ভবঘুরেকথা
তুলসীদাস

সাধক তুলসীদাস: তিন

বৃন্দাবন ও নৈমিষারণ্য ভ্রমণের পর কাশীধামে গিয়ে বাস করতে থাকেন তুলসীদাস। প্রথমে কাশীর হনুমান ফটকে নিজের একটি চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন। কিন্তু স্থানীয় লোকদের অনাচার সহ্য করতে না পেরে এ অঞ্চল ছেড়ে গোপাল মন্দিরে গিয়ে আশ্রয় নেন কিছুদিনের জন্য।

কিন্তু এখানকার বল্লভ শ্রেণীর গোস্বামীরা বড় সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন বলে তাদের সঙ্গে মতভেদ হয় তুলসীর। তখন তিনি অসিঘাটে চলে যান। এই ঘাটের গুহা ও মন্দিরেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাস করেন। সেইদিন থেকে এই স্থানটিই তাঁর সাধনস্থল হয়ে ওঠে। অসিঘাটে আজও তুলসী দাসের সাধনাগুহা ও নানা স্মৃতিচিহ্ন বর্তমান আছে।

এরপর কাশীধাম হতে আবার অযোধ্যায় এলেন তুলসীদাস। তিনি মনস্থ করলেন, প্রভু শ্রীরামের পূণ্য স্মৃতিবিজড়িত অযোধ্যার সরযূতটে একটি কুটির নির্মাণ করে সেখানে নবরামায়ণ রচনার কাজ শুরু করবেন। এবার অযোধ্যায় আসতেই ঘটনাক্রমে এক শক্তিমান যোগীপুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেল।

কিন্তু কি আশ্চর্য! প্রথম দর্শনেই সেই যোগীবর তুলসীকে ‘নবযুগের বাল্মিকী’ বলে সম্ভাষণ করলেন। তাঁরই উৎসাহে তুলসীদাস তাঁর অমর কীর্তি ‘রামচরিত মানস’ রচনার কাজে এবার প্রবৃত্ত হলেন।

সেই যোগীবরের সরযূতটে একটি পর্ণকুটির ছিল। তুলসীদাস যখন সেখানে তাঁর একটি নিজস্ব কুটির নির্মাণের কথা ভাবছিলেন, এমন সময় অকস্মাৎ একদিন সেই যোগীবর যোগশক্তিবলে দেহত্যাগ করলেন। ফলে তুলসীদাস সেই কুটিরেই অবস্থান করে তাঁর ‘রামচরিত মানস’ গ্রন্থটি রচনা করে যেতে লাগলেন পরম ভক্তিভরে।

এ যেন শুধু নিছক এক কাব্যসৃষ্টি নয়, অন্তর উজাড় করে ভক্তিরসে রসায়িত এক মহা-অর্ঘ্য থরে থরে সযত্নে সাজিয়ে নিবেদন করছেন তিনি তাঁর পরমপ্রভুর উদ্দেশ্যে। শুধু রামচরিত্র ও রামলীলার বর্ণনাই কিন্তু তাঁর ‘রামচরিত মানস’ রচনার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়।

এক বৃহত্তর তাৎপর্যে মণ্ডিত করে তুলতে চাইলেন তুলসীদাস তাঁর এই মহান গ্রন্থটিকে। বাল্মিকী রামায়ণ, যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ, অধ্যাত্ম রামায়ণ, প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ, পুরাণ, কালিদাসের রঘুবংশ, ভবভূতির উত্তররামচরিত, প্রসন্ন রাঘব, হনুমন্নাটিকা, শ্রীমদ্ভাগবত প্রভৃতি গ্রন্থ হতে অজস্র তথ্য, তত্ত্ব ও রসবস্তুগত উপাদান সংগ্রহ করে তাঁর অনবদ্য মহাকাব্য ‘রামচরিত মানস’ প্রণয়ন করেন তুলসীদাস।

এই গ্রন্থে শ্রুতিসম্মত আচার-অনুষ্ঠানের মাহাত্ম্যও তুলে ধরেন। ভাষার দিক থেকেও এই গ্রন্থ এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ‘রামচরিত মানস’। আউধী হিন্দী ও ব্রজবুলীর সংমিশ্রনের ফলে এ গ্রন্থের ভাষা সহজবোধ্য হওয়ায় তা প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

ভক্তকবি, সাধক ও শক্তিমান যোগী তুলসীদাসের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে দিকে দিকে। তাঁর চতুষ্পাঠীতে ছাত্র ও দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়ে যেতে থাকে দিনে দিনে।

তুলসীদাসের এই ক্রমবর্ধমান খ্যাতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে কাশীর একদল ব্রাহ্মণ। বিশেষ করে যারা রামায়ণপাঠ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করত। তারা ‘রামচরিত মানস’-এর জনপ্রিয়তায় বিব্রতবোধ করতে লাগল। কারণ ‘রামচরিত মানস’-এর ভাষা সহজ হওয়ায় রামায়ণ সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে সাধারণের কাছে।

এরপর একদল তান্ত্রিক অভিচার প্রয়োগ করে তুলসীদাসের প্রাণনাশের চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁর অভিভাবক মহাবীরজীর কৃপায় তান্ত্রিকদের চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তাঁর প্রাণরক্ষা হয়। নিরন্তন রামনাম জপ আর রামনাম প্রচারের প্রভাবে ক্রমে চৈতন্যময় হয়ে ওঠে তুলসীর মন্ত্র। সিদ্ধবাক হয়ে ওঠেন তিনি। যোগসিদ্ধির নানা লক্ষণ দেখা যায় বিভিন্ন ঘটনায়।

দুষ্টপ্রকৃতির সেই ব্রাহ্মণের দল ষড়যন্ত্র করে তুলসীদাসের গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি ও আশ্রমের জিনিসপত্র চুরি করে আনার জন্য দুজনকে নিযুক্ত করে।

একদিন গভীর রাত্রিতে ঐ দুজন তুলসীদাসের আশ্রমে চুরি করতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। তারা আশ্চর্য হয়ে দেখল, শ্যামবর্ণ দিব্যকান্তি এক কিশোর বালক ধনুর্বাণ হাতে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে। আশ্রমের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে সর্বক্ষণ। চোরেরা বারবার চেষ্টা করেও আশ্রমে ঢুকতে পারল না। কে এই অস্ত্রধারী তরুণ যুবক, তারা কিছুই বুঝতে পারল না। ভয়ে ও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ফিরে গেল তারা।

পরদিন সকালে তারা তুলসীদাসের আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হলো। তা জানতে চাইল, সেই তরুণ রক্ষীটি কে? এমন নয়নাভিরাম দিব্যকান্তি কিশোর জীবনে তারা কখনো দেখেনি। তাঁর রূপের কথা ভুলতে পারছে না তারা। কৌতূহলের সঙ্গে সঙ্গে অনুশোচনাও জেগেছে তাদের অন্তরে। চোরদুটি এবার তাদের চুরির অভিপ্রায়ের কথা ও গতরাত্রির বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা অকপটে বলল তুলসীদাসের কাছে।

তাদের সব কথা শুনে নয়নজলে ভাসতে লাগলেন তুলসীদাস। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ভাই! তোমরা ধন্য। তোমাদের পেয়ে ও কথা শুনে আমিও ধন্য হলাম। বহুজন্মের সঞ্চিত পূণ্যবলে তোমরা আমার প্রভু রঘুনাথজীর দর্শন পেয়েছ।

এসো, আলিঙ্গন দিয়ে আমায় পবিত্র করো।

স্বয়ং প্রভু রামচন্দ্র কিশোর বালকবেশে তাঁর আশ্রমরক্ষার জন্য সারারাত পাহারা দিয়েছেন, এই ভেবে মনে বড় ব্যথা পেলেন তুলসীদাস। তাঁর সারাজীবনের ভক্তির তুলনায় তাঁর মত অভাজনের প্রতি প্রভুর এ কৃপা ও ভালোবাসার যে তুলনাই হয় না।

এরপর একদল তান্ত্রিক অভিচার প্রয়োগ করে তুলসীদাসের প্রাণনাশের চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁর অভিভাবক মহাবীরজীর কৃপায় তান্ত্রিকদের চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তাঁর প্রাণরক্ষা হয়। নিরন্তন রামনাম জপ আর রামনাম প্রচারের প্রভাবে ক্রমে চৈতন্যময় হয়ে ওঠে তুলসীর মন্ত্র। সিদ্ধবাক হয়ে ওঠেন তিনি। যোগসিদ্ধির নানা লক্ষণ দেখা যায় বিভিন্ন ঘটনায়।

একদিন ভোরবেলায় এক ব্যক্তি কাঁদতে কাঁদতে তুলসীর কাছে এসে বলে, সে ব্রাহ্মণ হত্যা করে মহাপাপ করেছে। অনুতাপের জ্বালায় সে জর্জরিত। কিন্তু কোন্ প্রায়শ্চিত্ত করলে এ পাপ দূর হবে তা সে জানে না। কাশীর রক্ষণশীল পণ্ডিতেরা বিধান দিয়েছেন, আত্মহত্যা ছাড়া এ পাপ হতে মুক্তিলাভ সম্ভব নয়‌।

লোকটি তুলসীর চরণে পড়ে কাঁদতে লাগল। তাকে অভয় দান করে তিনি বললেন, সেকি কথা ভাই! রামনাম জপ করো। সর্বপাপহর রামনাম থাকতে তোমায় আত্মহত্যা করতে হবে কেন? তুলসীর নির্দেশমত লোকটি প্রতিনিয়ত রামনাম জপ করতে থাকে একাগ্রচিত্তে পরম ভক্তিভরে।

সেদিন মণিকর্ণিকার ঘাটের পাশ দিয়ে আপন মনে রামনাম জপ করতে করতে কোথায় যাচ্ছিলেন তুলসী। সেই সময় ঐ ঘাটে এক বিধবা নারী মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাবার জন্য আসে। তুলসীকে দেখেই সেই নারী শ্রদ্ধাভরে তাঁর চরণে লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করে। তার পরনে ছিল লালপাড় শাড়ি। সিঁথিতে ছিল সিঁদুর।

তুলসী ঘোষণা করলেন, লোকটি রামনামের প্রভাবে সম্পূর্ণরূপে পাপমুক্ত হয়ে গেছে। কারণ তাঁর মতে পৃথিবীতে এমন কোন পাপ নেই যা রামনামে দূরীভূত না হয়।

কিন্তু কাশীর রক্ষণশীল পণ্ডিতেরা একথা মানতে রাজী হলেন না। তুলসী তখন তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, কি নিদর্শন দেখলে তারা এই পাপমুক্তির কথা মেনে নেবেন।

পণ্ডিতেরা বললেন, তোমার রামনামের যদি এতই শক্তি তবে তার প্রমাণ আমরা দেখতে চাই। মন্দির প্রাঙ্গণে যে পাথরের বৃষমূর্তি আছে, ঐ ব্রহ্মঘাতী মহাপাপী সেই বৃষটিকে তৃণ ভক্ষণ করতে দেবে। বৃষটি জীবন্ত হয়ে যদি সে তৃণ ভক্ষণ করে, তবেই আমরা বুঝব, তোমার রামনামের মাহাত্ম্য আছে।

তবেই আমরা তোমার কথা মেনে নেব এবং স্বীকার করব, লোকটি সত্যসত্যই ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে মুক্ত হয়েছে। তুলসী বললেন, তাই হবে।

কথাটা সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে রটে যায়। ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখার জন্য দলে দলে লোক এসে জড়ো হয়। তুলসীর আদেশমত লোকটি সমবেত জনতার সামনে পাথরের বৃষমূর্তিটিকে তৃণ ভক্ষণ করতে দিলে মূর্তিটি সহসা জীবন্ত হয়ে তা ভক্ষণ করে।

এই অভাবনীয় অলৌকিক দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় সমবেত জনতা‌। চারিদিকে ধন্য ধন্য রব ওঠে। তুলসীর দেওয়া রামনামের শক্তি ও মাহাত্ম্য একবাক্যে অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করে। তারা বুঝতে পারে তুলসীদাস এক যোগসিদ্ধ অধ্যাত্মশক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষ।

সেদিন মণিকর্ণিকার ঘাটের পাশ দিয়ে আপন মনে রামনাম জপ করতে করতে কোথায় যাচ্ছিলেন তুলসী। সেই সময় ঐ ঘাটে এক বিধবা নারী মৃত স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাবার জন্য আসে। তুলসীকে দেখেই সেই নারী শ্রদ্ধাভরে তাঁর চরণে লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করে। তার পরনে ছিল লালপাড় শাড়ি। সিঁথিতে ছিল সিঁদুর।

তুলসী ভাবলেন, এই নারী তাঁর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করছে। নারীটিকে সধবা ভেবে ভাবাবিষ্ট অবস্থায় তিনি আশীর্বাদ করলেন, পতিপুত্রবতী হয়ে তুমি আনন্দে সংসার করো। তখন সেই নারী তুলসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার মৃত স্বামীকে দেখিয়ে দেয়।

তুলসী তাঁর যোগশক্তিবলে তার মৃত স্বামীকে বাঁচিয়ে দেন।

এইভাবে তুলসীদাস তাঁর অমূল্য অমিত অধ্যাত্মশক্তি শুধু নিজের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে বহু পাপীতাপী উদ্ধার ও গরীব দুঃখীদের দুঃখমোচনের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দেন। কারো কোন দুঃখকষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। তিনি তাঁর একটি দোহায় বলেন-

‘নহী দারিদ্র্যসম দুঃখ জগমাহী’।

কোন গরীব দুঃখী এসে তাঁর কাছে তার দুঃখের কথা বললেই তার দুঃখ মোচন করতেন তুলসীদাস। তাতে উদাসীন থাকতে পারতেন না। একদিন গঙ্গার ধারে একমনে রামনাম জপ করছিলেন তুলসী। এমন সময় এক গরীব ব্রাহ্মণ তাঁর কাছে এসে নিজ দুঃখ কষ্টের কথা বলে কাঁদতে থাকেন।

তিনি তুলসীদাসের অসামান্য যোগবিভূতির কথা জানতেন। তুলসীদাস তখন তার দুঃখ মোচনের জন্য গঙ্গামাঈকে অনুরোধ করেন। গঙ্গামাঈ তাঁর অনুরোধ রক্ষা করেন। গঙ্গার স্রোত তট হতে কিছুটা সরে যায়। তখন তুলসীদাস ঐ জলযুক্ত জমি ব্রাহ্মণকে দানের ব্যবস্থা করে দেন। পরে ঐ জমির ফসলে ব্রাহ্মণের দারিদ্র্য দূর হয়।

চিত্রকূটে অবস্থানকালে একজন দীন দুঃখীকে একটি দারিদ্র্যমোচন শিলা দান করেন তুলসীদাস। শোনা যায়, সেই শিলার প্রভাবে লোকটির সব অভাব দূর হয়। ধনধান্যে পূর্ণ হয়ে ওঠে তার সংসার।

এই সময় এক ধরনের মারাত্মক ব্রণের আক্রমণ দেখা দেয় তাঁর দেহে। তুলসীদাস বুঝতে পারলেন এ ব্রণ আর সারবে না। ক্রমে জীর্ণ হয়ে পড়ে দেহ। তিনি বেশ বুঝলেন, তাঁর প্রাণপ্রভু রঘুনাথজী এবার সত্যি সত্যিই তাঁর কাছে তাঁকে টেনে নিয়ে যেতে চান। তাই দেহটি শীর্ণ হয়ে পড়লেও চোখে মুখে আনন্দের দীপ্তিটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দিনে দিনে।

এইভাবে তুলসীদাসের অসামান্য যোগশক্তির কথা লোকের মুখে মুখে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এই সব জনশ্রুতি শুনে দিল্লীর বাদশা সম্রাট শাহজাহান তুলসীদাসকে রাজধানী দিল্লীতে আনার ব্যবস্থা করেন। তিনি সেখান গেলে সম্রাট তাঁকে কিছু অলৌকিক যোগশক্তির পরিচয় দিতে অনুরোধ করেন।

কিন্তু তুলসী এভাবে লোককে দেখাবার জন্য বা আত্মপ্রচারের জন্য যোগশক্তির কোন পরিচয় দিতেন না। ক্ষেত্রবিশেষে জনকল্যাণের জন্য প্রয়োজন হলেই তবে তা প্রকাশ করতেন। তুলসীদাস তাই সম্রাটকে বিনীতভাবে উত্তর করলেন, সম্রাট! আমি রামচন্দ্রজীর একজন দীন সেবক। অলৌকিকত্বের আমি কি জানি!

বাদশা ভাবলেন, তুলসী তাঁর কথা অগ্রাহ্য করছেন। তাই তিনি ক্রুব্ধ হয়ে তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখেন।

কিন্তু তুলসীর কারারুদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য বানরের উৎপাতে অতিষ্ট হয়ে ওঠে সারা রাজধানীর লোক। রাজধানী দিল্লীর সর্বত্র বানরে ভরে যায়। এত বানর কেউ কখনো দেখেনি। তখন নগরের বিশিষ্ট হিন্দুনেতারা বাদশার কাছে গিয়ে বোঝাতে থাকেন, এ হচ্ছে রামভক্ত তুলসীদাসের যোগশক্তিরই এক পরোক্ষ লীলা।

তা না হলে রাজধানীতে একসঙ্গে এত বানর এসে এত উৎপাত করবে কেন। আপনি মহাসাধক তুলসীদাসকে মুক্তি দিন। তা না হলে সারা রাজ্য ও রাজধানীতে আরো কত কি অমঙ্গল দেখা দেবে তা বলা যায় না।

বাদশাও তখন কথাটার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। তিনি বুঝতে পারলেন, তুলসীদাস সত্যিই একজন শক্তিমান সাধক। তাঁর সঙ্গে এই ধরনের আচরণ ঠিক হয়নি তার পক্ষে। তাই অবিলম্বে সসন্মানে তাঁকে মুক্তিদান করলেন।

এবার মনের মধ্যে জাগে দেহত্যাগের বাসনা। কেবলি মনে হয় রঘুনাথজী যেন তাঁকে ডাকছেন। এই মরদেহ ত্যাগ করে তাঁর কাছে চলে যেতে বলছেন। রামনামের মাহাত্ম্য প্রচারের যে গুরুভার তার প্রভু একদিন দিয়েছিলেন, সে গুরুভার তিনি এতদিন সার্থকভাবে বহন করে এসেছেন। তিনি প্রভুর সব আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন।

এই সময় এক ধরনের মারাত্মক ব্রণের আক্রমণ দেখা দেয় তাঁর দেহে। তুলসীদাস বুঝতে পারলেন এ ব্রণ আর সারবে না। ক্রমে জীর্ণ হয়ে পড়ে দেহ। তিনি বেশ বুঝলেন, তাঁর প্রাণপ্রভু রঘুনাথজী এবার সত্যি সত্যিই তাঁর কাছে তাঁকে টেনে নিয়ে যেতে চান। তাই দেহটি শীর্ণ হয়ে পড়লেও চোখে মুখে আনন্দের দীপ্তিটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দিনে দিনে।

অসিঘাটের আশ্রমকুটিরে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে প্রভুর সঙ্গে চিরমিলনের মহাক্ষণটির জন্য ব্যগ্রভাবে প্রতীক্ষা করছেন। ভক্ত শিষ্যেরা সমানে সেবা করে চলেছে। সেদিন তুলসীদাস তাঁর সেবক ও শিষ্যদের বললেন-

রামনাম জস বরনিকৈ হোন চহত অব মৌন।
তুলসীকে মুখ দীজিয়ে আবহা তুলসী গৌন।।

অর্থাৎ যে জিহ্বা রামনামের যশ বর্ণনা করত, আজ তা মৌন হয়ে থাকতে চায় একেবারে। সেদিন ১৭৩৭ খৃস্টাব্দের শ্রাবণ মাস। শুক্লা সপ্তমী তিথি। এবার সত্যি সত্যিই চিরদিনের মত মৌন হয়ে উঠল ভক্তকবি তুলসীদাসের রামনামপূত জিহ্বা।

শুধু মহাপ্রয়াণ নয়, তাঁর পরমপ্রভুর সঙ্গে চিরমিলনের অভিসার যাত্রা। এবার আর ক্ষণমিলনের ছলনায় বিভ্রান্ত করে প্রভু পালিয়ে যেতে পারবেন না। ক্ষণমিলনের চকিত বিদ্যুতালোকে আর কখনো তীব্রতর হয়ে উঠবে না তাঁর আধ্যাত্মিক বিরহের বেদনার্ত অন্ধকার। এবার আজ প্রভুর কাছে গিয়ে মত্ত হয়ে উঠবেন চিরমিলনের এক আনন্দলীলায়।

……………..
আরো পড়ুন:
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন

………………………..
ভারতের সাধক ও সাধিকা সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
স্বামী অড়গড়ানন্দজী
ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব
শিরডি সাই বাবা
পণ্ডিত মিশ্রীলাল মিশ্র
নীলাচলে মহাপ্রভুর অন্ত্যলীলার অন্যতম পার্ষদ ছিলেন রায় রামানন্দ
ভক্তজ্ঞানী ধর্মপ্রচারক দার্শনিক রামানুজ
সাধক ভোলানন্দ গিরি
ভক্ত লালাবাবু
লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত সৃষ্টি
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য
ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন
পরিব্রাজকাচার্য্যবর শ্রীশ্রীমৎ দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংসদেব
আর্যভট্ট কাহিনী – এক অজানা কথা
গিরিশচন্দ্র ঘোষ
কঠিয়াবাবা রামদাস
সাধু নাগ মহাশয়
লঘিমাসিদ্ধ সাধু’র কথা
ঋষি অরবিন্দ’র কথা
অরবিন্দ ঘোষ
মহাত্মাজির পুণ্যব্রত
দুই দেহধারী সাধু
যুগজাগরণে যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি মহারাজ
শ্রী শ্রী রাম ঠাকুর
বাচস্পতি অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে
মুসলমানে রহিম বলে হিন্দু পড়ে রামনাম
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : প্রথম খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব: দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্র দেব : অন্তিম খণ্ড
মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ
শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
শ্রীশ্রী ঠাকুর সত্যানন্দদেব
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: এক
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: দুই
মহাতাপস বালানন্দ ব্রহ্মচারী: তিন
সাধক তুকারাম
সাধক তুলসীদাস: এক
সাধক তুলসীদাস: দুই
সাধক তুলসীদাস: তিন
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: এক
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: দুই
শ্রীশ্রী মোহনানন্দ স্বামী: তিন

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!