ভবঘুরেকথা
নামাচার্য্য হরিদাস ঠাকুর

-মেঘনা কুণ্ডু

ভগবানের নাম প্রচার করবার জন্য শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আদেশ করেছিলেন-

শোনো শোনো নিত্যানন্দ, শোনো হরিদাস।
সর্বত্র আমার আজ্ঞা করহ প্রকাশ।
প্রতি ঘরে ঘরে গিয়া করো এই ভিক্ষা।
বলো কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, করো কৃষ্ণ শিক্ষা।

বলো কৃষ্ণ, ভজ কৃষ্ণ, কহ কৃষ্ণ নাম।
কৃষ্ণ মাতা কৃষ্ণ পিতা কৃষ্ণ ধন প্রাণ।
তোমা সব লাগিয়া কৃষ্ণের অবতার।
হেন কৃষ্ণ ভজ সবে ছাড়ো অনাচার।।
(চৈতন্য-ভাগবত)।।

আজ আমি যার কথা আপনাদের বলতে চলেছি, তিনি হলেন নামাচার্য্য হরিদাস ঠাকুর। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার অন্তর্গত কেড়াগাছি গ্রামে ১৩৭২ বঙ্গাব্দে মোতাবেক ১৪৪৯ খ্রীষ্টাব্দে অগ্রাহয়ণ মাসে নামাচার্য্য শ্রীশ্রী ব্রহ্ম হরিদাস ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন।

তার পিতার নাম সুমতি মিশ্র এবং মাতার নাম গৌরীদেবী। হরিদাসের বয়স যখন দু’মাস সেই সময় সুমতি মিশ্র পরলোক গমন করেন। সতীসাধ্বী গৌরীদেবী স্বামীর চিতায় সহমরণ বরণ করেন এবং ঠাকুর হরিদাস সম্পূর্ণ অনাথ হয়ে পরেন।

শিশু হরিদাস ঠাকুরের লালন পালনে কেউ এগিয়ে না এলে সুমতি মিশ্রের বন্ধু চাষী হাবিবুল্লা কাজী দয়া পরবশ হয়ে এই অনাথ শিশুটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হাবিবুল্লা কাজীর স্ত্রীর আদরযত্নে হরিদাস প্রতিপালিত হতে থাকেন। যবনের অন্নে যবনের ঘরে প্রতিপালন হবার জন্য তাঁকে যবন হরিদাস বলা হয়।

বাল্য থেকে কৈশরে পদার্পণ করার পর পালনকর্তা তাঁকে গরু চরানোর কাজে নিয়োগ করেন। হরিদাসের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর অন্তরে যেন কিসের একটা প্রবল আকর্ষণ অনুভব করতে থাকেন। যার ফলে যেখানেই হরিনাম সংকীর্তন হতো সেখানেই ছুটে যেতেন হরিদাস।

অন্তরে ঈশ্বর ভক্তি ও হরিনামে প্রবল অনুরাগ দেখা দিলে তিনি সব সময় উচ্চস্বরে হরিনাম জপ করতে লাগলেন। এমনি ভাবে চলতে থাকা অবস্থায় কাজীর দরবারে তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ গেল, কাজীর হুকুমে জল্লাদ হরিদাসের পায়ে রশি বেঁধে টানতে টানতে বাইশ বাজারে বেত্রাঘাত করে ঘোরালেও তাঁর হরিনাম বন্ধ করতে পারলো না।

পর্ণকুঠির হলো প্রেমকানন। ভক্তের আগমনে সেই জঙ্গলাকীর্ণ আশ্রম পরিণত হলো মহাতীর্থ স্থানে। অত্যাচারী রাজা রামচন্দ্র খাঁ ঠাকুর হরিদাসের গুণগান সহ্য করতে না পেরে তাঁকে জ্যান্ত পুরিয়ে মারার ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু তাও বিফল হলে হীরানামক এক বারবনিতাকে দিয়ে তাঁর সাধন, ভজন, যশ, খ্যাতি, ধর্মনাশ করার চক্রান্ত করতে থাকে।

হরিনামের প্রতি একনিষ্ঠ অবিচল ভক্তি দেখে সকলেই বিস্মিত ও স্তম্ভিত হলো। বিচারক কাজী সাহেব তার অন্যায় বিচারের অনুতাপ প্রকাশ করে ঠাকুর হরিদাসকে অন্যত্র চলে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন।

