“ঈশ্বরে বিশ্বাস যেকোন রকম অসাধ্যসাধন ঘটাতে পারে বটে কিন্তু একটি মাত্র বিষয় ছাড়া; তা হচ্ছে, না পড়ে পরীক্ষায় পাশ করা।” কথাগুলো পড়ে নিতান্ত বিরক্ত হয়েই অলস মুহূর্তে পড়তে নেওয়া সেই ভাবোউদ্দীপক পুস্তকখানি বন্ধ করলাম। ভাবলাম এই লেখক যে ব্যতিক্রমের কথা বলছেন, তাতে করে তাঁর বিশ্বাসের একান্ত অভাবই দেখা যায়।
বেচারার রাত জেগে পড়া তৈরির উপরই যথেষ্ট ভরসা আছে দেখছি। পিতার কাছে প্রতিশ্রুত ছিলাম যে আমি মাধ্যমিকের পড়া শেষ করব। আমি যে পরিশ্রমী ছিলাম তা বলতে পারি নে। মাসের পর মাস ক্লাস ঘরের চেয়ে কলকাতার স্নানের ঘাটে; কোনো নির্জন স্থানেই আমায় বেশি দেখা পাওয়া যেত। নিকটস্থ শ্মশানভূমি, বিশেষতঃ রাত্রিকালে যা বিভীষিকা উৎপাদন করে, যোগীদের কাছে তাই-ই পরম আকর্ষণীয় স্থান।
মৃত্যুহীন সত্ত্বার খোঁজে যারা ফেরে, গোটাকতক কেশহীন মড়ার খুলির দেখে নিশ্চয়ই তারা ভীত হয় না। মানুষের অসম্পূর্ণতা নানা অস্থি-কঙ্কালের অন্ধকার আবাসেই প্রকট হয়ে ওঠে। তাই পড়ুয়াদের রাতজাগা থেকে আমার রাতজাগা একটু ভিন্ন রকমের ছিল।
হিন্দু হাইস্কুলের চূড়ান্ত পরীক্ষার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছিল। পরীক্ষার প্রস্তুতির এই সময়টা শ্মশানভূমির ভয়ের মতই একটা বহুপরিচিত ভয়ের সৃষ্টি করে। তা সত্ত্বেও আমার মনে কোনো উদ্বেগ ছিল না। সাহস নিয়ে এই সব ভূতপ্রেতের রাজ্যে বিচরণ করে আমি এমন সব জ্ঞান আহরণে রত ছিলাম যা লেকচার হলে পাওয়া যায় না।
কিন্তু স্বামী প্রণবানন্দের মত তো আমার আর সে ক্ষমতা ছিল না, যাতে দু’ জায়গায় একই সময় উপস্থিত থাকতে পারি! আমার যুক্তি ( হায়! অনেকেরই কাছে হয়ত এটা অযৌক্তিক বলে মনে হবে) ছিল – ভগবানই আমার সমস্যা দেখে আমায় তার হাত থেকে উদ্ধার করবেন। বিপদ হতে উদ্ধার করবার হাজারো রকমের উদাহরণের অবাধ্য কারণ হতেই ভক্তের মধ্যে এইরকম যুক্তিহীনতা এসে পরে।
একদিন বিকালে গড়পার রোডে এক সহপাঠী বন্ধুর সাথে দেখা হল। বন্ধুটি বলল, “কিহে মুকুন্দ! আজকাল তোমার দেখা পাওয়াই যায় না। তার প্রীতিকোমল দৃষ্টির সম্মুখে আমি আমার সমস্যাকে উন্মুক্ত করে বললাম, “জানিস নান্টু! স্কুলে না গিয়ে আমার বড্ডই মুশকিলে পরতে হয়েছে।”
নান্টু ছিল খুবই ভালো ছাত্র। আমার কথা শুনে প্রাণ খুলে হাসল। অবশ্য আমার বিপদেও যে হাসির খোরাক ছিল না, তা নয়! বলল, “ফাইনাল পরীক্ষার জন্য তো তুমি কিছুমাত্র তৈান হও নি। তা হলে তোমায় কিছু সাহায্য করার দরকার দেখছি।”
তার এই অত্যন্ত সহজ কথাগুলো কিন্তু আমার কানে দৈব আশ্বাসবাণীর মতই এসে প্রবেশ করল। কালবিলম্ব না করে বন্ধুটির বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। মাস্টার মশাইয়ের কাছ থেকে যেসব প্রশ্ন আসতে পারে, তার উত্তরগুলো সব মোটামুটি আমায় বুঝিয়ে দিয়ে বন্ধুবর বলল, “এই প্রশ্নগুলোই হচ্ছে সব টোপ – যাতে সরল বিশ্বাসী অনেক ছাত্রই পরীক্ষার ফাঁদে ধরা পরে যাবে। আমি যে উত্তরগুলো বললাম সেসব মনে রেখো, তাহলে তুমি অনায়াসে রক্ষা পাবে।”
যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। অসময়ে পড়া তৈরি করার সঙ্গে অন্তরে প্রার্থনা করতে লাগলাম, যাতে করে সেই সাংঘাতিক দিনগুলি পর্যন্ত পড়াগুলো মনে থাকে। নান্টু আমায় অনেক পাঠ্যবিষয়েই সাহায্য করেছিল বটে, কিন্তু সময়ের অভাবে সংস্কৃতের কথাটা একেবারে ভুলে গিয়েছিল। কাতর প্রাণে আমি ভগবানের কাছে এই মারাত্মক ভুলের কথাটাও নিবেদন করে রাখলাম।
যাক্, তার পরদিন ত’ সকালবেলায় রাস্তায় একটু বেড়াতে বেরিয়ে পড়লাম। পায়চারি করতে করতে আমার নবলব্ধ বিদ্যা সব পরিপাক করবার জন্য। গলি পথে চলতে চলতে হঠাৎ নজর পরল, রাস্তার একটা কোণে কতকগুলো আগাছার ওপর খানকতক ছাপা কাগজ পড়ে রয়েছে।
কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে সেগুলো তুলে নিতেই তো দেখা গেল, তাতে সব সংস্কৃত শ্লোক ছাপা রয়েছে। আমার কল্পিত ভ্রান্ত অর্থ শুধরে নেওয়ার জন্য, এক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের কাছে গিয়ে হাজির হলাম।
গম্ভীর উদাওস্বরে সেই প্রাচীন শ্লোকগুলির সুমধুর আবৃত্তি শেষ করার পর তিনি সেগুলিকে সন্দিগ্ধস্বরে বাতিল করার ভঙ্গীতে বললেন, “কিন্তু এই অসাধারণ শ্লোকগুলো তো তোমার সংস্কৃত পরীক্ষায় কোন কাজে আসবে বলে মনে হয় না।”
ঐ বিশেষ শ্লোকগুলোর ব্যাখ্যা বেশ ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা থাকাতে, পরের দিনে সংস্কৃত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে আমার খুবই সহায়ক হয়েছিল। নান্টু্র সাহায্য থেকে অন্যান্য বিষয়েও আমি পাস মার্ক পেয়ে গেলাম। মাধ্যমিক পড়া শেষ করে কথা রেখেছি দেখে বাবা অত্যন্ত খুশি হলেন।
