-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
‘কালা জাদু’
জাদু বা ম্যাজিক একটা পরিবেশনমূলক শিল্প। মানবজাতির লোকসংস্কারের বিশাল পরিসর জুড়ে আছে এই জাদুবিদ্যা। আদি প্রায় সকল বিশ্বাস-ধর্মমতের সাথেই জাদুর নিবিড় সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। জাদুবিদ্যা মূলত অতীন্দ্রিয়-অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বশ করার বিশেষ এক কলা।
প্রাচীন বিশ্বাসে মৃতের আত্মাকে বশ করে নানা ক্রিয়াকৌশল যারা করতো সমাজে তাদের ছিল বিশেষ মর্যাদা। তারা একাধারে পুরোহিত, তান্ত্রিক, চিকিৎসক, জ্যোতিষের দায়িত্ব পালন করতো। সমাজের যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা হতো।
তারা সমাজ-গোত্র-জাতির দুর্যোগের আগামবার্তা দিয়ে দলপ্রধানকে সর্তক যেমন করত। তেমনি কোনো দুর্যোগ উপস্থিত হলে তা নিরোসনেও দিতো নানা বিধি। যে কোনো শুভ কাজও তাদের ভক্তি নিবেদন করেই শুরু করা হতো। এই তালিকায় শিশুর জন্ম, বিয়ে, মৃতের সৎকারের মতো সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন ছিল। তেমনি ছিল শিকার, যুদ্ধ, বাণিজ্যে যাওয়ার মতো অনুষ্ঠানও।
ধুপধোয়া, আগুন, বলি, রক্ত, দেহাবশেষ সহ নানান পশু-পাখি, লতাপাতার ব্যবহার করতো জাদু কলায়। মধ্যযুগীয় জাদুবিদ্যায় পশুপাখির মধ্যে সাপ, ব্যাঙ, বিড়াল, ছাগল, ভেড়া, কাক, ঈগল, শকুন, বাঁদুর, পেঁচা, মুরগি ইত্যাদির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
জাদুকররা যে শুধু দল বা গোত্রের সাথেই থাকতো তেমন নয়। বিচ্ছিন্নভাবেও তারা নিজেরাই দলগত ভাবেও বসবাস করতো। বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে বিভিন্ন তিথিতে ভিন্ন ভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে অর্থকড়ি টাকাপয়সা সংগ্রহ করতো।
জাদুর সাথে অতিপ্রকৃতি বিষয়টি সর্বকালেই যুক্ত ছিল। জাদু বা ম্যাজিক যাই বলা হোক না কেনো। মানুষ জাদু বলতে তার সাথে একটা রহস্য খুঁজতে চায়। সেই রহস্য যদি অপ্রাকৃত বা অলৌকিক কিছু হয় তাহলে তো কথাই নেই।
মানুষের উপকার যেমন তারা করতো, তেমনি ক্ষতিও কম করতো না। মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে কার্য হাসিল করে নেয়ার কৌশলও তারা ভালোই জানতো।
পরবর্তীতে প্রভাব কমতে শুরু করলে তারা কলাকৌশল দেখিয়ে অর্থ উপার্যনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। লোকে তাদের সকল সময়ই ভয় পেত। সমীহ করতো। দূরত্ব বজায় রাখতো। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসের জাদু থেকে বিনোদনের জাদুর জন্ম। যে জাদুতে আত্মা বা অতিপ্রাকৃতের কোনো সম্পর্ক নেই সেই জাদু বিনোদনের জগতে স্থান করে নেয়।
ইউরোপ-আমরিকার শিক্ষিত সমাজের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠে জাদু। পরবর্তীতে তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে। একসময় জাদু প্রদর্শনকারীরা নিজেদের জাদুকর হিসেবে দাবী করলেও। পরবর্তীতে মঞ্চের জাদু প্রদর্শনকারীরা নিজেদের জাদুশিল্পী হিসেবে উপস্থাপন করে। কারণ তাদের মধ্যে অতিপ্রাকৃত কোনো ব্যাপার নেই। তারা কেবলই কৌশল অবলম্বন করে মাত্র।
এই জাদুশিল্পীরা এতোটাই প্রভাব বিস্তার করে যে। তাদের অনেকে কেবল কলাকৌশল প্রদর্শন করলেও লোকে তা মানতে চাইতো না। লোকে ভাবতো তাদের বিশেষ ক্ষমতা আছে। আবার অনেকে দাবীও করতো তারা শুধু জাদুশিল্পী নয় জাদুকরও বটে। অনেক জাদুশিল্পী গোপনে জাদুবিদ্যার আদি প্রথাও গোপনে চর্চা করতো বলেও নানা সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পায়।
জাদুর সাথে অতিপ্রকৃতি বিষয়টি সর্বকালেই যুক্ত ছিল। জাদু বা ম্যাজিক যাই বলা হোক না কেনো। মানুষ জাদু বলতে তার সাথে একটা রহস্য খুঁজতে চায়। সেই রহস্য যদি অপ্রাকৃত বা অলৌকিক কিছু হয় তাহলে তো কথাই নেই।
জাদুশিল্প
প্রাশ্চাত্যে জাদুর কৌশল বিষয়ক আদি বইগুলির একটি ১৪৮৯ সালের প্রকাশিত গ্যানটজিয়নির ন্যাচারাল এন্ড আনন্যাচারাল। জাদু কৌশল বাস্তবায়ন নিয়ে ১৫৮৪ সালে ইংরেজ রেগনালড স্কট দ্য ডিসকভারি অফ উইচক্র্যাফ্ট প্রকাশ করেছিলেন।
পরের শতাব্দীতে প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে- দ্য আর্ট অফ কনজুরিং (১৬১৪) এবং দ্য এনাটমি অফ লিগারডেমাইন: দ্য আর্ট অফ জগিং (১৬৭৫) উল্লেখযোগ্য।
অষ্টাদশ শতাব্দী জাদু বিশ্বাসের বদলে বিনোদনের পর্যন্ত ম্যাজিক শোগুলি মেলাতে বিনোদনের একটি সাধারণ উৎস ছিল। ইংরেজ জাদুবিদ আইজাক ফকস ১৭২০ সালের দিকে রীতিমতো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সকলকে জাদুশিল্প সম্পর্কে জানান দিয়েছিল।
জিন ইউগেন রবার্ট-হাউডিন মূলত একজন ঘড়ি প্রস্তুতকারী ছিলেন। তার জাদু থিয়েটারে দর্শক থিয়েটারে টাকার বিনিময়ে জাদু দেখতে পেত। ১৮৪০ সালে জন হেনরি অ্যান্ডারসন লন্ডনে নিউ স্টান্ড থিয়েটার খুলেছিলেন।
ইহুদি জাদুকররা মনে করতো জাদুবিদ্যা শুধু বিশেষ দক্ষদের পক্ষেই করা সম্ভব। আর এই বিশেষ দক্ষদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো বাদশাহ সলোমন। ১৭৫০ সালে বাদশাহ সলোমনের সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়।
সেই সমাধি থেকে একটা ‘কি অফ সলোমান’ গ্রন্থটি পাওয়া যায়। যা পরবর্তীকালে জাদুবিদ্যার উল্লেখযোগ্য বই হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। গ্রন্থটি রেড ড্রাগন নামেও পরিচিত। এতে রয়েছে শয়তানের সাথে চুক্তি সম্পাদনের সমন জারির নির্দেশনাবলী।
এন্টিনিও ভেনিটিয়ানা ডেল রাবিনা’র লেখা ‘দ্যা গ্রান্ড গ্রিমোই’ গ্রন্থটি ব্ল্যাক ম্যাজিকের উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ। ধারণা করা হয়, এর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল বাদশাহ সলোমনের গ্রন্থ থেকে। ইহুদিদের আরো বিশ্বাস ছিল, জগতের প্রথম পুরুষ আদম পৃথিবীতে জাদুবিদ্যা সংক্রান্ত ‘দ্যা বুক অব রাজিয়েল’ নামে একটা বই সাথে এনেছিল।
১৭৫৬ থেকে ১৭৮১ সাল পর্যন্ত জ্যাকব ফিলাডেলফিয়া জাদুবিদ্যা নিয়ে বেশিরভাগ সময়ই ইউরোপ ও রাশিয়া জুড়ে বৈজ্ঞানিক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন।
আধুনিক বিনোদন জগতের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম জিন ইউজেন রবার্ট-হাউডিন ১৮৪৫ সালে প্যারিসে একটি জাদু থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। একই শতাব্দীর শেষ দিকে বড় বড় নাট্যমঞ্চে জাদু প্রদর্শন করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেয় হয়। উনিশ শতকে এবং বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মঞ্চের জাদুকররাও তাদের বিজ্ঞাপনে এই ধারণার ব্যবহার করেছিলেন।
