-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
‘পরকাল: দুই’
ইহুদি ধর্মে পরকাল
পরাকাল সম্পর্কে অন্যান্য বিশ্বাসের মতো ইহুদি ধর্মেও আছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী। ইহুদি ধর্মে শেষ বিচারের ধারণা নিয়ে ভিন্ন মত প্রচলিত। অনেকের ধারণা, এটি এমন একটি দিন যেদিন সমস্ত মৃত লোককে পুনরুত্থিত করা হবে। অনেকে মনে করে, এই বিচার মৃত্যুর সময়ই হয়ে যায়। অনেকে এটাও মনে করেন, এই শেষবিচার শুধুমাত্র অ-ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য কিন্তু ইহুদিদের জন্য নয়।
“যা মানবপুত্রদের সাথে ঘটে তা পশুদের সাথেও ঘটে; তাদের সকলের বেলায় একই ব্যাপার ঘটে। …কে বলতে পারে যে মানুষের আত্মা উপরের দিকে যাবে আর পশুর আত্মা মাটির নিচে যাবে?” (একলেসিয়াসতেস ৩:১৯-২১)
“কিন্তু যিনি জীবিতদের মধ্যে অংশগ্রহণ করে তার আশা আছে। …জীবিতরা জানে যে তিনি একদিন মারা যাবে; কিন্তু মৃতরা কিছুই জানে না, তাদের আর কোন পুরস্কার বা স্মৃতি কিছুই নেই। ভালবাসা, ঘৃণা, হিংসা সব বিনষ্ট হয়ে যাবে; সূর্যের নিচে যা যা করেছে তারা তা আর কিছুই করতে পারবে না।” (একলেসিয়াসতেস ৯:৪-৬)
বুক অব জবে বলা হয়েছে, “মানুষ মারা যায় এবং শায়িত হয়; যদি সে শ্বাস-প্রশ্বাস না নেয় তাহলে সে কোথায়?… যতক্ষণ পর্যন্ত স্বর্গ থাকবে না তারা জাগবেও না, ঘুম থেকেও উঠবে না… যদি একজন মানুষ মারা যায়, সে কি আবার জীবিত হবে?” (জব ১৪:১০, ১২, ১৪এ)
ওলাম হাবা:
বেশিভাগ মানুষই ওলাম হাবায় প্রবেশ করতে পারবে না। তারা তাদের পার্থিব জীবন পর্যালোচনার জন্য একটি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাবে। শুধু পাপমুক্ত জীবনযাপনকারীরা তৎক্ষণাৎ ওলাম হাবায় প্রবেশ করতে পারবে।
ইহুদি ধর্মগ্রন্থ জোহর অনুসারে গেহেনা বা নরক পাপাত্মাদের শাস্তির জায়গা নয়, এটা আত্মার শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার স্থান। এই সময়কাল শেষে, যা এক বছরের বেশি নয়, আত্মা ওলাম হাবায় প্রবেশ করে। চিরস্থায়ী নরকভোগের কথা তাদের মতবাদে নেই।
ইমাকে পৃথিবী শাসন করা প্রথম রাজা এবং প্রথম মৃত বলে বিশ্বাস করা হয়। ইমার রাজ্যে আত্মারা ছায়াময় অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে এবং তারা পৃথিবীতে জীবিত নিজেদের বংশধরের উপর নির্ভরশীল। বংশধরদের পৃথিবীতে করা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পূর্বপুরুষ আত্মার ক্ষুধা ও বস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে হয়।
জরাথুস্ট্রবাদে পরকাল
জরাথুস্ট্রবাদ বলে, মৃতের আত্মা নিচের দিকে ইমারের শাসিত মৃতের রাজ্যে যাবার আগে পৃথিবীতে তিন দিন অবস্থান করে সেখানে বিশ্রাম নেয়। সৎ আত্মা তার দেহের মাথার কাছে বসে আনন্দের সাথে উস্তাভইতি গাথাসের ভজন করে। আর মন্দ আত্মা পায়ের কাছে বসে দুঃখপ্রকাশ করে এবং ইয়াসনার ভজন করে।
সৎ আত্মার জন্য সুন্দরী কুমারী আবির্ভূত হয়। যা উত্তম চিন্তা, কাজ এবং বাক্যের রূপ। মন্দ আত্মার বেলায় বৃদ্ধ, কুৎসিত ও নগ্ন ডাইনি আবির্ভূত হয়। তিন রাতের পর মন্দ আত্মাকে ভিজারেসা নামের দৈত্য চিনভৎ সেতুতে নিয়ে যায়। যা অন্ধকারে (নরক) যাবার জন্য নির্মিত।
তিনদিনের প্রথম দিনে যে অনুষ্ঠানগুলো করা হয় সেগুলো অত্যাবশ্যকীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেগুলো আত্মাকে মন্দ ক্ষমতার হাত থেকে রক্ষা করে এবং এটা পরকালে যেতে শক্তি দান করে। তিনদিন পর আত্মা চিনভৎ সেতু পাড়ি দেবে। যা আত্মার শেষ বিচার।
রাশনু ও স্রাওশা শেষ বিচারের সময় উপস্থিত থাকবে। উপস্থিতদের তালিকা কখনও কখনও বর্ধিত হয় এবং এখানে ভাহমান, অরমাজদও থাকে। রাশনু হল ইয়াজাতা, যিনি ন্যায়ের দাঁড়িপাল্লা ধরে থকেন। দাঁড়িপাল্লায় যদি ভাল থেকে মন্দ কাজের চেয়ে ভারি হয় তাহলে আত্মা স্বর্গে যাওয়ার উপযুক্ত হবে। যদি খারাপ কাজ ভাল কাজের চেয়ে ভারি হয় তাহলে সেতুটি সরু হতে হতে একটি কিনারার সমান হবে এবং একটি বিকট ডাইনি আত্মাকে হাত দিয়ে টেনে নিচে নরকে নিয়ে যাবে।
মিসভান গাতু হল ‘মিশ্রিতদের স্থান’ যেখানে আত্মারা ধূসর অস্তিত্ব নিয়ে থাকে এবং কোন আনন্দ ও বেদনা থাকেনা। একটি আত্মা সেখানে যায় যদি রাশনুর দাঁড়িপাল্লায় তার ভাল কাজ ও খারাপ কাজের ভর সমান হয়।
ইমাকে পৃথিবী শাসন করা প্রথম রাজা এবং প্রথম মৃত বলে বিশ্বাস করা হয়। ইমার রাজ্যে আত্মারা ছায়াময় অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে এবং তারা পৃথিবীতে জীবিত নিজেদের বংশধরের উপর নির্ভরশীল। বংশধরদের পৃথিবীতে করা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পূর্বপুরুষ আত্মার ক্ষুধা ও বস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে হয়।
বাহাই ধর্মে পরকাল
বাব (আলি মুহাম্মদ সিরাজী) ও বাহাউল্লাহ-র মতে, ঈশ্বরের একটিই মাত্র ধর্ম। ঈশ্বর ও মানবজাতির মধ্যে সম্পর্ককে নতুন করে স্থাপন করতে সেখানে হাজার বছর পর একজন করে সংবাদবাহক আসে। প্রত্যেকবার সেই সংবাদবাহক বা ঈশ্বর ঠিক করেন বিচার দিবস কবে ঘটবে।
বাহাই ধর্ম মতে, পরকালের প্রকৃতি জীবিতদের বোঝার ঊর্ধ্বে। ঠিক যেমন জন্মগ্রহণ করেনি এমন ভ্রূণ মাতৃগর্ভের বাইরের জগৎ সম্পর্কে বুঝতে পারে না। …আত্মা অমর এবং মৃত্যুর পর স্রষ্টার উপস্থিতি অর্জন করার আগ পর্যন্ত এটি উন্নয়ন করা শুরু করবে। …পরকালে আত্মা নিজ সত্তা ধরে রাখে এবং তারা অন্যান্য আত্মাকে চিনতে এবং কথা বলতে পারে।
…আত্মা আর পরকালের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। আত্মারা নিজ কর্মফল বুঝতে পারবে। অর্থাৎ যারা স্রষ্টার পথে চলেছে তারা আনন্দ উপভোগ করবে। আর যারা ভুল পথে চলেছে তারা বুঝতে পারবে তাদের দেয়া সুযোগ হারিয়েছে। …আত্মারা সেইসব আত্মাকে চিনতে বা বুঝতে পারবে যারা তাদের সাথে একই উচ্চতায় পৌঁছেছে।
শিখ ধর্মে পরকাল
গ্রন্থ সাহিব ও দশম গ্রন্থে পরকালের অনেক ঘটনায় স্বর্গ-নরকের অস্তিত্বের কথা সূক্ষ্মভাবে বলা আছে। স্বর্গ-নরক পুরস্কৃত করতে ও শাস্তি দিতে তৈরি করা হয়েছে। পুরস্কার বা শাস্তি লাভ শেষে আবার জন্ম নিতে হবে। স্রষ্টার সাথে যুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে এই জন্মমৃত্যুর চক্রের মধ্যেই থাকতে হবে। তবে এর দ্বিমতও আছে শিখ ধর্মে।
উইক্কা মতে পরকাল
উইক্কাদের পরকালকে সাধারণভাবে দ্য সামারল্যান্ড হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এখানে আত্মা বিশ্রাম নেয়, জীবন থেকে পুনরুদ্ধৃত হয় এবং জীবদ্দশায় থাকার সময় তার অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটায়। বিশ্রামের একটা সময় শেষে, আত্মা পুনর্জন্ম লাভ করে, এবং গতজন্মের সব স্মৃতি এসময় মুছে যায়।
শিন্তৌ ধর্মে পরকাল
প্রাচীন জাপানী কিংবদন্তী অনুসারে, মৃতরা ইয়মি নামের একটা তমসাচ্ছন্ন পাতাল জগতে প্রবেশ করে। ইজানামি (শিনিগামি) কিংবদন্তী অনুসারে, সেখানে একটি নদী আছে যা জীবিতদেরকে মৃতের থেকে পৃথক করে। শিন্তৌ ধর্মে মৃত্যু এবং মৃতদেহকে কেগারে নামক দূষণের উৎস্য এবং স্বর্গীয়মাত্রায় মহিমান্বিত করার পথ হিসেবেও ধরা হয়।
ব্রাহ্মসমাজ মতাদর্শে পরকাল
ব্রাহ্ম মতাদর্শে বলা হয়েছে, দেহের মৃত্যুতে আমি বিনষ্ট হইব না, এ জ্ঞানই পরকালের বিশ্বাসের মূল। আত্মা অমর। আত্মার আকাঙ্ক্ষা অসীম, উন্নতির আদর্শ অনন্ত। সে আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শ ইহজীবনে সমগ্রভাবে পূর্ণ হয় না। মানবের এই অনন্ত আদর্শ ও আকাঙ্ক্ষা হইতেই জানা যায় যে পরকাল আছে। স্বয়ং ঈশ্বর মানবাত্মাতে এইরূপ প্রকৃতি ও আশা রোপন করিয়াছেন। তিনি আমাদিগকে যে আশা প্রদান করিয়াছেন, নিশ্চয়ই তাহা পূর্ণ হইবার ব্যবস্থাও করিয়াছেন।
পাপ ও পুণ্যের দণ্ড ও পুরস্কার মানুষ আকাঙ্ক্ষা করে। তাহা এই জীবনে পূর্ণ হয় না। পৃথিবীতে অনেক পাপের উপযুক্ত দণ্ড ও সংশোধন হয় না ; আবার অনেক পুণ্য কর্ম্মের উপযুক্ত পুরস্কার এবং তাহার পরে আকাঙ্ক্ষিত পরিমাণে উন্নতি লাভ সম্ভব হয় না। এই পার্থিব জীবনে আমাদের জানিবার আকাঙ্ক্ষা, ভালবাসিবার আকাঙ্ক্ষা ও পবিত্রতা লাভের আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না। এই জন্য আমরা বিশ্বাস করি যে, নির্দিষ্ট কাল পৃথিবীতে বাস করিয়াই আত্মার শেষ হয় না।
স্বাভাবিকভাবে মৃতদের স্থান হতো উত্তরে। সেখানে আটটি বাঁধা অতিক্রম করে নবম স্তরে পৌঁছাতে পারলে আত্মা চির শান্তিতে থাকার অনুমতি পেত। কুষ্ঠ রোগ, বজ্রপাত বা পানিতে ডুবো মৃতদের স্থান হতো দক্ষিণে। আহার-বিহারে তার হতো স্বয়ংসম্পূর্ণ।
দেহান্তে আত্মা কি ভাবে থাকিবে, সে প্রশ্নের দেওয়া অসম্ভব। ঈশ্বরের আশ্রয়ে আত্মা থাকিবে। তিনি কি ভাবে রাখিবেন, তাহার কল্পনা করিয়া ফল কি? তিনি যে প্রকারে রাখিয়া আত্মার কল্যাণ ও উন্নতি সাধন করিতে ইচ্ছা করেন, সেভাবেই তাহাকে রাখিবেন। সে সম্বন্ধে কোনপ্রকার কল্পনা করিতে গেলে ভ্রমে পড়িবারই সম্ভাবনা অধিক।
মেসোপটেমী সভ্যতায় পরকাল
মেসোপটেমিয়ার সভ্যতায় বিশ্বাস করা হতো মৃত্যুর পর মানুষ পাতালপুরী ফিরে যায়। যাওয়ার সময় দেহের অমর একটি অংশ প্রেতাত্মা হয়ে মাটিতে কিছু সময় অবস্থান করে। এরপর পিশাচে পূর্ণ অঞ্চল অতিক্রম করে খুবার নদীর তীরে পৌঁছায়। সেখানে সিলুশি নামের আত্মা নদী পেরোতে সাহায্য করে। এরপর পাতালপুরীর প্রহরী বিদুর অনুমতি নিয়ে একে একে সাতটি দরজা পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় পাতালপুরীতে।
পাতালপুরীতে বিচারের পর মৃতের গুণাবলী ও সৎকার সঠিকমতো হয়েছে কিনা তার ভিত্তিতে স্বর্গ-নরক নির্ধারিত হতো। সেটাই আত্মার চির আবাস।
অ্যাজটেক সভ্যতায় পরকাল
মেসোআমেরিকার অ্যাজটেক সভ্যতায় মৃত্যু কিভাবে হয়েছে সেটার ভিত্তিতে পরকাল নির্দিষ্ট হয় বলে ভাবা হতো। সে হিসেবে সন্তান জন্মদানের সময় মৃত নারীর পরকালে স্থান হতো পাতালপুরীর পূর্বদিকে। তাদের কাজ হতো পাতালপুরী থেকে প্রতিদিন সূর্যের উদয়ে সাহায্য করা। তাদের বিশ্বাস ছিল সূর্য অস্ত গেলে আর কখনোই উদীত না হতেও পারে। তাই সূর্য উদয়ে সাহায্য ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাভাবিকভাবে মৃতদের স্থান হতো উত্তরে। সেখানে আটটি বাঁধা অতিক্রম করে নবম স্তরে পৌঁছাতে পারলে আত্মা চির শান্তিতে থাকার অনুমতি পেত। কুষ্ঠ রোগ, বজ্রপাত বা পানিতে ডুবো মৃতদের স্থান হতো দক্ষিণে। আহার-বিহারে তার হতো স্বয়ংসম্পূর্ণ।
আর মৃত যোদ্ধাদের স্থান হতো পশ্চিমে। সেখানে স্রষ্টার সাথে মিলিত হয়ে অশুভ শক্তির সাথে লড়াই করে তারা সূর্য উদয় হওয়া নিশ্চিত করতো। চার বছর পর যোদ্ধারা পৃথিবীতে হামিংবার্ডের বেশে আবারো ফিরে আসতে পারতো।
মাওরি সভ্যতা পরকাল
নিউজিল্যান্ডে বসতি স্থাপনকারী মাওরি অধিবাসীরা বিশ্বাস করতো, মৃতের আত্মা হেঁটে হেঁটে উত্তরের শেষ অংশে কেপ রাইঙ্গা নামক স্থানে পৌঁছে পহুথুকাওয়া নামক একটি গাছ বেয়ে সমুদ্রে দিয়ে পাতালপুরীতে পূর্বপুরুষদের সাথে যোগ দেয়। সঠিক পদ্ধতিতে এই গাছ বেয়ে না নামতে পারলে জীবিত আত্মীয়-স্বজনকে দুর্যোগ পোহাতে হতো বলেও বিশ্বাস ছিল।
পাতালপুরী বিভিন্ন দেবতাদের শাসিত বেশ কিছু অঞ্চলে বিভক্ত থাকতো। সেখানে জীবদ্দশায় কৃতকর্মের কোনো বিচার বা শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো না আত্মাকে।
ভাইকিংদের পরকাল বিশ্বাস
ভাইকিংদের বিশ্বাস ছিল, মৃত ভাইকিং যোদ্ধারা ঢালের নির্মিত ছাদ বিশিষ্ট বিশাল ভালহাল্লা নামের প্রাসাদে প্রবেশ করে। এর পাহারায় থাকতো নেকড়ে আর ঈগল। শুধু যুদ্ধের ময়দানে মৃত যোদ্ধারাই এ সৌভাগ্য লাভ করতো।
দেবতা ওডিন অভিনন্দন জানিয়ে মৃত যোদ্ধাকে মধু ও পানির গাজন থেকে তৈরি বিশেষ প্রকারের পানীয় পান করাতেন। সেখানে যোদ্ধারা প্রতিদিন সদ্য জবাই করা শূকরের মাংস ও উত্তেজক পানীয় পানের সুযোগ পেত।
তাদের বিশ্বাস ছিল, মানুষের হৃদয়ে তার সকল কার্যাবলী লিপিবদ্ধ থাকে। সেজন্য মৃতের হৃদয়কে শু (সত্য ও ন্যায়বিচারের দেবী মা’আত) পালকের বিপরীতে দাড়িপাল্লায় ওজন করা হতো। যদি হৃদয় পালকের চেয়ে হালকা হতো তাহলে ফিল্ড অব অরুতে যাওয়ার অনুমতি পেত আত্মা। যদি ভারি হতো তাহলে আম্মিত নামক দৈত্যের খাবারে পরিণত হতে হতো।
পৃথিবীর শেষদিনে হতে যাওয়া যুদ্ধ র্যাগনারকের প্রস্তুতি হিসেবে সেখানে যোদ্ধারা নিজেদের মাঝে সবসময় যুদ্ধে রত থাকতো। র্যাগনারকের দিন ভালহাল্লার ৫৪০টি দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসবে বীর যোদ্ধারা, দেবতা ওডিনের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবে নর্স মিথলজির নেকড়ে দেবতা লোকীর পুত্র ফেন্রিরের সাথে, এমনি বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। যুদ্ধে কোনো সাহসী যোদ্ধা শহীদ হলে ভাইকিংরা ভাবতো র্যাগনারকের যুদ্ধের জন্য ওডিনের আরো একজন সাহসী যোদ্ধার প্রয়োজন।
যে সকল মৃত যোদ্ধারা ভালহাল্লায় যাবার সৌভাগ্য অর্জন করতো না। তারা দেবী ফ্রেয়ার শাসনাধীন ফোকভ্যাংর নামক স্থানে প্রবেশ করতো। সেখানে তারা গল্পগুজব করে সময় কাটাতো। এমনকি অবিবাহিত অবস্থায় মৃত নারীদের সঙ্গিনী হিসাবেও পেত।
সমুদ্রে ডুবে মৃত যোদ্ধদের আশ্রয় হতো সমুদ্র দেবতা এজিরের প্রাসাদে। অসৎরা মৃত্যুর পর প্রবেশ করতো বিষধর সাপের আখড়ায়। অসুস্থ বা বৃদ্ধ বয়সে মৃতরা সবচেয়ে নিম্নস্তরে প্রবেশ করতো।
প্রাচীন মিশরীয় ধর্মে পরকাল
সম্ভবত মিশরীয় ধর্মের লেখনিই ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত পরকাল সম্পর্কিত ধারণা। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল ধর্মের ভিত্তিতে। মৃত্যুর পর আত্মার কা (দ্বিতীয় দেহ) এবং বা (আত্মা) মৃতের রাজ্যে ফিল্ড অব অরু নামক স্থানে অবস্থান করে বলে তাদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল।
মৃত্যুর পর ‘বা’কে দেব-দেবীদের পাহারা দেয়া অনেকগুলো গেট পেরিয়ে এই ফিল্ড অব অরুতে প্রবেশ করতে হতো। সেই রাজ্যের শেষ প্রান্তে থাকেন পাতালপুরীর দেবতা ওসাইরিস। রাজ্যজুড়ে আরো ৪২ জন দেবতা থাকার কথাও উল্লেখ পাওয়া যায়। আত্মাদের প্রত্যেক দেবদেবীর কাছে নিজ নিজ কৃতকর্মের হিসেব দেয়ার বিধান ছিল।
