ভবঘুরেকথা

সন্তান জন্ম

গৃহে শিশুর জন্ম হইলে গৃহস্বামী এইভাবে কৃতজ্ঞতাসূচক প্রার্থনা করিতে পারেন-

জননী, বিশ্বধাত্রি, সন্তানজন্মে আমরা তোমাকে কৃতজ্ঞতা দান করি। তোমার এ দয়ার দান সাদরের গ্রহণ করি। আমাদের কত ভয় ভাবনার, প্রসূতির কত ক্লেশের, তুমি অবসান করলে। সন্তান দান ক’রে মাতার হৃদয় কত আনন্দে পূর্ণ করলে। জয়, তোমার করুণার জয়।

শিশুকে আশীর্ব্বাদ কর, মাতাকে আশীর্ব্বদ কর, পিতাকে আশীর্ব্বাদ কর, গৃহবাসী সকলকে আশীর্ব্বাদ কর, মাতাকে আশীর্ব্বাদ কর, পিতাকে আশীর্ব্বাদ কর, গৃহবাসী সকলকে আশীর্ব্বাদ কর। এই শিশুর জীবনে যেন তোমার মহিমা প্রকাশিত হয় এবং আমরা যেন উপযুক্ত যত্নে তোমার এই সন্তানকে পালন করতে পারি। কৃতজ্ঞাভরে ভক্তিভরে তোমাকে প্রণাম করি।

জাতকর্ম্ম

সন্তানজন্মের পর প্রসূতি যখন সুস্থ শরীরে ঈশ্বর-চরণে বসিতে পারিবেন, সে সময়ে (সন্তান জন্মের ন্যূনাধিক এক মাস পরে) পরিবারস্থ সকলে আত্মীয়গনের সহিত মিলিত হইযা শিশুর জাতকর্ম্ম অনুষ্ঠান সম্পন্ন করিবেন। এই অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত। ইহাতে উপস্থিত শিশুগণের আনন্দ বিধানের ব্যবস্থাও থাকিলে ভাল হয়।

জয়কর্ম্মের উপযোগী একটি প্রার্থনার আদর্শ নিম্ন প্রদত্ত হইল- “জগৎজননী, জন্মদায়ীনি, তুমিই ধাত্রী হ’য়ে ইহাকে নিরাপদে এই পৃথিবীতে আনলে। এ পৃথিবী তোমারই করুণার ক্ষেত্র। তোমার আলো বাতাস, তোমার অন্ন জল, তোমার প্রেরিত জ্ঞান পো্রম পুণ্য, এই পৃথিবীতে তোমার সন্তানের পরিচর্য্যা করবে। এই শিশুকে পেয়ে আজ আমাদের কত আনন্দত!

আজ আমরা সবান্ধবে শ্রদ্ধা যত্ন ও আদরের সহিত তোমার এ পবিত্র দান গ্রহণ করি। তুমি শিশুকে আশীর্ব্বাদ কর, পিতামাতাকে আশীর্ব্বাদ কর, এই গৃহকে আশীর্ব্বদ কর। পৃথিবীতে এই শিশুকে সুস্থ দীর্ঘ জীবন হউক। ইহার পরিবারের, তোমার জগতের ও মানব সমাজের সকল শ্রেষ্ঠ স্পর্শ যেন ইহার অমরাত্মার উপযুক্ত সেবা ক’রে, ইহাকে জ্ঞানে প্রেমে পুণ্যে নিত্য বর্দ্ধিত করতে পারে। তোমাকে ভক্তিভরে প্রণাম করি, ও তোমার এ অমূল্য দানকে আজ আমরা সাদরে অভ্যর্থনা ক’রে গ্রহণ করি।”

নামকরণ ও অন্নপ্রাশন

যখন শিশুর দন্তোদগম হইতে আরম্ভ হয়, তখনই জানা জায় যে তাহার নূতন প্রকারের আহারের প্রয়োজন হইয়াছে। সাধারণত: এই সময়ে (শিশুর এক বৎসর বয়স পূর্ণ হইবার পূর্ব্বে) অন্নপ্রাশন ও নামকরণ অনুষ্ঠান একসঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে শিশুগণ উপস্থিত থাকিবে, এজন্য এই অনুষ্ঠান দীর্ঘ না হইলে ভাল হয়।

