জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৬
-রব নেওয়াজ খোকন
দেহতত্ত্ব:
দেহশূন্য আত্মার প্রকৃতি বা অবস্থান সম্পর্কে মানুষ অনভিজ্ঞ। দেহোত্তীর্ণ বা দেহপূর্ব আত্মার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা, অবৈজ্ঞানিক বা অনুমান জ্ঞাপক। আপেক্ষিক বিষয়টিকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করা হাস্যকর। ধর্মীয় সূত্রে এর সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ থাকলেও, সাধকের পক্ষে বিষয়টি অন্ধভাবে মেনে নেয়া সম্ভব হয় না।
প্রকৃত সাধক চান বাস্তবতার নিরিখে সবকিছুর প্রত্যক্ষ সমাধান। এ সমাধানের জন্য আত্মাযুক্ত দেহকে বেছে নেয়াই সঙ্গত। তাই দেহধারণের মাধ্যমে আপন অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার সুযোগটুকু হাতছাড়া করতে চান না সাধক।
এ কারণেই বাউলবাদ বা সূফীবাদে ‘দেহতত্ব’ প্রসঙ্গটির অবতারণা। দেহতত্ত্ব থেকেই বাউলতত্ত্বের মূল উৎসারিত। এবং এটি অন্যতম প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। তাই কেউ কেউ বাউলতত্ত্বকে দেহতত্ত্ব বলে থাকেন।
জালাল উদ্দীন খাঁ বাউলতত্ত্বকে চৌদ্দপর্বে বিভক্ত করলেও দেহতত্ত্বের প্রাধান্যকে এড়িয়ে যাননি বা এর গুরুত্বকে গৌণ করে দেখেননি। কারণ, বাউলতত্ত্বের ঝর্ণাধারাটির উৎস হলো দেহ। এখান থেকেই সকল শাখা-প্রশাখার বিস্তার। আমরা কবির এ-তত্ত্বের বিভিন্ন গানে তার প্রমাণ পাই। দেহতত্বের উল্লেখযোগ্য একটি গান-
ও মন চিন যেয়ে তারে…
স্থুল দেহে বিরাজ করে
সূক্ষ্ম বস্তু শূন্যাকারে।।
যারে মানুষ বলে
সে আছে উল্টা কলে
সর্বত্রই বিরাজিত
চৌদ্দ ভুবন ছেড়ে…
জগতের বাহিরে থাকে
স্রষ্টা বলে তারে
আজ্ঞা-চক্রের উর্ধ্বে থেকে
মহাসিন্ধুর বিন্দু ঝরে।।
সেই বিন্দু বাষ্প হইয়া
অহম ভাবে যায় মিশিয়া
জীবের জীবন নাম ধরিয়া
হংস-ধ্বনি করে…
সাধনবলে ‘সোহং’ শব্দ
যে জাগাইতে পারে
ইচ্ছাতে হয় কর্ম সিদ্ধি
শমনের কি ধার ধারে।।
স্বরূপে অরূপের বিন্দু
ভরা আছে কাম-সিন্ধু
মণিপুরে বিরাজিত
মহাজন কয় তারে…
বায়ুরূপে আসা-যাওয়া
স্থুল দেহের ভিতরে
তার কি কখন ধ্বংস আছে?
ছায়া-মূরত গগন ভরে।।
জালালের পাগল মন
কী জানি কীসের কারণ
ভাবিতেছে জন্ম-মরণ
কেমনে যাবে দূরে…
জলবিন্দু যদি গিয়া
মিশে যায় সাগরে
মহাসাগর নাম ধরিবে
ভাবনা কি আর আছেরে।।
দেহের স্থূলত্বকে মহিমান্বিত করেছে বিশেষ সূক্ষ্ম বস্তু। মূলত এটি বস্তু নয়। সূক্ষ্ম শক্তি বিশেষ। কেবল শক্তিই পারে শূন্যাকারে বিরাজ করতে। কাব্যিক কারণে কবি হয়তো বস্তু বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু শূন্যাকারে বিরাজের কথাটি বলে তিনি বস্তুর মূল সত্তাকে শক্তির মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।
এই বিশেষ সূক্ষ্মশক্তি মহাশক্তিরই অংশবিশেষ। যা পূর্বেও আলোচিত হয়েছে। এটিই স্থুলদেহের একমাত্র চালিকা শক্তি। এর উপস্থিতিতেই জৈবিক সজীবতা সম্ভব। নতুবা দেহ অসার, অথর্ব। এখানে, এই দেহের মাঝেই মহাসত্তার সুলভ ও প্রকৃষ্ট প্রাপ্তি সম্ভব। তাই এখান থেকেই মহাসত্তার পরিচয় নেবার আহ্বান জানান কবি।
কেননা, জলবিন্দু সদৃশ দেহ সম্পন্ন আমিত্ব, মহাসিন্ধুতে মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি স্বভাবগত। তখন সিন্ধু আর বিন্দুর বৈষম্যও থাকবে না। একাকার হবে উভয়েই। অতএব এ বিষয়ে সাধক সুনিশ্চিত।
আমরা যাকে মানুষ বলছি, কবি তাকে বলছেন মহাসিন্ধুর বিন্দু। অর্থাৎ মহাসত্তার অংশ। তাহলে মানুষ কে? এ প্রশ্নের সাথে জড়িয়ে রয়েছে স্বসীমতার প্রচ্ছন্ন অজ্ঞতা। এ অজ্ঞতাকে স্বজ্ঞার আলোয় ভরাতে পারলে নিজেকে আবিষ্কার করা সম্ভব। আর তখন ‘মানুষ’ শব্দের ভ্রান্তি কেটে যাবে।
সর্বত্রই প্রতিভাত হবে পরমসত্তার একচ্ছত্র অস্তিত্ব। যেখানে মানবসত্তা গৌণতায় পর্যবসিত হবে। ভয় কেটে যাবে ক্ষুদ্রতার। মহারূপের সাথে মিলনোন্মুখ হয়ে উঠবে সাধকের মন।
স্রষ্টা বলে যাঁকে বাইরের জগতে আলাদা করা হয়েছে। কবি তাঁকে দেহের পরিমণ্ডলে বেঁধে সহজলভ্য করে তুলেছেন। আজ্ঞাচক্রের উর্ধ্বে থেকে যিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁরই খণ্ডাংশ আমি বা আমরা- এ মহাসত্যকে এ গানে মেলে ধরেছেন সাধক।
মহাসিন্ধুর বিন্দু হতে আবির্ভূত দেহধারী জীব যদি স্বচৈতন্যের স্বজ্ঞা বলে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে, সাধনার বলে জাগাতে পারে ‘সোহং’ শব্দ, তবেই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। ঘটে কর্ম সিদ্ধি। শমন তাঁকে ঠেকাতে পারে না। সে হয় মৃত্যুঞ্জয়ী।
স্বরূপে অরূপের ছায়াকে দেখতে পারলেই মণিপুরে বিরাজিত মহাজনকে দেখা যায়। বায়ুরূপে যাঁর আসা-যাওয়া স্থূল দেহের ভেতর। তাঁর কখনো ধ্বংস নেই, ক্ষয় নেই। তাঁর ক্ষয় নেই বলেই দেহধারী মানব বা জীবসত্তারও ক্ষয় নেই। তাই সাধক আশায় বুক বেঁধেছেন, জন্ম-মরণ তাঁর অস্তিত্বকে বিলীন করতে পারবে না।
কেননা, জলবিন্দু সদৃশ দেহ সম্পন্ন আমিত্ব, মহাসিন্ধুতে মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি স্বভাবগত। তখন সিন্ধু আর বিন্দুর বৈষম্যও থাকবে না। একাকার হবে উভয়েই। অতএব এ বিষয়ে সাধক সুনিশ্চিত।
দেহের পাঠশালায় রয়েছে জ্ঞানের বিশ্বকোষ। গুরুর সান্নিধ্য ও সহযোগিতায় এ জ্ঞানকোষের অনুসন্ধান করতে হয়। সাধকের নিম্নোক্ত গানে তা স্পষ্ট-
মাটির দেহ খাঁটি করো
খুলে তোমার দ্বীল-কোরান
বাড়ি জমির হিসাব নিবে
সাক্ষ্য দিচ্ছে বেদ-পুরাণ।।
‘আমি’ শব্দে কে-বা হয়
নিঃশব্দে কী কথা কয়
যম কোথায় বসে রয়
কই বা থাকে পঞ্চপ্রাণ,
গুরুর সঙ্গ স্বভাব নিয়া
নিগুঢ়তত্ত্ব লও খুঁজিয়া
বিশ্ববিজ্ঞান পাঠ করিয়া
সকলকেই দেখো সমান।।
বেছে নিয়ে মন্দের ভাগ
শ্রদ্ধা ভক্তি অনুরাগ
হিংসা নিন্দা পরিত্যাগ
করলে আটক মদন-বাণ,
অনন্তে মিশিবে তবে
আর না আসিবে ভবে
সঙ্গীরা সব বাধ্য হবে
ভাটি ছেড়ে যাবে উজান।।
কাঁচা মাটি পুড়ছে যাঁরা
সিদ্ধপুরুষ ভবে তারা
জীবন থাকতে গেছে মারা
স্বর্গ-নরক এক সমান,
ভয় থাকে না তার অন্তরে
ডুব দাওগে প্রেমসাগরে
পাথরে কি ঘুণে ধরে?
জালাল উদ্দী’র কথা মান্।।
দেহটা মাটির বলে অবমূল্যায়ন কিংবা অবজ্ঞা করা মোটেও সমীচীন নয়। কারণ এ মাটির দেহের ভেতরেই রয়েছে দ্বীল-কোরান। সে কোরানের চর্চা করতে পারলে মাটি হবে খাঁটি সোনা। আর এ নির্দেশনা ধর্মগ্রন্থেও দেয়া হয়েছে। ‘আমি’ শব্দে কার প্রকাশ! নীরবে নিঃশব্দে কার বাণী ঝরে অহর্নিশ! কোথায় রয়েছে যম? কোথায় বা আছে পঞ্চাত্মা বা পঞ্চপ্রাণ? এসব নিগুঢ় জ্ঞানের ঝাঁপি খুলতে সাধকগুরুর সঙ্গ একান্ত প্রয়োজন।
কারণ আদিকাল থেকে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় নিগুঢ়তত্ত্ব ভিত্তিক জ্ঞানের ধারক-বাহক তাঁরা। দূর্লভ এ মহাজ্ঞান বই-পুস্তক পড়ে পাওয়া সহজ সাধ্য নয়। কেননা জটিল ও বিতর্কিত এসব তত্ত্বজ্ঞান কোনোকালেই পরিপূর্ণতা নিয়ে সাধারণের মাঝে অবাধে প্রকাশ হতে পারেনি। সাধারণের স্বল্পজ্ঞান, উগ্র মানসিকতা, অজ্ঞতা এ মহাজ্ঞানের পথ আগলে দাঁড়িয়েছে যুগে-যুগে। তাই একমাত্র যোগ্য গুরুই জানেন এ আলোর সঠিক ঠিকানা।
বেছে নিতে হবে মন্দের ভাগ, যে ভাগে রয়েছে সাধারণের অজ্ঞতা বশত অবজ্ঞা। সংখ্যালঘুত্বের দুর্বলতাবশত সামাজিক কলঙ্ক। সেইসাথে নিতে হবে শ্রদ্ধা, ভক্তি, অনুরাগের মতো বিশুদ্ধ মানবিক গুণাবলী। পরিত্যাগ করতে হবে হিংসা, নিন্দার মতো পরিত্যাজ্য বিষয়গুলো, যেগুলো মানবমন তথা নৈতিক-মানবিক মূল্যবোধের বৈকল্য সাধন করে। তবেই রুদ্ধ হবে ষড়রিপুর প্রধান কাম রিপুর দ্বার।
যাকে বাউলের ভাষায় মদনা-চোরাও বলা হয়। আর তখনই অনন্ত কিংবা অসীম সত্তার সাথে মিলনের পথ প্রশস্ত হবে। ফলশ্রুতিতে জন্ম-জন্মান্তর প্রক্রিয়াটির সমাপন হবে। যে প্রক্রিয়ার সাথে জড়িয়ে রয়েছে দুঃখ, জরা, হতাশা প্রভৃতি বিষয়ক জৈবনিক যন্ত্রণা। আর জীবনসংশ্লিষ্ট অবিচ্ছেদ্য রিপুগুলিও তখন ধ্বংসাত্বক ভাটার গতিপথ বদল করে উজানের পানে ধাবিত হবে পরমসত্তার অনুকূলে।
কাঁচা মাটির দেহটিকে যাঁরা কঠিন সাধনার অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছেন, জীবন থাকতেও মৃতের মতো দিনাতিপাত করেছেন, তারাই কেবল সিদ্ধপুরুষের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। আর তাঁদের কাছে তথাকথিত স্বর্গ-নরক একাকার হয়ে মাথা ঠেকিয়েছে। স্বর্গ-নরকে নির্ভীক সেই সকল মনিষিগণকে অনুসরণ করে প্রেমসাগরে ডুব দেবার আহ্বান জানাচ্ছেন সাধককবি জালাল। নিজেকে পাথর সদৃশ কঠিনতায় গড়তে এর বিক্ল্প নেই।
মূল্যবোধ:
জালাল উদ্দীন খাঁর দেহতত্ত্ব জুড়ে দেহকেন্দ্রিক সাধনপথের সন্ধান পাওয়া যায়। যে পথের দিশা তিনি বহু গানে দিয়ে গেছেন। প্রচলিত ধর্মাচারে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু দার্শনিক বিচারে তা সাদরে গ্রহণীয়। তাছাড়া ধর্মগ্রন্থগুলোর মৌলিক রস আহরণ করলে দেখা যাবে সেখানেও রয়েছে এর নিগূঢ় রসায়ন। সর্বোপরি সত্য হলো, দেহতত্ত্ব চর্চায় রয়েছে বিশুদ্ধ মানব হিসেবে গড়ে উঠবার অনন্য উপায়।
(চলবে)
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৭>>
…………………………………………….
আরো পড়ুন-
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-১
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-২
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৩
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৪
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৫
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৬
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৭
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………..
আরও পড়ুন-
সাধক ভবা পাগলা
শাহ্ আব্দুল করিম : জীবনী ও গান
সাধক রাধারমণ দত্ত
মহর্ষি মনোমোহন ও মলয়া সঙ্গীত
মোহন চাঁন বাউল
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: এক
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: দুই
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: তিন