তাদের বিশ্বাস ছিল, মানুষের হৃদয়ে তার সকল কার্যাবলী লিপিবদ্ধ থাকে। সেজন্য মৃতের হৃদয়কে শু (সত্য ও ন্যায়বিচারের দেবী মা’আত) পালকের বিপরীতে দাড়িপাল্লায় ওজন করা হতো। যদি হৃদয় পালকের চেয়ে হালকা হতো তাহলে ফিল্ড অব অরুতে যাওয়ার অনুমতি পেত আত্মা। যদি ভারি হতো তাহলে আম্মিত নামক দৈত্যের খাবারে পরিণত হতে হতো।
তাদের ধারণায়- মৃত্যু একটি অস্থায়ী বাঁধা, পূর্ণসমাপ্তি নয়। চিরকালব্যাপী জীবন কেবল, দেবদেবীদের করুণা লাভ, মোমিকরার মাধ্যমে দেহের সংরক্ষণ এবং মূর্তি তৈরি ও অন্তেষ্টিক্রিয়ার আচার যথাযথভাবে পালনের উপর নির্ভর করে। পরকালকে উপভোগ করতে হলে তাই এই সবগুলো অংশকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা জরুরী।
যারা সমানভাবে ভাল ও মন্দ কাজ করে বা জীবনে যারা অমীমাংসিত ছিল। যাদের বিচার করা হয় নি তাদের জন্য এসফোডেল। ফিল্ড অব পানিশমেন্ট তাদের জন্য যারা প্রায়ই পাপ করে কিন্তু টারটারাস আশা করে না।
যদি মৃতদেহকে সারকোফেগাসে (প্রাচীন মিশরীয়দের কফিন) রেখে যথাযথভাবে পচনরোধক মাখানো হয় এবং মন্দিরে সমাধিস্থ করা হয়। তাহলেই পরোলোক প্রাপ্তি ঘটবে এবং সূর্যের সাথে ফিল্ড অব অরুতে প্রতিদিনের ভ্রমণে যোগ দিতে পারবে। এই বিশ্বাস থেকেই তারা মৃত্যু পরবর্তী সকল ক্রিয়া অতি সতর্কতা ও গুরুত্বের সাথে পালন করতো।
প্রাচীন গ্রীক ও রোমান ধর্মে পরকাল
মৃতরা পাতালপুরীর যেখানে অবস্থান করে গ্রিক পুরাণে তার দেবতার নাম হেডিস। মৃত্যুর পর মৃতের আত্মাকে পাতালপুরীর জীবন ও মৃত্যুর মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া স্টিক্স নদীর তীরে নিয়ে যেত বার্তাবাহক গ্রীক দেব হার্মিস।
সমাধিস্থ করার সময় যে মৃতের জিভের নিচে স্বর্ণমুদ্রা রাখা হতো, সে আত্মাকে ক্যারন মাঝি নদী পাড় করে হেডিসের কাছে নিয়ে যেত। সেখানে বিশাল বড় তিন মাথাওয়ালা সেরবেরাস কুকুরকে পার করে প্রবেশ করতে হতো পাতালপুরীতে।
পাতালপুরীতে একাস, রাডামেন্থাস ও মিনোস দেবতা আত্মার বিচার করে পুরস্কার বা শাস্তি অনুযায়ী এলিসিয়াম, টারটারাস, এসফোডেল ক্ষেত্র ও ফিল্ড অব পানিশমেন্টে পাঠানোর নির্দেশ দিতো।
যারা পবিত্র জীবনযাপন করে তাদের জন্য এলিসিয়াম। এর সর্বত্র সবুজ মাঠ, উপত্যকা আর পর্বতমালায় সুশোভিত। সূর্য সবসময় এখানে কিরণ দেয়। সকলে এখানে অনন্ত সুখে শান্তিতে থাকবে।
যারা দেবতাদের নিন্দা করে, বিদ্রোহ করে ও জেনে বুঝে খারাপ কাজ করে তাদের জন্য নির্দিষ্ট টারটারাস। টারটারাসে আত্মাকে লাভায় পুড়িয়ে বা র্যাকে টেনে কষ্ট দেয়া হবে।
যারা সমানভাবে ভাল ও মন্দ কাজ করে বা জীবনে যারা অমীমাংসিত ছিল। যাদের বিচার করা হয় নি তাদের জন্য এসফোডেল। ফিল্ড অব পানিশমেন্ট তাদের জন্য যারা প্রায়ই পাপ করে কিন্তু টারটারাস আশা করে না।
