-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
‘আত্মা: এক’
‘আত্মার দৃষ্টি’ রচনায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘আমাদের চেতনা আমাদের আত্মা যখন সর্বত্র প্রসারিত হয় তখন জগতের সমস্ত সত্তাকে আমাদের সত্তার দ্বারাই অনুভব করি, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নয়, বুদ্ধির দ্বারা নয়, বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা নয়। সেই পরিপূর্ণ অনুভূতি একটি আশ্চর্য ব্যাপার।’
আত্মা একটি ধর্মীয় ও দার্শনিক ধারণা। আত্মা দেহনির্ভর নয়। আত্মার অস্তিত্বের সপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। আত্মা সম্পর্কে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সভ্যতায় নানা মত গড়ে উঠেছে। তবে ভারতীয় ধর্ম-দর্শনের এর মৌলিকত্ব পাওয়া যায়।
মূলত আত্মা একটি স্থায়ী আধ্যাত্মিক সত্তা। যা জীবিত অবস্থায় দেহে আত্মা বিরাজ করে। আর মৃত্যুর সময় দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। জন্মান্তরের যাত্রাকে বুঝতে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘আত্মা’কে বোঝা। কিন্তু সমস্যা হলো আত্মাকে না ধরা যায়, না ছোঁয়া যায়, না দেখা যায়। এমনকি বর্ণনাতেও আনা যায় না। তাকে কি করে ব্যাখ্যাই করবো, আর কি করেই বা তার সম্বন্ধে ধারণা দেবো?
শুধু ‘আত্মা’ নয় এমন আরো বেশকিছু বিষয় ও শব্দ আছে যা সম্পর্কে একটা নূন্যতম ধারণা না থাকলে জন্মজন্মান্তরের এই গমনাগমন যাত্রার ধারাবাহিকতা বোঝা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এই বিষয় ও শব্দগুলো শুধু রহস্যময় তাই নয়; বেশ স্পর্শকাতরও।
তাই এসবের বিচার-বিশ্লেষণে না গিয়ে বিষয়গুলোকে নিয়ে বিভিন্ন ধর্ম-দর্শন-মতবাদ কি বলেছে, বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণীজন কি ভেবেছে, বিজ্ঞান কি ভাবে এসব জেনে নেয়ার জন্য আগামী পর্বগুলোতে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচিত বিষয় ও শব্দকে ঘিরে গড়ে ওঠা চিন্তা-চেতনার যৎসামান্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো বলে ভেবেছি।
মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে বিশ্বাস ছিল, আত্মা বা তার কিছু অংশ ঘুমন্ত মানুষের দেহ থেকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। আর আত্মার এই ঘুরে বেড়ানোই স্বপ্ন। কখনও কখনও স্বপ্নের দেবতারা স্বপ্নদর্শীকে বহন করতে বলে। আর চীনারা বিশ্বাস করতো, ঘুমের সময় মানুষের একটি আত্মা স্বপ্নের রাজ্যে যাত্রার সময় দেহ থেকে মুক্তি পায় আর অন্যটি দেহে অবস্থান করে।
সেই সূত্র ধরে এবারের বিষয় ‘আত্মা’। এই অনন্ত রহস্যময় ‘আত্মা’র ধারণাটিই অনেকের কাছে অবান্তর। আবার অনেকের কাছে আত্মাই সকল সাধনের কেন্দ্রবিন্দু। তাকে ধরার মধ্য দিয়ে পরমে লীন হওয়ার কি নিদারুণ সাধন-ভজন-তপস্যা।
‘আত্মা’ ধারণাটি এমনই এক তত্ত্ব বহন করে যে একে অবিশ্বাস করলেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ একে কাল্পনিক ভাবলেও এর বিকল্প ভাবনাগুলো আরো বেশি কাল্পনিক হয়ে উঠে যুক্তির মাপকাঠিতে। অনেকে অবশ্য এ বিষয় নিয়ে বেশি ভাবতে আগ্রহী নয়; কারণ যা ভেবে ভেবে কোথাও পৌছানো যায় না সেই নৌকায় উঠেই বা কি লাভ।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে এমন হাজারো ধারণা-তত্ত্ব বিরাজ করছে জগৎময়। যা সম্পর্কে চট্ করে মন্তব্য করা যায় না। তাই ফকির লালন বলেছেন- “ভেবে অন্ত নাহি দেখি, কার বা খাঁচায় কে বা পাখি”। আসলেই তাই ভেবে অন্ত পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তাই ভাববার আগে জানার যাত্রা শুরু করি। এবারের বিষয় “আত্মা”।
শ্রীশ্রী রামঠাকুর বলেছেন, “আমি কে’-ইহা জানিলে জ্ঞান হয়। যাহা দ্বারা সর্বভূত ও স্বীয় আত্মা অভিন্ন বোধ হয় এবং তারপর বোধ হয় যে আত্মা ভগবানেরই সত্তা। …সকল প্রাণীর সত্যরুপ আত্মা একই হয়, ভিন্ন কেহই নয়, দেহই অবয়বই পৃথক পৃথক দেখা যায়। ..অহংকাাদির দ্বারা ইহ সুখে প্রত্যাশিত হইয়া, আত্মার মর্যাদা লঙ্ঘন করিয়া জন্ম-মৃত্যুর সুখদু:খাদির আবরণে পতিত হইয়া থাকে, অতএব জীবের ভগবচ্চিন্তায় মগ্ন থাকাই মোক্ষধর্ম্ম।”
ব্রিটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম বলেন, “আত্মা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। কারণ আত্মার কোনো ইন্দ্রিয়ছাপ নেই। …অভিজ্ঞতা ছাড়া আমরা কিছুই দেখতে পাই না …আমরা যাকে আত্মা বলি তা বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সমষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়।”
মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে বিশ্বাস ছিল, আত্মা বা তার কিছু অংশ ঘুমন্ত মানুষের দেহ থেকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। আর আত্মার এই ঘুরে বেড়ানোই স্বপ্ন। কখনও কখনও স্বপ্নের দেবতারা স্বপ্নদর্শীকে বহন করতে বলে। আর চীনারা বিশ্বাস করতো, ঘুমের সময় মানুষের একটি আত্মা স্বপ্নের রাজ্যে যাত্রার সময় দেহ থেকে মুক্তি পায় আর অন্যটি দেহে অবস্থান করে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় দর্শনকে বেদের উপর বিশ্বাস ও অবিশ্বারে উপর ভিত্তিতে মূলত প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটা আস্তিক দর্শন আর অন্যটা নাস্তিক দর্শন। আস্তিক দর্শন হলো ছয়টি। সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা ও বেদান্ত এই ছয়টি মিলে হলো আস্তিক ষড়দর্শন।
বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম, চার্বাক, আজীবক ও অন্যান্য কয়েকটি দর্শন পরিচিত নাস্তিক দর্শন হিসেবে। এই দর্শনগুলো মূলত বেদকে অস্বীকার করে গড়ে উঠেছিল।
ভারতীয় আস্তিক দর্শনে আত্মা প্রসঙ্গ
ঋক বেদে এক স্রষ্টার কথা বলা হয়েছে। যিনি পরমসত্তা এবং জগতের সকলকিছুর উৎস। আত্রেয় ও বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, সর্বপ্রথম শুধু আত্মারই অস্তিত্ব ছিল। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, আত্মাকে জানলেই সবকিছু জানা হয়ে যায়। …শুরুতে শুধু একটিই সত্তাই ছিল, তিনি ছিলেন এক এবং তাঁর কোনো দ্বিতীয় ছিল না।
শংকরের অদ্বৈতবাদ হচ্ছে, বিশুদ্ধ নির্গুণ একত্ববাদ। তিনি এক ঈশ্বর ভিন্ন অন্য কিছুই স্বীকার করেন না। তাঁর মতে, জগৎ প্রকৃত সৃষ্টি নয়, আভাস মাত্র। স্রষ্টা তাঁর মায়ারূপ শক্তি দিয়ে জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং অবিদ্যার কারণেই জগতকে প্রকৃত জগৎ মনে হয়।
রামানুজ তার বিশিষ্টাদ্বৈতবাদে বলেছেন, ঈশ্বরের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ- জড়বস্তু ও সসীম আত্মা। প্রতিটি আত্মার একটি শারীরিক রূপ আছে, তথাপি আত্মা এই বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে। মুক্ত আত্মা ঈশ্বরের অনুরূপই হয়, অভিন্ন হয় না।
আবার সাংখ্য দর্শনে আত্মাকে দ্বিতীয় সত্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দ্বিতীয় সত্তা পুরুষ আর অন্য সত্তাটি প্রকৃতি। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনেই আত্মা বিবর্তিত হয়। আত্মার অস্তিত্ব স্ব-প্রকাশিত, কারণ প্রত্যেকেই তার স্ব-স্ব অস্তিত্ব অনুভব করে।
ন্যায়-বৈশেষিক ও মীমাংসা দর্শন বলে, আত্মা অবিনশ্বর, শাশ্বত ও অসীম। চেতনা আত্মার আবশ্যিক ও অবিচ্ছেদ্য গুণ নয়। দেহের সঙ্গে যুক্ত হলেই আত্মায় চেতনা ও জ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে। অবশ্য আত্মা সর্ব পরিব্যাপ্ত নয় বলে সকল জীবনদেহে পাওয়া যায় না। বিভিন্ন দেহের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আত্মা রয়েছে। দেহ প্রাপ্তি হলেই আত্মায় চেতনা জাগ্রত হয়, তার দেহের বিনাশে আত্মা সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান ও চেতনামুক্ত হয়।
যোগদর্শন অনুসারে স্থূল ও সূক্ষ্মদেহের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও আত্মা একটি মুক্ত সত্তা। সূক্ষ্ম দেহ ইন্দ্রিয়, মন, অহং ও বুদ্ধির দ্বারা গঠিত।
ভগবত গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ এ প্রসঙ্গে বলছেন-
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কারং ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।
(ভ.গী. ৭/৪)
“ভূমি, জল, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার- এই অষ্ট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত।”
উপনিষদে আত্মা প্রসঙ্গ: উপনিষদে আত্মাকে অসীম চেতনা হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। কঠোপনিষদে বলা হয়েছে-
অণোরণীয়ান্মহতো মহীয়ান্
আত্মাস্য জন্তোর্নিহিত গুহায়াম্।
তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো
ধাতুঃ প্রসাদন্মহিমানমাত্মনঃ।।
“পরমাত্মা এবং জীবাত্মা উভয়েই বৃক্ষসদৃশ জীবদেহের হৃদয়ে অবস্থিত। যিনি সব রকম জড় বাসনা এবং সব রকমের শোক থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন, তিনিই কেবল ভগবানের কৃপার ফলে আত্মার মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন।”
কঠোপনিষদ ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে উল্লেখ আছে-
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।
“দুটি পাখি একই গাছে বসে, কিন্তু যে পাখিটি ফল আহারে রত, সে তাঁর কর্মের ফলস্বরূপ সর্বদাই শোক, আশঙ্কা এবং উদ্বেগের দ্বারা মুহ্যমান। কিন্তু যদি সে একবার তার নিত্যকালের বন্ধু অপর পাখিটির দিকে ফিরে তাকায়, তবে তার সমস্ত শোকের অবসান হয়, কারণ তার বন্ধু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনি সমগ্র ঐশ্বর্যের দ্বারা মহিমান্বিত।”
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ-৫/৮-এ বলা হয়েছে-
‘বালাগ্র শতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ।
ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয়ঃ স চানন্ত্যায় কল্পতে।।’
‘কেশাগ্রকে শতভাগে ভাগ করলে তার যে আয়তন হয়, আত্মার আয়তনও ততখানি।’
ভারতীয় নাস্তিক দর্শনে আত্মা প্রসঙ্গ
জৈনদর্শন মনে করে, জীব ও অজীব সকল সত্তার মধ্যে আত্মা বিরাজমান। পৃথিবীতে যত সংখ্যক বস্তু আছে, ঠিক ততো সংখ্যক আত্মাও আছে। চৈতন্যযুক্ত দেহই আত্মা। চৈতন্য দেহের গুণ, আত্মার গুণ নয়। ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এই চারটি প্রত্যক্ষগোচর উপাদানের সমন্বয়ে দেহে চেতনার উদ্ভব হয়। দেহের মৃত্যু হলে এই চারটি উপাদান খণ্ড-বিখণ্ডিত হয় এবং চেতনার বিলুপ্তি ঘটে। ফলে চেতনার আর কোনো অংশই অবশিষ্ট থাকে না।
চার্বাক দর্শন আত্মা সম্পর্কিত ভাববাদী ও আত্মা দেহের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ এই মতবাদ প্রত্যাখ্যান করে।
বৌদ্ধদর্শনের প্রতীত্যসম্যুৎপাদ তত্ত্ব অনুসারে জগতের যাবতীয় বস্তু ‘অন্যকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত, আকস্মিক, অনিশ্চিত ও ঘটনাচক্রজাত এবং অন্য কিছু দ্বারা শর্তাধীন এবং সকল কিছু পৌর্বাপর্য সম্পর্কে সম্পর্কিত, অর্থাৎ সব কিছুর আগমন ঘটছে আবার তিরোহিত হচ্ছে, আবির্ভূত হচ্ছে আবার বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
ক্ষণিকত্ববাদ অনুসারে, সমগ্র বিশ্ব একটি অন্তহীন পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার অধীন, সকল দেহী এবং অদেহী বস্তু নিরন্তর পরিবর্তনশীল। সুতরাং মানুষের মধ্যে স্থায়ী বা শাশ্বত দ্রব্য বলে কিছু থাকতে পারে না।
