ভবঘুরেকথা
মা মনসা

সাধারণ জীব হয় কেবল প্রকৃতি হয়ে নির্জীবতায় জীবন অতিবাহিত করে অথবা পুরুষ হবার বাসনায় আধিপত্য করে। তবে মূলে দুটোই এক, কারণ পারমার্থিক সত্তাকে বোঝার কোন প্রচেষ্টা থাকে না। নিজেকে জানা বোঝার কোন কাজ চোখে পড়ে না।

তবে যারা করে তারাও জীবের ঊর্ধ্বে উঠতে সক্ষম নয়, কারণ তার কারবার শুধু চিন্তায় কোন কর্ম তার নেই। নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকলে তো আর জীবের ঊর্ধ্বে ওঠা যায় না। বরং জীবত্বের পুনরাবৃত্তি হয়। যদিও সে পুনরাবৃত্তি যথার্থ বিচারে ইতিহাস নয়।

কারণ সেখানে নতুন কিছু নির্মাণ নেই, বিকাশ নেই। বিকাশ বা নির্মাণের মাধ্যমে পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা ইতিহাস পদবাচ্য। আমরা ‘মানুষ’ বলতে যে ধারণা পোষণ করি তিনি সাধনা করেন সেই মানুষ হতে। কারণ মানুষ হতে গেলেই সাধনা লাগে। দেবতার ফয়সালা মানুষ ছাড়া কেউ করতে পারে না।

তাই শাস্ত্রে বা শাস্ত্রের বাইরে মানুষের মাহাত্ম্যই বর্ণিত হয়েছে। আমরা সাধকদের পদে শুনি: মানুষের উত্তম কিছু নাই। ইতিহাসে মানুষের কোনও স্থির ধারণা নেই। আবার সর্বকালেই যে মানুষ আমরা দেখি তার প্রকাশ ঘটে ব্যক্তির মধ্য দিয়ে।

শিব-শক্তি একই বিধায় শক্তিকে প্রাধান্য দিতে আপত্তি নেই; সৃষ্টি তো শক্তিরই লীলা। তন্ত্রে এই ধারণা এখনও বিদ্যমান যে, শিবের নয় সাধনাটা শক্তিরই। তন্ত্রমতে, শিব নিজেও শক্তির আরাধনা করেন এবং শক্তিবিহীন শিব শবমাত্র।

কিন্তু ব্যক্তি কোনোভাবেই মানুষকে ধারণ করা ছাড়া ব্যক্তি হতে পারে না। মানুষ তার ইষ্টের ন্যায় রহস্যময় বিধায় ইষ্টের ফয়সালা মানুষের মধ্যদিয়েই হয়। সহজ কথায় বলা যায়, মানুষ বর্তমানে যা তা অবশ্যই মানুষের ধারণা দেয় কিন্তু মানুষ যা ভবিষ্যতে যা হবার সম্ভাবনা রাখে তা যুক্ত করে মানুষ সম্পর্কে আপাত দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করা যায়।

মূলত, মানুষের সন্ধান করাই আসল সন্ধান। এই কারণে বৃহৎ বঙ্গের ভাবভক্তি চর্চায় ‘মানুষ’ ধারণাটা ব্যাপক শক্তির পৌঁছে গেছে। ফলে ইষ্টকে মানবায়িত করার প্রচলিত কারণের বাইরেও আরেকটা কারণের সন্ধান আমরা পেয়ে গেলাম।

প্রচলিত কারণ বলতে বোঝায়, যা আমরা বইপত্রে পড়ে থাকি। বইপত্রের কথা হল, নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে বিচার করতে মানুষ দেব-দেবতার মধ্যে মানুষের বৈশিষ্ট্য চাপিয়ে দেয়। এটা যে অস্বীকার করা হচ্ছে এমন নয়। কিন্তু বৃহৎ বঙ্গ, তার কাছে আরেকটা দার্শনিক কারণ থাকতে, এই কথাতে সম্পূর্ণ একমত হবে কেন?

বাঙলার ভাব অনুযায়ী মানুষ হওয়া কেন দরকারী সেটা জুড়ে দিলে দেবতার মানবায়নের ব্যাপারটা পুরোপুরি বোধগম্য হবে। আমরা এক্ষেত্রে বাড়তি করে একটা কথা যুক্ত করতে পারি যে, বাঙলার ভাবানুসারে দেবতাকে মানুষ হতেই হবে।

মনসা কেন মানুষ, অবশ্যই বৃহৎ বাঙলার ভাবভক্তির জায়গা থেকে, তা আর আমাদের বুঝতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু ঝামেলার জায়গা হল তিনি নারী। তাঁকে নারী কেন হতে হল এর মীমাংসা না করলে অসুবিধা রয়েই যাচ্ছে।

নারী আকারে বোঝার সাথে তন্ত্রের দার্শনিক জায়গা জড়িত। কারণ তন্ত্রমতে শক্তিই সকল কিছুর মূল এবং পুরুষ ও প্রকৃতি অভেদ। জড় ও চৈতন্যকে তন্ত্র একই সত্তার দ্বৈত রূপ হিসেবে বিচার করে। আর সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় এই দ্বৈত সত্তার নাম শিব-শক্তি।

শিব-শক্তি একই বিধায় শক্তিকে প্রাধান্য দিতে আপত্তি নেই; সৃষ্টি তো শক্তিরই লীলা। তন্ত্রে এই ধারণা এখনও বিদ্যমান যে, শিবের নয় সাধনাটা শক্তিরই। তন্ত্রমতে, শিব নিজেও শক্তির আরাধনা করেন এবং শক্তিবিহীন শিব শবমাত্র।

সে বিচারে নারীকে বিশেষায়িত করাটা কোনও নিপীড়নের চিহ্ন নয় বরং নতুনভাবে দার্শনিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। তাহলে দেখা গেল, নারী হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার বিধায় মনসা নারীরূপে আবির্ভূতা হয়ে দার্শনিক বিচারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। মনসা মানুষ এবং নারী। তাই যথার্থ বিচারে তিনি মানবী।

শক্তিকে প্রধানের জায়গা থেকে বুঝতে গিয়ে এবং শক্তিরই লীলা আকারে জগৎ প্রপঞ্চকে বুঝতে গিয়ে শেষে দেবী ব্রহ্মময়ী বা নারীরূপে ধরা দিয়েছেন। বোঝানো হয়েছে দেবীই সব, দেবীর বাইরে কিছুই নেই এবং লৌকিক জীবন ও পারমার্থিক জীবন সর্বত্রই দেবী।

এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন বারংবার ওঠে যে তাঁকে বিশেষায়িত করার মাধ্যমে ছোট করার পুরুষতান্ত্রিক ব্যাপার আছে কিনা। এই প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক এখনকার বিচারে। তবে মনে রাখতে হবে, তন্ত্রের যে দার্শনিক ও ঐতিহাসিক বিচারে এর উল্লেখ তাতে নারীতো পুরুষের চেয়ে ছোট নয়ই বরং অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে শক্তিশালী।

কারণ সৃষ্টির বিস্তারই বলি আর জগৎ সংসার ঠিক রাখার কথায়ই ধরি তন্ত্রের কথায় নারী ছাড়া এগুলো সম্ভবই নয়। নারী বরাবরই প্রতিপালক ও পুরুষ আধিপত্যকামী। জগৎ টিকিয়ে রাখতে প্রতিপালন জরুরি।

তান্ত্রিক সাধকরা এই এত কথা না বলে খুব সরল ভাষায় একটা কথা বলেন যে নারীর গর্ভধারিণী হতে পারে বলে নারী পুরুষের চেয়েও শক্তিশালী। আর তন্ত্রের দার্শনিক বিকাশের সাথে কৃষির সম্পর্ক ব্যাপক। আর কৃষির সাথে নারীর সম্পর্ক কৃষির জন্মলগ্ন থেকে।

সে বিচারে নারীকে বিশেষায়িত করাটা কোনও নিপীড়নের চিহ্ন নয় বরং নতুনভাবে দার্শনিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। তাহলে দেখা গেল, নারী হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার বিধায় মনসা নারীরূপে আবির্ভূতা হয়ে দার্শনিক বিচারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। মনসা মানুষ এবং নারী। তাই যথার্থ বিচারে তিনি মানবী।

(চলবে…)

<<মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -এক ।। মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -তিন>>

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………
আরো পড়ুন:
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -এক
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -দুই
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -তিন
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -চার
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -পাঁচ
মনসা: ভাবচর্চার অদেখা দিক -ছয়


মনসাদেবীর পাঁচালী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!