যাইহোক, এই নূতন গৌরব লাভের পর আমি প্রকাশ্যভাবেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে মনস্থির করলাম। আমার একটি তরুণ বন্ধু জিতেন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে কাশীধামের শ্রীভারত ধর্ম-মহামন্ডলের আশ্রমে যোগদান করে সেখানকার আধ্যাত্মিক শিক্ষাগ্রহণ করতে মনস্থ করলাম।
আমার অন্তরের গভীর কৃতজ্ঞতা ঈশ্বরের চরণে নিবেদন করলাম, একমাত্র যাঁর কৃপাবলে বলে আমি নান্টু্র সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, আর পরিত্যক্ত গলিতে জঞ্জালের উপর পড়ে থাকা সেই সংস্কৃত শ্লোকছাপা কাগজের পাতাগুলো কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। লীলাচ্ছ্বলে তিনি ঠিক সময় মতো আমায় দু’দুবার সাহায্য পাঠালেন, বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য!
আবার সেই পরিত্যক্ত বই খুলে দেখলাম, যাতে লেখক পরীক্ষার হলে ভগবৎশক্তির প্রাধান্য অস্বীকারই করে গেছেন। মনে মনে হাসি সংবরণ করতে পারলাম না, এই ভেবে যে, যদি লেখক মহাপ্রভুকে বলি, “শ্মশানে বসে ঈশ্বরের ধ্যানই হচ্ছে স্কুলের পরীক্ষায় পাস করবার সহজ পথ, তা শুনে ত’ বেচারার মাথা একেবারে গোলমাল হয়ে যাবে!”
যাইহোক, এই নূতন গৌরব লাভের পর আমি প্রকাশ্যভাবেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে মনস্থির করলাম। আমার একটি তরুণ বন্ধু জিতেন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে কাশীধামের শ্রীভারত ধর্ম-মহামন্ডলের আশ্রমে যোগদান করে সেখানকার আধ্যাত্মিক শিক্ষাগ্রহণ করতে মনস্থ করলাম।
গেরুয়াবসন পরিহিত সেই সন্ন্যাসীটি সস্নেহে আমায় শুধু একটি মৃদু চপেটাঘাত করলেন। হাতের কাছে জনকতক শিষ্যকে পেয়ে তিনি কপট ভৎসনার সুরে বললেন, “মুকুন্দকে তোমরা কেউ বিরক্ত করো না; ও আমাদের ধরণধারণ শীগগিরই শিখে নেবে।” বিনয়ের আড়ালে আমি আমার সন্দেহ গোপন করলাম। তিরস্কার লাভ করে আদৌ অপ্রতিভ না হয়ে শিষ্যরা সব ঘর ছেড়ে চলে গেল।
পরিবার-পরিজনের সঙ্গে বিচ্ছেদ ভাবনা একদিন মনকে খুব পীড়িত করে তুললো। মায়ের মৃত্যুর পর আমার দুই ছোট ভাই সনন্দ আর বিষ্ণু, এবং ছোট বোন থামুর উপর আমার স্নেহ আরও গাঢ়তর হয়ে উঠেছিল। আমার বহু কঠিন সাধনার স্থল সেই চিলেকোঠার ঘরটিতে গিয়ে দ্রুত আশ্রয় গ্রহণ করলাম।
প্রায় ঘণ্টা দুই অশ্রুবন্যায় প্লাবিত হবার পর আমার মধ্যে একটা অপূর্ব পরিবর্তন এলো – মনে হল যেন কোন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আমার অন্তর ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। সব আকর্ষণ দূরে চলে গিয়ে সকল বন্ধুর শ্রেষ্ঠ বন্ধু, একমাত্র ঈশ্বরকেই অনুসন্ধান করবার প্রচেষ্টা আমার অন্তরে পাথরের মত দৃঢ় হয়ে চেপে বসল।
পিতার আশীর্বাদ গ্রহণ করতে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে তিনি বললেন, “আমার একটি শেষ কথা রেখো, মুকুন্দ! তুমি আমাকে আর তোমার দুঃখি ভাইবোনদের ত্যাগ করে যেয়ো না।”
বললাম, “বাবা! আপনার প্রতি আমার ভক্তির কথা আর আমি কি বলব! কিন্তু যিনি আপনার মত আদর্শ পিতা আমাকে দিয়েছেন, সেই পরম পিতার প্রতি আমার ভক্তি যে তারচেয়েও বেশি। আমাকে যেতে দিন বাবা, যাতে করে কোন একদিন আমি আরও পরিপূর্ণ শুদ্ধজ্ঞান নিয়ে ফিরে আসতে পারি।”
পিতার অনিচ্ছাপ্রদত্ত সম্মতি সংগ্রহ করে আমি জিতেন্দ্রের সঙ্গে যোগদান করতে বেরিয়ে পড়লাম। সে ইতিমধ্যেই কাশীর আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। আমি সেখানে পৌঁছতে আশ্রমের তরুণ অধ্যক্ষ স্বামী দয়ানন্দ আমায় সাদরে গ্রহণ করলেন। দীর্ঘকায়, কৃশ, চিন্তাশীল স্বামীজী মহারাজের প্রতি আমার মনে অনুকূল ধারণারই উদয় হল।
তাঁর সুন্দর মুখের উপর বুদ্ধদেবের ন্যায় একটা ধ্যানস্তিমিত প্রশান্তির ভাব। আমার নতুন আবাসেও একটি ছোট চিলেকোঠা আছে দেখে ভারি খুশি হলাম। সেখানে আমি প্রত্যুষে এবং সকালবেলায় নিরালায় কাটাবার সুযোগ পেলাম। আশ্রমবাসীরা ধ্যানধারণার বিষয় অল্পই জানত বলে ভাবতো যে, সংগঠন কাজেই আমার সব সময় ব্যয় করা উচিত। সেইজন্য তাদের অফিসের কাজেই আমার বিকেলটা ব্যয় করছি দেখে আমায় প্রশংসা করতো।
একদিন সকাল সকাল সেই ছোট্ট ঘরটির দিকে চলেছি, এক সহ-আশ্রমিকের বিদ্রূপপূর্ণ কন্ঠস্বর কানে এসে পৌঁছল, “ওহে! ভগবানকে এত জলদি পাকড়াতে চেষ্টা কোরো না।”
স্বামী দয়ানন্দের কাছে গেলাম, দেখি যে তিনি গঙ্গার ধারে তাঁর ছোট ঘরটিতে অত্যন্ত কর্মব্যস্ত! বললাম, “স্বামীজী! আমি এখানে যে কি কাজে লাগব, তা বুঝতে পারছি না। আমি চাই ঈশ্বরের সাক্ষাৎ অনুভূতিলাভ। তাঁকে ছাড়া, কোন সঙ্গ, ধর্মমত বা সদাচরণ – এসব কিছুতেই আমি সন্তুষ্ট নই!”
