আত্মীয়-বান্ধব
-লুৎফর রহমান
শুধু পরস্পরকে কোনো সম্বন্ধ ধরে ডাকলে মানুষ মানুষের আত্মীয় হয় না। জীবনের পথে কোনো সত্যনীতি, মন্ত্র, বিশ্বাস বা ব্রত উদযাপনের যে প্রচ্ছন্ন সাধনা মানব জীবনে থাকে, সেই সাধনায় এবং রোগে, শোকে, অভাবে, বিপদে পরস্পরকে সাহায্য করে, তারাই আত্মীয় এবং বান্ধব।
আত্মীয়তার দিন উঠে গিয়েছে। সভ্যতা, শিক্ষা এবং জ্ঞান মানুষকে পশু করেছে- আত্মীয় বলতে মুসলমান সমাজে কেউ নেই।
আত্মীয় বাড়িতে এলে তাকে পেট ভরে একদিন খাওয়ানোই আত্মীয়তা এবং প্রেম নয়। বন্ধুকে একদিন দই-মাংস খাইয়ে দেওয়াই বন্ধুত্ব নয়। জীবন-যুদ্ধে মাঝে মাঝে যে কঠিন সমস্যার উদয় হয়; সেই সমস্যা সমাধানের জন্য যারা শরীর, বুদ্ধি, অর্থ নিয়ে অগ্রসর হয় তারাই আত্মীয়।
যে নামের আত্মীয়, তাকে মানুষের কাছে আত্মীয় বলে পরিচয় দিও না। তার বাড়ির ত্রিসীমানায় যেয়ো না। সে বিশ্বাসঘাতক। ফাঁকি দিয়ে তোমার ঘরে প্রবেশ করেছে। তোমার সুখ-দুঃখের সহভাগী নয় যে- তার নাম না নেওয়াই উচিত। অথবা কাউকে আত্মীয় বা বান্ধব বলে শব্দের অপব্যবহার না করাই ভালো। ওতে মানুষ ভ্রান্ত হয়।
যার সঙ্গে দরদের বা জীবন-নীতির কোনো সংশ্রব নেই, তাকে আত্মীয় না বলে তার নাম ধরে ডাকাই উচিত।
দরদের ধন হযরত মুহম্মদ (স) প্রতি প্রভাতে উঠে একবার পাড়া-প্রতিবেশীর খবর নিতেন। কই, সে প্রেম তো আজ মানুষের মধ্যে দেখি না। যার অবস্থা একটু ভালো, সে কি আর মনুষ্যের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেশীর খবর নেয়?
মেয়ে পুরুষ সবাইকে একই খোঁয়াড়ে আবদ্ধ করে রাখা হত, অতি কদর্য খাদ্য তাদেরকে দেওয়া হত। লঘু ও গুরু অপরাধের কোনো পার্থক্য ছিল না। বিচারের নামে মানুষের প্রতি নির্মম অবিচার হত। এইসব মনুষ্যপ্রেমিক এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। ফলে ক্রমে ক্রমে কয়েদিদের প্রতি মনুষ্যোচিত ব্যবহার করা হয়।
যে দরদ করে, দুঃখে সহানুভূতি জানায়, বিপদে আপনার জনের মতো পাশে এসে দাঁড়ায়, সেই আমাদের পরম বান্ধব, তার সঙ্গে রক্তের সংশ্রব থাক আর না থাক। যে সহোদর ভ্রাতা হয়ে দুঃখের সময় পরের মতো ব্যবহার করে, গত জীবনের কথা তুলে বিপদে প্রতিশোধ নিতে চায়, সে ভ্রাতা হলেও বেগানা। তার সঙ্গে কোনো সংশ্রব না রাখাই ভালো।
যে অসাধু এবং অত্যাচারী সে আপনার জন হলেও তার কোনো সাহায্য গ্রহণ করো না- কারণ সে অন্যায় করে। তার সাহায্য গ্রহণ করার অর্থ তার পাপ জীবনকে, আর পাপকে সমর্থন করা। পাপী দুরাত্মা ভ্রাতা হলেও সে আমাদের কেউ নয়। চিন্তা এবং ধর্মে যাদের সঙ্গে যোগ নেই তারা কখনও আত্মীয় নয়।
