ভবঘুরেকথা
লালন বলে কুল পাবি না

-মূর্শেদূল মেরাজ

মাথার ভেতর বেজেই চলে, লালন বলে কুলি পাবি না। গত এক বছর ধরে যে উত্তাল সময়টা আমি পার করেছি তা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য কত কি-ই না করেছি। অনেক পুরানো বন্ধুদের সাথে মাঝে মধ্যে সাক্ষাৎ করেছি। যদি অন্য কোনো ভাবনা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে জীবনটা সরল রেখায় নেয়া যায়।

মাথার মধ্যে একটা মলিন শুভ্রবস্ত্র পড়া একটা আলাভোলা লোক আমাকে-আমার চিন্তা-চেতনা ডিকটেট করবে তা আমি মানতে পারছিলাম না কিছুতেই। সর্বক্ষণ যা করছি তাতেই শীর্ষেন্দুর গল্পের নিষ্পাপ ভূতের মতো কেউ এসে দাঁড়িয়ে সরল ভাবে যেন সে সম্পর্কে জানতে চাইছে।

এটা করছি কেনো। ওটা করছি কেনো। এর কি আদৌ প্রয়োজন আছে? এমন সব জীবন তামাতামা করে দেয়া প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতে আমি বিরক্ত। আবার এসব না হলেও যেন আর ভাবতে পারি না। এরজন্য যে আমি নিজেকে বদলে নিয়েছি তা তো নয়।

বেশ ঠিকঠাক মতোই সব কিছু সামলে নিচ্ছিলাম। কিন্তু মনে একটা গোপন ক্ষরণ তো হয়ই। এমন কিছু ক্ষরণ তো মানুষের থাকেই। যা না যায় বলা, না যায় সওয়া।

এমনি একটা উৎভ্রান্ত দিনে অফিস শেষে কোনো কিছু না ভেবে শাহবাগের দিকে রওনা হলাম। পাবলিক লাইব্রেরিতে কি একটা ফিল্ম ফেস্টিভাল চলছিল। সব বিদেশী ভাষার ছবি। ঢুকে পরলাম ছবি দেখতে। বহুদিন ঘটা করে সিনেমা দেখা হয় না।

মাল্টিপ্লেক্স এসে সিনেমা দেখবার ধরণটা পাল্টে দিয়েছে। আগে সিনেমা দেখবে বলে মানুষ হলে যেত। এখন শপিং করতে করতে বা খাওয়ার ফাঁকে একটা সিনেমা দেখে নেয় আর কি। পাবলিক লাইব্রেরিতে না আসলে লোকে যে এখনো ভিড় করে সিনেমা দেখে সেটাও জানতে পারতাম না।

আরো অবাক হলাম যখন তালিকা দেখে টিকেট কাটতে গিয়ে দেখি বিদেশী ভাষার প্রায় কোন সিনেমারই টিকেট নেই। শেষে সত্যজিৎ রায়ের একটা সিনেমার টিকেট কেটে ঢুকে পরলাম। চলছিল উত্তম কুমার অভিনীত ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রটি।

তবে ঢাকা থেকে এতো দূরে কুষ্টিয়ায় এসে আজ এই সাধুর/শিল্পীর কথা শুনে সেই সব অকৃতজ্ঞার কথা স্মরণ আসলে, তাকে আর বিশেষ দোষ দিতে পারলাম না। নিজেই তো দোষী। মনে মনে একটা দুর্বল প্রতিজ্ঞা করলাম। এবার শহরে গেলে রফিক ভাইয়ের কাছে গিয়ে সত্যি সত্যি প্রাণ থেকে ক্ষমা চাইবো।

চলচ্চিত্রের এক পর্যায়ে উত্তম কুমার আর তার বন্ধুর মধ্যে আবেগঘন কিছু সংলাপ আমার চিন্তা-চেতনাকে স্থির করার বদলে উত্তাল করে দিয়েছিল। নায়ক চলচ্চিত্রটা টিভিতে আগেও দেখেছিলাম কিন্তু।

বিমর্ষ উত্তমকুমার বলছেন- জানি জানি… একটাই লাইফ টাইম… একটাই চান্স…

বন্ধু জ্যোতি- তুই কি ভাবছিস বলতো?

উত্তমকুমার- আচ্ছা! তোর কি বিশ্বাস হয়? ফিল্ম এ্যাকটাররা সবাই পুতুল? …সবাই পুতুল?

বন্ধু জ্যোতি- মানুষ হয়ে তোর মাসে তিনশ তেত্রিশ টাকা মাইনে পাচ্ছ। বছরে দশ টাকা ইনক্রিমেন্ট। তারচেয়ে একটা সাকসেসফুল পুতুল হলে পার পিকচার হেসে খেলে ত্রিশ হাজার টাকা।’

এই কয়েক সেকেন্ডের সংলাপগুলো শুনে চমকে উঠেছিলাম। মনে পড়ে গিয়েছিল। দেশে ফিরে যখন মন মতো কোনো চাকরি পাচ্ছিলাম না। তখন রফিক ভাই জেচে পড়ে এগিয়ে এসেছিলেন। পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলেন। সুযোগ তো রইলোই।

তুই এক কাজ কর আমি চাকরি ছেড়ে একটা ফার্ম খুলছি তাতে জয়েন করে ফেল। পাশাপাশি অন্য কাজের চেষ্টাটাও চালিয়ে গেলি। আর সরকারি চাকরি হয়ে গেলে তো কথাই নেই।

তখন রফিক ভাই কি পরম যত্নে নিজের সর্বস্ব দিয়ে অফিসটা দাঁড় করাচ্ছিলেন। দেশের আবহাওয়ায় মানিয়ে নেয়ার মতো কোনো প্রকার অভিজ্ঞতা না থাকার পরও আমাকে নিয়ে নিয়েছিল অনেক টাকা বেতনে। হাতে ধরে সব শিখিয়েছিল।

কিন্তু অফিসের অবস্থা যখন একটু খারাপের দিকে গেলো; তখন আমি রফিক ভাইয়ের পাশে না থেকে নতুন চাকরির লোভনীয় সব অফারে ডুবে গিয়েছিলাম। একবারও রফিক ভাইয়ের দুর্দিনে কৃতজ্ঞতার বাণী পর্যন্ত শোনাইনি। আড়ালে থাকার চেষ্টা করেছি যাতে রফিক ভাই আবার দেখা হলেই না টাকা পয়সা ধার চেয়ে বসে।

উত্তর কুমার যখন সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে এসব সংলাপ বলছিল তখন মনে হচ্ছিল এর প্রতিটা শব্দ আমাকে বিদ্ধ করছে। সিনেমা শেষের আগেই বের হয়ে এসেছিলাম। আজকাল এমন প্রায়ই হয় বেশি আবেগি ভাবনায় ডুবে যাই।

অবশ্য চারপাশের এতো প্রগতির ছোঁয়া যে এসব ভাবনা থেকে বের হতেও সময় লাগে না বেশি। কেবল একটা ক্ষরণ চলতে থাকে খুব নিরবে।

তবে ঢাকা থেকে এতো দূরে কুষ্টিয়ায় এসে আজ এই সাধুর/শিল্পীর কথা শুনে সেই সব অকৃতজ্ঞার কথা স্মরণ আসলে, তাকে আর বিশেষ দোষ দিতে পারলাম না। নিজেই তো দোষী। মনে মনে একটা দুর্বল প্রতিজ্ঞা করলাম। এবার শহরে গেলে রফিক ভাইয়ের কাছে গিয়ে সত্যি সত্যি প্রাণ থেকে ক্ষমা চাইবো।

এসব যখন ভাবছি সাঁইজির ধামের বাজানের পাশে বসে বসে। তখন নিরবতা ভেঙ্গে বাজান বলে উঠলো-

-গত রাতে ছিল বিশেষ যোগ। হিসাব অনুযায়ী গতরাতেই ছিল পূর্ণিমা। কিন্তু এখন তো সরকার পঞ্জিকা মন মতো পরিবর্তন কইরা ফেলছে। তাই প্রকৃতির সাথে মেলে না। পঞ্জিকা হিসেবে অনুষ্ঠান হইছে একদিন আগে। কিন্তু গতরাতেই ছিল মূল যোগ।

-যোগ মানে?

-সবকিছুর একটা সময় থাকে না বাজান? সাধন-ভজনেরও একটা সময় থাকে। যখন ব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞানরে বোঝা সহজ হয়। চব্বিশ ঘণ্টার দিনে, সপ্তাহের সাত দিন, মাসের ত্রিশ দিন, বছরের তিনশ পয়ষট্টি দিনই সাধন-ভজন করা যায়।

কিন্তু এরমধ্যে কিছু কিছু সময় লুকায়িত থাকে। সেই সময়ে ঠিক ঠিক ভজন সাধন করতে পারলে অল্প সময়েই সেই জ্ঞান লাভ করা যায়।

-আরেকটু বুঝিয়ে বলেন না বাজান।

-দেখো চব্বিশ ঘণ্টায় প্রহর হইলো আটটা। প্রত্যেক প্রহরে প্রকৃতি তার চেহারা পাল্টে ফেলে। প্রতি মুর্হূতেই পাল্টায়, কিন্তু সেটা ধরা কঠিন। তবে প্রহরের পরিবর্তনটা চাইলে বুঝা যায়। এই আট প্রহরের একেকটা প্রহর এক এক কাজের জন্য নির্দিষ্ট আছে।

তবে মোটা কথায় চব্বিশ ঘণ্টায় দেখবা দুইটা সময় আছে যখন সব কিছু থমকে যায়। এর একটা হইলো প্রভাত আরেকটা হইলো সইন্ধ্যা। মানে সূর্যদ্বয় আরেকা হলো সূর্যাস্ত।

দেখবা সব ধর্মেই এই দুইটা সময়রে বিশেষ গুরুত্ব দিছে। ধর্ম মানা না মানা ভিন্ন কথা। কিন্তু এই সময়গুলোকে কিন্তু এমনি এমনি নির্বাচন করা হয় নাই বাজান। এর পেছনে আছে নিগূঢ় রহস্য।

আবার দেখবা প্রত্যেক ধর্মেই সপ্তাহের, মাসের, বছরের কিছু কিছু দিনের কথা উল্লেখ আছে। রাতের কথা বলা আছে। আবার সেই দিন বা রাতের একটি বিশেষ লগ্নের কথা উল্লেখ থাকে।

অনেক অনেক ক্রিয়ার জন্য দেখবা নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার কথাও বলা আছে। এরকম প্রত্যেক মতের, প্রত্যেক পথের নিজস্ব নিয়মে আচারের যেমন বিধি আছে। তেমনি কাল-লগ্ন-ক্ষণের কথা উল্লেখ আছে। এগুলো সাধন-ভজনের রীতি অনুযায়ী সেসব বিধি নির্ধারিত হয়।

এই নির্দিষ্ট মুর্হূতই হইলো যোগ। আর যোগের মধ্যে সবচেয়ে সেরা যোগ হইলো ‘মহাযোগ’। বুঝলা কিছু?

-পরিষ্কার করে বুঝেছি বললে ভুল হবে। তবে একটা ধারণা হয়েছে। তা বাজান কাল কিসের যোগ ছিল?

-বাজান তুমি যদি কোনো শিক্ষালয়ে যায়া বলো স্যার আমারে অমুক গবেষণা কেমনে করেন বলেন? তাইলে কি কেউ তোমারে তা বলব? যদি কোনো শিক্ষকের বলার ইচ্ছাও থাকে তাও কিন্তু বলার উপায় নাই। তোমারে বললেই তুমি তা বুঝবা কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।

তোমারে বলা ঠিক হবে কিনা সেটা আরেক প্রশ্ন। তুমি শোনার উপযুক্ত কিনা সেটাও বিবেচনার বিষয়। আবার যদি গবেষণায় কোনো গোপন রাখার বিষয় থাকে তাহলে সেটা তুমি গোপন রাখতে পারবে কিনা সেটাও তো বিবেনায় নিতে হবে ঠিক কিনা বলো?

-জ্বি বাজান বুঝতে পারছি।

এই যে আমি কুষ্টিয়ায় আসার পর থেকে ক্রমাগত অগ্নির চরিত্র থেকে বের হয়ে জীবন দা’র মতো করে ভাববার চেষ্টা করে চলেছি। সেটা কি অভিনয় হয়ে যাচ্ছে? আমি যতটা আন্তরিকতার ভাব করছি। আসলেই কি আমি অতটা আন্তরিক হতে পারছি মনে মনে?