গেরুয়াবসন পরিহিত সেই সন্ন্যাসীটি সস্নেহে আমায় শুধু একটি মৃদু চপেটাঘাত করলেন। হাতের কাছে জনকতক শিষ্যকে পেয়ে তিনি কপট ভৎসনার সুরে বললেন, “মুকুন্দকে তোমরা কেউ বিরক্ত করো না; ও আমাদের ধরণধারণ শীগগিরই শিখে নেবে।” বিনয়ের আড়ালে আমি আমার সন্দেহ গোপন করলাম। তিরস্কার লাভ করে আদৌ অপ্রতিভ না হয়ে শিষ্যরা সব ঘর ছেড়ে চলে গেল।
ঈশ্বরের মন হয়ত সে’সময় অন্য কোথাও ছিল! যাইহোক, ঘড়িতে অত্যন্ত মন্থর গতিতেই যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টাগুলো কেটে যেতে লাগল। স্বামীজী যখন আশ্রমে এসে প্রবেশ করলেন, তখন সন্ধ্যা নামছে। অকৃত্রিম আনন্দেই তখন আমি তাঁকে অভ্যর্থনা করলাম। জিতেন্দ্র একটা মূর্তিমান দুগ্ৰহের মত উদয় হয়ে এসে বলল, “এখনো খাবার দেরি আছে হে! দয়ানন্দজী এখন স্নান করবেন, ধ্যানে বসবেন, তারপর ধ্যান থেকে উঠবার পর আমরা সব খেতে বসবো।”
দয়ানন্দজীর আমাকে আরও কিছু বলার বাকি ছিল। স্বামী দয়ানন্দজী বললেন, “মুকুন্দ! দেখছি তোমার বাবা তোমায় বেশ নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছেন। টাকা তাঁকে ফিরিয়ে দিও; এখানে তোমার তা কিছুমাত্র দরকার নেই। আর তোমার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সংযমবিধি আহার বিষয়ে। ক্ষিদে পেলে তুমি তা বলবে না।”
চোখে আমার ক্ষিদের আগুন জ্বলছিল কি না বলতে পারি না, তবে আমার যে দস্তুর মত ক্ষিদে পেয়েছিল তা তখন ভালরকমই টের পাচ্ছিলাম। বেলা বারটা নাগাদ আশ্রমে প্রথম আহার দেওয়া হতো। নিজের বাড়িতে কিন্তু বেলা ন’টার মধ্যেই বেশ বড় রকমের একটি প্রাতঃরাশ খাওয়াই আমার অভ্যাস ছিল। এই তিন ঘণ্টার ফাঁক কিন্তু দিনের পর দিনই আমার অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল।
হায়রে! কলকাতার সেসব দিন কবেই না চলে গেছে, যখন দশ মিনিট দেরী করলেই রাঁধুনী বামুনকে আমি বকেঝকে অনর্থ বাধিয়ে দিতাম।
এখন আর কি করি, উপায় নেই দেখে অগত্যা ক্ষিদে বশ করবার চেষ্টা করতে লাগলাম। একদিন তো চব্বিশ ঘণ্টা উপোষ করেই পরে রইলাম। ফল এই হলো যে, উদরের মধ্যে অগ্নি দ্বিগুণ বেগে প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল আর আমি অধীর আগ্রহে পরদিন মধ্যাহ্নকালীন আহারের প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।
ভগ্নদূত জিতেন্দ্র আমার ঘরে ঢুকে এই নিদারুণ সংবাদটি ঘোষণা করে গেল, “দয়ানন্দজীর ট্রেন দেরীতে চলছে ; তাঁর না এসে পৌঁছন পর্যন্ত আমরা আজ আর খেতে বসতে পাচ্ছি না।”
প্রায় দু’ সপ্তাহ বাইরে থাকার পর দয়ানন্দজী আজ ফিরে আসছেন; কাজেই সেই উপলক্ষ্যে নানাপ্রকার উপাদেয় ভোজ্যসামগ্রী দিয়ে তাঁর পরিপাটিরূপে সেবার ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রবল ক্ষুধার উদ্রেককারী নানাবিধ সুখাদ্যের সৌরভে বাতাস ভরপুর। মনের তখনকার যা অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়! কিছুই এখন না মিললে, কালকের উপবাসের দম্ভ ছাড়া আর এখন কি-ই বা নীরবে পরিপাক করা যায়?
মনে মনে ভগবানকে ডাকতে লাগলাম, “তাড়াতাড়ি ট্রেনটি পৌঁছিয়ে দাও, ঠাকুর!” ভাবলাম, দয়ানন্দজী যে সব বিধিনিষেধ আমার উপর আরোপ করে আমায় চুপ করিয়ে রেখেছিলেন, তার মধ্যে ভগবান তো আর পারেন না।
ঈশ্বরের মন হয়ত সে’সময় অন্য কোথাও ছিল! যাইহোক, ঘড়িতে অত্যন্ত মন্থর গতিতেই যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টাগুলো কেটে যেতে লাগল। স্বামীজী যখন আশ্রমে এসে প্রবেশ করলেন, তখন সন্ধ্যা নামছে। অকৃত্রিম আনন্দেই তখন আমি তাঁকে অভ্যর্থনা করলাম। জিতেন্দ্র একটা মূর্তিমান দুগ্ৰহের মত উদয় হয়ে এসে বলল, “এখনো খাবার দেরি আছে হে! দয়ানন্দজী এখন স্নান করবেন, ধ্যানে বসবেন, তারপর ধ্যান থেকে উঠবার পর আমরা সব খেতে বসবো।”
দয়ানন্দজী অন্যমনস্কভাবে আহার করে চলেছেন। বেশ বোঝা গেল, তিনি আমার স্থূল ভোজনানন্দের ঊর্দ্ধে! পরিপূর্ণ ভোজনসুখের পর স্বামীজীর পড়বার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেখানে তিনি একলাই ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, “স্বামীজী, আপনার কি আজ ক্ষিধে ছিল না?”
তখন ত’ নাড়ী ছেড়ে যাবার উপক্রম! এ ধরনের ক্লেশে অনভ্যস্ত আমার তরুণ উদর, দুর্ভিক্ষপীড়িত লোকেদের কঙ্কালসার মূর্তির ছবি আমার চোখের সামনে দিয়ে যেন ছায়ামূর্তির মত ভেসে যেতে লাগল। ভাবলাম, “কাশীতে অনাহারে আর একটি মৃত্যু এই আশ্রমে এখনই ঘটল বলে।” যাক্, রাত ন’টা নাগাদ আসন্ন ঐ দণ্ড হতে অব্যাহতি পেলাম; আহারের জন্য অমিয় মধুর আহ্বানে।
আহা! কি অমৃতবর্ষী সেই আহ্বান! স্মৃতিপটে সে রাত্রের ভোজটি জীবনের একটি স্মরণীয় মুহূর্তরূপে হয়ে রয়েছে। ভোজে গভীর মনোযোগ দেওয়া সত্ত্বেও আমি লক্ষ্য করে দেখলাম যে, দয়ানন্দজী অন্যমনস্কভাবে আহার করে চলেছেন। বেশ বোঝা গেল, তিনি আমার স্থূল ভোজনানন্দের ঊর্দ্ধে! পরিপূর্ণ ভোজনসুখের পর স্বামীজীর পড়বার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম।
সেখানে তিনি একলাই ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, “স্বামীজী, আপনার কি আজ ক্ষিধে ছিল না?”
বললেন, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই, ছিল বই কি! গত চারদিন ত’ আমার কোন রকম দানাপানি জোটে নি। তাছাড়া তুমি ত’ জানো, ট্রেনে আমি কখনও আহার করি না। সেখানকার হাওয়া সংসারী লোকেদের নানা কামনাবাসনায় দূষিত। আমাদের সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ সব আমি কঠোরভাবে মেনে চলি।” আমাদের আশ্রমের সংগঠন কাজের কতকগুলো জটিল বিষয় মনকে চিন্তিত করে তুলেছে।
কলকাতা থেকে একটিমাত্র সম্পত্তি যা সঙ্গে করে এনেছিলাম, তা হচ্ছে মায়ের দেওয়া সাধুর সেই রূপোর মাদুলিটি। বহু বৎসর সেটিকে সযত্নে রক্ষা করে এসেছি; এখন আশ্রমে এসে সেটিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আমার আশ্রমের ঘরে লুকিয়ে রাখলাম। কবচটির অলৌকিকতার কথা স্মরণ করে সেটিকে দেখে আনন্দলাভের জন্যে একদিন সকালবেলায় চাবি দিয়ে বাক্সটি খুলে ফেললাম।
তাই আজকে আশ্রমের ভোজে আর মন দিতে পারিনি। তাছাড়া তাড়াতাড়িই বা কিসের হে? কালকেই না হয় পরিপাটিরূপে ভোজনে মন দেওয়া যাবে, কি বল?” এই বলে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে হেসে উঠলেন। লজ্জায় শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
কিন্তু কালকের কষ্টের কথা ত’ আর ভোলবার নয়, তাই সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেললাম, “স্বামীজি, আমি ত’ আপনার উপদেশ ঠিক বুঝতে পাচ্ছিনা। ধরুণ, আপনার উপদেশ পালন করতে গিয়ে খাবার যদি না চাই, অথবা কেউ যদি কিছু খেতেই না দেয় – তা হলে তো অনাহারে একেবারে মরেই যাব।”
“মর তাহলে।” এই নিদারুণ বাক্যে বায়ুমণ্ডল বিদীর্ণ করে স্বামীজী বললেন, “মরতে যদি হয় তো মর, মুকুন্দ! একথা কখনও মনে ঠাঁই দিও না যে, তুমি কেবল খাওয়ার জোরেই বেঁচে আছ, ঈশ্বরের শক্তিতে নয়! যিনি সকল রকম পুষ্টির স্রষ্টা, যিনি আমাদের ক্ষুধা দিয়েছেন, তিনি অবশ্যই দেখবেন যাতে তাঁর ভক্তের প্রাণরক্ষা হয়। মনেও কোরো না যে, অন্নই তোমায় বাঁচিয়ে রাখে, বা টাকাকড়ি অথবা লোকজনই তোমায় রক্ষা করে।
ভগবান যদি তোমার প্রাণবায়ুটুকু টেনে নেন, তাহলে কি তারা আর তোমায় রক্ষা করতে পারবে? তারা হচ্ছে তাঁর যন্ত্র মাত্র। তোমার উদরে যে অন্ন পরিপাক হয়, তাতে তোমার নিজের কোন কৃতিত্ব আছে বলে মনে কর নাকি? মুকুন্দ! তুমি তোমার বুদ্ধিবিচারের তরবারি ধর, কর্তৃত্ববুদ্ধির শৃঙ্খল কেটে ফেল, আর সেই পরম কারণকে অনুভব করতে চেষ্টা কর।”
তাঁর এই সূতীক্ষ্ণ মন্তব্য আমার মজ্জার গভীরে গিয়ে প্রবেশ করল। বহুকালের ভ্রান্তি, যাতে করে দেহের দাবী আত্মাকে ছাপিয়ে চলে, তার আজ নিরাসন ঘটল। সেই ক্ষণে, সেই মুহূর্তেই, আমি আত্মার সর্বার্থসিদ্ধি উপলব্ধি করলাম। পরবর্তী জীবনে অবিরাম ভ্রমণকালে কত অপরিচিত শহরে, কাশীর আশ্রমে প্রাপ্ত এই উপদেশের উপযোগীতা প্রমাণ করতে কত উপলক্ষ্য যে এসে উপস্থিত হয়েছিল, তা আর কি বলব!