জিন ইউগেন রবার্ট-হাউডিন মূলত একজন ঘড়ি প্রস্তুতকারী ছিলেন। তার জাদু থিয়েটারে দর্শক থিয়েটারে টাকার বিনিময়ে জাদু দেখতে পেত। ১৮৪০ সালে জন হেনরি অ্যান্ডারসন লন্ডনে নিউ স্টান্ড থিয়েটার খুলেছিলেন। তিনি বিশ্বজনীন জাদুকর হয়ে ওঠেছিলেন। ১৮৪৫ সালে তিনি গ্লাসগোতে দ্বিতীয় থিয়েটার খুলেন।
১৮৭৩ সালে লন্ডনের পিকাডিলিতে ব্রিটিশ অভিনেতা জেএন মাস্কিলেনি এবং তার সঙ্গী কুকি থিয়েটার মিশরীয় হল প্রতিষ্ঠা করেন।
অতিপ্রাকৃত জাদু
অতিপ্রাকৃত জাদু বিষয়েই আজকের চুরাশির ফেরের এই পর্ব। আত্মাকে বশ করা বা মৃতের আত্মাকে দিয়ে কার্যসিদ্ধি করার দাবী করার যে কৌশল মানুষ যুগে যুগে রপ্ত করেছে বা করবার চেষ্টা করেছে। সেই বিদ্যায় তারা কতটা সফল বা বিফল সেটা আলোচনার বিষয় না।
বা আদৌতেই জাদুবিদ্যায় আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিনা সেটার বিশ্লেষণও এই লেখার মমার্থ নয়। এ লেখা কেবল মানুষ যুগে যুগে মৃতের আত্মার সাথে যোগাযোগ বা বশ করার যে পথ অবলম্বন করেছে সেই যাত্রার ইতিহাস নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করবার চেষ্টা মাত্র।
দেহের বাইরেও আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে মানুষ কিভাবে ভেবেছে তা জানতে গেলে জাদুবিদ্যা, কালাজাদু সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা আবশ্যক। এর সত্যতা-বাস্তবতা-যথার্থতা-বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু আত্মার সাথে মানুষের যোগাযোগের এই পন্থা সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা জন্মান্তরকে বুঝতে সাহায্য করবে বলেই মনে করছি। তাই এই আলোচনা-
মাজি
সম্ভবত ইংরেজি ‘ম্যাজিক’ শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ মাজি থেকে। ফারসি মাজশ বা পূজারী গ্রিক ভাষায় মাজু নামে পরিচিত ছিল। পারস্য প্রজাদের অতিপ্রাকৃত ক্রিয়াকলাপকে গ্রিকরা mageia (μαγεία) বলে ডাকতো। এই মাজিয়াই পরবর্তীতে ম্যাজিক রূপ নিয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক হাজার বছর আগে পারস্যের জোরেয়াস্তায় মাজিয়ান নামে ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। প্রকৃতিনির্ভর শুদ্ধ চর্চা ছিল তাদের ধর্মীয় মূল প্রতিপাদ্য। পরবর্তীতে এই ধর্মমতে জাদুবিদ্যা বিকাশ লাভ করে।
মাজিয়ান পুরোহিতরা পরিচিত ছিল মাজি নামে। তারা মূলত পঞ্চতত্ত্ব অর্থাৎ সূর্য, চন্দ্র, মাটি, পানি ও বাতাসের শুদ্ধতার কলা চর্চা করতো। প্রকৃতি বিচার করে হিসেব কষে ভবিষ্যত গণনায় পারদর্শী ছিল তারা। তবে আনুষ্ঠানিতার পূর্বে মানব শিশু বা পশু বলি দেয়ার বিধান ছিল তাদের ধর্মমতে। এর জন্য লোকে তাদের ভয় পেত। এড়িয়ে চলতো তাদের সঙ্গ।
জাদুর প্রকার
ইতিহাসের বিভিন্ন সময় জাদুবিদ্যা তার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। কখনো এই জাদু ছিল পরিত্রাণ স্বরূপ। কখনো বিশ্বাসের স্তম্ভ। কখনো বা হয়েছে শত্রুকে দমনের হাতিয়ার। কখনো হয়েছে অন্যকে ক্ষতির করা প্রথা। আবার কখনো হয়েছে বিনোদনের মাধ্যম। কখনোবা নিছক মজা-মশকরার উপাদান।
