ভবঘুরেকথা
কর্মফল জন্মান্তর চুরাশির ফেরে

-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ

‘কর্মফল: এক’

কর্মফল হলো সেটাই যা ভবিষ্যতে বা আজ ঘটবে তা ঘটার ভিত আমরা বহুজন্ম পূর্বেই রচনা করে এসেছি। বা এভাবেও বলা যায়- আমরা আজ যা করছি তাতেই অনাগত জন্মের বা আগামীর কাহিনী আমরা নিজেরাই লিপিবদ্ধ করছি। কর্মবাদের হিসেবে জন্ম-জন্মান্তরের যে সিঁড়ি বেয়ে আমরা উপরে উঠছি তার প্রতিটি ইট আমরাই রচনা করেছি আমাদের কৃতকর্মের ভিত্তিতে।

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে সেটা পথ না হয়ে সিঁড়িই বা হলো কেনো কেনই বা আমরা উঠছি? আমরা চলছি বললেই তো যৌক্তিক হতো। কিন্তু কর্মবাদীরা বলেন মানুষ যখন তার কৃর্তকর্মকে দেখতে শুরু করে-হিসেব করতে শুরু করে তখন থেকেই সে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হলেও তা সংশোধনের চেষ্টা শুরু করে। আর এই সংশোধনের যাত্রা ঊর্দ্ধগামী।

আদৌতে কর্মফল এমন একটা বিষয় যাকে সকলেই গ্রহণ করেছে। তার সে ধর্ম হোক বা বিজ্ঞান। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সকলেই অনুধাবন করে, ‘ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়’ অর্থাৎ ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’। তবে বিজ্ঞান, দর্শন আর ধর্মে এর ব্যাখ্যা বা প্রয়োগ ভিন্ন। তবে কর্মের ফল যে পেতেই হবে সেটা সরাসরি অস্বীকার তেমন একটা করে নি কেহ ই।

আধুনিক সময়ে নিউটন তার তৃতীয় সূত্রে বলেছেন, ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে’। আর ধর্ম প্রাচীনকাল থেকেই বলে আসছে, প্রত্যেক কর্মেরই ফল আছে এবং প্রত্যেককেই তার কৃতকর্মের ফল বহন করতে হবে।

আর প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্রে যথাক্রমে বলেছেন, ‘বল প্রয়োগ না করলে স্থির বস্তু স্থির থাকবে এবং সমবেগে চলতে থাকবে।’ আর ‘বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার তার উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং যেদিকে বল প্রয়োগ করা হয় ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিকে হয়।’ এই সূত্রদ্বয়ও একই কথার ভিত্তি মজবুত করে।

একবার গৌতম বুদ্ধের কাছে দীক্ষাগ্রহণে ইচ্ছুক এক যুবক এসে বললো, “আপনাকে দেখে… আপনার পথ চলা দেখে… আপনার প্রসাদপূর্ব কান্তি দেখে… এই অপূর্ব-অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে আমার মনে গভীর আকাঙ্খা জেগেছে সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করার। যদিও ইতিপূর্বে আমি কখনো সন্ন্যাসী হওয়ার কথা কল্পনাও করিনি। ধর্ম বিষয়েও আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। পণ্ডিত-পুরোহিত থেকেও আমি দূরত্ব বজায়ই রাখতাম সকল সময়।

জোড় করেও তাদের কাছে কেউ নিয়ে যেতে চাইলে আমি কখনো রাজি হইনি। তাদের কথা শুনে আমার মাথা ধরে যায়। কিন্তু আপনাকে দেখে আমার ভেতরে কেমন জানি একটা উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। মনে হচ্ছে আমিও দীক্ষা নিয়ে নেই। কিন্তু একটা বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। হঠাৎ আমার এমন হলো কেনো?

সন্ন্যাসী হওয়ার মতো তো কোন কারণ আমি আমার মধ্যে খুঁজে পাচ্ছি না। আচমকা এতো বড় সিদ্ধান্ত আমি কি করে নিয়ে নিলাম সেটাও আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।

তার কথা শুনে বুদ্ধ চোখ বন্ধ করলেন। কিছু সময় চুপ থেকে বলতে শুরু করলেন, “হে যুবক! তোমার জানা নেই তুমি আগের জন্মে ছিলে হাতি। বনে আগুন লেগেছিল। তুমি সকলের মতোই পালাচ্ছিলে। বনের সকল পশুপাখিও পালাচ্ছিল।

দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ক্লান্ত হয়ে তুমি একটা গাছের নিচে বিশ্রাম নেয়ার জন্য জন্য দাঁড়ালে। তোমার পা অসাড় হয়ে আসছিল। খেয়াল হলো এক পায়ের নিচে কাঁটা বিঁধেছে। তুমি সেই পা উপরে তুললে। ঠিক যে সময় তুমি যে জায়গা থেকে পা উপরে তুলেছিল একটা ছোট্ট খরগোস সেই জায়গায় আশ্রয় নিল।

তখন এমন একটা সময় যে পুরো বনে আগুন লেগে গেছে। সকলে পালাচ্ছে। সকলেই ক্লান্ত। তুমি ভাবলে আমি এতো বড় হাতি হয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি আর এই ছোট্ট খরগোসটি না জানি কত ক্লান্ত। সে নিশ্চিন্তে আমার পায়ের নিচে আশ্রয় নিয়েছে।

এই মুহূর্তে বনের সকলেই বিপদে আছে। আমি যদি এখন পা মাটিতে রাখি তাহলে খরগোসটি নিশ্চিত মারা যাবে। যদিও তুমিও বাঁচার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছো সকলের মতোই। তরপরও তোমার মনে খেয়াল আসলো, আমি যেমন বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি, তেমনি এই খরগোসটিও করছে।

এ কথা মনে আসতেই তোমার ভেতর একটা বোধ কাজ করলো। তুমি পা যেভাবে তুলে রেখেছিলে সেভাবেই তুলে দাঁড়িয়ে থাকলে। আর খসগোসটি মাটিতে সেখানে নিশ্চিতে বসে রইলো। যখন খরগোস সেখানে থেকে চলে গেলো তখন তুমি পা মাটিতে রাখতে চাইলে। কিন্তু ততক্ষণে পা আকড়ে গেছে। তুমি আর তা নিচে রাখতে না পেরে গড়িয়ে পরে গেলে।

গীতায় আছে- ‘কর্মের গতি বড় জটিল।’ এ কথা খুব সত্য। দেখ না, যে কর্মটা কখন তুমি ভাল বলে মনে করছ, সেটায় হয়তো কালে কুফল হবে। সেজন্য খুব বিচার করে কাজ করতে হয়। বিচার করে করলে যে ভুল হয় না এমন নয়- ভুল হয়, তবে কম ভুল হয়। যারা বিচার করে কাজ করে না, তাদের বেশি ভুল হয় আর সেজন্য দুঃখও বেশি ভোগে।

খরগোস তো বেঁচে গেলো কিন্তু বনের আগুনে পুড়ে তোমার মৃত্যু হলো। কিন্তু মৃত্যুর সময় তুমি বড়ই তৃপ্ত ছিলে। শান্তি ছিল। অপূর্ব উল্লাস ছিল। আনন্দের ভাব ছিল এই ভেবে যে, আমি মরে গেছি সেটা বিষয় না কিন্তু খরগোসটা তো বেঁচে গেছে সেটাই বড় কথা।

আর তার ফলেই তুমি এ জন্মে মানুষরূপে জন্মেছ। তুমি যে করুণা প্রদর্শন করেছিলে তার জন্যই তুমি মানুষ রূপে জন্মানোর সম্মান পেয়েছ। সেই করুণার জন্যই তোমার ভেতরে প্রজ্ঞার বীজ বপন হয়ে গেছে। যার জীবনে করুণা আছে, সেই প্রজ্ঞা লাভ করতে পারে। যার জীবনে প্রজ্ঞা আসে তার জীবনে করুণা আসে। আসলে এই দুটি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

আর সেই করুণার বলেই আজ আমাকে রাস্তায় দেখে তোমার মনে এই ভাবের উদয় হয়েছে। তুমি যে ভাবছো এটা অকারণ হয়েছে। আদৌতে তা নয়। এর পেছনে সিলসিলা আছে-শৃঙ্খলা আছে। মানুষ মানুষরূপে যে জন্মায় এর পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে। এটা অকারণ হয় না। জন্মজন্মান্তরের এই গমনাগমনে তুমি কিছু না কিছু কর্ম করেছ তার ফলই এই মানবজীবন প্রাপ্তি। এই মানব জীবন তাই অতীব মূল্যবান।

কিন্তু মনে রাখতে হবে এটা তোমাকে দেয়া একটা উপহার মাত্র। এই মানব জনম তোমার কর্মের ফল স্বরূপ তোমাকে দেয়া উপহার মাত্র। এর মালিক তুমি নও। তুমি কেবল ধারক মাত্র। আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে। গত কালের বা গত জন্মের প্রাপ্তিতে তা যা লাভ করেছ। আজকের কর্মদোষে তা হারিয়েও ফেলতে পারো।

হাতি করুণার জন্য যেমন মানুষ রূপে জন্মাতে পারে। ঠিক তেমনি মানুষও তার কঠোরতা-হিংসা-হিংস্রতার কারণে পরের জন্মে হাতি হতে পারে।”

এ প্রসঙ্গে সাধক লাটু মহারাজ বলেছেন, “কর্মফল ভুগতেই হবে, তা তুমি জান আর নাই জান। যেমন আগুনে হাত দিলে পুড়বেই পুড়বে। তা তুমি জেনেই দাও আর না জেনেই দাও, ঠিক তেমনি। যে বুদ্ধিমান, সে এ তত্ত্ব জেনে এমন কর্ম করে না যাতে শেষে দুঃখ পেতে হবে।

গীতায় আছে- ‘কর্মের গতি বড় জটিল।’ এ কথা খুব সত্য। দেখ না, যে কর্মটা কখন তুমি ভাল বলে মনে করছ, সেটায় হয়তো কালে কুফল হবে। সেজন্য খুব বিচার করে কাজ করতে হয়। বিচার করে করলে যে ভুল হয় না এমন নয়- ভুল হয়, তবে কম ভুল হয়। যারা বিচার করে কাজ করে না, তাদের বেশি ভুল হয় আর সেজন্য দুঃখও বেশি ভোগে।

শ্রমণরা ছিলেন অবৈদিক। তারা নিজ নিজ বিশ্বাস ও বিচারধারা অনুযায়ী আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ অর্জনের লক্ষ্যে সন্ন্যাস জীবনে তপস্যার মাধ্যমে মোক্ষ সাধনে রত থাকতেন। তাদের মধ্যে আস্তিক-নাস্তিক উভয় ধারাই ছিল। তখনো স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসের ভিত্তিতে আস্তিক্য ও নাস্তিক্য নির্ধারণ হতো না। হতো পরলোকে কর্মফল আছে বা নেই এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে।

পতিত, পাপী কেউ নেই, কর্মই হচ্ছে দোষী। মন্দ কর্ম ত্যাগ করে ভাল কর্ম করলেই মানুষ সৎ হয়ে যায়। রত্নাকর দস্যু ছিল, সে-ভাব ত্যাগ করে সাধন করলে- ঋষি হয়ে গেল। তাই মানুষকে ঘৃণা করা অন্যায়, তার কর্মকে ঘৃণা করতে পার।”

শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, “তা সংসারে আছ, থাকলেই বা, কিন্তু কর্মফল সমস্ত ঈশ্বরকে সমর্পণ করতে হবে। নিজে কোন ফল কামনা করতে নাই। তবে একটি কথা আছে। ভক্তি-কামনা, কামনার মধ্যে নয়। ভক্তি-কামনা, ভক্তি-প্রার্থনা করতে পার। ভক্তির তমঃ আনবে। মা-র কাছে জোর কর।

ত্রৈলোক্য বলেছিল, আমি যেকালে ওদের ঘরে জন্মেছি, তখন আমার হিস্যা আছে। তোমার যে আপনার মা গো! এ কি পাতানো মা, এ কি ধর্ম মা। এতে জোর চলবে না তো কিসে জোর চলবে? আপনার মা! জোর কর! যার যাতে সত্তা থাকে, তার তাতে টানও থাকে। মা-র সত্তা আমার ভিতর আছে বলে, তাই তো মা-র দিকে অত টান হয়।যে ঠিক শৈব সে শিবের সত্তা পায়। কিছু কণা তার ভেতর এসে পড়ে। যে ঠিক বৈষ্ণব তার নারায়ণের সত্তা ভেতরে আসে।”

মা সারদা দেবী বলেছেন, “ভারী সাবধানে চলতে হয়। প্রত্যেক কর্মের ফল ফলে। কাউকে কষ্ট দেওয়া, কটু কথা বলা ভাল নয়।”

জন্মান্তরবাদ বিশ্বাসের আরেকটি দিক হচ্ছে, এই বিশ্বাস অনুযায়ী প্রতিটি জীবন একই সাথে একটি পরকাল এবং পূর্বকাল। এই বিশ্বাস মতে, বর্তমান জীবন হল পূর্বজন্ম বা কর্মের ফল। কর্মবাদ ভারতীয় দর্শনের একটি নৈতিক ধারণা। কর্মবাদ অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষকে তার কৃতকর্মের ফলভোগ করতে হবে। কর্মফলের মধ্য দিয়ে শুভ, অশুভ, পাপ ও পুণ্য সংরক্ষিত থাকে।

বুদ্ধের জন্মের সময় ভারতবর্ষে বহু মতবাদের প্রচলন ছিল। পরলোক, মৃত্যুর পরবর্তী অস্তিত্ব, কর্মবিপাক বা কর্মফল ইত্যাদি বিষয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও বৈদিক মতেরই প্রাধান্য তখন। ফলে ব্রাহ্মণ ও শ্রমণ এই প্রাচীন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধও ছিল তুঙ্গে।

শ্রমণরা ছিলেন অবৈদিক। তারা নিজ নিজ বিশ্বাস ও বিচারধারা অনুযায়ী আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ অর্জনের লক্ষ্যে সন্ন্যাস জীবনে তপস্যার মাধ্যমে মোক্ষ সাধনে রত থাকতেন। তাদের মধ্যে আস্তিক-নাস্তিক উভয় ধারাই ছিল। তখনো স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসের ভিত্তিতে আস্তিক্য ও নাস্তিক্য নির্ধারণ হতো না। হতো পরলোকে কর্মফল আছে বা নেই এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে।

অনেকে আবার অনারদ্ধ ও আরদ্ধ এই দুই ভাবে কর্মকে ভাগ করেছে। যে কর্মের ফলভোগ শুরু হয়নি তাকে অনারদ্ধ আর যে কর্মের ফলভোগ শুরু হয়েছে তাকে আরদ্ধ কর্ম বলে। অনারদ্ধ কর্মকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে: সঞ্চিত কর্ম ও সঞ্চীয়মান কর্ম। সঞ্চিত কর্ম হচ্ছে অতীত জীবনের কর্ম এবং সঞ্চীয়মান কর্ম হচ্ছে বর্তমান জীবনের কর্ম।

পাণিনির নির্বচন অনুসারেও পরলোকে কর্মফলে বিশ্বাসীরা আস্তিক আর অবিশ্বাসীরা নাস্তিক। সে কারণে আস্তিক শ্রমণরাও স্রষ্টার অস্তিত্ব ও বেদের প্রামাণ্যও স্বীকার করতো না। তারা সংসারী না হয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করতো।

অন্যদিকে ব্রাহ্মণরা বৈদিক ধর্ম অনুসারে দুষ্কৃত ও সুকৃত কর্মফলে বিশ্বাসী ছিল এবং বেদে উল্লেখিত অনুষ্ঠানকে বিধিসম্মত বলে প্রাধান্য দিতো। উপনিষদ যুগের (৭০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্ব) শেষভাগে যজ্ঞে পশুবধের বিরুদ্ধে আর্য জনমত গড়ে ওঠে।

বেদান্তীদের কাছে তখন বেদের কর্মকাণ্ডের বদলে জ্ঞানান্বেষণই প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করে। এ মতানুসারে যাগযজ্ঞাদি কর্ম হীন আর ব্রহ্মজ্ঞান শ্রেষ্ঠ এবং মৃত্যুর পর জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হয়, যাগাদি কর্ম হতে জন্ম ও মৃত্যুচক্রের নিরোধ হয় না। এ ধর্মমতকেই বলা হয় ব্রাহ্মণ্য।

পরবর্তী দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (৩৮০-৪১৮ খ্রি) সময় বৈদিকধর্মের পুনরুত্থান হলে তখন থেকে আস্তিক-নাস্তিক শব্দ দুটির ভিন্ন অর্থ দাঁড়ায়। বেদকে স্বীকার ও অস্বীকারের ভিত্তিতে আস্তিক ও নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এই বিভাজন শর্তে ‘বেদের সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত’ এই মতের বিরোধী হিসেবে জৈন ও বৌদ্ধ দর্শনকে নাস্তিক দর্শনের স্বীকৃতি পায়। তবে যেকোন বিচারে চার্বাক মতাদর্শীদের শুধু নাস্তিকই নয়, নির্দ্বিধায় জড়বাদী হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়। বৌদ্ধ দর্শন ভাববাদকে স্বীকার করলেও চার্বাকরা ছিলেন এর প্রচণ্ড বিরোধী।

বুদ্ধের সুত্তপিটকের দীঘনিকায়ের পুনর্জন্মের কথা জানা যায়। জাতক গ্রন্থে বুদ্ধের পুনর্জন্মের কথারূপে প্রায় ৫৫০টি গাথা বর্ণিত হয়েছে।

ভগবদ গীতা অনুসারে, অর্জুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তার আত্মীয় স্বজনকে হত্যা করতে দ্বিধা বোধ করছিলেন। তখন কৃষ্ণরূপে ঈশ্বর অর্জুনকে বলেন, “তুমি কি বিশ্বাস করো যে তুমি এই কাজের কর্তা? না। তুমি আমার হাতের নিছক একটি যন্ত্র।

তুমি কি মনে করো যে তোমার সামনের এই মানুষগুলো জীবিত? এরা ইতিমধ্যেই মৃৎ। ক্ষত্রিয় হিসেবে তোমার জনরা এবং ভূমিকে রক্ষা করা তোমার দায়িত্ব। যদি তুই তোমার এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নাও, তাহলে তুমি ধর্মের নীতিকে অনুসরণ করবে না।”

কর্ম হচ্ছে কারণ আর সুখ-দুঃখ ভোগ হচ্ছে কর্মফল। অনেকে ভারতীয় দর্শনে কর্মকে সকাম ও নিষ্কাম কর্ম-এই দুইভাগে ভাগ করেছে। সকাম কর্মই কর্মবাদের অধীন, নিষ্কাম কর্ম কর্মবাদের অধীন নয়। রাগ, দ্বেষ ও মোহবশত ও ফলের আকাঙ্ক্ষায় সম্পাদিত কর্মই সকাম কর্ম। সকাম কর্মের ফলে জীবকে বারবার ধরাধামে ফিরে এসে কর্মফল ভোগ করতে হয়। কর্মবাদের ওপর ভিত্তি করেই ভারতীয় দর্শনে জন্মান্তরবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

অনেকে আবার অনারদ্ধ ও আরদ্ধ এই দুই ভাবে কর্মকে ভাগ করেছে। যে কর্মের ফলভোগ শুরু হয়নি তাকে অনারদ্ধ আর যে কর্মের ফলভোগ শুরু হয়েছে তাকে আরদ্ধ কর্ম বলে। অনারদ্ধ কর্মকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে: সঞ্চিত কর্ম ও সঞ্চীয়মান কর্ম। সঞ্চিত কর্ম হচ্ছে অতীত জীবনের কর্ম এবং সঞ্চীয়মান কর্ম হচ্ছে বর্তমান জীবনের কর্ম।

জৈন, ন্যায়, বৈশেষিক ও মীমাংসা দার্শনিকদের মতে-কর্ম এক প্রকার শক্তি সৃষ্টি করে এবং এই শক্তিই কর্মফল প্রদান করে। জৈন দর্শনে এই শক্তিকে ‘কষায়’, মীমাংসা দর্শনে ‘অপূর্ব’, বৌদ্ধ দর্শনে ‘সংস্কার’ নামে অভিহিত করা হয়।

হিন্দু ধর্মে কর্মফল

হিন্দুধর্ম মতে, পুণ্যের ফলে মানুষ সুখ, শান্তি ও আনন্দ লাভ করে; এতে স্বর্গও লাভ হয়। পাপের ফলে মানুষ দুঃখ, অশান্তি, কষ্ট পায়; এতে নরক লাভ হয়। প্রত্যেককেই কর্মের ফল পেতে হবে, এটা অবশ্যম্ভাবী। কর্মফল ভোগ সম্পূর্ণ না হলে মুক্তি বা মোক্ষ লাভ হয় না।

সকল কর্ম এই মহাজাগতিক কর্মকাণ্ডেরই একটা অংশ। জগতের কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। সব কিছুর সাথেই সবার যোগ রয়েছে। সনাতনী বা বৈদিক প্রায় সকল গ্রন্থেই বলা হয়েছে, জগৎকে সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মকেও জীবের কর্মের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়।

উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘পুণ্যকর্ম করলে দেহান্তরে শীঘ্রই ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যযোনিতে জন্মলাভ করে। আর পাপকর্ম করলে শীঘ্রই কুকুর বা শূকর বা চণ্ডালযোনিতে পুনর্জন্ম হয়।’

বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘…তিনি কর্মকেই আশ্রয় করে থাকেন। তাই পুণ্য করলে ভালো আর পাপ করলে মন্দ ফল ভোগ করতে হয়। পাপ-পুণ্যের আবর্তে জীব-পুরুষকে জন্মচক্রে পাক খেতে হয়। তাই কর্ম হলো জীবের গতি, কর্ম হলো জীবের মুক্তি। কর্মই স্থির করে দেবে জীব-পুরুষের অবস্থান।’

ব্রহ্মবাদী বেদান্ত সূত্রকার মহর্ষি বাদরায়ণ বলেছেন, ‘জগতে সুখ দুঃখাদি দেখে ব্রহ্মকে পক্ষপাতযুক্ত বলা যায় না, কারণ শাস্ত্রে এই বৈষম্যের হেতু ও ব্রহ্মের স্বরূপ প্রদর্শিত হয়েছে। …জীবের কর্মফলদাতা যে ঈশ্বর তাই যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত। সৃষ্টি অনাদি তাই কর্মও অনাদি, সৃষ্টির পূর্বে জীব ও ব্রহ্মের কোন ভেদ ছিল না। সৃষ্টির সময় ঈশ্বর ভেদ সৃষ্টি করেছেন, যদি এরূপ বলা হয়, তাহলে এর উত্তরে বলা যায় যে, না জীবজগৎও অনাদি।’

উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘অগ্নিই উদান। মানুষের যখন মৃত্যু হয় তখন তার দেহ শীতল হয়ে যায়। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় তখন মনে লীন হয় এবং সে জন্মান্তরের জন্য প্রস্তুত হয়। মৃত্যুকালে জীবাত্মা প্রাণে প্রবেশ করে। সঙ্গে থাকে মন এবং সেই সময়কার মনের যত সংস্কার বা চিন্তা ও বাসনাসমূহ। প্রাণ তখন অগ্নি অর্থাৎ উদানের সঙ্গে যুক্ত হয়। আত্মা যে লোক কামনা করে প্রাণ তাকে সেই লোকেই নিয়ে যায়। তারপরে আত্মা নতুন জন্মগ্রহণ করে।’

বৃহদারণ্যক উপনিষদে, ‘এই শারীর-পুরষ আত্মা দুর্বলতার কারণে যখন সংজ্ঞালোপ পাবার মতো অবস্থায় আসে তখন সবকটি প্রাণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয় এসে জড়ো হয় আত্মার কাছে। যে তেজশক্তি নিয়ে ইন্দ্রিয়রা ছিল প্রকাশমান, করছিল নিজ নিজ নির্দিষ্ট কাজ, তাদের সেই তেজকে নিয়ে প্রবেশ করে হৃদয়ে।

সঙ্গত কারণেই চাক্ষুষ-পুরুষ আদিত্যের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে, চোখ আর কেমন করে রূপ দেখবে? তাই মুমূর্ষুর চোখে কোন রূপই ধরা পড়ে না। আত্মার সঙ্গে এক হয়ে মিশে গেলে, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকলে কি আর স্বাতন্ত্র্যতা থাকে? একীভূত হয়ে থাকার ফলে, লোকে বলতে, শুনতে, চিন্তা করতে, স্পর্শ করতে পারছে না, কিছু জানতেও পারছে না।

সেই সময় তার হৃদয়ের অগ্রভাব দীপ্তিযুক্ত হয়ে ওঠে, প্রকাশিত হয় হৃদয়পথে নির্গমন দ্বার। দেহকে ছেড়ে জ্যোতির সাহায্যে সেই আত্মা জীবের কামনা অনুযায়ী অনুরূপ পথ দিয়ে বেরিয়ে যান। যদি তার সাধনা থাকে আদিত্যলোকের তবে আত্মা নিষ্ক্রান্ত হন চক্ষুপথে, ব্রহ্মলোকের জন্য ব্রহ্মতালু পথে, আবার নানা-বাসনা, নানা কর্মানুসারে অনুরূপ অপরাপর ইন্দ্রিয়পথে।

ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘কুয়াশা হয়ে মেঘ হন, মেঘ হয়ে বর্ষণ করেন। তারপর জীবগণ এই পৃথিবীতে ব্রীহি, যব, ওষধি, বনস্পতি, তিল ও মাষ ইত্যাদি রূপে জাত হন। এই শষ্যাদি থেকে নিষ্ক্রমণ দুঃসাধ্য। যে যে প্রাণী ওই অন্ন আহার করে এবং সন্তান উৎপন্ন করে, সেই সেই প্রাণিরূপে জীবগণ পুনরায় জন্মগ্রহণ করে।’

আত্মা নির্গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যপ্রাণ তাঁর অনুগমন করে, সেই সঙ্গে অপরাপর প্রাণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ও তাঁর অনুগমন করে। আত্মা তখন বিজ্ঞানময়। এই বিজ্ঞানময় আত্মার অনুগমন করে বিদ্যা, কর্ম আর সংস্কার। জলায়ুক বা জলৌকা অর্থাৎ জোঁক যেমন ঘাসের এক ডগা ছেড়ে আর এক ডগায় গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নেয়, আত্মাও তেমনি দেহত্যাগের পর অবিদ্যা দূর করে, স্থূল দেহটাকে পরিত্যাগ করে আশ্রয়রূপ অন্য দেহকে অবলম্বন করে।’

বাদরায়ণও বলেন, ‘জীব সূক্ষ্মভূত-সমন্বিত হয়ে দেহত্যাগান্তে অন্যদেহ প্রাপ্তির জন্য গমন করে- তা শ্রুতি বর্ণিত প্রশ্নোত্তর থেকে অবগত হওয়া যায়।’ বৃহদারণ্যক শ্রুতি বলেন যে, ‘জীব উৎক্রান্ত হলে জীবের সাথে ইন্দ্রিয় সকলও গমন করে।’

ছান্দোগ্য উপনিষদে, ‘জন্মগ্রহণ করে যতদিন তার আয়ু ততদিন সে জীবিত থাকে। যথানির্দিষ্ট রূপে দেহত্যাগ করে, তখন তাকে ঘর থেকে সেই অগ্নিতে নিয়ে যায়- যে অগ্নি থেকে সে এসেছে, যে অগ্নি থেকে সে উৎপন্ন হয়েছে। যাঁরা পঞ্চাগ্নিবিদ্যা জানেন এবং যাঁরা অরণ্যে বাস করে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তপস্যাদি করেন, তাঁরা মৃত্যুর পর জ্যোতির্লোক প্রাপ্ত হন।

জ্যোতি থেকে দিনে, দিন থেকে শুক্ল পক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয় মাসে। সেখান থেকে সংবৎসরে, সংবৎসর থেকে আদিত্যে, আদিত্য থেকে চন্দ্রলোকে এবং চন্দ্রলোক থেকে বিদ্যুৎ-লোক প্রাপ্ত হন। সেই স্থানে এক জ্যোতির্ময় পুরুষ এসে তাদের ব্রহ্মলোকে নিয়ে যায়। এই পথই দেবযান বা দেবলোকের পথ।

আর যে সকল গৃহস্থ যজ্ঞ, সমাজসেবামূলক কর্ম এবং দান ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেন তাঁরা ধূমকে প্রাপ্ত হন। ধূম থেকে রাত্রি, রাত্রি থেকে কৃষ্ণপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ থেকে দক্ষিণায়ণের ছয়মাসে গমন করেন। এঁরা সংবৎসরকে প্রাপ্ত হন না। দক্ষিণায়ণের ছয়মাস থেকে পিতৃলোকে, পিতৃলোক থেকে আকাশে, আকাশ থেকে চন্দ্রলোকে গমন করেন। ইনিই রাজা সোম।

ইনি দেবতাদের অন্ন, দেবতারা এঁকে ভোগ করেন। কর্মফল ক্ষয় না হওয়া পর্যন্ত চন্দ্রলোকে বাস করে তারপর যে পথে তাঁরা গিয়েছিলেন সেই পথেই পুনরায় ফিরে আসেন। তাঁরা প্রথমে আকাশ ও পরে বায়ুকে প্রাপ্ত হন। বায়ু হয়ে ধূম, ধূম হয়ে কুয়াশা হন।’

বাদরায়ণ বলেন, ‘শ্রুতি-স্মৃতি থেকে জানা যায় যে, জীব যে-পথে চন্দ্রলোকে গিয়েছিল, কর্মফল ভোগের পর আবার সেই পথেই এবং অন্যভাবেও ভুক্তাবশিষ্ট কর্মসহ পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করে। …চন্দ্রমণ্ডল হতে অবতরণ কালে জীব আকাশাদির সদৃশ হয়। আকাশস্বরূপ হয় না- কারণ সদৃশ হওয়াই যুক্তিসঙ্গত।’

ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘কুয়াশা হয়ে মেঘ হন, মেঘ হয়ে বর্ষণ করেন। তারপর জীবগণ এই পৃথিবীতে ব্রীহি, যব, ওষধি, বনস্পতি, তিল ও মাষ ইত্যাদি রূপে জাত হন। এই শষ্যাদি থেকে নিষ্ক্রমণ দুঃসাধ্য। যে যে প্রাণী ওই অন্ন আহার করে এবং সন্তান উৎপন্ন করে, সেই সেই প্রাণিরূপে জীবগণ পুনরায় জন্মগ্রহণ করে।’

বাদরায়ণ বলেন, ‘শ্রুতি বলেন জীবের চন্দ্রলোক হতে নানা অবস্থার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আসতে বেশি বিলম্ব হয় না। এ বিষয়ে বিশেষ শ্রুতি তাই বলে। জীব ব্রীহি ইত্যাদি রূপ প্রাপ্ত হয় বলা হয়েছে; তার অর্থ হলো সেই সেই ব্রীহিতে অবস্থান হয় মাত্র, কারণ শ্রুতিতে এ প্রসঙ্গে আকাশাদি সম্বন্ধে যেরূপ উল্লেখ আছে, ব্রীহির সম্বন্ধেও সেরূপই উল্লেখ আছে।

কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে, যম বলছেন, ‘সংসারী মানুষ মাত্রই নিজ নিজ পরিবারের প্রতি অতিশয় আসক্ত। ধন-সম্পদের মোহ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাদের বুদ্ধি অপরিণত। তারা তাদের চারপাশের জগৎকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করে। এর বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, সে খোঁজ রাখে না। ইহলোকই আছে,পরলোক বলে কিছু নেই- যে- ব্যক্তি এ কথা মনে করে সে বারবার আমার অধীন হয়। অর্থাৎ তার পুনঃ পুনঃ জন্মমৃত্যু ঘটে থাকে।’

চন্দ্রলোক প্রত্যাগত জীব ধান ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার পর যারা শুক্রনিষেক করে জন্মদান করতে সমর্থ তাদের দেহে প্রবিষ্ট হয়। যোনিকে আশ্রয় করেই জীব স্বীয় ভোগায়তনদেহ লাভ করে।’

পুণ্যবানগণ চন্দ্রলোকে যান। নবকলেবর ধারণের জন্য চন্দ্রমা থেকে মেঘ, জল, অন্নাদির যে রাস্তার কথা উপনিষদে বলা হয়েছে তাতে ফিরে আসতে দেরি হয় না।

অবতরণকারী জীবাত্মা অন্য জীবাত্মার দ্বারা প্রাণবন্ত বৃক্ষাদির মধ্যে অবস্থান মাত্র করে- যে পর্যন্ত না নতুন কোন জন্মের সুযোগ পায়। সেই শস্য ভক্ষণের পর আবার রক্ত-বীর্য-যোনির সংযোগ হয়, যার ফলে হয় নতুন দেহ সৃষ্টি। অর্থাৎ পরিশেষে জীবাত্মা একজন সন্তান-উৎপাদনসক্ষম পুরুষের সংস্পর্শে এসে নারীর গর্ভে প্রবেশ করে এবং সেখানে একটি নতুন দেহ লাভ করে, যে দেহ পূর্ব-কৃত-কর্মের ভুক্তাবশিষ্ট ফল ভোগ করার জন্য সমর্থ।

এখানে আরেকটি প্রশ্ন উঠে যে, ইহলোক থেকে যারা উৎক্রমণ করে তাদের সকলেই কি চন্দ্রলোকে গমন করে থাকে? যে-সকল জীবের কর্মফল চন্দ্রলোক গমনের পক্ষে যথেষ্ট নয়, অর্থাৎ যারা যজ্ঞাদি বা কোন ধর্মানুষ্ঠান করে না, কিংবা অনিষ্টকারী ব্যক্তি, মৃত্যুর পর তাদের কী গতি হয়?

ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘যারা উভয় পথের কোন পথ দিয়েই যায় না, তারা পুনঃ পুনর্জন্ম আবর্তনশীল ক্ষুদ্র প্রাণিরূপে জন্মগ্রহণ করে। জন্মাও আর মরো। এই হলো তৃতীয় স্থান। এজন্যেই এই লোক পূর্ণ হয় না। সুতরাং ঘৃণা করবে।’

বাদরায়ণ বলেন, ‘অনিষ্টকারী ব্যক্তি যমলোকে গমন করে; কারণ অনিষ্টকারীর সংযমী নামক যমপুরে যাওয়ার কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে।’

কঠ উপনিষদে বলা হয়েছে, যম বলছেন, ‘সংসারী মানুষ মাত্রই নিজ নিজ পরিবারের প্রতি অতিশয় আসক্ত। ধন-সম্পদের মোহ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তাদের বুদ্ধি অপরিণত। তারা তাদের চারপাশের জগৎকেই একমাত্র সত্য বলে মনে করে। এর বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, সে খোঁজ রাখে না। ইহলোকই আছে,পরলোক বলে কিছু নেই- যে- ব্যক্তি এ কথা মনে করে সে বারবার আমার অধীন হয়। অর্থাৎ তার পুনঃ পুনঃ জন্মমৃত্যু ঘটে থাকে।’

চন্দ্রলোকে আরোহণ শুধুমাত্র শুভকর্মের ফল ভোগেরই জন্য। অনিষ্টকারিরা চন্দ্রলোকে যায় না। তাদের গন্তব্য হয় নরকে। কৃতকর্মের কষ্টভোগের মাধ্যমে পাপমুক্ত হয়ে পূর্ব-কৃতকর্মের ভুক্তাবশিষ্ট ফল ভোগ করার জন্য পুনরায় জন্মগ্রহণ করে জীব দেহধারী হয়।

বাদরায়ণ বলেন, ‘স্মৃতিশাস্ত্রেও পাপীদের নরক গমনের কথা দৃষ্ট হয়। অধিকন্তু পাপীদের ভোগের জন্য সাতটি নরক আছে। পাপীদের চন্দ্রলোকে গমন হয় না, কারণ, বিদ্যাদ্বারা দেবযান এবং কর্মের দ্বারা পিতৃযান প্রাপ্তির কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে।

(চলবে…)

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………………..
সূত্র:
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া

…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২

চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চৌদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১

চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!