কলকাতা থেকে একটিমাত্র সম্পত্তি যা সঙ্গে করে এনেছিলাম, তা হচ্ছে মায়ের দেওয়া সাধুর সেই রূপোর মাদুলিটি। বহু বৎসর সেটিকে সযত্নে রক্ষা করে এসেছি; এখন আশ্রমে এসে সেটিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আমার আশ্রমের ঘরে লুকিয়ে রাখলাম। কবচটির অলৌকিকতার কথা স্মরণ করে সেটিকে দেখে আনন্দলাভের জন্যে একদিন সকালবেলায় চাবি দিয়ে বাক্সটি খুলে ফেললাম।
সীলকরা আধারটি কেউই ছোঁয় নি, কিন্তু কি আশ্চর্য! কবচটি তার ভেতর থেকে একেবারে উধাও হয়ে গেছে। অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হৃদয়ে তার খামটা ছিঁড়ে ফেলে দেখলাম, সত্যিই কবচটি আর নেই। সাধুটির ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে যে শূন্য থেকে সেটা এসেছিল, সেই শূন্যেতেই সেটা বিলীন হয়ে গেছে!
দয়ানন্দজীর শিষ্যবর্গের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ক্রমশঃই আরও অপ্রীতিকর হয়ে উঠতে লাগল। কারোর সঙ্গে মিশতাম না বলে সমস্ত আশ্রমিকরা আমায় এড়িয়ে চলত। যে আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমস্ত পার্থিব আশা-আকাঙ্ক্ষা দূরে ফেলে রেখে গৃহত্যাগ করে চলে এসেছি, তার ধ্যানে আমার গভীর নিষ্ঠা কিন্তু চারদিক থেকে লঘু সমালোচনাই সৃষ্টি করেছিল।
মনে তখন ভাবের উত্তাল তরঙ্গ; তাই মুখে সমুচিত কোন জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে দ্রুত ঐদিকে এগিয়ে গেলাম। যেন হাওয়ায় উড়ে সেই সরু গলিটার ভিতর গিয়ে পৌঁছালাম। চাকিতদৃষ্টিতে তাকাতেই সেই সৌম্যমূর্তি নজরে পড়ল। দেখলাম, তখনও তিনি একদৃষ্টে আমারই দিকে তাকিয়ে আছেন। দ্রুত কয়েক পা এগোতেই তাঁর চরণপ্রান্তে এসে পৌঁছালাম।
দারুণ আধ্যাত্ম যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে একদিন সকালবেলায় সেই চিলেকোঠার ঘরটিতে প্রবেশ করলাম; প্রতিজ্ঞা করলাম যতক্ষণ না কোন নিশ্চিত উত্তর পাই, ততক্ষণ প্রার্থনা চালিয়ে যাব। বললাম, “করুণাময়ী মা আমার! হয় তুমি স্বপ্নে আমাকে শিক্ষা দাও, না হয় কোন সদ্ গুরু পাঠিয়ে আমায় দীক্ষা দাও।”
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেতে লাগল, কত কাঁদলাম, তবুও তাঁর কোন সাড়া পেলাম না। হঠাৎ মনে হল যেন আমি অসীম শূন্যে ভেসে চলেছি! চারপাশ হতে দেবদূতী কন্ঠের একটি মধুর বাণী কানে ভেসে আসতে লাগল, “তোমার গুরু আজই আসছেন।”
একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে আসা এক জোর আওয়াজে এই অতীন্দ্রিয় অনুভুতিকে একেবারে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিল। নীচে রান্নাঘর থেকে একটি ছোকরা পূজারী, ডাক নাম তার হাবু সে আমায় ডাকছে, মুকুন্দ! অনেক ধ্যান হয়েছে! তোমায় এক জায়গায় এক্ষুণি যেতে হবে।” অন্যদিন হলে হয়তো একটা কড়া গোছের উত্তরও দিতাম। আজ আর কিন্তু সে সব কিছু না করে, অশ্রুস্ফীত মুখ মুছে ফেলে অত্যন্ত নিরীহভাবে হুকুম তামিল করলাম।
হাবু আর আমি বেরিয়ে পড়লাম। একটু দূরে, কাশীর বাঙ্গালিটোলার ভিতর একটা বাজারের দিকে। বাজারে কেনাকাটা করবার সময় অকরুন সূর্যদেব তখনও মধ্যগগনে আরোহণ করেন নি। আমরা তখন গৃহস্থ স্ত্রীলোক, পান্ডা, পুরোহিত থানপরা বিধবা, গম্ভীর স্বভাব ব্রাহ্মণ, আর সর্বত্র বিচরণশীল ধর্মের ষাঁড়ের বিচিত্র সমাবেশের ভিতর দিয়ে পথ করে এগোতে লাগলাম।
হাবু আর আমি চলতে চলতে একটা অজানা সরু গলির দিকে তাকাতে গিয়ে দেখি – গলির শেষ প্রান্তে, গেরুয়াকাপড় পরা যিশুখ্রিস্টের মত এক মহাপুরুষ সন্ন্যাসী নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দেখামাত্রই মনে হল যেন কত যুগযুগান্তের পরিচয় তাঁর সঙ্গে! ক্ষণেকের জন্য আমার তৃষিত দৃষ্টি তাঁর উপর আবদ্ধ হল, পরক্ষণেই একটা সন্দেহ মনে এসে উপস্থিত হল।
মনকে বোঝালাম, মন! এই পরিব্রাজক সন্ন্যাসীটিকে তোমার পরিচিত কোন লোকের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলছ। ও সব কিছু নয় স্বপ্নবিলাসী, এগিয়ে চল।
মিনিট দশেক পরে পা দু’টো কেমন যেন অসাড় হয়ে এল। মনে হলো যেন তা পাথর হয়ে গেছে। আর এক পাও আমাকে টেনে নিতে অক্ষম। অতি কষ্টে ঘুরে দাঁড়াতেই, আশ্চর্য, তক্ষুণি পা দু’টো আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পেল! বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়াতেই, অদ্ভুতভাবে আবার তা ভারি হয়ে গেল। সাধুটি আমায় কোনো আকর্ষণশক্তির বলে নিজের দিকে টানছেন!