যাদের মুখে নদী পারাপারের ভাড়া বাবদ স্বর্ণমুদ্রা থাকতো না। তাদের পৃথিবী ও পাতালপুরীর মধ্যবর্তী স্থানে নির্যাতিত অবস্থায় দিন কাটাতে হতো।
পরকাল বিষয়ে রোমানদের বিশ্বাসও অনেকটা একইরকম। তাদের পুরাণে হেডিস দেবতা প্লুটো নামে পরিচিত।
নর্স ধর্মে পরকাল
নর্সদের পরকাল সম্পর্কিত ধারণা ছিল, যুদ্ধে শহীদদের অর্ধেক, ভালহালার দেবতা ওডিনের সৈন্যদলে যোগ দেয়। শহীদদের বাকি অর্ধেক, দেবী ফ্রেইয়ার সৈন্যদলে যোগ দিয়ে বিস্তীর্ণ তৃণভূমি ফকভ্যাংগারে বাস করে। আর যারা খুব ভাল বা খুব খারাপ কোনটাই না তারা হেল-এ অবস্থান করে। যারা শপথ ভঙ্গ করে এবং দুষ্কার্য করে তারা নিফলহেলে কঠোর শাস্তি ভোগ করে।
আধ্যাত্মবাদে পরকাল
আধ্যাত্মবাদী এডগার কেসের মতে, পরকাল নয়টি জগৎ নিয়ে গঠিত যা জ্যোতিশাস্ত্রের নয়টি গ্রহকে ইঙ্গিত করে। প্রথমটি শনি গ্রহের প্রতীকস্বরূপ, এটি আত্মার শুদ্ধিকরণের একটি স্তর। দ্বিতীয়টি বুধ যা সমস্যাকে বুঝতে পারার ক্ষমতা দান করে। তৃতীয়টি পৃথিবী যা পার্থিব সন্তুষ্টির সাথে সম্পর্কযুক্ত। চতুর্থটি শুক্র যেখানে ভালবাসা খুঁজে পাওয়া যায়। পঞ্চমটি মঙ্গল গ্রহ যেখানে সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানা জায়।
ষষ্ঠটি নেপচুন এখানে সৃজনশীলতা ব্যবহার করতে এবং বস্তুজগৎ থেকে মুক্ত করতে শেখা যায়। সপ্তমটি বৃহস্পতি যা আত্মার কার্যকারিতাকে বৃদ্ধি করে যার ফলে আত্মা কোন অবস্থাকে বুঝতে পারে, মানুষ, স্থান, বস্তু এবং অবস্থা বিশ্লেষণ করতে পারে। অষ্টম পরকালের রাজ্য ইউরেনাস, এটা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। নবমটি প্লুটো যা অচেতনদের জ্যোতিশাস্ত্রীয় রাজ্য।
এই পরকালের জগৎ একটি খণস্থায়ী স্থান যেখানে আত্মারা সৌরজগতের অন্য জগৎগুলোতে ভ্রমণ করতে পারে। এটা আত্মার চিরকালীন স্বাধীনতা, এবং এই জগৎ আমাদের সৌরজগৎ থেকে মহাজগতের দিকে দরজা খুলে দেয়।
সুফি স্কলার ইবনে আরাবি বলেছেন, এটা দেহের জগৎ এবং আত্মার জগতের মধ্যবর্তী অবস্থা। এটা ছাড়া দুই জগতের মধ্যে সংযোগ থাকবে না এবং দুই জগতের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। তিনি এই মধ্যবর্তী জগৎকে আত্মার জগতের মতই সরল এবং আলোকিত হিসেবে বর্ণনা করেছে।
দার্শনিক মতবাদে পরকাল
সক্রেটিসের মতে, মৃত্যু হয় একটি স্বপ্নহীন চিরস্থায়ী ঘুম, নয়তো আরেকটি নতুন জীবনের শুরু। …কর্মবহুল জীবনের পর বিশ্রাম অনেকটা প্রয়োজনই।
সক্রেটিসের কল্পিত এই পরকালের নাম ছিল হেডিস। সে জগতটা অনেকটা এথেন্সের মতই। সেখানে মানুষ বাস করবে শুধুই মন হিসেবে; দেহের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কারণ দেহের তো পৃথিবীতেই পড়ে থাকবে। দেহ একটা উটকো ঝামেলা। একে খাওয়াতে হয়, ঘুম পাড়াতে হয়, কত কিছু দিতে হয়! তাই দেহহীন পরকালে সক্রেটিস ইতিহাসের সেরা সেরা চিন্তাবিদদের সাথে দার্শনিক আড্ডায় মজে থাকার স্বপ্ন দেখতেন।