এই সব বাউলফকিরপাগলদের সাথে কি আমি অভিনয় করে চলেছি কেবলই? নাকি কুষ্টিয়ার… সাঁইজির ধামের একটা মাহাত্ম্য আছে? যার ফলে আমার ভেতরে একটা কোমলতা কাজ করছে? বিষয়টা আমার ভেতর বারবার উঠে উঠে আসছে।

তারচেয়ে বড় ভাবনার কথা হলো শেষ বিচারে কে জয়ী হবে? আমার জীবন দার মতো ভববার চেষ্টা করার অভিনয়? নাকি সেই কোমলতা যা আমি খুব ভেতর থেকে অনুভব করছি?

বাকি দিনটা এসবই ভাবতে লাগলাম। যার কোনো আগাপাশতলা নেই। একবার কালীগঙ্গার ধারে গেলাম। মিলপাড়া বাজারের দিকেও গেলাম। কেমন যেন একটা অস্থিরতা কাজ করছে। আবার বাসার জন্যও মনটা কেমন করছে। মেয়েটার সাথে ফোনে কথা বলে শেষে মনটা একটু হালকা হলো।

ফোনটা অফ করে পকেটে পুরে মানুষের আসা-যাওয়া দেখছি আর ভাবছি। এতো এতো মানুষ কেনো আসে? এটা কি শুধুই আসে মেলায় বাহারি পণ্য কিনবার জন্য? মাকসুদের মেলাই যাইরে গানের সারমর্ম মেনে তারা আসে মজা করতে? নাকি আরো বেশি কিছু?

নাকি অতি উৎসাহী বাঙালী সবকিছুই যেমন ভীড় করে দেখে বা ভীড় দেখলেই জমা হয় তার জন্যই এতো মানুষ জড়ো হয়েছে? নাকি এই ছোট্ট দেশে এতো বিপুল জনসংখ্যার কোনো বিনোদন নেই বলে যা পায় তাতেই মানুষ ভীড় বাড়াতে চলে আসে?

আমি অগ্নিই বা এসেছি কেনো? আসলেই লালন সাঁইজিকে খুঁজতে? যারা সমগ্র জীবন দিয়ে লালন ফকিরকে খুঁজছেন তারাই দিশা পাচ্ছে না। আমার মতো কর্পোরেট মানুষ কি করে তার দেখা পাবে? আমি কেবল এসব দেখে নানা ব্যবসায়িক আইডিয়া ডেভলপ করতে পারি।

কি কি করলে ব্যবস্থাপনাটা আরো উন্নত করা যায়। একটা বিজনেস বের করে আনা যায়। লালনকে কি করে মার্কেটিং-এর টুলস হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কি করে প্রোজেক্ট বের করে টাকা কামিয়ে নেয়া যায়। এসবই তো আমার ভাবনার বিষয়বস্তু হওয়ার কথা।

তখন সেই লেখালিখিতে ব্যস্ত ভদ্রলোক আমাকে ইশারা করে কাছে ডাকলেন। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন। ভাই এরা সব ভণ্ড। এদের পাল্লায় পরবেন না। অভাবী অভাবী ভাব দেখায়া পরের টাকায় তামাশা করে। ভণ্ড ফকিরে ভরা। সাধুগুরুদের বিশ্বাস করবেন না। এরা এক একটা আস্তা শয়তান।

কিন্তু মিথ্যা বলছি না, আমি কেনো যেনো সেসব ভাবতে পারছি না। বা চাইছি না। কিন্তু গত এক দশকের বেশি সময়ে আমি যেখানে গেছি। দেশ-বিদেশ এমনকি গ্রামের বাড়িতে গেলেও মনে হয়েছে কি করে একটা প্রোজেক্ট বের করে পয়সা কামানো যায়।

নাহ্ আর ভাবতে পারছি না। এটাও বুঝছি না বাজানের কাছে ফিরে যাবো? নাকি রাসু পাগলাকে খুঁজতে বের হবো? এসব ভাবতে ভাবতে আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম। দোকানী বললো, ভেতরে আইসা বসেন। এখন ফাঁকা আছে।

আসলেই অনেকটা সময় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে পা টনটন করছিল। মাথা নুইয়ে দোকানে ঝোলানো জিনিসপত্র বাঁচিয়ে আলো আধারিতে দোকানের বিশাল টেবিলের দুই পাশে পাতা বেঞ্চির একটিতে বসে পরলাম।

ভেতরের দিকে অন্ধকার অংশে বেশ বয়স্ক দুইজন বসে বনরুটি-কলা খাচ্ছে। দুজনের মাঝে বেশ ভাব বোঝা যাচ্ছে। তারা নিজের মতো কথা বলছে। তাদের ঠিক উল্টোদিকে বসা এক ভদ্রলোক এই প্রায় অন্ধকারের মধ্যেও কাগজ কলমে কি সব লিখছেন। দেখলেই বোঝা যায় শহুরে মানুষ।

আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আবার লেখায় মনোযোগ দিলেন। বয়স্ক দুই ভদ্রলোক বারবার হিসেব জানতে চাইছেন দোকানির কাছে। কত টাকা খেলেন এই সব। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম উনাদের খিদে মিটেনি কিন্তু টাকার হিসেবে আর খাবেন কি খাবেন না ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।

তাদের একজনের গায়ে কটকটা হলুদ রঙের পোশাক। আরেকজনের সাধারণ সাদা রঙের পাঞ্জাবী আর ঘাড়ে মলিন উত্তোরিয়। অনেকটা সময় নিয়ে তারপর তাদের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। যা কথা হয় আর কি। ঐ কোথা থেকে এসেছেন। কবে এসেছেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।

আরো অনেকটা সময় নিয়ে বললাম আপনাদের কি রাতের সেবা দিতে পারি? আমিও সেবা নিবো। চলেন একটা খাবার হোটেলে যাই। তারা অবশ্য ঘাইঘুই করলেন। আমি একটু জোর করেই নিয়ে গেলাম। চায়ের বিল মিটিয়ে যখন দুই সাধুকে নিয়ে দোকান থেকে রাস্তায় পা রাখতে যাচ্ছি।

তখন সেই লেখালিখিতে ব্যস্ত ভদ্রলোক আমাকে ইশারা করে কাছে ডাকলেন। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন। ভাই এরা সব ভণ্ড। এদের পাল্লায় পরবেন না। অভাবী অভাবী ভাব দেখায়া পরের টাকায় তামাশা করে। ভণ্ড ফকিরে ভরা। সাধুগুরুদের বিশ্বাস করবেন না। এরা এক একটা আস্তা শয়তান।

পকেট থেকে দেশের একটা স্বনামধন্য পত্রিকার ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিলেন। বললেন- আপনাকে দেখেই মনে হয়েছে আপনি নতুন মানুষ। তাই একটু সতর্ক করলাম। বাকিটা আপনার ইচ্ছা। এই সব ফকিরদের ভণ্ডামি-নষ্টামির কথা জানতে হলে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। আমি কালও আছি। আপনার নাম্বারটা দেন।

আমার ধারণা ছিল এতোটা গভীরভাবে কেবল উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিত জনরাই ভাবতে পারে। অফিসের বিভিন্ন প্রজেক্টে মাঝে মধ্যে যে সকল শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীদের ইনক্লুড করতে হয়। তাদের চিন্তা-ভাবনা থেকেও এই যে না খেতে পারা মানুষগুলো চিন্তা-ভাবনা এতোটা গভীরে হতে পারে তাই বা কে বিশ্বাস করবে?

আমি নাম্বারটা দিলাম মুখে মুখে। তারপর কথা না বাড়িয়ে বেড়িয়ে আসলাম। সাধু দুইজন দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোকের কথাগুলো পুরোপুরি না শুনলেও যে তারা আন্দাজ করতে পেরেছে তা তাদের অঙ্গ-ভঙ্গি দেখেই আন্দাজ করতে পারলাম।

পরিবেশটা হালকা করতে আমি হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে গেলাম। তারা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো- আপনি সেবা নেন। আমরা নইলে মঞ্চের দিকে যাই।

আমি অবশ্য তাদের কথা শুনিনি। কিছুটা জোর করেই একটা ভাতের হোটেলে নিয়ে গেলাম। কোন মতেই তাদের বিশেষ কিছু দিয়ে খাওয়াতে পারলাম না। তারা আলু ভর্তা, সবজি আর ডাল দিয়ে খেয়ে নিলো। এক যাত্রায় আর পৃথক ফল করে লাভ কি। আমিও সেই পদ দিয়েই সেবা সেরে নিলাম।

যদিও আমার মোটেও খিদে পায়নি। তাদের সঙ্গ দেয়ার জন্যই খাওয়া। খেতে খেতে অনেক আলাপ হলো তাদের সাথে। জীবনের সহজ সরল অনেক সত্য জানলাম-শুনলাম। বুঝবার চেষ্টা করলাম। তাদের সাথে কথা বলতে বলতে দাদার কথা মনে পরছিল।

এই বয়সে দাদার সাথে যখনি দেখা হতো তিনি সর্বক্ষণ তার সম্পদ-সম্পত্তি-দেহের রোগবালাই আর আত্মীয় স্বজনের খুনসুটি করে সময় কাটিয়েছেন। কে কাকে কি দিলো। কার জন্য তিনি কি কি করেছেন। কারা তার প্রতিদান দেননি। ইত্যাদি ইত্যাদি।

দাদাকে আমি এসব কথাবার্তার বাইরে তেমন কিছু বলতে শুনিনি কখনো। বাবাকেও না। অবশ্য বাবার কাছে ক্যারিয়ার শব্দটা সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে। বাবা-দাদাদের বয়সী মানুষরা যে এর বাইরেও জীবন নিয়ে এতোটা ভিন্নভাবে ভাবতে পারে তা কে জানতো।

আমার ধারণা ছিল এতোটা গভীরভাবে কেবল উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিত জনরাই ভাবতে পারে। অফিসের বিভিন্ন প্রজেক্টে মাঝে মধ্যে যে সকল শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীদের ইনক্লুড করতে হয়। তাদের চিন্তা-ভাবনা থেকেও এই যে না খেতে পারা মানুষগুলো চিন্তা-ভাবনা এতোটা গভীরে হতে পারে তাই বা কে বিশ্বাস করবে?

অনেক সময় তাদের ব্যবহৃত শব্দগুলো নতুন বা শিক্ষিত সমাজ থেকে আলাদা। কিন্তু তাদের বোধের জায়গাটা দেখে সত্যিই সম্মান না করে উপায় থাকে না। অনেকটা হাঁটাহাঁটি আর আলাপের পর একটা গান শোনার আবদার করতে। হলুদ পোশাক পড়া সাধুটি শশ্মানের পাকা ভিটেটার উপর বসে গাইতে শুরু করলেন-

যদি গৌর চাঁদকে পাই।
গেল গেল এ চার কুল
তা’তে ক্ষতি নাই।।

কি ছার কূলের গৌরব করি,
অকূলের কূল গৌর হরি,
এ ভব তরঙ্গে তরী
গৌর গোঁসাই।।

জন্মিলে মরিতে হবে,
কুল কি কার সঙ্গে যাবে,
মিছে কেবল দুই দিন
ভবে,কূলের বড়াই।।

ছিলাম কূলের কূলবালা,
স্কন্ধে লয়ে আছলা ঝোলা,
লালন বলে গৌর বালা
আর কারে ডরাই।।

-অগ্নি সাহেব… অগ্নি সাহেব… দাঁড়ান…

পেছনে তাকিয়ে দেখি সেই দোকানে দেখা হওয়া সাংবাদিক ভদ্রলোক ভীড় ঠেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি ধামের দিকে যাচ্ছিলাম। রাত প্রায় শেষের দিকে। এখনো মানুষের স্রোত। তবে বেশিভাগ মানুষ এখন ফিরছে।

ভদ্রলোক রীতিমতো হাঁপাতে হাঁপাতে আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো-

-তা কত খসলো?

-মানে?

-মানে আবার কি… ভণ্ড সাধুফকিরদের পেছনে কত খরচ করলেন? কি খাওয়ালেন বিরিয়ানি??

বুঝলাম ভদ্রলোক আমাকে মূর্খ প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। আমি তার কাছ থেকে সুযোগটা কেড়ে নিলাম না। প্রথমটায় একটু চটে উঠতে গিয়েও শেষটায় নিজেকে সামলে নিলাম।

তিনি বলতে লাগলেন তার অভিজ্ঞতার কথা। সব সাধুগুরুরাই আদৌতে ভণ্ড। তারা কোনো কাজটাজ কিছুই করে না। কিছু ভক্ত বানায় তাদের টাকায় খায় দায় ঘুরে বেড়ায়। এক গাদা সঙ্গিনী নিয়ে থাকে। নানা অনাচার করে বেড়ায়। আর সেজে থাকে সাধু।

এসব শুনতে শুনতে এক সময় বললাম- ভাই আপনার যদি এসব নাই ভালো লাগে তাহলে আসেন কেনো?

বিষয়টায় বেশ মজা পেলেন ভদ্রলোক। সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে বললেন- ঢাকার বাইরে এসাইমেন্টে গেলে মোটা টাকা পাওয়া যায়। অফিসের টাকায় বেড়ানো হয়। তার উপর কয়টা দিন বাড়ি থেকে দূরে থাকা যায়। নয়তো ঢাকায় তো সেই একঘেয়ে জীবন। আর ভালো লাগে না বুঝলেন।

সাধুগুরুদের নানা বিষয়ে তার আপত্তি শুনতে শুনতে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম। ভদ্রলোককে আমার চরম বিরক্ত লাগছে কেনো? ভদ্রলোক আমার সরল চিন্তা করার চেষ্টাটাকে উল্টে দিতে চাইছে বলে? নাকি ভদ্রলোক সেই ভাবে ভাবছে আমি যে ভাবে সারাজীবন ভেবেছি।

নাকি যে ভাবে প্রকৃতপক্ষে ভাবা উচিৎ উনি আসলে সেই ভাবেই ভাবছেন। আমিই জীবন দা’র পড়িয়ে দেয়া টিনের চশমা পরে ভিন্নভাবে সবকিছু বুঝবার চেষ্টা করছি। হাঁটতে হাঁটতে কখন মঞ্চের দিকটায় চলে এসেছি বুঝতে পারিনি।

ভদ্রলোক বকেই চলেছেন। আমি উনার কথা-আমার নিজের ভাবনার কথা সব কিছু বাদ দিয়ে মঞ্চের দিকে মন ঘুড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে এক সময় প্রবীন এক বাউলে গাওয়া গানে ডুবে যেতে শুরু করলাম। বাউল গাইছেন-

গুরুপদে ডুবে থাকরে আমার মন।
গুরুপদে না ডুবিলে জনম যাবে অকারণ।।

গুরু-শিষ্য এমনি ধারা
চাঁদের কোলে থাকে তারা,
আয়নাতে লাগায়ে পারা
দেখে তারা ত্রিভুবন।।

শিষ্য যদি হয় কায়েমী
কর্ণে দেয় তার মন্ত্রদানী,
নিজ নামে হয় চক্ষুদানী
নইলে অন্ধ দুই নয়নে।।

ঐ দেখা যায় আন্‌কা নহর
অচিন মানুষ অচিন শহর,
সিরাজ সাঁই কয় লালন রে তোর
জনম গেল অকারণ।।

(চলবে…)

<<লালন বলে কুল পাবি না: চার ।। লালন বলে কুল পাবি না: ছয়>>

…………………………………………..
কাভার ছবি: মাহামুদুল হাসান

.…………………………………………..
আরো পড়ুন:
সিজন : এক
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই
লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

সিজন : দুই
লালন বলে কুল পাবি না: এক
লালন বলে কুল পাবি না: দুই

লালন বলে কুল পাবি না: তিন
লালন বলে কুল পাবি না: চার
লালন বলে কুল পাবি না: পাঁচ
লালন বলে কুল পাবি না: ছয়
লালন বলে কুল পাবি না: সাত
লালন বলে কুল পাবি না: আট

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • IbrahimKhalil , বুধবার ২৮ অক্টোবর ২০২০ @ ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

    লেখাটি অসম্ভব ভালো লাগছে। আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে। অসংখ্য ধন্যবাদ লেখক ও সংশ্লিষ্টদেরকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!