এই ভেবে আমি হাবুর হাতে জিনিসপত্রগুলো সমর্পণ করলাম। হাবু অবাক হয়ে আমার এলোমেলোভাবে পা ফেলা দেখছিল; এখন হো হো করে হেসে উঠল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “তোমার কি হয়েছে বল ত’? মাথা খারাপ হল না কি?”
মনে তখন ভাবের উত্তাল তরঙ্গ; তাই মুখে সমুচিত কোন জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে দ্রুত ঐদিকে এগিয়ে গেলাম। যেন হাওয়ায় উড়ে সেই সরু গলিটার ভিতর গিয়ে পৌঁছালাম। চাকিতদৃষ্টিতে তাকাতেই সেই সৌম্যমূর্তি নজরে পড়ল। দেখলাম, তখনও তিনি একদৃষ্টে আমারই দিকে তাকিয়ে আছেন। দ্রুত কয়েক পা এগোতেই তাঁর চরণপ্রান্তে এসে পৌঁছালাম।
“গুরুদেব!” এই মূর্তি আমার হাজার স্বপ্নের মধ্যে দেখা তাঁর দিব্যমূর্তি ছাড়া ত’ আর কারোর নয়! সিংহসদৃশ উন্নত মস্তকে ঐ দুই শান্ত চোখ, সূঁচালো দাড়ি, আর বাবরি চুল – এই ত’ প্রায়ই আমার নৈশস্বপ্নের অন্ধকার ভেদ করে উঁকি মারত, আর যে ইঙ্গিত করত, পুরোপুরি কোনদিন তাকে বুঝে উঠতে পারতাম না।
আমার গুরুদেব আনন্দকম্পিত স্বরে বাংলায় বার বার বলতে লাগলেন, “বাছা আমার, তুমি অবশেষে এলে। কত বছরধরে যে আমি তোমার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছি।”
পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতার মধ্যে আমরা তখন দু’জনে এক হয়ে গেছি। কথা বলা তখন যেন নিতান্তই বাহুল্যমাত্র। গুরুর অন্তর থেকে শিষ্যের অন্তরে নীরব ভাষায় বাক্যের স্রোত যেন অবিরামভাবে বয়ে যেতে লাগল। অভ্রান্ত অন্তর্দৃষ্টির অ্যানটেনার সাহায্যে জানতে পারলাম যে, আমার গুরু ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন আর আমাকেও তাঁর সন্নিধানে নিয়ে যেতে সক্ষম।
এ জীবনের অন্ধতমিস্রা, পূর্বজন্মের স্মৃতির অচিরস্থায়ী ঊষার আলোকে অন্তর্হিত হল। একটা নাটকীয় মুহূর্ত। অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ যেন তার চক্রবৎ দৃশ্যাবলী। ঐ চরণযুগলে যেন আমার এই প্রথম প্রণতি নয়। আমার হাত ধরে তিনি কাশীর রাণামহলে তাঁর বাসা বাড়িতে আমায় নিয়ে চললেন। তাঁর দেহ বলিষ্ঠ সুগঠিত – দৃঢ় পদক্ষেপে তিনি অগ্রসর হলেন।
তাঁর এই কথাতে আমার মনে কিন্তু ভয় এল! আমার পরিবারবর্গ কলকাতায় ফিরে আসবার জন্যে আমায় অনবরত তাগিদ দিচ্ছিলেন; চিঠিতে তাঁদের বহুবিধ উপরোধ অনুরোধের আমি এ পর্যন্ত কোনোরকম উত্তরই দিই নি। অনন্তদা টিপ্পনী কেটে বলেছিলেন, “নবীন পাখী আধ্যাত্মিক আকাশে এখন বিচরণ করুক। সেখানকার ভারি হাওয়ায় তার ডানা শীগগিরই শ্রান্ত হয়ে পরবে।
সেইসময় তাঁর বয়স প্রায় পঞ্চান্ন বছর। তাঁর দীর্ঘ ঋজু দেহ, যুবকের ন্যায় সতেজ ও কর্মঠ। বড় বড় কালো সুন্দর দু’টি চোখ যেন অসীম জ্ঞানের জ্যোতিঃতে সমুজ্জ্বল। ঈষৎ কুঞ্চিত কেশ, তাঁর দৃঢ়তাব্যঞ্জক মুখে কোমলতা এনে দিয়েছিল। শক্তির সঙ্গে সে যেন স্নিগ্ধ পেলবতার এক মৃদু সংমিশ্রণ!
বাড়িটি গঙ্গার ধারে। দোতলায় পাথরের বারান্দায় গিয়ে বসতে, সস্নেহে তিনি আমায় বললেন, “দেখ, আমার আশ্রম আর অন্য যা কিছু আছে – সবই তোমায় দিয়ে দেব, বুঝলে?” বললাম, “প্রভু! আমি এসেছি জ্ঞানলাভ আর ঈশ্বরোপলব্ধির আশায়; আপনার ঐসব ঐশ্বর্যগুলির ওপরেই আমার লোভ – অন্য কিছুতে নয়!”
দ্রুত ক্ষীয়মাণ গোধূলির আলো ক্রমশঃই স্তিমিত হয়ে আসতে লাগল। গুরুদেবের নয়নে অতল গভীর কোমলতা। স্নেহমধুর কন্ঠে তিনি আমায় বললেন, “তোমাকে আমি আমার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিলাম।”
অমিয় মধুর অমূল্য সে’ বাণী! পঁচিশ বছর পরে আবার তাঁর এইরকম স্নেহের আর এক একটি বাচনিক প্রমাণ পেয়েছিলাম। তাঁর ওষ্ঠে কদাচিৎ আকুলতা প্রকাশ পায়; নীরবতাই তাঁর সমুদ্রসম হৃদয়ের উপযুক্ত। শিশুর ন্যায় সরল বিশ্বাসে তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমিও কি আমায় ঐ রকমই ভালোবাসা দিতে পারবে?” বললাম, “গুরুদেব! আমি চিরকালই আপনাকে ভক্তি করব।”
নম্রমধুর স্বরে তিনি বললেন, “সাধারণ ভালোবাসা স্বার্থময়, কামনা-বাসনা পরিতৃপ্তির গাঢ় অন্ধকারের ভিতরই এর মূল দৃঢ় হয়ে থাকে। স্বর্গীয় ভালোবাসা প্রতিদান চায় না; তা সীমাহীন, তার কোন পরিবর্তন নেই।
অনাবিল প্রেমের পরশমণির ছোঁয়ায় মানব মনের অবিলতা চিরতরে দূর হয়ে যায়। আর দেখ, কখনও যদি তুমি আমায় ভগবদ্ বিচ্যুত হতে দেখ, তাহলে প্রতিজ্ঞা করে যে, আমার মাথা তোমার কোলে নিয়ে আমাদের উভয়ের প্রেমের ঠাকুরের কাছে আমাকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করবে।”
তারপর সেই ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে তিনি উঠে পরলেন এবং আমায় ভিতরের একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে গেলেন। বাদামের তক্তি, আম ইত্যাদি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কথাবার্তার ভিতর দিয়ে আমার অজ্ঞাতসারেই তিনি আমার প্রকৃতির অন্তরঙ্গভাব প্রকাশ করে দিলেন।
অন্তরের বিনয়নম্র ভাবের সঙ্গে তাঁর জ্ঞানের বিরাট ঐশ্বর্য দেখে আমি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বললেন, “কবচের জন্য দুঃখ কোরো না। তার কাজ ফুরিয়ে গেছে, তাই সে চলে গেছে।” আমার সারা জীবনের প্রতিচ্ছায়া আমার গুরুদেব যেন তাঁর মনের দিব্য আয়নায় প্রতিবিম্বিত হতে দেখলেন।
“আপনার সাক্ষাৎ দর্শন, গুরুদেব, দেবদর্শনের আনন্দের চেয়েও বেশি।”
“আশ্রমে তুমি এখন খুবই অস্বস্তিতে আছ দেখছি, কাজেই এখন তোমার তা বদলান দরকার।” আমার জীবনের কোন বিষয়ের কোন উল্লেখই আমি করি নি। তা এখন নিতান্তই বাহুল্য বলে বোধ হল। তাঁর নিতান্ত সহজ সরল আর অত্যন্ত সাধারণভাবে কথা বলার ধরণে বুঝলাম-আলোকদৃষ্টির ক্ষমতা দেখিয়ে কাউকে তিনি চমক লাগিয়ে দিতে চান না।
তারপর তিনি বললেন, “তোমার কলকাতায় ফিরে যাওয়া উচিত। তোমার আত্মীয়স্বজনদেরই বা তোমার বিশ্বপ্রেম হতে বঞ্চিত করবে কেন, বল ?”
তাঁর এই কথাতে আমার মনে কিন্তু ভয় এল! আমার পরিবারবর্গ কলকাতায় ফিরে আসবার জন্যে আমায় অনবরত তাগিদ দিচ্ছিলেন; চিঠিতে তাঁদের বহুবিধ উপরোধ অনুরোধের আমি এ পর্যন্ত কোনোরকম উত্তরই দিই নি। অনন্তদা টিপ্পনী কেটে বলেছিলেন, “নবীন পাখী আধ্যাত্মিক আকাশে এখন বিচরণ করুক। সেখানকার ভারি হাওয়ায় তার ডানা শীগগিরই শ্রান্ত হয়ে পরবে।
তার পরদিন সকালেই লক্ষ্য করলাম যে, আশ্রমবাসীদের ব্যবহারে একটা বিরুদ্ধভাব বেশ বেড়ে উঠেছে। নিয়ত রুক্ষ ব্যবহারে তারা আমার দিনগুলিকে ক্রমশঃ অসহনীয় করে তুলতে লাগল। এইভাবে তিন সপ্তাহ কেটে গেল, দয়ানন্দজী বোম্বাইয়ে একটা কনফারেন্সে যোগদান করতে চলে গেলেন। আমার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।
আর আমরা এও দেখব যে সে নীড়ের দিকে দ্রুত ফিরে আসবে আর পাখাটি গুটিয়ে আবার সে সংসারের দাঁড়ে ঠিক এসে বসবে!” এইরকম দারুণভাবে মন দমিয়ে দেওয়া উপমা – আমার মনে বরাবরই জাগ্রত ছিল; তাই কলকাতার দিকে আর “ঝাঁপিয়ে” পরব না বলে মনে মনে স্থির করেছিলাম। বললাম, “প্রভু বাড়ির দিকে আমি আর ফিরছি না। কিন্তু আপনি যেখানে বলবেন, সেখানেই যাব। এখন আপনার নাম ঠিকানাটা একটু দয়া করে আমায় দিন।”
“স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি। প্রধান আশ্রম, রানাঘাট লেন, শ্রীরামপুর। এখানে দিনকতকের জন্যে মাকে দেখতে এসেছি।” ভক্তের সঙ্গে ভগবানের গূঢ়লীলার পরিচয় পেয়ে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
কলকাতা হতে শ্রীরামপুর মাত্র বার মাইল দূরে, অথচ ঐ অঞ্চলে আমি আমার গুরুর দেখা মুহূর্তের জন্যও পাই নি। আমাদের মিলনের জন্য আমাকে লাহিড়ী মহাশয়ের পুণ্যস্মৃতিবিজড়িত প্রাচীন কাশীধাম পর্যন্ত দৌড়াতে হ’ল। অবশ্য এখানকার মাটিও বুদ্ধ, শঙ্করাচার্য অন্যান্য যোগী মহাপুরুষদের পদরজঃপূত।
“তোমায় ঠিক চার সপ্তাহের মধ্যে আমার কাছে আসতেই হবে।” এই প্রথম শ্রীযুক্তেশ্বর গিরিজীর কন্ঠস্বর কাঠিন্য প্রকাশ পেল। বললেন, “আমার চিরন্তন স্নেহ আর তোমায় খুঁজে পেয়ে আমার কত যে আনন্দ হয়েছে তা মুখ ফুটে বললাম। এখন তুমি আমার অনুরোধ ইচ্ছা হলে উপেক্ষা করতে পারো। এরপর তোমার সঙ্গে দেখা হলে তোমার উপর আমার আগ্রহ আবার জাগিয়ে তুলতে হবে।
সহজে কিন্তু তোমায় আমি শিষ্য বলে গ্রহণ করছি না। আমার কঠোর শিক্ষার কাছে সম্পূর্ণ বাধ্যতা স্বীকার করে, তোমায় পরিপূর্ণভাবে আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে।” তবুও আমি নিজের গোঁ ধরে চুপ করে বসেই রইলাম। গুরুদেব অবশ্য সহজেই আমার মুশকিল বুঝতে পেরে বললেন, “তোমার মনে বুঝি ভয় হচ্ছে, তোমার আত্মীয়স্বজনেরা তোমায় ঠাট্টা করবেন?
“আমি বাড়ি যাব না।”
“ঠিক তিরিশ দিনের মধ্যে তোমায় ফিরতেই হবে।”
“কখনই না” এই বলে ভক্তিভরে তাঁর চরণে প্রণাম করে মতপার্থক্যের চাপ না কাটতেই প্রস্থান করলাম। মাঝরাতে নিষ্প্রভ অন্ধকারে আশ্রমের দিকে চলতে চলতে ভেবে আশ্চর্য হলাম – আমাদের অলৌকিক সাক্ষাতের কেন এ রকম বিসদৃশ পরিণতি ঘটল। মায়ার তুলাদন্ডে সুখের সঙ্গে সমান ভাবে আসে দুঃখ। আমার কিশোর হৃদয়, তখনও বোধহয় আমার গুরুদেবের হাতে গড়ে তুলবার মত উপযুক্ত নমনীয় হয়ে ওঠেনি!
তার পরদিন সকালেই লক্ষ্য করলাম যে, আশ্রমবাসীদের ব্যবহারে একটা বিরুদ্ধভাব বেশ বেড়ে উঠেছে। নিয়ত রুক্ষ ব্যবহারে তারা আমার দিনগুলিকে ক্রমশঃ অসহনীয় করে তুলতে লাগল। এইভাবে তিন সপ্তাহ কেটে গেল, দয়ানন্দজী বোম্বাইয়ে একটা কনফারেন্সে যোগদান করতে চলে গেলেন। আমার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।
একদিন কানে এসে পৌঁছাল, “মুকুন্দ একটি গলগ্রহ; দিব্যি আরামে আশ্রমে আছে, প্রতিদানে কিছুই দেবার নামটি পর্যন্ত নেই।” ঐ শুনে আমি সেই প্রথম অনুতাপ করতে লাগলাম এই কথা ভেবে যে – কেন আমি পিতার কাছে টাকা ফেরৎ দেবার অনুরোধ রাখতে গিয়েছিলাম।
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আশ্রমে আমার একমাত্র বন্ধু জিতেন্দ্রকে খুঁজে বার করে বললাম, “জিতেন্দ্র! আমি চললাম। দয়ানন্দজী ফিরলে তাঁকে আমার ভক্তি প্রণাম জানিয়ে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিও।”
আমিও চলে যাব মুকুন্দ! আমারও এখানে ধ্যানধারণার চেষ্টার সুযোগ তোমার চেয়ে যে বেশি কিছু মেলে, তা নয়।” জিতেন্দ্রের স্বর দৃঢ়তাব্যঞ্জক।
আমি বললাম, “জিতেন্দ্র! আমি এক ঈশ্বরকোটিক সাধুর সাক্ষাৎ পেয়েছি। চল, শ্রীরামপুরে তাঁকে দর্শন করে আসি।”
তারপর – তারপর আর কি, সেই পাখিটি এবার বিপজ্জনক ভাবে কলকাতার সান্নিধ্যে ঝাঁপিয়ে পরতে প্রস্তুত হল।
সূত্র:
যোগী-কথামৃত (Autobiography of a Yogi)
**শ্রী শ্রী পরমহংস যোগানন্দ বিরচিত পূজনীয় ও পরমারাধ্য আমার গুরুদেব শ্রী শ্রী স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বর গিরি মহারাজের শ্রীকরকমলে অর্পিত।
**মৎপ্রণীত ইংরাজী ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ্ এ যোগী’র বঙ্গানুবাদে শ্রীমান ইন্দ্রনাথ শেঠের স্বেচ্ছা প্রণোদিত প্রয়াস ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ ও আশির্বাদ জানাই। -শ্রী শ্রীপরমহংস যোগানন্দ
………………………..
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………………
আরও পড়ুন-
যোগীবর শ্যমাচরণ লাহিড়ী মহাশয়
মহাযোগী শ্রীশ্রী তৈলঙ্গস্বামী
ত্রৈলঙ্গ স্বামীর কিছু কথা
গাঁধীজিকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি
তারা মায়ের আদরের দুলাল ‘বামাক্ষেপা’
মহর্ষি মহেশ যোগীর কথা
স্বামী শ্রীযুক্তেশ্বরের দর্শনলাভ : যোগী-কথামৃত থেকে
‘বাবাজী’ আধুনিক ভারতের মহাযোগী
বিনিদ্র সাধু
রামদাস বাবাজী
সীতারাম
তারাপীঠের ‘বামদেব’
বহুবর্ষজীবি শ্রীশ্রী বরফানী দাদাজি
মহাবতার বাবাজীর দর্শন লাভ: এক
মহাবতার বাবাজীর দর্শন লাভ: দুই
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: এক
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: দুই
যোগীবর শ্রীশ্রী অমল বিকাশ চৌধুরী: তিন