প্রত্যক্ষগোচরীভূত মানবসত্তা পঞ্চখণ্ডের সমষ্টি যা নাম-রূপ নামে অভিহিত। এখানে রূপ হচ্ছে জড় অংশ এবং নাম হচ্ছে মানসিক অবস্থা। যেমন- অনুভূতি, প্রত্যক্ষ, মানসিক গঠন ও চেতনা। আত্মাকে যেমন এই খণ্ডগুলোর সমষ্টি বলা যায় না, তেমনি এসব থেকে ভিন্নও বলা যায় না। আত্মা হচ্ছে শুধুমাত্র এসব খণ্ডের সমষ্টির নাম মাত্র।
হিন্দু ধর্মে আত্মা প্রসঙ্গ
হিন্দু বিশ্বাস মতে ‘আত্মা’ হল চিৎকণা, যা সর্বব্যাপী। মৃত্যুর পর আত্মা পরমাত্মার কাছে যায় এবং পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু জীবিত অবস্থায় পাপ করলে কর্মফল ভোগ করার জন্য আত্মাকে স্বর্গ বা নরক ভোগ করতে হয়। অথবা পশু বা নিম্নযোণী প্রাপ্ত হয়, কিছু সময়ের জন্য।
সেই সময়ে আত্মা কর্মফলের পুণ্য বা পাপ বিনষ্ট করে আবার পবিত্র হয় এবং অতপর পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়। জীবাত্মা, পরমাত্মা, বোধাত্মা, প্রেতাত্মা, আত্মারামেশ্বর-এগুলো নিয়ে পঞ্চ আত্মা। জীবাত্মা হলো পরমেশ্বরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পরমেশ্বর হচ্ছে পূর্ণ আর আত্মা তার অংশ।
অর্থাৎ আকাশ, বায়ু, ধূম, মেঘ, বর্ষ, ব্রীহি, যব, ওষধি, বৃক্ষ এ এবং তিল পার হয়ে উপস্থিত হয় পুরুষ বীর্যে এবং পরে সেখান থেকে যায় নারী গর্ভে। বলা হয়, জীবাত্মা যখন চন্দ্রলোক থেকে ফিরে আসতে থাকে ক্রমশ এর গুণ কমতে থাকে। এই যাওয়া আসাকে বলা হয় ‘পিতৃযান’। আত্মা জীবজগতে ফিরে আসে উদ্ভিদ হয়ে। এরপর কর্ম অনুসারে জন্ম নেয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র কিংবা বৈশ্যর ঘরে।
প্রেতাত্মা হল এমন একটি আত্মা যা পরমাত্মার কাছে ফিরে যাবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না বা কর্মফল জনিত কারণে সাজা ভোগ করছে।
গরুড় পুরাণে বলা হয়েছে, যখন মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসে তখন মৃত্যুর দেবতা তার দূতদেরকে দেহ থেকে আত্মা আনতে পাঠান। …আত্মা দেহত্যাগ করার পর দক্ষিণ দিকে একটি দীর্ঘ এবং অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ পাড়ি দেয়।
সম্ভবত এই বিশ্বাস থেকেই মৃতের পাশে তেলের বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়, যাতে আলোকিত সুড়ঙ্গপথ দিয়ে আত্মা স্বাচ্ছন্দে যেতে পারে।
শাস্ত্রমতে, জীবন বা আত্মার চারটি সংস্কার- মন (প্রতিকৃয়ারূপ), পঞ্চপ্রাণ (প্রাণ, অপ্রাণ, উদান, ধ্যান, সমান), সূক্ষ্ম শরীর (প্রাণময় কোষ) এবং কর্ম। মৃত্যুর পর এই চার সংস্কার আত্মাকে অনুসরণ করে। আত্মা মুক্তিলাভের পর এগুলি নিঃশেষ হয়ে যায়।
আত্মাকে দেহ থেকে বের করে নিয়ে যায় উদান বায়ু। আত্মার পরিণাম স্থির হয় কৃতকর্মের ফল অনুসারে। পাপমুক্ত আত্মা ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ, দক্ষিণায়ন, পিতৃলোক, আকাশ পার হয়ে উপস্থিত হয় চন্দ্রে। এখানে কৃতকর্মের কিছুটা ভোগ করে ফিরে আসে পুনর্জন্মের উদ্দেশ্য।
অর্থাৎ আকাশ, বায়ু, ধূম, মেঘ, বর্ষ, ব্রীহি, যব, ওষধি, বৃক্ষ এ এবং তিল পার হয়ে উপস্থিত হয় পুরুষ বীর্যে এবং পরে সেখান থেকে যায় নারী গর্ভে। বলা হয়, জীবাত্মা যখন চন্দ্রলোক থেকে ফিরে আসতে থাকে ক্রমশ এর গুণ কমতে থাকে। এই যাওয়া আসাকে বলা হয় ‘পিতৃযান’। আত্মা জীবজগতে ফিরে আসে উদ্ভিদ হয়ে। এরপর কর্ম অনুসারে জন্ম নেয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র কিংবা বৈশ্যর ঘরে।
গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন-
অবিনাশী তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বং ইদং ততম্।
বিনাশং অবিনাশ্যস্য ন কিঞ্চিৎ কর্তুমর্হসি।।
(ভ.গী.- ২/১৭)
“সমগ্র দেহে পরিব্যাপ্ত রয়েছে যে অক্ষয় আত্মা, জেনে রেখো তাকে কেউ বিনাশ করতে সক্ষম নয়।”
দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি।।
(ভ.গী.- ২/১৩)
“দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য কোন দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না।”
অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে।
তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি।।
(ভ.গী.-২/২৫)
“এই আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকারী বলে শাস্ত্রে উক্ত হয়েছে। অতএব এই সনাতন স্বরূপ অবগত হয়ে দেহের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়।”
অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ দেহিনঃ।
আনশিনোহপ্রমেয়স্য তষ্মাদ্ যুধ্যস্বভারত।।
(ভ.গী.-০২/১৮)
“আত্মা যে দেহকে আশ্রয় করে অবস্থান করেন, সেই দেহ নশ্বর বলে কথিত হয়েছে। কিন্তু আত্মা নিত্য, বিনাশ রহিত ও প্রমাণের অতীত।”
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরানি।
তথা দেহানি বিহায় জীর্ণা- ন্যানানি সংযাতি নবানি দেহী।।
(ভ.গী.-০২/২২)
“মানুষ যেমন পুরনো কাপড় ছেড়ে নতুন কাপড় পরিধান করে। আত্মাও তেমনি পুরনো দেহ পরিত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে।”
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রানি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।
(ভ.গী.-০২/২৩)
“হে অর্জুন! এই আত্মাকে শস্ত্রাদি কাটতে পারে না। একে অগ্নি দগ্ধ করতে পারে না। একে জল আর্দ্র করতে পারে না এবং বায়ু শুষ্ক করতে পারে না।”
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ- নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরানো ন হন্যমানে দেহে।।
(ভ.গী.-০২/২০)
“এই আত্মা কখনো জন্মে না বা কদাচ মরেন না। অন্যান্য জাত বস্তুর ন্যায় তিনি যে জন্ম লাভে অস্তিত্ব লাভ করেন তাও নয়। তিনি জন্মরহিত, সর্বদা একরূপ, বিনাশরহিত ও পুরান। দেহ হত হলেও তিনি হত হন না।”
সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি।
উক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শন।।
(ভ.গী.- ০৬/২৯)
“এভাবে যোগযুক্ত পুরুষ সর্বত্র সমদর্শী হয়ে আত্মকে সর্বভূতে এবং সর্বভূতকে আত্মাতে দর্শন করেন।”
যতো যতো নিশ্চরতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্।
ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশংনয়েৎ।।
(ভ.গী.-০৬/২৬)
অর্থাৎ মন স্বভাবতঃ চঞ্চল। অতএব ইহা অস্থির হয়ে যে যে বিষয়ে ধাবিত হয়, সেই সেই বিষয় থেকে তাকে প্রত্যাহার করে আত্মাতেই স্থিত করবে অর্থাৎ ভগবদ্ অভিমুখী করবে।
বৈষ্ণব মতাদর্শে আত্মা প্রসঙ্গ
চৈতন্য, প্রকৃতি থেকে উৎসারিত নয় বরং তা আত্মার লক্ষণ। প্রত্যেক জীব তার বর্তমান দেহ থেকে পৃথক। আত্মা অমর, অপরিবর্তনশীল, অবিনশ্বর, অনাদি ও অনন্ত। মায়ায় আচ্ছন্ন জীব পৃথিবীতে বারবার জন্মগ্রহণ করে কর্মের ও জাগতিক কামনাবাসনার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অন্যান্য জীবের সঙ্গে জীবনধারণ করে। সংসারের এই প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি লাভ করার নাম মোক্ষ। বিভিন্ন যোগের মাধ্যমেই সংসার থেকে মুক্তি লাভ করা যায়।
(চলবে…)
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………………………..
সূত্র:
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া
…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২
চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চৌদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১
চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি