ভবঘুরেকথা
লালন বলে কুল পাবি না

-মূর্শেদূল মেরাজ

…আজ মনটা খুবই খারাপ। তার অনেকগুলো কারণ আছে। মেলা শেষ। সব জায়গা ফাঁকা হয়ে গেছে। এই কয়দিন মনে হয়েছিল এতো মানুষ কেনো। আজ সারাদিন ঘুরে ঘুরে মনে হয়েছে ইস্ মানুষগুলো থাকলেই বরঞ্চ ভালো হতো। এটাই মনে হয় মানুষের চরিত্র। যা থাকে তা লাগে না ভালো। যাক সে কথা।

আজ বিকেলে এক মায়ের সাথে পরিচয় হয়েছে। এই কয়দিন তিনি নদীর পাড়ে আস্তানা গেড়েছিলেন। আজ সেখান থেকে পাগলপাড়ার এক পাশে আসন নিয়েছেন। সাঁইজির ধাম লাগোয়া পাশের চায়ের দোকানে তার সাথে পরিচয়।

চা-বিস্কুট-কেকের টাকা দিতে গিয়ে দোকানি জানালো আমার বিল নাকি দেয়া হয়ে গেছে। দূর থেকে বেশ অভিজাত দেখতে মলিন বস্ত্র পরিহিত এক মা হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন যাও বাবা, তোমাকে বিল দিতে হবে না। বিল দিয়ে দিয়েছি।

আমি অবশ্য গেলাম না, বরঞ্চ তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি বেঞ্চিতে না বসে সরু ফুটপাথের উপরে মাদুর পেতে বসেছেন। সাথে আরো দুজন। এরমধ্যে একজন অবশ্য দাঁড়িয়ে। মা পান চিবুতে চিবুতে বসবার জন্য জায়গা করে দিলো আসনের এক পাশে।

দিনের বেশিভাগ সময়টা তার সাথেই কেটে গেলো। তার ভক্ত দুই জন সারাক্ষণই তার দেখভালে ব্যস্ত। এক ফাঁকে সকলে মিলে দুপুরের সেবা নিলাম রাণীঘাটের একপাশে। ভক্ত নারী দুজন সেখানেই রান্নার আয়োজনও করে ফেলেছে। মায়ের হাঁটাচলা, কথাবার্তা, ভাব-ভঙ্গীতে একটা রাশভারী বিষয় আছে।

মূলত তার সম্পর্কে জানার এক দুর্নিবার আকর্ষণ নিয়েই আমি ঘুরছি। কিন্তু তিনি বিশেষ কথা বলনে না। দু হাতে প্রতি আঙ্গুুলে অগনতি আংটি, কবজি থেকে প্রায় কুনুই পর্যন্ত বিভিন্ন মেটালের বালা। চোখে মোটা করে দেয়া কাজল। কপালে বড় আকাড়ের লাল টিপ।

তবে তারা আড্ডা জমায় না। খেয়ে দেয়ে বা খাবার হাতে করে নিয়ে চলে যায়। আমি তার সাথে এখানে সেখানে যাচ্ছি এটা সেটা খাচ্ছি। কোনো কিছুরই পয়সা দিতে দিচ্ছেন না। মেলা প্রাঙ্গনে এখনো গোটা কয়েক দোকান আছে এটা সেটা বিক্রি করছে। মা জননী সেখান থেকে কত কি কিনলেন।

চিকন লাল পাড়ের সাদা শাড়ি আর মাথার জটা। পান খাওয়া লাল ঠোটের ষাঠার্দ্ধ মা জননী যতই মলিন বস্ত্র পরিধান করুক না কেনো আভিজাত্য, নেতৃত্ব, মানুষকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়ার বিষয়টা রয়েই গেছে। সাধুদের আমি চিনতে পারি না সত্য। তবে কর্পোরেট জগতে থেকে অভিজাত সমাজের মানুষকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি।

এই মা জননীর মাঝে সেই একটা বিশেষ ভাব কোথায় জানি ঝলক দিয়ে উঠছে। তাই তার সাথে রয়েছি। জানার একটা সুপ্ত ইচ্ছে হলো তিনি কেনো এই পথে। আর এই পথে হয়েও কেনো তিনি বিচ্ছিন্ন? তার আশেপাশে তিনি কাউকেই তেমন ভিড়তে দেন না।

অজ্ঞাত কারণে আমাকে এখনো কিছু বলেন নি। মানে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেননি। অনেকেই ভিড় জমাতে চায় কিন্তু তার দৃঢ় কণ্ঠের বকুনিতে কাছে ভিড়তে আর সাহস রাখে না। তবে পাগলদের জন্য তার অগাধ মায়া। পাগলদের ডেকে ডেকে খাওয়ান। বিষয়টা বেশ লাগে। পাগলরাও তার মহা ভক্ত। এসেই মা বলে ভক্তি দেয়।

তবে তারা আড্ডা জমায় না। খেয়ে দেয়ে বা খাবার হাতে করে নিয়ে চলে যায়। আমি তার সাথে এখানে সেখানে যাচ্ছি এটা সেটা খাচ্ছি। কোনো কিছুরই পয়সা দিতে দিচ্ছেন না। মেলা প্রাঙ্গনে এখনো গোটা কয়েক দোকান আছে এটা সেটা বিক্রি করছে। মা জননী সেখান থেকে কত কি কিনলেন।

আমাকে একটা খেলনা পুতুল কিনে দিয়েছে আমার মেয়ের জন্য। আমি সেই বিশাল সাইজের পুতুল নিয়ে তার পিছু পিছু ঘুরছি। দুপুরে সেবার পর তার সঙ্গী দুজন একটু গড়াগড়ি দিচ্ছে। আমি ঘাটে বসে ভাবছি কি করি। ঘুম ঘুম ভাব আমারো হচ্ছে। মা জননী রসিয়ে আয়েশ করে পান চিবুচ্ছেন।

ভাবছিলাম বাজানের কাছে গিয়ে একটু গড়াগড়ি দেই। তখন দেখলাম মা জননী আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমিও ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। মা জননী হাঁটা দিয়েছেন ধামের দিকে। আমিও তার পিছু নিলাম। সেই কথা হীন হাঁটা গিয়ে থামলো একেবারে শ্মশান ঘাটে গিয়ে।

নদীর ঠাণ্ডা জল পা বেয়ে মাথায় উঠে আসছিল। সারা দেহ জুড়ে ছড়িয়ে পরতে পরতে এক চরম প্রশান্তির বার্তা দিয়ে কি জানি একটা বলতে চাইছিল। আমি চোখ বন্ধ করে কান পেতে তার তরঙ্গ অনুভব করতে লাগলাম। মায়ের কণ্ঠের গানটা মাদকতা ছড়িয়ে দিয়ে চোখ বেড়ে জল নেমে আসছিল। মা জননী গাইছেন-

নদীর পাড়ের কিছু অংশ বাঁধা হয়েছে। এ পাশটায় বড় গাছ নেই বললেই চলে। সদ্য গজানো লিকলিকে দু একটা গাছ বেড়ে উঠছে। ইস্ পরিকল্পনা করে গাছপালা লাগালে ছায়ায় বসা যেত। বা এমনো বলা যায় হয়তো গাছপালা না কেটে ফেললে আদি গাছের নিচেই বসা যেত। যাক মা জননী থামলেন না।

তিনি হাঁটতে হাঁটতে ঠিকই একটা বিশাল পাকুড় গাছের কাছে পৌঁছে গেলেন। বুঝলাম এসব এলাকা তার নখদর্পনে। গাছটার নিচে উল্টে রাখা একটা নৌকার উপর বসে মা গুণ গুণ করে গাইতে লাগলো। আমি নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

নদীর ঠাণ্ডা জল পা বেয়ে মাথায় উঠে আসছিল। সারা দেহ জুড়ে ছড়িয়ে পরতে পরতে এক চরম প্রশান্তির বার্তা দিয়ে কি জানি একটা বলতে চাইছিল। আমি চোখ বন্ধ করে কান পেতে তার তরঙ্গ অনুভব করতে লাগলাম। মায়ের কণ্ঠের গানটা মাদকতা ছড়িয়ে দিয়ে চোখ বেড়ে জল নেমে আসছিল। মা জননী গাইছেন-

নিগূঢ় বিচারে সত্য তাই গেল জানা।
মায়েরে ভজিলে হয় বাপের ঠিকানা।।

পুরুষ পরওয়ারদেগার
অঙ্গে ছিল প্রকৃতি তাহার,
প্রকৃতি প্রকৃতি সংসার
সৃষ্ট সব জনা।।

নিগূঢ় খবর নাহি জেনে
কেবা সেই মায়েরে চেনে,
যাহার ভার দিন দুনিয়ার পর
দিলেন রব্বানা।।

ডিম্বের মধ্যে কেবা ছিল
বের হয়ে কারে দেখিল,
লালন বলে সে ভেদ যে পেল
তার ঘুচল দেনা।

-বুঝলা বাপ! জীবনে হেন অপরাধ নাই যা করি নাই। এখন কেবল পাপ ধোয়ার চেষ্টা মাত্র। জানি যা পাপ করছি তা ধুইতে শত না সহস্র জনম লাগবে। তারপরও বাজান চেষ্টা তো নিতেই হবে তাই না। গুরু যদি কৃপা করে তাহলে যদি ক্ষমা পাই।

মা অঝোরে কাঁদছে আর বলে যাচ্ছেন তার জীবনের অজানা কথা। আমি তার পায়ের কাছে বসে বসে কাদছি। কেনো কাদছি জানি না। সারাজীবন তো মানুষের দু:খ-কষ্টের কথা শুনে হেসেছি। গোপনে উপহাস করেছি। আজ কান্না আটকে রাখতে পারছি না। যেন নিজের মায়ের পায়ের কাছে বসে আছি।

-খুব সুন্দরী ছিলাম। তা নিয়ে খানিকটা গড়িমাও ছিল। তার উপর বড়লোক বাবার ছোট কন্যা বলে কথা। অল্প বয়সে যা হয় আর কি। প্রাইভেট টিউটরের প্রেমে পড়ে গেলাম। সে কি প্রেম। জানাজানি হয়ে গেলো। কলঙ্ক ঢাকতে তাকে তাড়িয়ে দিয়ে বাবার এক বন্ধুর ছেলের সাথে তড়িঘড়ি করে বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো।

তার সাথে কখনোই প্রেম ভাবটা হলো না। বিয়ের পরও পড়াশোনাটা চালিয়ে গেলাম। কন্যার বয়স পাঁচ হওয়ার পর বিয়েটা আর টানতে পারলাম না। লোকটা খারাপ ছিল না। কিন্তু তার সাথে কখনো মনের মিল হয় নি আমার। আমার মনে তখন প্রেমের জোয়ার বইছে। সকাল বিকেল এর-ওর প্রেমে পড়ছি।

কোথায় যাই কিছুই বুঝতেছি না। এই সময় এক মহিলা এসে বললো, বাবার মাজারে যাইবেন নাকি? আপাদমস্তক বোরকা পরিহিত আমি মাথা নেড়ে সায় দিতে। তিনি বললো, চলেন আমিও যামু। ওরশ শুরু হইয়া গেছে। সেই বাবার আস্তানায় এক এক করে তিন মাস কাটিয়ে দিলাম।

এ নিয়ে চরম অশান্তির পর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো আমাদের। বিষয়টা আমার বাবা-মাও সেভাবে গ্রহণ করলো না। ওরাও মেয়েটাকে আমার কাছে দিলো না। তারপর শুরু হলো আমার নতুন জীবন। নতুন চাকরি। তারপর একে একে তিন-চারটা বিয়ে ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দিয়ে সম্পর্ক বিষয়টা আমার কাছে কোনো মানেই রইলো না।

এরই মাঝে নেশায় জড়িয়ে স্বামী সংসার, চাকরি সব হারিয়ে জড়িয়ে পরলাম নানা অপকর্মে। সেসব অপকর্মের কথা ভাবলে কেঁপে কেঁপে উঠতে হয় বাপ। কি করে বলি সে সব কথা। মুখে আনাও পাপ। একবার এক কঠিন কেসে জড়িয়ে পরলাম। কিছুতেই তা আর পিছু ছাড়ে না। জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো।

গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি হলো। পালিয়ে গেলাম। কোথায় পালাই। আমাকে একবার যে দেখেছে সে ভুলবে না মোটেও। তাই পালিয়ে বেড়ানোটা আমার পক্ষে সহজ না। রাজবাড়িতে এক উকিলের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু পুলিশ সেখানেও হানা দিলো।

উকিল সাহেবের বৌ আমাকে বাড়ির পেছন দিকে রাস্তায় তুলে দিয়ে বললো, আপা পালান। আমিও আবার পালালাম। কিন্তু কই যাই একা একা। পথঘাট কিছুই চিনি না। উল্টা পাল্টা চলছি। সামনে যা পাচ্ছি তাতেই উঠে পরছি।

কখনো ভ্যান, কখনো বাস, কখনো রিক্সা। এই করে করে যখন সন্ধ্যা তখন আমি ফরিদপুরের কোন একটা জায়গায়।

কোথায় যাই কিছুই বুঝতেছি না। এই সময় এক মহিলা এসে বললো, বাবার মাজারে যাইবেন নাকি? আপাদমস্তক বোরকা পরিহিত আমি মাথা নেড়ে সায় দিতে। তিনি বললো, চলেন আমিও যামু। ওরশ শুরু হইয়া গেছে। সেই বাবার আস্তানায় এক এক করে তিন মাস কাটিয়ে দিলাম।

সকলের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। মাজারের মুরব্বী বলছিল, মা ক্ষমা চাও। তিনি অসীম দয়ালু-রহমানুর রাহিম। তার দরবারে হাত তুললে কেউ খালি হাতে ফেরে না। তারপর শহরে ফিরলাম সকল কেসকামারি মীমাংসা করলাম। সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। পথে নামলাম।

এরপর থেকে বাপ মাজারে মাজারে, রওজায় রওজায়, দরবারে দরবারে ঘুরি আর মহতদের চরণে ভক্তি দিয়ে ক্ষমা চাই। যদি ক্ষমা পাই। কুল পাই না। বাপ মনের মধ্যে পাপ থাকলে ক্ষমা পাওয়া কষ্ট। বড় কষ্ট। আজ তেত্রিশ বছর ধইরা ঘুরতাছি তবু তার চরণ পাইলাম না বাপ। চরণ পাইলাম না-

আমারে কি রাখবেন গুরু চরণদাসী।
ইতরপনা কার্য আমার ঘটে অহর্নিশি।।

জঠর যন্ত্রণা পেয়ে
এসেছিলাম কড়ার দিয়ে।
সে সকল গিয়াছি ভুলে ভবে তে আসি।।

চিনলাম না সে গুরু কি ধন
করলাম না তার সেবা সাধন।
ঘুরতে বুঝি হলো রে মন আবার চুরাশি।।

গুরুরূপ যার বাঁধা হৃদয়
শমন বলে তার কিসের ভয়।
লালন বলে মন তুই আমায় করিলি দোষী।।

বাপ কতো ব্যবসা যে দেখলাম আর কতো ব্যবসা যে করছি এক জীবনে। তার হিসাব এখন আমারো মনে নাই। তবে এটুকু বুঝি সেই পাপের শেষও নাই-ক্ষমাও নাই। এখন যতই কান্দিকাটি মানুষের অভিশাপ বইলাতো একটা কথা আছে তাই না?

হাজার বছর ধইরা তার দরবারে কান্দাকাটি করলেও কি আর সেই পাপ থেকে মুক্তি আসবো??

-তাহলে এই তেত্রিশ বছর ঘুরে কিছুই পেলেন না!

-পাওয়ার হিসাব কষা বড় কঠিন বাপ। তবে হারাইও নাই কিছুই এটা সত্য। যখন বাক্স ভর্তি টেকা ছিল তখন কত চিন্তা-ভাবনা ছিল। এখন টেকাও নাই চিন্তাও নাই। তিনি ঠিকই চালায়া নেয়। তেত্রিশ বছর যখন চালায়া নিছে বাকিটাও নিবো।

-তাহলে কি পাপ-পুণ্যে কাটাকাটি হয় না?

-হয় হয়তো। কিন্তু তেমন পুণ্য তো করা লাগবো বাপ তাই না। পাপ বেশি হয়া গেলে তারে উৎড়ানো সহজ নারে বাপ। সহজ না।

সন্তানকে একবার দেখবার জন্য তিনি কি কি করেছিলেন এক কালে। কোন কোন অপরাধ আজও তাড়িয়ে বেড়ায় এসব অনেক কথাই বলেছিলেন মা জননী। বলেছিলেন উনার গুরুর কথা। গুরুমার কথা। অনেক অনেক কথা। আমার কেবলই কান্না পাচ্ছিল। কেবলই কান্না পাচ্ছিল।

এমন তো কত-শত কাহিনী তো টিভিতে-সিনেমায় দেখি। আরো কতো করুণ সব ঘটনার সাথে আমরা পরিচিত হই। কিন্তু এতো আবেগ। এতো ভালোবাসা। এতো ভক্তি কখনো আগে অনুভব করিনি। একি স্থান মাহাত্ম্য? নাকি মহতের মাহাত্ম্য?

মা জননীর অপরাধের ইতিহাস শুনে তাকে ঘৃণা করাই যৌক্তিক। কিন্তু তা আমি পারছি না। বরং তার প্রতি ভক্তি আরো বাড়ছে। উনি নিজেকে নিজেই শাস্তি দিয়ে চলেছেন। শুনেছি যাবজ্জীবন শাস্তি নাকি হয় চৌদ্দ বছর। আবার জেলখানার বছর নাকি হয় নয় মাসে।

আইনের চোখে তিনি এখন আর অপরাধী নন। কারণ তার বিরুদ্ধে কোনো কেস অবশিষ্ট নেই। কিন্তু বিবেকের চোখে তিনি আজো অপরাধী। সেই অপরাধের ক্ষমা প্রার্থী হয় ঘুরে বেড়াচ্ছেন তীর্থে তীর্থে। সাথে একথাও জেনে যে, এক জীবনে সেই ক্ষমা প্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনাই নেই।

প্রচণ্ড খিদে লাগছে। পথে কিছু খেতে দেয়নি রাসু। বলেছে ফকিরের আখড়ায় যেয়ে খাবি। আগে খেলে খিদা মইরা যাইবো। তখন শুনতে বেশ লেগেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার কথা শোনা ঠিক হয় নাই। তারচেয়ে খেয়ে দেয়ে হোটেলে গিয়ে ঘুমালে ঢের ভালো হতো।

আসলে জীবনকে দেখবার কত রকম দৃষ্টিভঙ্গী আছে তাই না। একজন মানুষ অপরাধী না সাধু চট করে তার সিদ্ধান্ত নেয়া বেশ জটিল হয়ে উঠছে ক্রমশ। অপরাধ তত্ত্বটা জানলে বেশ হতো। আপরাধ কোনটা? যেটা করে মানুষ পাপ অনুভব করে সেটা? নাকি যেটা করে মানুষ পাপ অনুভব করে না???

আবার প্রায়শ্চিত্ত কি? যাকে জোর করে ধরে শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দেয়া? নাকি যে নিজেই পাপ স্বীকার করে নিজের শাস্তি নিজেই ধার্য করে?? না আর ভাবতে পারছি না। বিষয়টা ক্রমশ জটিল হয়ে পরছে আমার পক্ষে। ঐদিকে বাজান কাল সকালে রওনা দিবেন বাড়ির পথে।

তার সাথে যাবো নাকি রাসু পাগলার সাথে যাবো এখনো বুঝে উঠতে পারছি না। নাকি সব কিছু পেছনে ফেলে কর্মক্ষেত্রে আমার শহরে আমার পরিবারে ফিরে যাবো? কিছুই যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না তখন আমি রাসুর পিছু পিছু হাঁটছি।

মা জননী ঘুমিয়েছেন পাগলপাড়ার আস্তানায়। আর বাজান অডিটোরিয়ামের নিচে। এখনো গুটি কয়েক সাধুগুরুরা আছেন। শিষ্য-ভক্ত-অনুসারীরাও আছেন। কিন্তু গত তিন দিনের তুলনায় তা এতোটাই তলানিতে যে সংখ্যায় গুণে বলা যায়।

আমরা যাচ্ছি আজিজ ফকিরের আখড়ায়। আজিজ ফকিরের বাড়িতে নাকি রাসুর দাওয়াত। সেখানে সে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। রাসুর কথায় ভরসা করে যাওয়া ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতেছিনা। কারণ আর যে কতদূর সেটাই বুঝতে পারছি না। ও কেবল বলছে- আরে অস্থির হইস না। এই তো চইল্ল্যা আসছি।

প্রচণ্ড খিদে লাগছে। পথে কিছু খেতে দেয়নি রাসু। বলেছে ফকিরের আখড়ায় যেয়ে খাবি। আগে খেলে খিদা মইরা যাইবো। তখন শুনতে বেশ লেগেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার কথা শোনা ঠিক হয় নাই। তারচেয়ে খেয়ে দেয়ে হোটেলে গিয়ে ঘুমালে ঢের ভালো হতো।

এমন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি যে ভ্যান পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নাই। তার উপর তিন দিনের অনুষ্ঠানের পর সকলেই এখন সম্ভবত রেস্টে আছে। খিদের পেটে জোনাকির আলোও আর ভালো লাগছে না। গরম গরম ধোয়া উঠা ভাতের কল্পনা করতে করতে কানে আসলো। বহুদূরে কোথাও গান হচ্ছে।

সেই গানের সূত্র ধরে যত এগিয়ে যেতে লাগলাম ততই বুঝতে লাগলাম রাসু ভুল পথে না সঠিক পথেই রওনা হয়েছে। যত এগিয়ে যাচ্ছি ততই সাঁইজির গান স্পষ্ট হচ্ছে-

নিগূঢ় প্রেম কথাটি তাই আজ আমি
শুধাই কার কাছে।
যে প্রেমেতে আল্লাহ্ নবি মেরাজ করেছে।।

মেরাজ সে ভাবেরই ভুবন
গুপ্ত ব্যক্ত আলাপ হয়রে দুইজন,
কে পুরুষ আকার কে প্রকৃতি তার
শাস্ত্রে প্রমাণ কি রেখেছে।।

কোন প্রেমের প্রেমিকা ফাতেমা
করেন সাঁই কে পতি ভজনা,
কোন প্রেমের দায় ফাতেমাকে সাঁই
মা বোল বলেছে।।

কোন প্রেমে গুরু হয় ভবতরী
কোন প্রেমে শিষ্য হয় কাণ্ডারি,
না জেনে লালন প্রেমের উদ্দীপন
পিরিত করে মিছে।।

(চলবে…)

<<লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ।। লালন বলে কুল পাবি না: সাত>>

.…………………………………………..
আরো পড়ুন:
সিজন : এক
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

সিজন : দুই
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই

লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

Related Articles

3 Comments

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • শফিক হাসান , রবিবার ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ @ ৮:৫৫ অপরাহ্ণ

    প্রথম পর্ব পরে পড়ব।
    দ্বিতীয় পর্ব পড়লাম।
    ভালো লাগল।

    • ভবঘুরে , রবিবার ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ @ ৮:৫৮ অপরাহ্ণ

      অনেক অনেক ধন্যবাদ শফিক ভাই। আপনাকেও লিখবার আমন্ত্রণ রইলো। জয় হোক।

  • Kaniz Lovely , সোমবার ৪ জানুয়ারি ২০২১ @ ৬:৫১ অপরাহ্ণ

    অজানা ঠিকানায় মনটা আটকে গ্যালো! তারপর…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!