প্রথমে নামকরণ হইবে। তাহাতে প্রথম সঙ্গীতের পর আচার্য্য এইভাবে ঈশ্বরের স্তুতি ও প্রার্থনা করিতে পারেন- “হে জীবনদাতা, আমাদের সকলের পিতামাতা, আমাদের আদরের এই শিশুকে কোলে ক’রে আজ আমরা তোমার চরণে উপস্থিত হয়েছি। এ বিশ্বজগতে তোমার আশ্চর্য্য সৃষ্টিধারা চলেছে। আমাদের পিতৃগণের মাতৃগণের জন্মদাতা তুমি ; তাঁদের পূর্ব্বপুরুষগণেরও জন্মদাতা তুমি।

সমুদয় জীবের জীবনে তুমি প্রাণরূপে প্রকাশিত। কিন্তু মানুষকে তুমি প্রাণ ছাড়া আরও কিছু দিয়েছ, তাকে হৃদয় দিয়েছ, আত্মা দিয়েছ। তার দ্বারা সে তোমার জগৎকে কতভাবে আস্বাদন করে ; তার দ্বারা সে পৃথিবীর সঙ্গে কত সম্বন্ধে আবদ্ধ হয় ; তার দ্বারা সে তোমার ইচ্ছা জানবার, তোমার ইচ্ছা পালন করবার এবং তোমার পুত্র কন্যা সঙ্গী ও সহায় হবার অধিকার লাভ করে।

আমাদের প্রিয় এই শিশু ক্রমে ক্রমে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে তোমার এই সুন্দর জগতে বিচরণ করবে, তোমার জগৎকে কতভাবে আস্বাদন করবে, মানুষের মধ্যে গণনীয় হ’য়ে কত কাজ করবে ; আজ আমরা সেই ভবিষ্যৎকে মনের চক্ষে দর্শন ক’রে, কাজ করবে ; আজ আমরা সেই ভবিষ্যৎকে মনের চক্ষে দর্শন করে, ইহাকে একটি নাম দিবার জন্য সবান্ধবে তোমার কাছে উপস্থিত হয়েছি।

তুমি আজ এ শিশুর জন্য আমাদের সকলের, বিশেষত: পিতামাতার, হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ কর। এই শিশুরা আমাদের জীবনতরুর শ্রেষ্ঠ ফুল স্বরূপ। আমরা আশা করি, আমাদের প্রত্যেক গৃহ পরিবার তোমার পূজার দেউল হবে ; পিতামাতা সেই দেউলের দাসদাসী হবেন এবং প্রাণপণ যত্নের দ্বারা জীবনতরুর শ্রেষ্ঠ ফুলগুলিকে, গৃহের শিশু সন্তানগুলিকে, প্রস্ফুটিত ক’রে তুলে, সেই ফুলে তোমার পূজা করবেন।

হে দেব, আজকার এ অনুষ্ঠান পিতামাতার হৃদয়ের সেই আকাঙ্ক্ষার একটু নিদর্শন মাত্র। সেই আকাঙ্ক্ষাতেই আমরা আজ ইহাকে একটি নাম দান করচি, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সেই নামে এই শিশুর পরিচিত হবার আয়োজন ক’রে দিচ্চি। তুমি এই শিশুকে আশীর্ব্বাদ কর ; সুস্থ দেহে দীর্ঘ জীবনে এই নাম বহন ক’রে যেন এই শিশু নিজ চরিত্রের দ্বারা তোমার মহিমা প্রকাশ করতে পারে এবং পিতামাতার ও সকল প্রিয়জনের আনন্দ বর্দ্ধিত করতে পারে।

পিতামাতাকে, এই পরিবারকে এবং উপস্থিত প্রিয়জনদিগকে তুমি এই আশীর্ব্বাদ কর, যেন স্নেহ ভালবাসা দ্বারা, ব্যবহার ও দৃষ্টান্তের দ্বারা, ইহার অমরাত্মার সুকোমল ভাব সকলকে ফুটিয়ে তুলতে সকলে সাহায্য করতে পারেন। এই শিশুর পিতামাতার হৃদয় আজ এক দিকে আনন্দে আপ্লুত, অপর দিকে তেমনি নিজ দায়িত্বের অনুভূতিতে তোমার চরণে অবনত ; তুমি পিতা-মাতার হৃদয়ের সেই কৃতজ্ঞতার অঞ্জলি গ্রহণ কর, তাঁহাদের মনের সকল শ্রেষ্ঠ আকাঙ্ক্ষায় তুমি আশীর্ব্বদ কর।”

ইহার পর আচার্য্য শিশুর জন্মপত্রিকার প্রথমাংশ পাঠ ও শিশুর নাম ঘোষণা করিবেন। জন্মপত্রিকার প্রথমাংশ পাঠ ও শিশুর নাম ঘোষণা করিবেন। জন্মপত্রিকায় অভিভাবকের (পিতা বা মাতার হইলেই ভাল হয়) একটি প্রার্থনাও লিখিত থাকিবে। আচার্য্য কর্ত্তৃক নাম ঘোষণার পর অভিভাবক সেই প্রার্থনাটি পাঠ করিবেন। তৎপরে উপস্থিত ব্যক্তিগণের মধ্য হইতে কয়েকজন জন্মপত্রিকায় স্বাক্ষর করিবেন।

জন্মপত্রিকা

জন্মপত্রিকা এক খানি দীর্ঘকালস্থায়ী মজবুত কাগজে লিখিত হওয়া উচিত। তাহা এই ভাবে লিখিত হইতে পারে-

ওঁ
শ্রীমান্ …’র জন্মপত্রিকা

অদ্য … বঙ্গাব্দের … মাসের … দিবসের, …খ্রিস্টাব্দের … মাসের … দিবসে, … বাসরে, মঙ্গলময় পরমেশ্বর ও সমাগত ধর্ম্মবন্ধুগণের সমক্ষে, … নিবাসী শ্রীযুক্ত … … ও শ্রীযুক্তা … … র … (প্রথম, দ্বিতীয় ইত্যাদি) সন্তান ও … (প্রথম, দ্বিতীয় ইত্যাদি) … (পুত্রের বা কন্যার) নামকরণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হইল। শিশুকে … এই শুভ নাম প্রদত্ত হইল।

শিশুর জাতাহ্ … … বঙ্গাব্দের … মাসের … দিবস, … খ্রিস্টাব্দের … মাসের … দিবস, … বার, … পক্ষের … তিথি, … … (সময়) জন্মস্থান … … … …।

অদ্য শিশুর বয়স … বৎসর … মাস … দিন।

ঈশ্বর এই শিশুকে দীঘায়ু করুন।

[অভিভাবকের প্রার্থনা]

হে করুণাসিন্ধু, তোমার কৃপায় অদ্য আমাদিগের এই শিশু সন্তান শ্রী …র নামকরণ সম্পন্ন হইল। ইহাকে তুমি আশীর্ব্বাদ কর, যেন তোমার প্রসাদে ইহার শরীর মন উপযুক্ত রূপে বিকশিত হয় ও ইহার জীবনস্রোত তোমার পথে প্রবাহিত হয়। ইহার জীবনে তোমার মহিমা মহীয়ান হউক।

ওঁ ব্রহ্মকৃপাহিকেবলম্।

[সাক্ষীদিগের স্বাক্ষর]

অদ্য আমরা শ্রী … …র এই শুভ নামকরণ অনুষ্ঠঅনে উপস্থিত হইয়া আনন্দ লাভ করিলাম।
(আচার্য্য) শ্রী … … …
(ঠিকানা) … …
(সাক্ষী) শ্রী … … …
(ঠিকানা) … …
(সাক্ষী) শ্রী … … …
(ঠিকানা) … …

অনানপ্রাশন

জন্মপত্রিকা স্বাক্ষরিত হইলেই নামকরণ ক্রিয়া শেষ হইল। তাহার অব্যবহিত পরেই অন্নপ্রাশন হওয়া বাঞ্ছনীয়। গৃহস্বামী অন্নাদি এমন করিয়া প্রস্তুত রাখিবেন যে নামকরণের পর অন্নপ্রাশন আরম্ভ করিতে যেন কালবিলম্ব না ঘটে। তৎপরে শিশুর পিতামাতা কিংবা অন্য কোন আত্মীয় অথবা আচার্য্য এই মর্ম্মের একটি প্রার্থনা করিবেন-

“জননী, বিশ্বপালয়িত্রি, তোমারই করুণায় এই শিশু এ পর্য্যন্ত সুস্থ দেহে বর্দ্ধিত হ’য়ে আমাদের হৃদয়ে কত আনন্দ দান করছে। আজ এর মুখে বয়স্কদের যোগ্য অন্ন প্রথম তুলে দিবার সময় আমরা তোমাকে স্ববান্ধবে কৃতজ্ঞতা ও ভক্তির সহিত স্মরণ করি। তুমিই অন্ন দিয়ে শরীর পোষণ কর, আবার তুমিই জ্ঞান প্রেম পুণ্যে আত্মাকে পুষ্ট কর। তোমার অন্ন এর জীবনে কল্যাণের কারণ হোক, তোমার প্রেম-অন্ন সারাজীবনে এক আত্মাকে পুষ্ট করুক। আমরা তোমাকে ভক্তিভরে প্রণাম করি।”

ইহার পর শিশুর মুখে কিছু সুমিষ্ট খাদ্য প্রদান করা হইবে।

…………………………
ব্রাহ্মধর্ম্ম ও ব্রাহ্মসমাজ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………
আরও পড়ুন-
ব্রাহ্মসমাজ
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হইবার যোগ্যতা
ব্রাহ্ম ধর্মের মূল সত্য
ব্রহ্ম মন্দিরের ট্রাস্টডিড
ব্রাহ্মধর্ম্মের মূল সত্য
আত্মা
মানুষের ভ্রাতৃত্ব
উপাসনা ও প্রার্থনা
শাস্ত্র
গুরু
মধ্যবর্ত্তী ও প্রেরিত
সুখ-দু:খ : দু:খবাদ ও আনন্দবাদ
পাপ ও পুণ্য
পুনর্জ্জন্ম
পরকাল
স্বর্গ ও নরক
ধর্ম্ম রক্ষা
পরিবারে পুরুষ ও নারীর অধিকার-সাম্য
ব্রাহ্মসমাজের প্রতি ব্রাহ্মদিগের কর্ত্তব্য
সমবেত উপাসনা
পূর্ণাঙ্গ উপাসনার আদর্শ 
স্তুতি
বিবিধ অবস্থায় প্রার্থনা
নৈমিত্তিক অনুষ্ঠান
সন্তান জন্ম
ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ ও ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ
ধর্ম্মসাধন ব্রতে দীক্ষা
ব্রাহ্মধর্ম্ম গ্রহণ ও ধর্ম্মদীক্ষা
বিবাহ ও তাহার আনুসঙ্গিক অনুষ্ঠান
বিবাহের বাগদান
বিবাহ
মৃত্যু ও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া
শ্রাদ্ধ
গৃহ প্রবেশ
ব্রহ্ম ও ব্রহ্মের স্বরূপ
ব্রহ্ম ধ্যান
ব্রাহ্মধর্ম
সকলেই কি ব্রাহ্ম?
ব্রাহ্মোপসনা প্রচলন ও পদ্ধতি
আদি ব্রাহ্ম সমাজ ও “নব হিন্দু সম্প্রদায়”
পূর্ণাঙ্গ উপাসনার আদর্শ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!