নিজ গ্রামের পারিপার্শ্বিক প্রতিকূল অবস্থা অনুধাবন করে কোনো এক নির্জন নিশিথে ঠাকুর হরিদাস অজানার উদ্দেশ্যে পথে বেরিয়ে পরলেন। ঘুরতে ঘুরতে ঠাকুর হরিদাস তৎকালীন সময়ের প্রতাপশালী রাজা রামচন্দ্র খাঁর অধীনে গহীন জঙ্গলে আশ্রয় নিলেন। সেই জঙ্গলাকীর্ণ স্থানটি আজকের বেনাপোল নামাচার্য্য শ্রী শ্রী ব্রহ্ম হরিদাস ঠাকুরের পাটবাড়ী আশ্রম।

এহেন জঙ্গলাকীর্ণ আশ্রমে ঠাকুর হরিদাস যখন হরিনাম জপ সাধনে নিমগ্ন তখন হরিদাস ঠাকুরের প্রতিদিন তিনলক্ষ বার হরিনাম জপের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পরতে থাকে। তাঁর সুধাময় কণ্ঠের মধুর হরিনামাকর্ষণে দলে দলে ভক্ত ছুটে এল পর্ণকুঠিরে।

পর্ণকুঠির হলো প্রেমকানন। ভক্তের আগমনে সেই জঙ্গলাকীর্ণ আশ্রম পরিণত হলো মহাতীর্থ স্থানে। অত্যাচারী রাজা রামচন্দ্র খাঁ ঠাকুর হরিদাসের গুণগান সহ্য করতে না পেরে তাঁকে জ্যান্ত পুরিয়ে মারার ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু তাও বিফল হলে হীরানামক এক বারবনিতাকে দিয়ে তাঁর সাধন, ভজন, যশ, খ্যাতি, ধর্মনাশ করার চক্রান্ত করতে থাকে।

সমস্ত চক্রান্তে ব্যর্থ হয়ে বারবনিতা হীরা হরিনাম মহামন্ত্রে দিক্ষিত হয়ে হরিদাস ঠাকুরের পরম বৈষ্ণবী হয়ে যান। নামাচার্য্য শ্রী শ্রী ব্রহ্ম হরিদাস ঠাকুর ছিলেন প্রকৃত বৈষ্ণবের জলন্ত নিদর্শন এবং দৈন্যের অবতার তিনি প্রতিদিন তিনলক্ষ বার হরিনাম জপ করে নামাচার্য্য নামে খ্যাত হন এবং ব্রহ্মত্ব অর্জন করেন।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শ্রীবাস অঙ্গনে হরিনাম সংকীর্তন আরম্ভ করলে হরিদাস ঠাকুর সেই সংকীর্তন আন্দোলনে যোগ দিয়ে তাঁর একজন অগ্রদূতে পরিণত হলেন। যখন নিত্যানন্দ প্রভু নবদ্বীপে পোঁছালেন তখন মহাপ্রভু নিত্যানন্দ প্রভু ও হরিদাস ঠাকুরকে হরিনাম প্রচারের দায়িত্বভার অর্পণ করলেন।

মহাপ্রভু বললেন, “হরিদাস! তুমি বর প্রার্থনা কর, তুমি যা চাইবে আজ তোমায় তাই দিব।” নামাচার্য্য হরিদাস ঠাকুর উত্তর দিলেন, “হে আমার প্রভু! আমি বর চাইনে! মৃত্যুর সময়ে আমি যেন আপনার চরন তলে বসে, আপনাকে দর্শন করতে পারি।”

উচ্চস্বরে হরিনাম করতে করতে তাঁরা পথে পথে ঘুরতে লাগলেন। যারা তাদেরকে ভিক্ষুক বলে অপমান করত তাদেরকেও তাঁরা হরিনাম করার জন্য অনুরোধ করতেন। নবদ্বীপের নগরে নগরে যাদের মাঝে তারা হরিনাম প্রচার করতে লাগলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিল পণ্ডিত আর দুর্গাদেবীর উপাসক।

এমনকি জগাই মধাইয়ের মতো দুর্বৃত্তরাও তখন সাধুতে পরিণত হলো। হরিদাস ঠাকুর এই সময়েই নামাচার্য্য উপাধি পেলেন। মহাপ্রভু যখন জগন্নাথপুরীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করলেন; তখন হরিদাস ঠাকুরের জন্য তিনি বকুল গাছের নিচে একটি কুটির নির্মাণ করেছিলেন, যা পরবর্তীতে ‘সিদ্ধ বকুল’ নামে খ্যাত হয়।

এখানে মহাপ্রভু প্রতিদিন হরিদাস ঠাকুরকে দেখতে আসতেন। যদিও হরিদাস ঠাকুর তখন বৃদ্ধ ছিলেন তথাপি তিনি প্রতিদিন তিন লক্ষ নাম জপ চালিয়ে যেতে লাগলেন। একদিন তিনি নামজপ করতে গিয়ে খুব দুর্বল বোধ করেন।

মহাপ্রভু তখন তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “হরিদাস, তোমার শরীর কেমন?” হরিদাস ঠাকুর উত্তর দিলেন, “প্রভু আমার শরীর ভালো কিন্তু মন ভালো নয়। বার্ধক্যের কারণে আমি আমার নামসংখ্যা শেষ করতে পারছি না”।

মহাপ্রভু বললেন, “হরিদাস! তুমি বর প্রার্থনা কর, তুমি যা চাইবে আজ তোমায় তাই দিব।” নামাচার্য্য হরিদাস ঠাকুর উত্তর দিলেন, “হে আমার প্রভু! আমি বর চাইনে! মৃত্যুর সময়ে আমি যেন আপনার চরন তলে বসে, আপনাকে দর্শন করতে পারি।”

পরদিন হরিদাস ঠাকুর, মহাপ্রভু ও তাঁর ভক্তগণের উপস্থিতিতে দেহত্যাগের এক মহত্ত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হরিদাস ঠাকুরের সামনে এসে তাঁর দর্শন দিলে হরিদাস ঠাকুর শ্রীচৈতন্য মহাপ্ৰভু ও অন্যান্য সমস্ত বৈষ্ণবের শ্রীপাদপদ্মে তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হরিদাস, তুমি কেমন আছ?”

হরিদাস ঠাকুর উত্তর দিলেন, “হে প্রভু, সব তোমার কৃপা”।

তখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সেই অঙ্গনে মহাসংর্কীতন আরম্ভ করলেন, যেখানে বক্রেশ্বর পণ্ডিতও নৃত্য করতে লাগলেন। স্বরূপ দামোদর গোস্বামী প্রমুখ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর ভক্তরা সবাই হরিদাস ঠাকুরকে বেষ্টন করে অতি ধীর করুন সুরে, কেঁদে কেঁদে নাম-সংকীর্তন করতে লাগলেন-

হরে কৃষ্ণ ~ হরে কৃষ্ণ ~ কৃষ্ণ কৃষ্ণ ~ হরে হরে,
হরে রাম ~ হরে রাম ~ রাম রাম ~ হরে হরে”

রামানন্দ রায়, সার্বভৌম ভট্টাচার্য প্রমুখ মহান ভক্তগণের সামনে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হরিদাস ঠাকুরের মহিমা বর্ণনা করতে লাগলেন। হরিদাস ঠাকুরের অপ্রাকৃত গুণাবলী বর্ণনা করতে করতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পঞ্চমুখ ধারণ করলেন।

যতই তিনি তার মহিমা কীর্তন করতে লাগলেন, ততই তার আনন্দ বর্ধিত হতে লাগল। সবাই হরিদাস ঠাকুরের অপ্রাকৃত গুণাবলী শ্রবণ করে সকলে অত্যন্ত বিস্মিত হলেন, এবং তারা সকলে হরিদাস ঠাকুরের শ্রীপাদপদ্ম বন্দনা করতে লাগলেন।হরিদাস ঠাকুর শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে সামনে বসিয়ে ভ্ৰমর সদৃশ নয়ন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মুখপদ্মে নিবদ্ধ করলেন।

আজও সারা বিশ্বের ভক্তগোষ্ঠী হরিদাস ঠাকুরের দৃষ্টান্তে অনুপ্ৰাণিত হয়ে আসছে। তিনি খুব সাধারণ একটি নির্দেশ প্রদান করে গেছেন- জীবনে মরণে অহৰ্নিশি হরিনামামৃত আস্বাদন করুন। এই নামই আপনাকে সরাসরি কৃষ্ণের সান্নিধ্য প্রদান করবে।। হরিবোল। জয় নামাচার্য্য হরিদাস ঠাকুর।।

…………………………
পুণঃপ্রচারে বিনীত -মেঘনা কুণ্ডু

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কঠিয়াবাবা রামদাস
সাধু নাগ মহাশয়
লঘিমাসিদ্ধ সাধু’র কথা
ঋষি অরবিন্দ’র কথা
অরবিন্দ ঘোষ
মহাত্মাজির পুণ্যব্রত
দুই দেহধারী সাধু
যুগজাগরণে যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে
মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনাম
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : প্রথম খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব: দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : অন্তিম খণ্ড
মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
শ্রীশ্রী ঠাকুর সত্যানন্দদেব
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন
সাধক তুকারাম
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: এক
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: দুই
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!