এর গতি-প্রকৃতি দেখে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে জাদুকে বহুভাগে ভাগ করা হয়েছে। আত্মার সাহায্যে মানুষের উপর প্রয়োগের জাদুকে স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজারের প্রধান দুই ভাগে ভাগ করেছেন-
১. হোমিওপ্যাথিক ম্যাজিক
এই জাদু বিদ্যায় সাধারণত শত্রুকে প্রতিহত করতে ব্যবহৃত হয়। মোম, মাটি, কাঠ, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে শত্রুর শত্রুর প্রতিমূর্তি বা ছবি তৈরি করা হয়। তারপর সেই প্রতিমূর্তি বা ছবি তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে কেটে, পানিতে ডুবিয়ে, পুড়িয়ে বা পঁচিয়ে ধ্বংস করা হয়।
ধারণা মতে, প্রতিমূর্তিতে যে যন্ত্রণা দেয়া হয় শত্রুও তেমন যন্ত্রণা বা আঘাত পায়। এই জাদুবিদ্যা লোকের উপকার-অপকার দুই করা হয়।
২. কন্টেজিয়াস ম্যাজিক
এ জাদু বিদ্যায় মানুষের দেহের- চুল, নখ, পরিধেয় বস্ত্র, দেহাবশেষ মাধ্যমে জাদু করে মানুষের ক্ষতি বা উপকার করা করা হয়। শত্রুর আঙ্গুলের নখ, চুল, ভ্রু, থুথু ইত্যাদি সংগ্রহ করে মোমের সাহায্যে শত্রুর একটা অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করে তা ছয় দিন ধরে মোমের আলোয় ঝলসেসাত দিনের দিন মূর্তিটি পুড়িয়ে ফেললে শত্রুর মৃত্যু হবে।
তবে অতিপ্রকৃত জাদুবিদ্যাকে সাধারণভাবে জাদুবিদ্যাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়-
ক. হোয়াইট ম্যাজিক:
সকলের উপকারের জন্য যে জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করা হয় তাকে তাকে সাদা জাদু বলে। সাধারণত এই জাদু ফসলের উৎপাদন, ব্যবসায় উন্নতি, বৃষ্টি আনা, ঝড়বৃষ্টি প্রতিরোধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়।
খ. গ্রে-ম্যাজিক:
সাদা এবং কালা জাদুর মধ্যবর্তী কিছু জাদু থেকে যায়। এই জাদু সেই ভাগের মধ্যে পরে। অনেকে একে সাদা জাদু বলেেও চিহ্নিত করে। মূলত প্রতিরোধের জন্য এই জাদু ব্যবহৃত হয়। কালাজাদুর প্রভাব কাটানো, রোগবালাই-মহামারী থেকে মুক্তি, আসু বিপদ থেকে পরিত্রাণ ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত জাদু।
গ. ব্ল্যাক ম্যাজিক:
জাদুবিদ্যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো কালা জাদু। বস্তুত অন্যের ক্ষতিসাধন করাই এই জাদুর মূল উদ্দেশ্য। এই জাদু প্রয়োগ করে শত্রুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো হয়। আত্মা সংক্রান্ত ধারণা থেকেই ব্ল্যাক ম্যাজিকের উদ্ভব।
তবে এই বিদ্যা আয়ত্ত করতে চাই দীর্ঘ সাধনা, দুর্ধর্ষ সাহস, কঠিন মনোবল, আত্মবিশ্বাস এবং প্রত্যয়। কারণ এই বিদ্যার জন্য নিজেকে উপযোগী প্রমাণ করতে যে সকল বাঁধা টপকাতে হয় তা সাধারণের কর্ম নয়। দুর্বলচিত্তের কেউ এসব করতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনাই অধিক।
পৃথিবীতে ধর্মের আবির্ভাবের আগেও মানুষের মধ্যে আত্মার চর্চা ছিল। আবার ধর্মের আবির্ভাবের পরও এই চর্চা অব্যাহত আছে। আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ভবিষ্যৎবাণী বা কোনো কাজ করিয়ে নেয়ার বিদ্যাকে ব্ল্যাক ম্যাজিক, নেক্রোম্যান্সি বা কালো জাদু বলে।
কালাজাদুকরা নিজেদের প্রয়োজনে মৃতের আত্মাকে ব্যবহার করে থাকে। এই বিশ্বাসের চর্চা মূলত ছিল আফ্রিকানদের মধ্যে। তাই বিশ্বজুড়ে এটি আফ্রিকান ব্ল্যাক ম্যাজিক নামেও পরিচিত। এ বিদ্যায় পারদর্শীদের ডাকি, ওঝা, গুণিন বলা হয়। আর আফ্রিকান ভাষায় বলে কিনডকি।
কালা জাদু আসলে মৃত আত্মার সাথে তন্ত্র-মন্ত্রের এক ধরনের উপাচার। এ এক বিশাল জগৎ। সাধারণত অন্যকে ক্ষতি করার জন্যই এই বিদ্যা ব্যবহৃত হয়। যার ক্ষতি করার হবে তার ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র এমনকি তার দেহের চুল, নখ, রক্ত ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় এই বিদ্যায়।
মৃত আত্মাকে দিয়ে ক্ষতি করার এই বিদ্যা পশ্চিমা দুনিয়ার পাশাপাশি ভারতবর্ষেও ব্যাপক জনপ্রিয়। তবে এই বিদ্যা চর্চা ও প্রয়োগ উভয়ই আখেরে ক্ষতির কারণ বলেই স্বীকৃত। তারপরও ক্ষমতা-শক্তি-প্রভাব লাভ, কামনা-বাসনা চরিতার্থে অশুভ আত্মার চর্চায় যারা একবার ডুবে যায় তারা আর সহজে এর মায়াজ্বাল থেকে বের হতে পারে না। এর দুর্নিবার আকর্ষণ-রোমাঞ্চ সকল বয়সী মানুষকেই আকৃষ্ট করে।
তবে এই বিদ্যা আয়ত্ত করতে চাই দীর্ঘ সাধনা, দুর্ধর্ষ সাহস, কঠিন মনোবল, আত্মবিশ্বাস এবং প্রত্যয়। কারণ এই বিদ্যার জন্য নিজেকে উপযোগী প্রমাণ করতে যে সকল বাঁধা টপকাতে হয় তা সাধারণের কর্ম নয়। দুর্বলচিত্তের কেউ এসব করতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনাই অধিক।
রবার্ট এম প্লেসেস তার ২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘জাদু ও রসায়ন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘ব্ল্যাক ম্যাজিকের সমান্তরালে রয়েছে অশরীরী আত্মার ঘনিষ্টতা লাভে আদিম শামানিস্টিক প্রচেষ্টা।’
মুহাম্মদর নবুয়ত প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত সেমেটিক জাতিগুলোর মধ্যে ব্যাপকভাবে জাদুবিদ্যা চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়। মেসোপটেমিয় (২৪০০ খ্রিপূ) সভ্যতাগুলো থেকে জাদুবিদ্যার প্রচুর আলাতম পাওয়া গেছে, যেখানে দুই শ্রেণীর পুরোহিতের কথা বলা হয়েছে-
বারু:
বারুরা পরিচিত ছিল জাদুকর ও জ্যোতিষ হিসেবে। এরা মৃত প্রাণীর যকৃৎ, নাড়ি-ভুড়ি দেখে ভবিষ্যৎ গণনা করতো।
অছিপু:
অছিপু নামের পুরোহিতরা মূলত ওঝার দায়িত্ব পালন করতো। ভূত প্রেত তাড়ানো, বিষাক্ত প্রাণীর দংশনের উপাচার ইত্যাদি কাজ করতো।
ইতহাসে জাদুবিদ্যায় সবচাইতে বেশি ব্যবহার দেখা যায় প্রাচীন মিশরীয়দের সংস্কৃতিতে। চতুর্থ রাজবংশ প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই মিশরে জাদুবিদ্যার চর্চা ব্যাপক প্রচলনের ইতিহাস পাওয়া যায়। প্রায় সকল কিছুর প্রতিকারের জন্যই তাদের আলাদা আলাদা জাদুবিদ্যার কৌশল ও প্রয়োগ ছিল। ছিল আলাদা আলাদা জাদুকর।
চীনাদের বিশ্বাস মতে, তাদের অপদেবতা ‘শা’ সরলরেখা বরাবর চলে, তাই তাকে প্রতিহত করতে স্থাপত্যে কোণগুলো বাঁকা করে নির্মাণ করে। কনফুসিয়াসের ‘আই চিং’ মতাদর্শও প্রধানত ভবিষ্যৎ গণনার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল।
তারা মনে করতো জাদুকররা অন্যের আত্মাও চুরি করতে পারে। তাই তারা মৃতদেহ সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দিতো। যাতে মৃতদেহের সাথে জাদুকররা কোনো ক্রিয়া না করতে পারে।
প্রাচীন গ্রিকদের জাদুবিদ্যার দেবী ছিল ‘হেকেটি’। তাদের জাদুবিদ্যাকে এমনই পবিত্র মনে করতো যে তার জন্য তারা বিশেষ বর্ণমালার সৃষ্টি পর্যন্ত করেছিল। এই পবিত্র বর্ণমালা দিয়ে লেখা হতো জাদুর যাবতীয় লেখাজোকা। বলা হয়ে থাকে, পবিত্র কালি দিয়ে এসব লিখবার সময় বারবার পাঠ করা হতো। তাদের বিশ্বাস ছিল, এই পবিত্র বাক্য, পবিত্র কালি দিয়ে, পবিত্র বর্ণে লিখবার সময় বারবার পাঠ করলে জাদুকর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারি হয়ে উঠে।
রোমান জাদুকররা ভাগ্য বিচার ও ভবিষ্যতবাণীতে বিশেষ পারদর্শী ছিল। নানা আঁকিবুজি করে তার উপর কড়ি দিয়ে তারা স্বপ্নের ব্যাখ্যা, কোষ্ঠিবিচার করতো। জন্য নানারকম প্রসাধনীও ওঝারা বিক্রী করত। রোমানদের ‘এভিল আই’ বা ‘অশুভদৃষ্টি’তেও অঘাৎ বিশ্বাস ছিল।
ইহুদি জাদুকররা রক্তস্নান-বাষ্পস্নানের মাধ্যমে পশু বা নরবলি দিয়ে শয়তানকে উৎসর্গ করে অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বশ করার চেষ্টা করতো। এদের জাদু চর্চায় স্থূল যৌনাচারের বিধির প্রচলনও ছিল।
ভারতবর্ষের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে মৃতের আত্মার সহযোগে জাদুবিদ্যা সম্পর্কে প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়। এমনকি এ অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতা হরপ্পা মহেঞ্জোদারো থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্বে জাদুবিদ্যার নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা।
চীনাদের বিশ্বাস মতে, তাদের অপদেবতা ‘শা’ সরলরেখা বরাবর চলে, তাই তাকে প্রতিহত করতে স্থাপত্যে কোণগুলো বাঁকা করে নির্মাণ করে। কনফুসিয়াসের ‘আই চিং’ মতাদর্শও প্রধানত ভবিষ্যৎ গণনার জন্যই নির্দিষ্ট ছিল।
জাপানের প্রাচীন শিন্টো ধর্মেও জাদুবিদ্যা চর্চার কথা জানা যায়। তারা বিশ্বাস করে, চালের মধ্যে কালা জাদু প্রতিহত করার বিশেষ শক্তি আছে।
এছাড়া পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে থাকা আদিবাসীগোষ্ঠীদের মধ্যে মৃতের আত্মার মাধ্যমে জাদুবিদ্যা চর্চার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। স্বপ্নব্যাখ্যাও প্রাচীন জাদুবিদ্যার অঙ্গরূপে স্বীকৃতি পেয়েছিল।
প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সভ্যতায় মানুষের জীবন ও কল্পনায় জাদুবিদ্যা প্রভাব বিস্তার করতে থাকলেও মধ্যযুগে এসে এটা দানবীয় রূপ ধারণ করে। আর জাদুবিদ্যার পরিবর্তীত রূপে শয়তান চর্চা বেশির ভাগ দেশেই পূর্ণতা পায়।
কালা জাদুতে প্রতীক ও সংকেত চিহ্ন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সকল মতের কালা জাদুতেই এর ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার দেখা যায়। তবে অনেক বিশ্বাসেই দুষ্টআত্মার প্রতীক হলো ‘শিং’ এর ব্যবহার দেখা যায়। সেকারণেই হয়তো কালা জাদু চর্চায় শিং-এর ব্যবহার প্রায় পৃথিবীর সকল অঞ্চলেই দেখা যায়।
…………………………………..
সূত্র:
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া
…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২
চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চোদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১
চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি