লালন ফকিরের নববিধান : এক
-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
ভরতবর্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক সাধক ফকির লালন শাহ্। তাঁকে অস্বীকার করে ভারতবর্ষের আধ্যাত্মবাদ নিয়ে আলোচনা করলে তা অপূর্ণ থেকে যাবে; এতে কোনো সন্দেহ নেই। লোকায়িত দর্শনের মাঝে ফকির লালন সাঁইজি নিজেই এমন এক রহস্যময় জগৎ; যাকে অনুসন্ধানে নামলে ডুবতে ডুবতে আর তল পাওয়া যায় না। তিনি এই রহস্য অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছেন দেহত্যাগের প্রায় দেড়’শ বছর পরেও।
ফকির লালনের মাঝে কি সেই রহস্য তা জানতে গেলে ডুবতে হবে তার গানে ও জ্ঞানে। সাধারণ জ্ঞানে অবশ্য তা ধরা দেবে না। তা বুঝতে গেলে চাই গভীর জ্ঞান। আবার জ্ঞানের স্তর উন্নত হলেই যে সে রহস্য প্রকাশ তাবে তাও নিশ্চিত করা বলা কঠিন। লালন মতে বিশ্বাসীরা বলেন, গুরুজ্ঞানের ভেদ গুরুর কাছ থেকেই গ্রহণ করতে হয়। অন্যথায় তালগোল পাকিয়ে যায়।
লোকায়িত গুপ্ত মত-পথ এভাবেই রহস্যের রূপকে আড়াল করে তাদের মত প্রচার করে থাকে। যাতে সাধারণ মানুষ এর একটা গতানুগতিক অর্থ পেয়ে বিনোদিত হতে পারে। আর যারা মূল সত্যের দিকে যাত্রা করবে তারাই কেবল ধীরে ধীরে মূলতত্ত্ব বা মূল অর্থ অনুধাবণ করতে পারবে। তবে বেশিভাগ মানুষ এসব কথা মানতে নারাজ। তারা ভাবেন, এসব প্রচার আসলে লোকায়িত মতকে গুপ্ত রাখবার কৌশল মাত্র।
তবে যারা রহস্য ভেদ করতে এই রহস্যময় জগতে প্রবেশ করেন তারাই টের পান এর গভীরতা। এদের মধ্যে যারা এর গভীরতায় ডুবতে ডুবতেও ভেসে উঠতে পারে তারাও এতোটাই মজে যায় যে এই রহস্য ভেদ প্রকাশে আগ্রহ হরিয়ে ফেলেন। এর একটা সাধারণ কারণ হয়তো, এই মত-পথকে বুঝতে গেলে গোটা আধ্যাত্মবাদকে বুঝতে হয়। আর যারা আধ্যাত্মবাদকে বোঝে না তাদের কাছে এই ভেদের কথা বলা অর্থহীন।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে ফকির লালন শাহ্ কি তার পদে অন্যান্য লোকায়িত দর্শনের পুনরাবৃত্তি করেছেন, নাকি দিয়েছেন নতুন বিধান? আর যদি নতুন বিধান দিয়েও থাকেন তাহলে তার কতটা সাধারণের জন্য উন্মুক্ত? সাধারণ জ্ঞান দিয়ে আমরা তার কতটা বুঝতে পারি।
তাই এই ভেদ আলোচনা গুরুশিষ্য পরম্পরাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। গুরু তার শিষ্যকে প্রস্তুত করে অর্থাৎ পাত্র তৈরি করে সেই পাত্রে জ্ঞান দান করেন। অপাত্রে এই জ্ঞান দানে কোনো মাহাত্ম্য নেই।
এতোসব প্রতিবন্ধকতার মাঝে যারা বলতে চান রহস্য ভেদের কথা তাদেরকেও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে মাথায় রেখে আবারো সেই রূপকে আড়াল করেই বলতে হয়। মদ্দ্যা কথা এই রহস্যময় জাগতের কথা ‘যে লাউ সেই কদু’ই থেকে যায়। আর এই আধ্যাত্মবাদের অন্যতম সাধক ফকির লালন সাঁইজিকে বোঝা আরও জটিল। প্রথমে মনে হবে সবই বোঝা যাচ্ছে। তারপর যত এর গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করা হবে ততই ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে এ বুঝতে গেলে আরো অনেক অনেকটা পথ পারি দিতে হবে।
সাধক পর্যায়ের অনেকে এই রহস্যের অর্থ নিশ্চিত হয়ে বললেও প্রকৃত সাধুগুরুরা বলেন, “যে যার জ্ঞান অনুযায়ী এর অর্থ খুঁজে পায়। আজ পর্যন্ত আমার যে জ্ঞান তা দিয়ে আমি এতোটুকুই বুঝতে পেরেছি। তবে এ কথাও সত্য যে, আগামীকাল জ্ঞানের আরেকটু গভীরে প্রবেশ করতে পারলে আমি জানি এর ভেতরে আমি আরো অন্তনির্হিত অর্থ পাবো।”
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে ফকির লালন শাহ্ কি তার পদে অন্যান্য লোকায়িত দর্শনের পুনরাবৃত্তি করেছেন, নাকি দিয়েছেন নতুন বিধান? আর যদি নতুন বিধান দিয়েও থাকেন তাহলে তার কতটা সাধারণের জন্য উন্মুক্ত? সাধারণ জ্ঞান দিয়ে আমরা তার কতটা বুঝতে পারি।
কতটা পালন করবার চেষ্টা করতে পারি। হয়ে উঠতে পারি লালনের অচিন মানুষ বা সহজ মানুষ। এই সহজ মানুষের প্রস্তুতির জন্য লালন ফকির বেশ কিছু পদ দিয়ে গেছেন যার মাঝে অন্তর্নিহিত অর্থ লুকায়িত থাকলেও সাধারণের জন্যেও রয়েছে বিধি বিধান। সাধারণের জন্য দেয়া বিধি বিধান সমৃদ্ধ পদগুলোর অন্যতম হলো-
সত্য বল সুপথে চল
ওরে আমার মন,
সত্য সুপথ না চিনিলে
পাবিনে মানুষের দরশন।।
খরিদ্দার মহাজন যে জন বাটখারাতে কম
তারে কসুর করবে যম,
গদিয়ান মহাজন যেজন
বসে কেনে প্রেমরতন।।
পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ করোনা
পারে যেতে পারবে না,
যতবার করিবে হরণ
ততোবার হবে জনম।।
লালন ফকির আসলে মিথ্যে
ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে,
সই হলো না একমন দিতে
আসলেতে প’লো কম।।
ফকির লালনের সাধারণের জন্য নববিধান-
- সাধককে সত্য ও সুপথ চিনতে হবে; এটাই সাধনার প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ। আর এই সত্য কি এবং সুপথ কি এই ভেদ জানতে পারলেই সাধক আত্মাদর্শন লাভের পথ খুঁজে পাবে। সাধক শুরু করতে পারে আত্মাদর্শনের সাধনা।
- সাধককে যার যা প্রাপ্য নির্মোহভাবে সঠিক পরিমাপে তাকে তা দিতে হবে। এতে ত্রুটি-বিচূত্যি হলে চলবে না। আর এই যার যা প্রাপ্য তা যেই সাধক সুচারুরূপে পরিশোধ করবে সেই প্রেমানন্দে থাকার অধিকার রাখে।
- যাতে অন্যের অধিকার রয়েছে তা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা বা জোর করে আদায়ের চেষ্টা সাধক করতে পারবে না। তা সে সম্পদ-সম্পত্তি-দ্রব্যই হোক বা নারীকূল।
ফকির লালন সাঁইজি এখানে কেবল প্রকৃতির চলমান প্রকৃয়ার কথাই ব্যক্ত করেছেন। যা করলে যা হবে। তিনি কোনো অলৌকিক শক্তিবলে সমস্ত দৃশ্যপট পাল্টে দেবেন। সাধককে উৎকর্ষে পৌঁছাবেন যাদু-মন্ত্রবলে এমন কোনো অঙ্গিকার করেন নি। আর এটাই ফকির লালনের মতের সৌন্দর্যতা।
প্রকৃতির যে নিয়ম তা পালন করলেই প্রকৃতিকে পাওয়া সম্ভব। এর ব্যাত্যয় ঘটলেই সর্বনাশ। ফকির লালন তার নতুন বিধানে সেই আদি ও অকৃত্রিম কথাই আবারো প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তা অনেক বেশি সহজ ও সাবলীল ভাষায়। সহজ গাথুঁনিতে। আর এ জন্যই ভক্তকূলের মাঝে লালন স্থায়ী আসন করে থাকবেন সর্বকালে সমকালীন হয়ে। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা প্রার্থী।
সাধুগুরুপাগল সর্ব চরণে ভক্তি। জয়গুরু।।
…………………………………..
চিত্র:
ফকির লালন সাঁইজির প্রকৃত কোনো ছবি নেই। ব্যবহৃত ছবিটি লালন ফকিরের কাল্পনিক ছবি মাত্র। বহুল ব্যবহৃত হলেও এই ছবির সাথে লালন সাঁইজির আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায় না।
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন-
voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
………………………..
আরো পড়ুন:
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: এক
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: দুই
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: তিন
…
লালন ফকিরের নববিধান: এক
লালন ফকিরের নববিধান: দুই
লালন ফকিরের নববিধান: তিন
…
লালন সাঁইজির খোঁজে: এক
লালন সাঁইজির খোঁজে: দুই
…
লালন সাধনায় গুরু : এক
লালন সাধনায় গুরু : দুই
লালন সাধনায় গুরু : তিন
…
লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: এক
লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: দুই
…
ফকির লালন সাঁই
ফকির লালনের ফকিরি
ফকির লালন সাঁইজি
চাতক বাঁচে কেমনে
কে বলে রে আমি আমি
বিশ্ববাঙালি লালন শাহ্ফকির লালন সাঁইজির শ্রীরূপ
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন
বিকৃত হচ্ছে লালনের বাণী?
লালন ফকিরের আজব কারখানা
মহাত্মা লালন সাঁইজির দোলপূর্ণিমা
লালন ফকির ও একটি আক্ষেপের আখ্যান
লালন আখড়ায় মেলা নয় হোক সাধুসঙ্গ
লালন অক্ষ কিংবা দ্রাঘিমা বিচ্ছিন্ন এক নক্ষত্র!
লালনের গান কেন শুনতে হবে? কেন শোনাতে হবে?
লালন গানের ‘বাজার বেড়েছে গুরুবাদ গুরুত্ব পায়নি’
‘গুরু দোহাই তোমার মনকে আমার লওগো সুপথে’
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির স্মরণে বিশ্ব লালন দিবস
3 Comments