পরকাল সম্পর্কে বিজ্ঞান
মহাকাশ বিজ্ঞানী ও পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং ব্রিটেনের দৈনিক গার্ডিয়ানকে সাক্ষাৎকারে বলেন, “মানুষের মস্তিষ্ক শেষবারের মতো মিট মিট করে সাড়া দেওয়ার পর আর কিছুই থাকে না।
আমি মস্তিষ্ককে কম্পিউটার হিসেবে বিবেচনা করি। এর উপাদানগুলো ব্যর্থ হলে এটা কাজ করা থামিয়ে দেবে। এই কম্পিউটার ভেঙে গেলে আর স্বর্গ বা পরকাল বলে কিছুই থাকে না। অন্ধকারের ভয়ে ভীত মানুষের জন্য এটা রূপকথার গল্প।
প্রাথমিক অবস্থায় মহাবিশ্বের কোয়ান্টামের অত্যল্প আলোড়নে গ্যালাক্সি, তারকা ও মানবজাতির উৎপত্তি হয়েছে। বিজ্ঞানের অনুমানে বিভিন্ন ধরনের মহাবিশ্ব স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকবে, কোনো কারণ ছাড়াই। আর এই সম্ভাবনার মধ্যে আমরা আছি।
আধুনিক মহাকাশসংক্রান্ত্র বিভিন্ন যন্ত্রে মহাবিশ্বের প্রাথমিক মুহূর্তগুলোর প্রাচীন আলো সনাক্ত করা সম্ভব এবং মহাশূন্যে আমাদের জায়গা কিভাবে এলো তাও বের করা যাবে।”
অন্যদিকে আমেরিকাভিত্তিক বিজ্ঞানী সংস্থা ‘নাসা’ বলে, “এই সুবিশাল মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষ আদতে খুব অল্পই জানতে পেরেছে। সমগ্র মহাবিশ্বের তুলনায় মানুষের জানার পরিমাণ অত্যন্ত ক্ষুদ্র। নাসা জানাচ্ছে, এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষ এখন পর্যন্ত কেবল ৫% জানতে পেরেছে। বাকি ৯৫% সম্পর্কে মানুষ কিছু জানে না।”
পরকাল বিষয়ে মানুষের এই নানাবিধ ভাবনা নিছক কল্পনা নাকি বাস্তব তা প্রমাণ করা অসম্ভব। সে তর্কে-বিতর্কের কুতর্কে না যেয়ে মানুষ যুগে যুগে পরকাল সম্পর্কে কি কি ভেবেছে তার কিঞ্চিৎ জেনে নেয়াই এই লেখার উদ্দেশ্য; যাতে জন্মান্তরকে বুঝতে একটু হলেও সহজ হয়।
তবে এই তর্ক-বিতর্ক-কুতর্ক ছাপিয়ে পরকাল নিয়ে ফকিরকুলের শিরোমণি ফকির লালন সাঁইজি গেয়ে উঠেন-
সহজ মানুষ ভজে দেখ নারে মন দিব্যজ্ঞানে।
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।।
ভজ মানুষের চরণ দুটি
নিত্য বস্তু হবে খাঁটি,
মরিলে সব হবে মাটি
ত্বরায় এই ভেদ লও জেনে।।
মলে পাবে বেহেস্তখানা
তা শুনে ত মন মানে না,
বাকির লোভে নগদ পাওনা
কে ছাড়ে এই ভুবনে।।
আসসালাতুল মেরাজুল মোমেনিনা
জানো সেই নামাজের বেনা,
বিশ্বাসীদের দেখাশোনা
লালন কয় এই জীবনে।।
(চলবে…)
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………………..
সূত্র:
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া
…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২
চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চৌদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১
চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি