জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-১
-রব নেওয়াজ খোকন
প্রাককথন:
জীবন ও জগতের রহস্য-ভিত্তিক বিষয়াবলি যেমন- জীবনের উৎস-পরিণতি, জীবনের সাথে জগতের সম্পর্ক-তাৎপর্য প্রভৃতির সার্থক সমাধান পাবার অদম্য ইচ্ছা থেকে সৃষ্টি দর্শনের। সৃষ্টি ধর্মেরও। বিজ্ঞানও কখনো কখনো তার বস্তুগত ভাবনার দেয়াল টপকে এ অভিযানে শরিক হয়েছে। অভিযানে অর্জিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে প্রতিটি জ্ঞানকোষ থেকে এ ব্যাপারে সন্তোষজনক মতবাদ দেয়া হয়েছে।
যা কখনো আপেক্ষিক কখনো স্থিরসত্য হিসেবে মানুষের বিশ্বাসে জায়গা করে নিয়েছে। তবে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তিভেদে ভিন্নতার কারণে সবাই একসূত্রে, একক সিদ্ধান্তে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। ফলে ভিন্নমত, ভিন্নদর্শন কিংবা ভিন্নধর্মের ছায়ায় আলাদা আলাদা আশ্রয় হয়েছে মানুষের।
অভিন্ন মতের অনিশ্চয়তার কারণে দলগত বৈরিতাও কম তৈরি হয়নি। যে বৈরিতা যুগে যুগে জন্ম দিয়ে আসছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও যুদ্ধ-বিগ্রহের। সাম্প্রতিক বিশ্বের ধর্মীয় জঙ্গিবাদ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর জন্যে পারস্পরিক মতের অসহিষ্ণুতাই দায়ী। চিররহস্যের বৃত্তবন্দী জীবন ও জগত বিষয়ক তত্ত্বে, মত ও পথের ভিন্নতা থাকা সহজ-স্বাভাবিক বিষয়।
কিন্তু প্রজ্ঞার স্বল্পতা বা শূন্যতার কারণে দলবাজি, সাম্প্রদায়িক অসহযোগ, দাঙ্গা বা জীবন-বিনাশী কর্মকাণ্ড মানবজাতির জন্য লজ্জাকর। এ-লজ্জা সাম্প্রতিক বিশ্বের আন্তর্জাতিক লজ্জা হয়ে আজ মানব-সভ্যতার মাথা নুইয়ে দিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ দরকার। সেজন্য ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি তত্ত্বভিত্তিক জ্ঞানকোষ নিয়ে নিরপেক্ষ অধ্যয়ন একান্ত জরুরি।
প্রতিটি বিষয় থেকে অধিবিদ্যিক দর্শনের সার বা নির্যাস সংগ্রহ করে, স্বকীয় প্রজ্ঞার আলোকে বিশ্লেষণপূর্বক, নিজস্ব মতটিকে নির্ধারণ করা প্রত্যেকের জন্য যেমন মানবিক অধিকার, অপরের গৃহীত মতকেও গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া নৈতিক কর্তব্য।
সমাজ বা রাষ্ট্রের যেকোনো দর্শন ও বিজ্ঞানচেতা ব্যক্তিকে তার যৌক্তিক মতাদর্শ প্রচারে বিঘ্ন সৃষ্টি করা অন্যায়। তবে মতাদর্শটি হতে হবে মানব-মঙ্গল ও কল্যাণোপযোগী। কারণ মানবিক মূল্যবোধশূন্য দর্শন অথর্ব। যে অপদর্শনের অন্ধকার জাতিকে গ্রাস করার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বার্তা বহন করে, তাকে ঠেকানোও জরুরি।
তাঁরা এই দর্শনটিকে যুগে যুগে প্রচার ও প্রসারে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। দর্শন কোনো গণ্ডিবদ্ধ সুনিশ্চিত বিষয় না হওয়ায়, নানাজনের হাতে এসে নানারঙে রঙিন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। তবে মূল জায়গাটিতে প্রায় সবার চেতনাই এক ও অভিন্ন।
কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য, পাঠককে একটি নিরপেক্ষ মননের বার্তা দিয়ে মূলবিষয়ের দিকে এগিয়ে নেয়া। মরমীসাধক, বাউলকবি, লোকায়ত দর্শনের বলিষ্ঠ প্রবক্তা জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন আলোচনাই আমার মূলবিষয়। জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বসাধনার স্বরূপ জানতে তাঁর গীতিকাব্যিক সাহিত্যকে বিশ্লেষণের বিকল্প নেই। যেকোনো সাধকসত্তাকে জানতে তাঁর সৃষ্টিকর্মের বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
প্রাশ্চাত্য কিংবা বিশ্বদর্শনের আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে বাঙালি দর্শনের দাপট কোনো অংশে কম নয়। আর বাঙালি দর্শনের স্বকীয় ধারাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বাউলদর্শন। বাউলদর্শন মূলত লোকায়ত দর্শনের একটি পরিপূর্ণ আত্মপ্রকাশ। সাধক সিরাজ সাঁইজি থেকে ক্রমধারায় লালন সাঁইজি, হাসনরাজা, রশিদ উদ্দীন, জালাল উদ্দীন খাঁ, উকিল মুন্সী, রাধারমন, শাহ আব্দুল করিমসহ অসংখ্য গুণী সাধকের জন্ম এদেশে।
তাঁরা এই দর্শনটিকে যুগে যুগে প্রচার ও প্রসারে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। দর্শন কোনো গণ্ডিবদ্ধ সুনিশ্চিত বিষয় না হওয়ায়, নানাজনের হাতে এসে নানারঙে রঙিন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। তবে মূল জায়গাটিতে প্রায় সবার চেতনাই এক ও অভিন্ন।
বাউলদর্শনের কেন্দ্র হলো দেহ। দেহকে কেন্দ্র করে এর সকল ভাবনা আবর্তিত। কেননা আত্মা তার আশ্রয়স্থল হিসেবে দেহকে প্রাধান্য দেবে এটাই স্বাভাবিক। তাই কেউ কেউ একে দেহতাত্ত্বিক দর্শনও বলে থাকেন। সাধুজনদের মধ্যে বহুল প্রচলিত এর মূলবাণী হলো, ‘যা নেই ভাণ্ডে, তা নেই ব্রহ্মাণ্ডে’।
এর অর্থ বিশ্বজগত সৃষ্টির সকল প্রকার আদি উপকরণের লীলাভূমি ও সকল সমস্যার সমাধানকোষ হলো নিজসত্ত্বা। আর নিজসত্ত্বার আকারগত রূপ হল দেহ। এই দেহ বা আত্মকেন্দ্রিক নিবিড় ধ্যান ও একাগ্র সাধনার মাধ্যমে জৈবনিক রহস্য ও পরমসত্তার স্বরূপ উন্মোচন করা সম্ভব।
তবে সাধক জালাল উদ্দীন খাঁ বাউলদর্শনকে কেবল ‘দেহতত্ত্ব’ শিরোনামে প্রচার করেননি। তিনি তাঁর তত্ত্বদর্শনকে মোট ১৪টি ভাগে ভাগ করে ১৪টি অভিনব তত্ত্বে প্রকাশ করেছেন। বিভাগগুলো যথাক্রমে- ১.আত্মতত্ত্ব, ২.পরমতত্ত্ব, ৩. নিগুঢ়তত্ত্ব, ৪. দেহতত্ত্ব, ৫. সৃষ্টিতত্ত্ব, ৬. সংসারতত্ত্ব, ৭. সাধনতত্ত্ব, ৮. গুরুতত্ত্ব, ৯.প্রেমতত্ত্ব, ১০.মাতৃতত্ত্ব, ১১.লোকতত্ত্ব, ১২.দেশতত্ত্ব, ১৩.বিরহতত্ত্ব ও ১৪.ভাটিয়ালি।
ভারতীয় দর্শনের স্বজ্ঞাবাদ, প্রজ্ঞাবাদ, চার্বাকবাদ, মুসলিমদর্শনের জাবারিয়া, কাদেরিয়া, মোতাজিলা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মতবাদেরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে এ লোকায়ত মিশ্রদর্শনে। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ যেমন- আল-কুরআন, বেদ, ইঞ্জিল, তাওরাত, যাবুর ইত্যাদির প্রভাবতো রয়েছেই। তবে এর স্পষ্টত সাদৃশ্য লক্ষিত হয় সূফীবাদ ও বৈষ্ণববাদের সাথে।
উল্লেখিত তত্ত্বগুলোর আলোকে তাঁর তত্ত্বদর্শনের স্বরূপ পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ও সত্যতা নিরূপণ করাই আমার উদ্দেশ্য। প্রতিপর্বে গোটাকয়েক গুরুত্বপূর্ণ গান নিয়ে তাঁর দর্শনবোধের স্বরূপ আলোচনা করবো। যদিও তাঁর প্রতিটি গানেরই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ও অভিনব দিক রয়েছে। তাঁর দর্শনের পরিপূর্ণ অবয়ব অংকন প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া এটি ভাববাদ ও বস্তুবাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জটিলতর দর্শন। এ জটিলতার কারণ, তত্ত্ব ও তথ্যের বহুমুখিতা।
বাউলদর্শনে রয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যদর্শনের প্রভাব। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য- সক্রেটিস, এরিস্টটল, ইমানুয়েল কান্ট, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, আল-ফারাবি, আল-গাজ্জালি, মাওলানা রুমি, কবি ইকবালসহ অসংখ্য মনিষী কর্তৃক প্রচারিত মতবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব।
ভারতীয় দর্শনের স্বজ্ঞাবাদ, প্রজ্ঞাবাদ, চার্বাকবাদ, মুসলিমদর্শনের জাবারিয়া, কাদেরিয়া, মোতাজিলা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মতবাদেরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে এ লোকায়ত মিশ্রদর্শনে। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ যেমন- আল-কুরআন, বেদ, ইঞ্জিল, তাওরাত, যাবুর ইত্যাদির প্রভাবতো রয়েছেই। তবে এর স্পষ্টত সাদৃশ্য লক্ষিত হয় সূফীবাদ ও বৈষ্ণববাদের সাথে।
বাউল তাত্ত্বিক স্বজ্ঞাবাদের শিকড় অন্বেষণ করলে মুসলিমদর্শনের সূফীবাদ ও সনাতনদর্শনের বৈষ্ণববাদের প্রভাব এড়ানো সম্ভব নয়। তবুও বাউলদর্শন স্বকীয়তায় ভাস্বর। জগতের সকল ধর্মমতের মধ্যে যেমন সাদৃশ্য রয়েছে। সকল দর্শন বা কলায়ও রয়েছে সাদৃশ্য।
তা সত্ত্বেও সকল ধর্ম ও দর্শন এককভাবে স্বকীয়তার মর্যাদা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। বাউলদর্শনের মর্যাদাকে চুড়ান্ত যৌক্তিকতায় প্রতিষ্ঠার বাণী নিয়ে, বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আবির্ভাব সাধককবি জালাল উদ্দীন খাঁর। বিশ শতকের বিশ থেকে ষাটের দশক; প্রায় পঞ্চাশ বছর তিনি বাউলতত্ত্ব সাধনায় মশগুল ও মুখর ছিলেন।
(চলবে)
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-২>>
…………………………………………….
আরো পড়ুন-
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-১
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-২
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৩
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৪
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৫
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৬
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৭
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………..
আরও পড়ুন-
সাধক ভবা পাগলা
শাহ্ আব্দুল করিম : জীবনী ও গান
সাধক রাধারমণ দত্ত
মহর্ষি মনোমোহন ও মলয়া সঙ্গীত
মোহন চাঁন বাউল
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: এক
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: দুই
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: তিন