ভবঘুরেকথা
হাসন রাজা

হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: তিন

-জহির আহমেদ

এভাবেই হাসন রাজার মরমি জীবন ভাবনাগুলো সরল প্রাঞ্জল ভাষায় গান হয়ে বেড়িয়ে আসতে লাগলো। জমিদারি ও সংসারে থেকেও দোতারা হাতে, যে তাকে বাউল বানিয়েছে, সেই মহান মালিকের শানে গাইতে লাগলেন-

বাউলা কে বানাইলো রে হাসন রাজারে,
বাউলা কে বানাইলো রে।
বানাইলো বানাইলো বাউলা, তার নাম হইলো মওলা।
দেখিয়া তার রুপের ঝলক, হাসন রাজা হইলো আউলা।।

হাসন রাজা হইল পাগল প্রাণ বন্ধের কারণে।
বন্ধু বিনে হাসন রাজা অন্য নাহি মানে।।
হাসন রাজা গাইছে গান হাতে তালি দিয়া।
সাক্ষাতে দাঁড়াইয়া শোনে হাসান রাজার প্রিয়া।।

আল্লাহকে চিনলে বান্দার আর কিছুর দিকে মন টানে না। হাসন রাজা আল্লাকে চিনেছে। তাই তাঁর দিকেই ছুটে চলছে তার মনপ্রাণ-

আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে,
হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।।

হাসন রাজার গানে আত্ম উপলব্ধিজাত একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। কারো দেখানো পথে নয়, নিজের দর্শনেই তিনি বিশ্বজাহানের মালিককে দেখেছেন-

বিচার করি চাইয়া দেখি সকলেই আমি।
সোনা মামি! সোনা মামি গো! আমারে করিলায় বদনামি।।

আমি হইতে আল্লা রছুল, আমি হইতে কুল।
পাগলা হাছন রাজা বলে, তাতে নাই ভুল।।

আমা হইতে আসমান জমিন আমি হইতেই সব।
আমি হইতে ত্রিজগত, আমি হইতে সব।।..

আমি আউয়াল, আমি আখের জাহের বাতিন।
না বুঝিয়া দেশের লোকে, বাসে মোরে ভিন।।

হাসন রাজা সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারী ছিলেন। তিনিই বলেছেন-

“আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে,
হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।”

আরেক গানে তাঁর কন্ঠেই উচ্চারিত হয়েছে –

“আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,
আমি কি তোর যমকে ভয় করি।
শত যমকে তেড়ে দিব, সহায় শিবশঙ্করী।।”

তিনি রাধাকৃষ্ণ ও আল্লারাসুলকেও অবলীলায় মিলাতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন, যিনি কৃষ্ণের রাধা, তিনিই রাসুলের খোদা। নামেই কেবল ভিন্ন বা আলাদা।

আমি তোমার কাঙ্গালী গো সুন্দরী রাধা,
আমি তোমার কাঙ্গালী গো।
তোমার লাগিয়া কন্দিয়া ফিরে,
হাছন রাজা কাঙ্গালী গো।।..

হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা।
রাধা বলিয়া ডাকিলে, মুল্লা মুন্সিয়ে দেয় বাধা।।
হাছন রাজা বলে আমি, না রাখিব যুদা।
মুল্লা মুন্সির কথা যত সকলই বেহুদা।।

কে এই আমি? যে আমি থেকে রাধাকৃষ্ণ, আল্লারাসুল ও কুল মাখলুকাত। এই আমিই আদিসত্ত্বা বা আদিজাত, বাকি সব কেবল নাম ও সিফাত। পারিবারিক ও সামাজিক পরিচয়ে মানুষ একটি ধর্মসম্প্রদায়ে বাস করে। কিন্তু এক স্রষ্টার দিকে যারা মনোনিবেশ করেছেন, তাঁদের কোন সম্প্রদায় থাকে না।

সমগ্র সৃষ্টিজগতে তাঁরা এক ভিন্ন দুই দেখে না। মরমিসাধনার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই জাতধর্ম ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির ওপরে ওঠা। মরমি সাধকেরা সব ধর্মের নির্যাস আধ্যাত্ম-উপলব্ধির ভেতর দিয়ে আত্মস্থ করে নেয়। তখন তাদের কাছে ধর্মের এক অভিন্ন রূপ ধরা পড়ে।

তাই তাদের বাণীতে সম্প্রদায়িক ধর্মের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সর্বমানবিক এক ধর্মীয় চেতনার ঐক্যসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্যেক ধর্মের হাকিকত বা মর্মবাণী এটাই। হাসন রাজার জীবন, সঙ্গীত ও দর্শনে এই চেতনার প্রতিফলন সুস্পষ্ট।

তাঁর মনে সাম্প্রদায়িক বিভক্তির কোন স্থান ছিল না। অকপটে তিনি এসবের বিরুদ্ধে বলেছেন। একদিকে তিনি ‘আল্লাজি’র নাম নেন, অন্যদিকে ‘কানাই’-এর গান করেন।

এই চিরন্তন মানব ধর্মই মরমি সাধকদের পরম ধর্ম। এক পরমকেই ভিন্ন ভিন্ন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপলব্ধি করে। তিনিই সৃষ্টির জন্য স্রষ্টা। গোলামের জন্য মালিক। আশেকের জন্য মাশুক।

মরমি সুফি-বাউলদের কাছে এই মাশুক আবার বন্ধু রূপেও দেখা দেন। হাসন রাজা যে বন্ধুর রুপের ঝলক দেখে পাগল হলেন- ফানা হলেন, আশ-পড়শি তাঁর কিছুই বুঝলো না। তারা শুধু তামাশাই দেখলো-

সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইলো
সোনা বন্ধে আমারে পাগল করিল।
আরে না জানি কি মন্ত্র করি জাদু করিল।।

কবে ক’নে হইল আমার তার সংগে দেখা
অংশীদার নাইরে তার সে তো হয় একা।।

রূপের ঝলক দেখিয়া তার আমি হইলাম ফানা
সেই অবধি লাগল আমার শ্যাম পিরিতির টানা।।

হাসন রাজা হইল পাগল লোকের হইল জানা
নাচে নাচে পালায় পালায় আর গায় গানা।।

মুখ চাইয়া হাসে আমার যত আরি পরী
দেখিয়াছি বন্ধের রূপ ভুলিতে না পারি।।

হাসন রাজার গানে সুফিতত্ত্বের দর্শন দেখা গেলেও, তিনি অন্য সুফিদের মতো ছিলেন না। নিজেকে ‘বাউলা’ বা ‘বাউল’ বললেও তিনি আনুষ্ঠানিক বাউলও ছিলেন না। হাসন রাজার গানে তাঁর গুরু বা মুর্শিদের নাম না থাকলেও, তিনি গুরুকে অস্বীকার করেন নি।

“গুরুর উপদেশ শুনিয়া হাসন রাজায় কয়,
সব তেয়াগিলাম আমি দেও পদাশ্রয়।”

যাহোক, সুফিমতের সঙ্গে বাঙালির মরমিয়া ভাবনা ও সাধনালব্ধ আত্মোপলব্ধির দর্শনের সমন্বয় ছিল হাসন রাজার জীবন ও সঙ্গীত সাধনা।

হাসন রাজার স্বকীয় দর্শনের প্রসঙ্গে কয়েকটি গান উদ্ধৃত করে রবীন্দ্রনাথ এক বক্তৃতায় বলেছিলেন-

“পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির (হাসন রাজা) গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য।”

হাসন রাজা কোন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন কি-না, তা জানা যায় না। তবে তিনি স্ব-শিক্ষিত ছিলেন। তাঁর জমিদারির দলিলপত্রে ‘দেওয়ান হাসন রাজা’ স্বাক্ষরও আছে। তবে গান তিনি নিজ হাতে লিখতেন না। তিনি গাইতেন আর তাঁর নায়েব-গোমস্তারা লিখে রাখতেন।

হাসন রাজা ঠিক কত গান লিখেছেন, তার সঠিক সংখ্যা করা যায় না। ‘হাসন উদাস’ গ্রন্থে ২০৬টি গান সংকলিত আছে। এছাড়া ‘হাছন বাহার’ নামে আরেকটি গানের বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘সৌখিন বাহার’ তাঁর একটি গদ্যগ্রন্থ। হাছন রাজার রচিত কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথ একাধিক অনুষ্ঠানের ভাষণে হাসন রাজার প্রসঙ্গে বলেছেন। ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবার্ট লেকচারে’ রবীন্দ্রনাথ ‘The Religion of Man’ নামে বক্তৃতায় হাসন রাজার দর্শন ও সঙ্গীতের উল্লেখ করেন।

মানব সভ্যতার আদি থেকেই মহাসাধকগণ যে চিরসত্যটি বলে আসছেন, তা হলো- আত্মতত্ত্ব জানলেই, পরমতত্ত্ব জানা হয়। এই আত্মতত্ত্ব বিষয়ে হাসন রাজা যেন মনসুর হাল্লাজের আরেক ‘আনাল হক’। সাধনার চরম প্রাপ্তির আত্মপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় তার গানে।

হাসন রাজার কিছু গানে যে দর্শনের প্রকাশ, তা অনবদ্য- অবিশ্বাস্য সুন্দর। যেমন- হাসন রাজার পরমেশ্বর একদিন নিজের ভেতর থেকে বাহির হয়ে আদমসুরাতেই তাঁকে দেখা দিলেন। সেই নুরের ঔজ্জ্বল্য দেখে হাসন রাজা গাইলেন-

রুপ দেখিলাম রে নয়নে আপনার রুপ দেখিলাম রে।।
আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে।।

দেখা দিয়া প্রাণ লইয়া সামাইলো ভিতরে।
আদম ছুরত দিলো দেখা গড়িয়া আমারে।।

নূরেরও বদন খানি যেন কাঞ্চা সোনা।
আপনারই রুপ দেখিয়া আপনি ফানা।।

চন্দ্রসূর্য নহে হায়রে ওই রুপের সমান।
সে রুপ দেখিয়া আমার বাঁচে না পরাণ।।

আপনার রুপ দেখিয়া আপনি পাগল।
ত্রিভুবন জুড়িয়া রুপে করে ঝলমল।।

ভাবনা চিন্তা দূর হইল বন্ধু কোলে লইয়া।
নাচে নাচে হাসন রাজা বন্ধুয়ারে পাইয়া।।

বাংলার এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ মরমি গীতিকবি দেওয়ান হাসন রাজা ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর মাত্র ৬৭ বছর বয়সে জনমের জন্য কালনি নদীর তীরে ঘুরাঘুরি সাঙ্গ করে পার্থিব পর্দার আড়াল হয়ে যান।

কিন্তু দৈহিক মৃত্যু হলেও, কর্মে তিনি চিরঞ্জীব। তাঁর সুর ও গান জাগতিক মোহবন্ধন থেকে মুক্তিকামী মানুষের প্রাণ চিরকালই শীতল করবে, পরমের প্রেমে আকৃষ্ট করে যাবে।

(সমাপ্ত)

<<হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: এক

……………………..
আরো পড়ুন:
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: এক
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: দুই
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: তিন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………..
আরও পড়ুন-
সাধক ভবা পাগলা
শাহ্ আব্দুল করিম : জীবনী ও গান
সাধক রাধারমণ দত্ত
মহর্ষি মনোমোহন ও মলয়া সঙ্গীত
মোহন চাঁন বাউল
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-১

জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-২
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৩
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৪
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৫
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৬
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৭

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!