যারা মানুষের প্রতি প্রেমবশত হাসপাতাল নির্মাণ করেন- বিপন্ন, পীড়িত দরিদ্র কুষ্ঠরোগগ্রস্তদের জন্যে আপন ধনভাণ্ডার খুলে দেন, তারা মানুষের পরম আত্মীয়। মানুষের আত্মীয় হবার মতো সৌভাগ্য মানব জীবনে আর কি! হাজী মহসীন বাঙালি মুসলমানের পরম আত্মীয়।
মনুষ্য-হিতাকাক্ষী মাত্রেই মানুষের আত্মীয়। জন হাওয়ার্ড, বানিয়র, কাউন্ট, টলস্টয়, সাধু ভিনসেন্ট, সারা মার্টিন, মিসেস ফ্লাই টানেল, রাইট এঁরা মানুষের পরম আত্মীয় ছিলেন।
জন হাওয়ার্ড সম্বন্ধে বাগ্মী বার্ক বলেছেন- দুঃখী বন্দিদের দুরবস্থা, তাদের প্রতি মানুষের নির্মম ব্যবহার সারা ইউরোপ ঘুরে তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি ৪২ হাজার মাইল পথ হেঁটে ইউরোপের কারাগৃহসমূহ পরিদর্শন করেন। দুঃখী মানুষের প্রতি এমনিই তার মমতার টান।
দুঃখীরা কীভাবে অন্ধকারে, রোগে-দুঃখে জীবন কাটায়, মানুষের নিষ্ঠুর ব্যবহার কীভাবে তাদেরকে আরও অমানুষ ও পশু করে, হাওয়ার্ড তার সবিস্তার বর্ণনা সর্বত্র প্রকাশ করেন। যতক্ষণ না চোখে আঙ্গুল দিয়ে সাধারণ সংসারী মানুষকে দেখিয়ে দেওয়া যায়, ততক্ষণ সংসারের মানুষ পরের বেদনা অনুভব করতে পারে না।
কারাগারে পূর্বকালে বন্দিদের অবস্থা অতি ভয়ানক ছিল। যেমন সেগুলো মহাপাপের আড্ডা ছিল। মানুষকে কুকুরের মতো ব্যবহার করা হতো। জীবিত বন্দিদের শরীরে অস্ত্র চালনা করে ডাক্তারেরা শরীরতত্ত্ববিদ্যা শিখতেন, নানাপ্রকার ব্যাধি-পীড়ায় তারা আয়ু থাকতে মারা যেত।
মেয়ে পুরুষ সবাইকে একই খোঁয়াড়ে আবদ্ধ করে রাখা হত, অতি কদর্য খাদ্য তাদেরকে দেওয়া হত। লঘু ও গুরু অপরাধের কোনো পার্থক্য ছিল না। বিচারের নামে মানুষের প্রতি নির্মম অবিচার হত। এইসব মনুষ্যপ্রেমিক এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। ফলে ক্রমে ক্রমে কয়েদিদের প্রতি মনুষ্যোচিত ব্যবহার করা হয়।
শুধু দিন-রাত্রি ঘরে বসে উপাসনা করাই আল্লাহর উপাসনা নয়। দুঃখী মানুষের সেবা করে, জগতে পাপ ও অন্যায়ের সংস্কার করে প্রেম ও আত্মীয়তার পরিচয় দিতে হবে। যে মানুষের আত্মীয় সেই মহাজন ঈশ্বরের আত্মীয়।
মানুষের আত্মীয় হবার এমন সুবর্ণ সুযোগ আর পাবে না। সামান্য হলেও সেবা ও প্রেমের পথে দান কর। এইভাবে বাঙালি জাতির আত্মীয় হয়ে তোমরা আল্লাহর আশীর্বাদ লাভ কর। একজনের পক্ষে বিপুল অর্থ ব্যয় করা এবং সেবার পথে তা দান করা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে।
সাধু ভিনসেন্ট এক কয়েদিকে মুক্তি দিয়ে নিজে কয়েদির লৌহশৃঙখল পরেন। কর্তৃপক্ষ শেষকালে জানতে পেরে তাকে মুক্তি দান করনে। প্রেম, ভালবাসা, উপদেশ ও সহানুভূতিতে দুরন্ত মানুষকে যে আবার শান্ত সুবোধ করা যায়- এ কথা সরকারি কর্মচারীরা না বুঝলেও এইসব মানবপ্রেমিকেরা বুঝেছিলেন।
এঁরা শত শত কয়েদিকে দীক্ষা দ্বারা আবার মানুষ করে তুলেছিলেন। অবহেলা ও নির্মম দণ্ডে যে মানব মনের কতখানি অবনতি হয়, তা আগে কেউ জানত না। ছোটকে ভালবাসো, এমন ব্যবস্থা করে যাও যাতে মানুষকে আর মন্দপথে না চলতে হয়।
শাসক ও শাসিতের সঙ্গে সম্বন্ধ ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে পিতা-পুত্রের সম্বন্ধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের যারা প্রতিনিধি তাদের স্মরণ করা উচিত ঈশ্বরের নজর তাদের ওপর আছে। অত্যাচার ও ঘৃণায় মানুষ আরও পিশাচ হয়। দুরন্ত ছেলে যাতে সুবোধ ও সৎ হয় তার জন্য সহানুভূতিপূর্ণ চেষ্টা করা।
উচিত। মানুষ যতই মন্দপথে হাঁটুক, সে তো মানুষ। তার ভিতর যে মহৎ বৃত্তিগুলো আছে। তাতে আঘাত কর, সে উত্তর দেবে। সে একেবারে পশু হতে পারে না। তাকে সন্তান ও ভ্রাতা বলে তার মঙ্গল কর। এতেই মহত্ত্ব ও উচ্চ মানবতার পরিচয় দেওয়া যায়।
সামান্য সামান্য মাসিক দানে দেশের সর্বত্র হাজার হাজার পীড়িতের আবাস, জলাশয় এবং বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অবহেলিত সামান্য পয়সা এক জায়গায় সঞ্চিত হলে দেশের কত দরিদ্র মানুষের মঙ্গল হতে পারে। কেন অকৃতজ্ঞ নিন্দুক মানুষের উদর-সেবার জন্য অর্থ ব্যয় কর?
বরং পীড়িত ও তৃষিতের মুখে শান্তির অমৃত তুলে ধর। এইভাবে দেশের মানুষের পরম আত্মীয় হও এবং জীবন ধন্য কর। আমাদের দেশে মহাপাপে, রোগে, দুঃখে, অনাহারে শত শত নরনারী মারা যাচ্ছে, তাদের কাতর চীৎকার তোমাদের পাষাণ হৃদয়কে গলাবে না কি? পাপ ও অন্ধকারের অতল হতে তাদের উদ্ধার করবে না?
মানুষের আত্মীয় হবার এমন সুবর্ণ সুযোগ আর পাবে না। সামান্য হলেও সেবা ও প্রেমের পথে দান কর। এইভাবে বাঙালি জাতির আত্মীয় হয়ে তোমরা আল্লাহর আশীর্বাদ লাভ কর। একজনের পক্ষে বিপুল অর্থ ব্যয় করা এবং সেবার পথে তা দান করা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে।
প্রভুর পথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দান করা কোনোমতে কষ্টকর নয়। প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগতভাবে জাতীয় অনুষ্ঠানে, সেবা-প্রতিষ্ঠানে, রোগীর আশ্রমে কিছু কিছু দান করা উচিত। এতে কোনোমতে কৃপণতা করা উচিত নয়।
জনৈক ডেপুটিকে দেখেছিলাম, তার স্বভাব হাকিমী-চলন মোটেই ছিল না। তিনি সকলের বাড়িতেই যেতেন, সকলের সঙ্গে মিশতেন। বিবাহ উৎসবে যোগ দিতেন। স্বভাবে তাঁর অহঙ্কার ছিল না। একখানা কাপড় পরে সাধারণ মানুষের মতো রাস্তায় বেড়াতেন।
