ভবঘুরেকথা

-নূর মোহাম্মদ মিলু

নবীজী ঘরে না ঢুকে ফিরে গেলেন। বুদ্ধিমতি কন্যা ফাতেমা বুঝে গেলেন, পিতা কেন ঘরে না ঢুকে ফিরে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পর্দা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলেন এবং দুই ছেলের হাত থেকে চুড়ি খুলে ফেলেন।

তাঁরা কাঁদতে কাঁদতে তাঁদের নানার নিকট চলে যায়। তখন নবীজীর মুখ থেকে উচ্চারিত হয়, এরা আমার পরিবারের সদস্য। আমি চাই না পার্থিব সাজ-শোভায় তারা শোভিত হোক। (সাহাবিয়াত-১৪৭)

একবার নবীজী ফাতেমা, আলী, হাসান ও হুসায়নকে বললেন- যাদের সঙ্গে তোমাদের যুদ্ধ, তাদের সাথে আমারও যুদ্ধ, যাদের সঙ্গে তোমাদের শান্তি ও সন্ধি তাদের সঙ্গে আমারও শান্তি ও সন্ধি।

অর্থাৎ যাদের প্রতি তোমরা অখশী তাদের প্রতি আমিও অখুশি, আর যাদের প্রতি খুশি, তাদের প্রতি আমিও খুশি।

নবীজীর অতি আদরের কন্যা ফাতেমাকে সব সময় স্পষ্ট করে বলে দিতেন যে, নবীজীর কন্যা হওয়ার কারণে পরকালে মুক্তি পাওয়া যাবে না। সেখানে মুক্তির একমাত্র উপায় হবে আমল, তাকওয়া ও খাওফে খোদা। একবার তিনি ভাষণে বলেন-

‘হে কুরায়শ গোত্রের লোকেরা! তোমরা তোমাদের নিজ নিজ সত্তাকে ক্রয় করে নাও। আল্লাহর নিকট আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারবো না।… হে ফাতেমা! তুমি আমার সম্পদ থেকে যা ইচ্ছা আমার নিকট চেয়ে নাও। তবে আল্লাহর নিকট তোমার জন্য কিছুই করতে পারবো না।’ (বুখারী-৬/১৬ (তাফসীর সুরা আশ শুআরা); নিসা’ হাওলার রাসূল-১৪৯)

তিনি একথাও বলেন- ‘হে ফাতেমা, তুমি নিজকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। আমি আল্লাহর দরবারে তোমার উপকার ও অপকার কিছুই করতে সক্ষম হবো না।’

এক মাখযূমী নারী চুরি করলে তার গোত্রের লোকেরা নবীজীর প্রীতিভাজন উসামা ইবন যায়দের (রা) মাধ্যমে সুপারিশ করে শাস্তি মওকুফের চেষ্টা করে। তখন নবীজী বলেন-

আল্লাহর কসম! ফাতেমা বিনত মোহাম্মদও যদি চুরি করে তাহলে আমি তার হাত কেটে দেব। (বুখারী- আল-হুদূদ; মুসলিম- বাবু কিত‘উস সারিক (১৬৮৮))

পিতার উত্তরাধিকার দাবী
নবীজী দেহত্যাগ করলেন। তাঁর উত্তরাধিকারের প্রশ্ন দেখা দিল। ফাতেমা সোজা খলিফা আবু বকরের কাছে গেলেন এবং তাঁর পিতার উত্তরাধিকার বণ্টনের আবেদন জানালেন। আবু বকর তাঁকে নবীজীর এ হাদিসটি শোনান-

‘আমরা যা কিছু ছেড়ে যাই সবই সাদাকা হয়। তার কোন উত্তরাধিকার হয় না।’

তারপর তিনি বলেন, এরপর আমি তা কিভাবে বণ্টন করতে পারি? এ জবাবে ফাতেমা একটু রুষ্ট হলেন। (মুসলিম- ফিল জিহাদ ওয়াস সায়ব (১৭৫৯); বুখারী- ৬/১৩৯, ১৪১; ৭/২৫৯ ফিল মাগাযী- বাব- হাদিসু বানী আন-নদীর; তাবাকাত-৮/১৮; সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/১২০)

ফাতেমা ঘরে ফিরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এ রকমও বর্ণিত হয়েছে যে, আবু বকরের এ জবাবে ফাতেমা দুঃখ পান এবং আবু বকরের প্রতি এত নারাজ হন যে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর সাথে কোন কথা বলেননি।

কিন্তু ইমাম আশ-শা‘বীর (রহ) একটি বর্ণনায় জানা যায়, ফাতেমা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন আবু বকর তাঁর গৃহে যান এবং সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করেন।

আলী ফাতেমার কাছে গিয়ে বলেন, আবু বকর তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছেন। ফাতেমা আলীকে প্রশ্ন করলেন- আমি তাঁকে সাক্ষাতের অনুমতি দিই তাতে কি তোমার সম্মতি আছে?

আলী বললেন- হ্যাঁ। ফাতেমা অনুমতি দিলেন।

আবু বকর ঘরে ঢুকে কুশল বিনিময়ের পর বললেন- আল্লাহর কসম! আমি আমার অর্থ-বিত্ত, পরিবার-পরিজন, গোত্র সবকিছু পরিত্যাগ করতে পারি আল্লাহ, আল্লাহর নবীজী এবং আপনারা আহলে বায়ত তথা নবী পরিবারের সদস্যদের সন্তুষ্টির বিনিময়ে।

আবু বকরের এমন কথায় ফাতেমার মনের সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। তিনি খুশি হয়ে যান। (তাবাকাত-৮/২৭)

ইমাম আয-যাহাবী (রা) এ তথ্য উল্লেখ করার পর মন্তব্য করেছেন, স্বামীর গৃহে অন্য পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে স্বামীর অনুমতি নিতে হয়- এ সন্নাত সম্পর্কে ফাতেমা অবহিত ছিলেন। এ ঘটনা দ্বারা সেকথা জানা যায়। (সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা’ -২/১২১)

এখানে উল্লেখিত এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় ফাতেমার অন্তরে পূর্বে কিছু অসন্তুষ্টি থাকলেও পরে তা দূর হয়ে যায়।

তাছাড়া একটি বর্ণনায় একথাও জানা যায় যে, ফাতেমা মৃত্যুর পূর্বে আবু বকরের স্ত্রীকে অসীয়াত করে যান, মৃত্যুর পরে তিনি যেন তাঁকে গোসল দেন। (নিসা‘ মুবাশশারাত বিল কজান্নাহ-২২৪; টীকা নং-১)

মৃত্যু
ফাতেমার অপর তিন বোন যেমন তাঁদের যৌবনে মারা গেলেন তেমনি তিনিও নবীজীর ওফাতের আট মাস, মতান্তরে সত্তর দিন পর ইহলোক ত্যাগ করেন। অনেকে নবীজীর মৃত্যুর দুই অথবা চার মাস অথবা আট মাস পরে তাঁর মৃত্যুর কথাও বলেছেন।

তবে এটাই সঠিক যে, নবীজী মৃত্যু বরণের আগে বলে যান। নবীজীর ভবিষ্যদ্বাণী- আমার পরিবারের মধ্যে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সঙ্গে মিলিত হবে‘- সত্যে পরিণত হয়।

নবীজীর নবুওয়াত লাভের পাঁচ বছর পূর্বে যদি ফাতেমার জন্ম ধরা হয় তাহলে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ২৯ বছর হয়। আর কেউ বলেছেন যে, নবুওয়াত লাভের এক বছর পর ফাতেমার জন্ম হয়, এই হিসাবে তাঁর বয়স ২৯ বছর হবে না।

যেহেতু অধিকাংশ সীরাত বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মৃত্যুকালে ফাতেমার বয়স হয়েছিল ২৯ বছর, তাই তাঁর জন্মও হবে নবুওয়াতের পাঁচ বছর পূর্বে। (সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা‘ -২/১২৭)

আল-ওয়াকিদী বলেছেন, হিজরি ১১ সনের ৩ রমাদান ফাতেমার মৃত্যুর হয়। হজরত আব্বাস (রা) জানাযার নামাজ জড়ান।

হজরত আলী, ফাদল ও আব্বাস (রা) কবরে নেমে দাফন কাজ সম্পন্ন করেন। তাঁর অসীয়াত মত রাতের বেলা তাঁর দাফন করা হয়। একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, আলী, মতান্তরে আবু বকর জানাযার নামাজ পড়ান। স্বামী আলী ও আসমা বিনত উমাইস (রা) তাঁকে গোসল দেন। (আল-ইসতীআব- ৪/৩৬৭, ৩৬৮; আনসাব আল-আশরাফ-১/৪০২, ৪০৫)

ফাতেমার অন্তিম রোগ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। মারাত্মক কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে কিছুকাল শয্যাশায়ী ছিলেন, এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।

উম্মু সালমা (রা) বলেন, ফাতেমার ওফাতের সময় আলী পাশে ছিলেন না। তিনি আমাকে ডেকে পাঠান এবং বলেন, আমার গোসলের জন্য পানির ব্যবস্থা করুন। নতুন পরিচ্ছন্ন কাপড় বের করুন, পরবো।

আমি পানির ব্যবস্থা করে নতুন কাপড় বের করে দিলাম। তিনি উত্তমরূপে গোসল করে নতুন কাপড় পরেন।

তারপর বলেন আমার বিছানা করে দিন বিশ্রাম করবো। আমি বিছানা করে দিলাম। তিনি কেবলামুখী হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।

তারপর আমাকে বলেন, আমার বিদায়ের সময় অতি নিকটে। আমি গোসল করেছি। দ্বিতীয়বার গোসল দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার পরিধেয় বস্ত্রও খোলার প্রয়োজন নেই। এরপর তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

আলী ঘরে আসার পর আমি তাঁকে এসব ঘটনা বললাম। তিনি ফাতেমার সেই গোসলকেই যথেষ্ট মনে করলেন এবং সেই অবস্থায় দাফন করেন। (দ আ‘লাম আন-নিসা’ -৪/১৩১)

এ রকম বর্ণনা উম্মু রাফি থেকেও পাওয়া যায়। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, আলী, মতান্তরে আবু বকরের তাঁকে গোসল দেন। (তাবাকাত-৮/১৭, ‘৮; সিয়ারু আ‘লামত আন-নুবালা’ -২/১২৯)

জানাযায় খুব কম মানুষ অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তার কারণ, রাতে তাঁর মৃত্যু হয় এবং আলী ফাতেমার অসীয়াত অনুযায়ী রাতেই তাঁকে দাফন করেন। তাবাকাতের বিভিন্ন স্থানে এ রকম বর্ণনা এসেছে।

আয়েশা বলেন, নবীজীর পরে ফাতেমার ছয় মাস জীবিত ছিলেন এবং রাতের বেলা তাঁকে দাফন করা হয়। (সিয়ারু আ‘লামত আন-নুবালা’ -২/১২৯)

লজ্জা-শরম ছিল ফাতেমার স্বভাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তিনি আসমা বিনত উমাইসকে (রা) বলেন, মেয়েদের লাশ উন্মুক্ত অবস্থায় যে, গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এ আমার পছন্দ নয়। এতে বেপর্দা হয়।

নারী-পুরূষের লাশের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য করা হয় না। পুরুষরা যে মেয়েদের লাশ খোলা অবস্থায় বহন করেন, এ তাদের একটা মন্দ কাজ।

আসমা বিনত উমাইস (রা) বললেন, আল্লাহর রাসূলের কন্যা! আমি হাবশায় একটি ভালো পদ্ধতি দেখেছি। আপনি অনুমতি দিলে দেখাতে পারি। একথা বলে তিনি খেজুরের কিছু ডাল আনলেন এবং তার উপর একটি কাপড় টানিয়ে পর্দার মত করলেন। এ পদ্ধতি ফাতেমার বেশ পছন্দ হলো এবং তিনি বেশ উৎফুল্ল হলেন।

ফাতেমার লাশ পর্দার মধ্য দিয়ে কবর পর্যন্ত নেওয়া হয়। ইসলামে সর্বপ্রথম এভাবে তাঁর লাশটিই নেওয়া হয়। তাঁর পরে উম্মুল মু‘মিনীন হজরত যয়নাব বিনত জাহাশের লাশটিও এভাবে কবর পর্যন্ত বহন করা হয়।

হজরত আলী স্ত্রী ফাতেমার দাফন-কাফনের কাজ সম্পন্ন করে যখন ঘরে ফিরলেন তখন তাঁকে বেশ বিষণ্ণ ও বেদনাকাতর দেখাচ্ছিল। শোকাতুর অবস্থায় বার বার নীচের চরণগুলো আওড়াচ্ছিলেন-

আমি দেখতে পাচ্ছি আমার মধ্যে দুনিয়ার রোগ-ব্যাধি প্রচুর পরিমাণে বাসা বেঁধেছে। আর একজন দুনিয়াবাসী মৃত্যু পর্যন্ত রোগগ্রস্তই থাকে। (আ‘লাম আন-নিসা’-৪/১৩১)

ভালোবাসার লোকদের প্রতিটি মিলনের পরে বিচ্ছেদ আছে। বিচ্ছেদ ছাড়া মিলনের সময়টুকু তা অতি সামান্যই।

আহমাদের (সা) পরে ফাতেমার বিচ্ছেদ এ কথাই প্রমাণ করে যে, কোন বন্ধনই চিরকাল থাকে না।’

হজরত আলী প্রতিদিন ফাতেমার কবরে যেতেন, স্মৃতিচারণ করে কাঁদতেন এবং নিম্নের এ চরণ দু‘টি আবৃত্তি করতেন-

আমার একি দশা হয়েছে যে, আমি কবরের উপর সালাম করার জন্য আসি; কিন্তু প্রিয়ার কবর আমর প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।

হে কবর! তোমার কী হয়েছে যে, তোমার আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দাও না?

তুমি কি তোমার প্রিয়জনের ভালোবাসায় বিরক্ত হয়ে উঠেছ?

দাফনের স্থান
আল-ওয়াকিদী বলেন, আমি আবদুর রহমান ইবন আবিল মাওলাকে বললাম, বেশীর ভাগ মানুষ বলে থাকে ফাতেমার কবর বাকী গোরস্তানে। আপনি কী মনে করেন?

তিনি জবাব দিলেন- বাকীতে তাঁকে দাফন করা হয় নি। তাঁকে আকীলের বাড়ির এক কোণে দাফন করা হয়েছে। তাঁর কবর ও রাস্তার মধ্যে ব্যবধান ছিল প্রায় সাত হাত। (সাহাবিয়াত-১৫৩)

(সমাপ্ত)

…………………………………
আরো পড়ুন:
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!