমন আমরা কখনও ভীত বা ক্লান্ত না হই। আমাদের শক্তি দাও।

সমস্ত বিশ্বভূবন জুড়ে তোমার লীলা। আবার হৃদয়কাননে, অতি গভীরে গোপনে আমাদের কাছে ও মাঝে রয়েছো; আমরা বুঝি বা না বুঝি তুমি ত স্নেহনেত্রে আকাশে ভরে আমাদের পানে চেয়ে আছ। এ ধরণীকে, সাগর-নদী, গাছ তৃণ, পাহাড়-ঝরণা, কত কি দিয়ে সাজিয়েছ। আমাদের নানা প্রয়োজন মেটোবার জন্য, আলো, বাতাস, বারিধারা, ফল ফুল, সবই ভরে রেখেছ।

আমাদের সব প্রয়োজনই তোমার জানা। সকল রাজার রাজা তুমি! তোমার অসীম প্রেমধন আমাদের মনে কণায় কণায় ভাগ করে দিয়েছে; তাই তো আমরা জীব, জন্তু, মানুষ, গাছ-পালা, পরস্পরকে ভালোবেসে ও ধরার অঙ্গণে পরমানন্দে খেলে বেড়াই।

আনন্দরূপ তুমি! কখনও দু:খের বেশে রুদ্ররূপে, তুমি আমাদের জীবনে, আসো। প্রিয়জনকে হারাই, প্রাকৃতিক বিপর্য্যয়ে, দুর্ঘটনায় অনেক ধন, প্রাণ নষ্ট হয়।

হে পরমকরুণিক! তোমারই করুণায়, তোমার দখিন হাতের অমৃত-প্রলেপে আমরা বেদামুক্ত হই, বল পাই। ভাঙ্গা মনে, চোখের চলে চেয়ে দেখি ‘তুমি আছ’। গভীর অন্তরে শুনি ‘পিতদা নোহসি’।

আনন্দস্বরূপ, অমৃতস্বরূপ সত্য দেবতা তুমি! সকল মানবলোকে তুমি আছ। দীপ্যমান পরমেশ্বর! তোমার বিধানে তোমার সকল সন্তান আমরা তোমার দেওয়া কর্মযজ্ঞের ও আনন্দভোজের অধিকারী, অমৃতের অধিকারী। আমরা পরস্পরে দ্বেষ, হিংসা, বিবাদ যেন না করি।

জীবনপথের হে সারথি! আমাদের সৎপথে চালিত করো। আমরা যেন তোমার প্রভুত্বে, তোমার চালনায় মঙ্গলকাজে সদা নিযুক্ত থাকি। ন্যায় কাজে, সত্যকথনে ও মানুষের কল্যাণ কাজে যেমন আমরা কখনও ভীত বা ক্লান্ত না হই। আমাদের শক্তি দাও।

হে করুণাঘন স্বামী। তোমার মঙ্গলেচ্ছা পূর্ণ হোক! এই আমাদের প্রার্থনা।

ওঁ একমেবাদ্বিতীয়ম্

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………
আরও পড়ুন-
ব্রাহ্মসমাজ
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হইবার যোগ্যতা
ব্রাহ্ম ধর্মের মূল সত্য
ব্রহ্ম মন্দিরের ট্রাস্টডিড
ব্রাহ্মধর্ম্মের মূল সত্য
আত্মা
মানুষের ভ্রাতৃত্ব
উপাসনা ও প্রার্থনা
শাস্ত্র
গুরু
মধ্যবর্ত্তী ও প্রেরিত
সুখ-দু:খ : দু:খবাদ ও আনন্দবাদ
পাপ ও পুণ্য
পুনর্জ্জন্ম
পরকাল
স্বর্গ ও নরক
ধর্ম্ম রক্ষা
পরিবারে পুরুষ ও নারীর অধিকার-সাম্য
ব্রাহ্মসমাজের প্রতি ব্রাহ্মদিগের কর্ত্তব্য
সমবেত উপাসনা
পূর্ণাঙ্গ উপাসনার আদর্শ 
স্তুতি
বিবিধ অবস্থায় প্রার্থনা
নৈমিত্তিক অনুষ্ঠান
সন্তান জন্ম
ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ ও ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ
ধর্ম্মসাধন ব্রতে দীক্ষা
ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ ও ধর্ম্মদীক্ষা
বিবাহ ও তাহার আনুসঙ্গিক অনুষ্ঠান
বিবাহের বাগদান
বিবাহ
মৃত্যু ও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া
শ্রাদ্ধ
গৃহ প্রবেশ
ব্রহ্ম ও ব্রহ্মের স্বরূপ
ব্রহ্ম ধ্যান
ব্রাহ্মধর্ম
সকলেই কি ব্রাহ্ম?
ব্রাহ্মোপসনা প্রচলন ও পদ্ধতি
আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও “নব হিন্দু সম্প্রদায়”
পূর্ণাঙ্গ উপাসনার আদর্শ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!