যে এই দানে আপত্তি তোলে এবং যে এই সামান্য দানকে আপন জীবনের সুখ-সুবিধার অন্তরায় মনে করে, সে মানুষের আত্মীয় নয়। তার জীবনধারণ বৃথা। পরিবারে দুর্বল নিঃসহায় অধীনস্থদের প্রতি অত্যাচার, মৃত ভ্রাতার বিধবা পত্নী ও পুত্র-কন্যাদের ওপর অত্যাচার, বরিশাল জেলার বিকৃতমস্তিষ্ক ভ্রাতার স্ত্রী মনোরমার মতো নারীর ওপর অত্যাচার কখন ও আত্মীয়ের কাজ নয়।
পরিবারের বুড়া-বুড়িকে জীবনের শেষ অবস্থায় কোনোরকম অসম্মান করা ঘোর নিষ্ঠুরতা। যারা এরূপ করে তারা কখনও প্রিয়জন নয়। Wagram-এর যুদ্ধে ঊর. Sals dirf-এর একখানা পা গোলার আঘাতে একেবারে চূর্ণ হয়ে যায়। তার সম্মুখে একটা আহত সৈনিক গুলীবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল; ডাক্তার নিজে মৃত্যুর পথে দাঁড়িয়েও পরম আত্মীয়ের ন্যায় এই আহত সৈনিক-দেহে অস্ত্রোপচার করে তাকে বাঁচালেন।
নিজের বেদনাকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। যিনি নিজকে ভুলে দুঃখীকে এমন করে জীবন দান করেন তিনি আপনার চেয়েও আপনার। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহৎ কাজের সমষ্টিতেই এক একটা মহাজীবন রচিত হয়।
জনৈক কলেজের যুবক তার চাচা-শ্বশুরের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে জনৈক ডেপুটির সঙ্গে দেখা করে বল্লেন; মহাত্মন! আমি দরিদ্র, আমার এক পয়সাও ব্যয় করবার ক্ষমতা নেই। আমার বাড়ি-ঘর-দরজা কিছুই নেই। মৃত শ্বশুরের আত্মীয় নিরন্তর আমাকে নির্যাতন করেন। তাঁর আপন ভ্রাতুস্পুত্রীকে খুন করতে আসেন।
আমরা উত্তরাধিকারি হলেও শ্বশুরের পরিত্যক্ত সম্পত্তির কানাকড়ি আমাদেরকে দিতে চান না। মহানুভব ডেপুটি যুবকের আবেদন গ্রাহ্য করলেন। বিনা খরচে তিনি যুবককে সর্ব বিপদ হতে রক্ষা করলেন। যুবকের বালিকা-পত্নী যখন কোটে উপস্থিত হন তখন ডেপুটি এইভাবে কথা বলেছিলেন; মা, তুমি ভয় করো না।
সাহস করে আমার সম্মুখে কথা বল। আজ আমি ছাড়া তোমার আর কোনো আত্মীয়স্বজন নেই- আমি তোমার মা-বাপ। সত্য কথা নির্ভীকভাবে বল, আমি তোমাদের নিরাপদময় ব্যবস্থা করে দেব।
আজকাল বিচারপতির মুখে বিচারপ্রার্থীর প্রতি এমন আত্মীয়ের মতো পরম ভরসার কথা, এমন নিরহংকার প্রেমের সম্বোধন প্রায়ই শোনা যায় না।
জনৈক ডেপুটিকে দেখেছিলাম, তার স্বভাব হাকিমী-চলন মোটেই ছিল না। তিনি সকলের বাড়িতেই যেতেন, সকলের সঙ্গে মিশতেন। বিবাহ উৎসবে যোগ দিতেন। স্বভাবে তাঁর অহঙ্কার ছিল না। একখানা কাপড় পরে সাধারণ মানুষের মতো রাস্তায় বেড়াতেন।
বিচারের সময় বিচারকের আসনে গিয়ে বসতেন। অন্যথায় একেবারে সহজ-নিরহংকার ভাব গ্রহণ করতেন। বিচারপতিতে এই আত্মীয়তার ভাব বড়ই প্রশংসনীয়।
<<স্বাধীন গ্রাম্যজীবন ।। সত্য প্রচার>>
……………………
মহা জীবন -লুৎফর রহমান।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা