-নূর মোহাম্মদ মিলু
দারিদ্রের কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখী
পিতৃগৃহ থেকে ফাতেমা যে স্বামী গৃহে যান সেখানে কোন প্রাচুর্য ছিল না। বরং সেখানে যা ছিল তাকে দারিদ্রের কঠোর বাস্তবতাই বলা সঙ্গত। সে ক্ষেত্রে তাঁর অন্য বোনদের স্বামীদের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক অনেক ভালো ছিল।
যায়নাবের বিয়ে হয় আবুল আসের (রা) সাথে। তিনি মক্কার বড় ধনী ব্যক্তি আবদুল উযযা ইবন আবদিল মুত্তালিবের দুই ছেলের সাথে। ইসলামের কারণে তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর একের পর একজন করে তাঁদের দু‘জনেরই বিয়ে হয় উছমান ইবন আফফানের (রা) সাথে।
আর উছমান ছিলেন বিত্তবান ব্যক্তি। তাঁদের তুলনায় আলী ছিলেন একজন নিতান্ত দরিদ্র মানুষ। তাঁর নিজের অর্জিত সম্পদ বলে যেমন কিছু ছিল না, তেমনি উত্তরাধিকার সূত্রেও কিছু পাননি। তাঁর পিতা মক্কার সবচেয়ে সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তবে তেমন অর্থ-বিত্তের মালিক ছিলেন না।
আর সন্তান ছিল অনেক। তাই বোঝা লাঘবের জন্য নবীজী ও তাঁর চাচা আব্বাস তাঁর দুই ছেলের লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন। এভাবে আলী যুক্ত হন নবীজীর পরিবারের সাথে।
এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, আলীর মত মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশীয় বুদ্ধিমান যুবক এত সীমাহীন দারিদ্রের মধ্যে থাকলেন কেন? এর উত্তর আলীর জীবনের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। মোহাম্মদ (সা) রাসূল হলেন। কিশোরদের মধ্যে আলী সর্বপ্রথম তাঁর প্রতি ঈমান আনলেন। ইবন ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী তখন তাঁর বয়স দশ বছর। (প্রাগুক্ত-৬১২)
আর তখন থেকে তিনি নবী নবীজীর জীবনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। নবীজী যত কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন, আলীর জীবন যেভাবে শুরু হয় তাতে এ পেশার মাধে জড়ানোর সুযোগ ছিল কোথায়? মক্কার কুরাইশদের সাথে ঠেলা-ধাক্কা করতেই তো কেটে যায় অনেকগুলো বছর।
মদীনায় গেলেন একেবারে খালি হাতে। সেখানে নতুন জায়গায় নতুনভাবে দাওয়াতী কাজে জড়িয়ে পড়লেন। এর মধ্যে বদর যুদ্ধ এসে গেল। তিনি যুদ্ধে গেলেন। যুদ্ধের পর গনীমতের অংশ হিসেবে নবীজী তাকে একটি বর্ম দিলেন। এই প্রথম তিনি একটি সম্পদের মালিক হলেন।
আলী যে একজন নিতান্ত দরিদ্র মানুষ ছিলেন তা ফাতেমার জানা ছিল। তাই, বালাযুরীর বর্ণনা যদি সত্য হয়- নবীজী ফাতেমাকে যখন আলীর প্রস্তাবের কথা বলেন তখন ফাতেমা আলীর দারিদ্রের কথা উল্লেখ করেন। তার জবাবে নবীজী বলেন-
সে দুনিয়াতে একজন নেতা এবং আখিরাতেও সে সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন হবে। সাহাবীদের মধ্যে তার জ্ঞান বেশী। সে একজন বিচক্ষণও। তাছাড়া সবার আগে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে।’ (প্রাগুক্ত; হায়াত আস-সাহাবা-৩/২৫৬)
এই বর্ণনাটি সত্য হতেও পারে। কারণ, বিয়ে-শাদীর এ রকম পর্যায়ে অভাব-দারিদ্র বিবেচনায় আসা বিচিত্র কিছু নয়।
ফাতেমা আঠারো বছরে স্বামী গৃহে যান। সেখানে যে বিত্ত-বৈভবের কিছু মাত্র ছিল না, সে কথা সব ঐতিহাসিকই বলেছেন। সেই ঘরে গিয়ে পেলেন খেজুর গাছের ছাল ভর্তি চামড়ার বালিশ, বিছানা, এক জোড়া যাতা, দু‘টো মশক, দু‘টো পানির ঘড় আর আতর-সুগন্ধি।
স্বামী দারিদ্রের কারণে ঘর-গৃহস্থালীর কাজ-কর্মে তাঁকে সহায়তা করার জন্য অথবা অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজগুলো করার জন্য কোন চাকর-চাকরানী দিতে পারেন নি। ফাতেমা একাই সব ধরনের কাজ করতেন। যাতা ঘুরাতে ঘুরাতে তাঁর হাতে কড়া পড়ে যায়, মশক ভর্তি পানি টানতে টানতে বুবে দাগ হয়ে যায় এবং ঘর-বাড়ি ঝাড়ু দিতে দিতে পরিহিত কাপড়-চোপড় ময়লা হয়ে যেত। (তাবাকাত-৮/১৫৯; আল-ইসাবা-৪/৪৫০)
তাঁর এভাবে কাজ করা আলী মেনে নিতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর করারও কিছু ছিল না। যতটুকু পারতেন নিজে তাঁর কাজে সাহায্য করতেন। তিনি সব সময় ফাতেমার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতেন। কারণ, মক্কী জীবনে নানারূপ প্রতিকূল অবস্থায় তিনি যে অপুষ্টির শিকার হন তাতে বেশ ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে পড়েন।
ঘরে-বাইরে এভাবে দু‘জনে কাজ করতে করতে তাঁরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন। একদিন আলী তাঁর মা ফাতেমা বিনত আসাদ ইবনে হাশিনকে বলেন- তুমি পানি আনা ও বাইরের অন্যান্য কাজে নবীজীর মেয়েকে সাহায্য কর, আর ফাতেমা তোমাকে বাড়িতে গম পেষা ও রুটি বানাতে সাহায্য করবে।
এ সময় ফাতেমার পিতা নবীজী প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ও যুদ্ধবন্দীসহ বিজয়ীর বেশে একটি যুদ্ধ থেকে মদীনায় ফিরলেন। আলী একদিন বললেন- ফাতেমা! তোমার এমন কষ্ট দেখে আমার বড় দুঃখ হয়। আল্লাহ বেশ কিছু যুদ্ধ বন্দী দিয়েছেন।
তুমি যদি তোমার পিতার কাছে গিয়ে তোমার সেবার জন্য যুদ্ধবন্দী একটি দাসের জন্য আবেদন জানাতে! ফাতেমা ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় হাতের যাতা পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বলেন- আমি যাব। তারপর বাড়ির আঙ্গিনায় একটু বিশ্রাম নিয়ে চাদর দিয়ে গা-মাথা ঢেকে ধীর পায়ে পিতৃগৃহের দিকে গেলেন।
পিতা তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন- মেয়ে! কেন এসেছো?
ফাতেমা বললেন- আপনাকে সালাম করতে এসেছি। তিনি লজ্জায় পিতাকে মনের কথাটি বলতে পারলেন না। বাড়ি ফিরে এলেন এবং স্বামীকে সে কথা বললেন। আলী এবার ফাতেমাকে সংগে করে নবীজীর নিকট গেলেন। ফাতেমা পিতার সামনে লজ্জায় মুখ নীচু করে নিজের প্রয়োজনের কথাটি এবার বলে ফেলেন।
পিতা তাঁকে বলেন- আল্লাহর কসম! তোমাদেরকে আমি একটি দাসও দিব না। আহ্লস সুফফার লোকেরা না খেয়ে নিদারুণ কষ্টে আছে। তাদের জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না। এগুলো বিক্রি করে সেই অর্থ আমি তাদের জন্য খরচ করবো।
একথা শোনার পর তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দু‘জন পিতাকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘরে ফিরে আসেন। তাঁদেরকে এভাবে খালি হাতে ফেরত দিয়ে স্নেহশীল পিতা যে পরম শান্তিতে থাকতে পেরেছিলেন তা কিন্তু নয়। সারাটি দিন কর্মক্লান্ত আদরের মেয়েটির চেহারা তাঁর মনের মধ্যে ভাসতে থাকে।
সন্ধ্যা হলো। ঠাণ্ডাও ছিল প্রচণ্ড। আলী-ফাতেমা শক্ত বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এত ঠাণ্ডায় কি ঘুম আসে? এমন সময় দরজায় করাঘাতের শব্দ। দরজা খুলতেই তাঁরা দেখতে পান পিতা মুহাম্মাদ মুস্তাফা দাঁড়িয়ে।
তিনি দেখতে পান, এই প্রবল শীতে মেয়ে-জামাই যে কম্বলটি গায়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্ট করছে তা এত ছোট যে দু‘জন কোন রকম গুটিশুঁটি মেরে থাকা যায়। মাথার দিকে টানলে পায়ের দিকে বেরিয়ে যায়। আবার পায়ের দিকে সরিয়ে দিলে মাথার দিক আলগা হয়ে যায়।
তাঁরা এই মহান অতিথিকে স্বাগত জানানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি তাঁদেরকে ব্যস্ত না হয়ে যে অবস্থায় আছে সেভাবে থাকতে বলেন। তিনি তাঁদের অবস্থা হৃদয় দিয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করেন, তারপর কোমল সুরে বলেন- তোমরা আমার কাছে যা চেয়েছিলে তার চেয়ে ভালো কিছু কি আমি তোমাদেরকে বলে দিব?
তাঁর দু‘জনই এক সাথে বলে উঠলেন- বলুন, ইয়া রাসূলাল্লাহ!
তিনি বললেন- জিব্রাইল আমাকে এই কথাগুলো শিখিয়েছেন- প্রত্যেক নামাজের পরে তোমরা দু‘জন দশবার সুবহানাল্লাহ, দশবার আলহামদুলিল্লাহ ও দশবার আল্লাহু আকবর পাঠ করবে। আর রাতে যখন বিছানায় ঘুমাতে যাবে তখন সুবহানাল্লাহ তেত্রিশবার, আলহামদুলিল্লাহ তেত্রিশবার, আল্লাহু আকবার চৌত্রিশবার পাঠ করবে।
একথা বলে তিনি মেয়ে-জামাইকে রেখে দ্রুত চলে যান। (হাদিসটি সাহীহ বুখারী ও সাহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া তাবাকাত-৮/২৫; আ‘লাম আন-নিসা’-৪/১১১-দ্র)
এ ঘটনার শত বর্ষের এক তৃতীয়াংশ সময় পরেও ইমাম আলীকে নবীজীর শিখানো এই কথাগুলো আলোচনা করতে শোনা গেছে। তিনি বলতেন- নবীজী আমাদেরকে এই কথাগুলো শিখানোর পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি একদিনও তা বাদ দিইনি।
একবার একজন ইরাকী প্রশ্ন করেন- সিফফীন যুদ্ধের সেই ঘোরতর রাতেও না? তিনি খুব জোর দিয়ে বলেন- সিফফীনের সেই রাতেও না। (সাহীহ মুসলিম; আদ-দোয়া, খণ্ড-৪, হাদিস নং-২০৯১; তাবাকাত-৮/১৯)
এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। আলী একবার দারুণ অভাব অনটনে পড়লেন। একদিন স্ত্রী ফাতেমাকে বললেন, যদি তুমি নবীজীর কাছে গিয়ে কিছু চেয়ে আনতে তাহলে ভালো হতো। ফাতেমা গেলেন। তখন নবীজীর পাশে নিকট উম্মু আয়মন বসা ছিলেন।
ফাতেমা দরজায় টোকা দিলেন। নবীজী উম্মু আয়মনকে বললেন- নিশ্চয় এটা ফাতেমার হাতের টোকা। এমন সময় সে আমাদের নিকট এসেছে যখন সে সাধারণতঃ আসতে অভ্যস্ত নয়। ফাতেমা ঘরে ঢুকে বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই ফেরেশতাদের খাদ্য হলো তাসবী-তাহলীল ও তাহমীদ। কিন্তু আমাদের খাবার কি?
বললেন- সেই সত্তার শপথ যিনি আমাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, মুহাম্মাদের পরিবারের রান্না ঘরে ত্রিশ দিন যাবত আগুন জ্বলে না। আমার নিকট কিছু ছাগল এসেছে, তুমি চাইলে পাঁচটি ছাগল তোমাকে দিতে পারি। আর তুমি যদি চাও এর পরিবর্তে আমি তোমাকে পাঁচটি কথা শিখিয়ে দিতে পারি যা জিব্রাইল আমাকে শিখিয়েছেন।
ফাতেমা বললেন- আপনি বরং আমাকে সেই পাঁচটি কথা শিখিয়ে দিন যা জিব্রাইল আপনাকে শিখিয়েছেন। এই পাঁচটি কথা শিখে ফাতেমা ফিরে গেলেন আলীর নিকট।
(চলবে…)
…………………………………
আরো পড়ুন:
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২