জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য: দ্বিতীয় পর্ব
শব্দের মূল ভাব বা ব্রহ্মাণ্ডের শব্দকে বুঝতে গেলে যেমন নিরব হতে হয়। তেমনি দৃষ্টির মূল ভাব বা ব্রহ্মাণ্ডের মূল রূপ দেখবার জন্য দৃষ্টি বন্ধ করতে হয়। অর্থাৎ চোখ বন্ধ করে দেখতে হয়। তাতেই দৃশ্যমান হয় রূপের রহস্য।
এ এক আজব লীলা। যে ইন্দ্রিয় যার দ্বারা নিজেকে প্রকাশ করে। তাকে সঠিক ভাবে বুঝতে গেলে তার প্রকাশ বন্ধ করতে হয়। তবেই সেই ইন্দ্রিয়ের মূলে যাওয়া যায়।
জাদুশিল্পে বহুল ব্যবহৃত একটা পদ্ধতি হলো ‘ব্ল্যাক-আর্ট’। ব্ল্যাক আর্টের আবিষ্কারক জার্মানির নাট্য পরিচালক ম্যাক্স আউজিঙ্গার। জানা যায়, তার পরিচালিত একটি নাটকের দৃশ্য প্রথম মঞ্চায়নের সময় এই পদ্ধতিটি আবিষ্কৃত হয়। এই পদ্ধতি উদ্ভাবনের পেছনে আছে চমকপ্রদ এক ঘটনা।
সেই নাটকের এক দৃশ্যে পিতা তার অবাধ্য কন্যাকে একটা প্রায় অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রেখেছেন। অন্ধকার বুঝাতে পরিচালক মঞ্চের তিন দিকের দেওয়াল কালাে মখমলের পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন।
মেয়েটিকে উদ্ধার করতে ওপরের নেমে এলাে এক নিগ্রো ক্রীতদাস। এমন নাটকীয় মুর্হূতে দর্শকদের উত্তেজনায় বদলে নিরবতা দেখে পরিচালক দ্রুত মঞ্চ থেকে নেমে এলেন দর্শকের সাড়িতে। মঞ্চে তাকাতেই কারণটা স্পষ্ট হলো তার কাছে।
স্বল্প আলোয় মঞ্চে কালাে ক্রীতদাস কালাে পর্দার সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে। তাকে দেখাই যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাক্সের মাথায় এলাে ব্ল্যাক-আর্টের মূল তত্ত্ব। গাঢ় রঙের পর্দা টাঙিয়ে সেই ধরনের গাঢ় রঙের যে কোন কিছু সামনে রাখলে তা দেখা যায় না।
যদি তারা দেখে আপনার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করে নেয়া সম্ভব। তাহলে আপনার উপস্থিতিতে ভরা মজলিসে নিজস্ব লোকজন দিয়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটাবেন যে আপনি নিশ্চিত হবেন তার অলৌকিকত্বে। এতে বিশ্বাস যেমন দৃঢ় হবে তেমনি টাকা-কড়ি দিতেও পিছপা হবেন না।
আর এই তত্ত্ব মেনে আজও জগৎ জুড়ে বিভিন্ন নব নব জাদু প্রদর্শিত হয়ে আসছে। সবই ঘটছে সকলের সামনে কিন্তু উপস্থিত দর্শক তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এটাই দৃষ্টি ভ্রম। অর্থাৎ আমরা যা দেখে সিদ্ধান্তে চলে আসছি সেটি সত্য নাও হতে পারে।
আবার এমনি সব কৌশলে ভণ্ড-প্রতারক-জোচ্চরা-জালিয়াতরা নানা নতুন নতুন ফাঁদে মানুষকে ফেলে প্রতিনিয়ত। কেউ শূন্যে ভেসে দেখায়, কেউ জলের উপর হাঁটে, কেউ হাতে মুঠো খুললেই তাতে কত কি বের হয়ে আসে।
আবার অনেকে আরো এগিয়ে তৈরি করে দৃশ্য। একসময় শহরের ব্যস্ত রাস্তার পাশে দেখা যেত মৃতের উপর কাফনের কাপড় জড়িয়ে এক বা একদিক স্বজন স্বজোড়ে কাঁদছে। সে সব দেখে সাধারণ মানুষ তাদের সাধ্য মতো সাহায্যে এগিয়ে আসতো। এখন মানুষ জানে সে সব ভণ্ডামী। তাই সেই চাল এখন পুরানো।
প্রতারকরা তাই নতুন নুতন দৃশ্য মঞ্চায়ন করেন। অনেকে আবার সাধুগুরু-পীর-ফকির পর্যন্ত সেজে বসেন। অলৌকিক সব ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। যে কোনো সমস্যা সমাধানের গ্যারান্টি-ওয়ারেন্টি পর্যন্ত দেন। আপনি হয়তো এসব শুনে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য তাদের স্মরণোপন্ন হলেন।
যদি তারা দেখে আপনার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করে নেয়া সম্ভব। তাহলে আপনার উপস্থিতিতে ভরা মজলিসে নিজস্ব লোকজন দিয়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটাবেন যে আপনি নিশ্চিত হবেন তার অলৌকিকত্বে। এতে বিশ্বাস যেমন দৃঢ় হবে তেমনি টাকা-কড়ি দিতেও পিছপা হবেন না।
এমন সব প্রতারণার দৃশ্য কেবল প্রতারকরাই সৃষ্টি করেন তা নয়। এসব ঘটনার পেছনে বহু বড় বড় ষড়যন্ত্রও কাজ করে। যার কলকাঠি নাড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী। আবার তাদের মদদে স্থানীয় ক্ষমতাশালীরাও দেশে দেশে এমনকি ছোট ছোট ক্ষেত্রেও নানা দৃশ্য মঞ্চায়ন করে।
যার মূল বিষয় ছিল পরিবারের একে অন্যের নানাবিধ ছোটখাটো বিষয় নিয়ে জটিলতা। অহেতুক কিছু হাস্যরস। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-হাঙ্গামা-অবিশ্বাস ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো ভাগ ভাগ করে প্রচারের ব্যবস্থা করা হলো। দুপুরে যখন গৃহিনীরা বাড়িতে থাকবে তাদের কি দেখানো হবে।
যা দেখে সাধারণ মানুষ ভাবে তারা যা দেখছে তাই সত্য। কিন্তু তার পেছনে যে অন্য সত্য লুকিয়ে আছে সেটি তারা ধরতে পারে না। খুব সাধারণ উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হয়-
রাষ্ট্র অনেক সময় জনতাকে ‘টিনের চশমা’ পড়িয়ে রাখে। অর্থাৎ রাষ্ট্র চায় জনতা এমন সবকিছুই দেখুক যা তাদের দেখনো হবে। এর বাইরে তারা যাতে কিছু দেখতে না পারে তার জন্যই এই টিনের চশমা অর্থাৎ মূল সত্য আড়াল করে কাল্পনিক এক দৃশ্যের মঞ্চায়ন।
এসব ঘটনা মঞ্চায়নের জন্য অনেক সময় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রাষ্ট্রগুলোকে সহায়তা করে। প্লট সাজিয়ে দেয়। রালফ ওয়াল্ডো এমারসন বলেছেন, ‘আপনি কখনই জানেন না আপনি কীভাবে অন্য ব্যক্তির চোখ দিয়ে দেখেন।’
অনেক সময় রাষ্ট্রের বা যে কোনো পরিচালনা পরিষদের দেশে বা তাদের প্রতিষ্ঠানে এমন অনেক কিছু ঘটনা ঘটানোর প্রয়োজন পরে। যাতে করে সকলের দৃষ্টি ভিন্নভাতে ঘুরিয়ে দেয়া যায়।
যেমন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতিতে হিমশিম খাওয়া মধ্যবিত্ত মানুষ যখন যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতে শুরু করে। তখন আমেরিকার মতো রাষ্ট্র বেশ পরিকল্পনা করে ‘ডেইলো সোপ’ নামে টিভিতে এমনি কিছু ফ্যামেলী ড্রামা শুরু করে।
যার মূল বিষয় ছিল পরিবারের একে অন্যের নানাবিধ ছোটখাটো বিষয় নিয়ে জটিলতা। অহেতুক কিছু হাস্যরস। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-হাঙ্গামা-অবিশ্বাস ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো ভাগ ভাগ করে প্রচারের ব্যবস্থা করা হলো। দুপুরে যখন গৃহিনীরা বাড়িতে থাকবে তাদের কি দেখানো হবে।
শিশুদের কি দেখানো হবে। কাজ শেষে গৃহকর্তা ক্লান্ত হয়ে ফিরলে তাকে কি দেখানো হবে। এমন সব মহা পরিকল্পনা নিয়ে নানা অনুষ্ঠান-নাটক নির্মাণ ও প্রচার করা শুরু হলো। আর এর প্রভাবে অল্পদিনেই মানুষ রাষ্ট্রের কাছে মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন করার পরিবর্তে নিজস্ব সব দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেলো।
মানুষ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বদলে আরো বেশি বিচ্ছিন্ন হতে লাগলো। ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ -বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়ালো। তাতে রাষ্ট্র স্বস্তি পেলো। সে শিক্ষা-চিকিৎসা-স্বাস্থ্য খাতে ভুর্তিকির বদলে সামরিক খাতে আরো বেশি বরাদ্দ করতে লাগলো। কিন্তু তাতে জনতা আর মাথা ঘামালো না।
পৃথিবীতে স্রেফ ক্ষমতার দখলে প্রতিনিয়ত অগণিত নিরিহ মানুষকে খুব পরিকল্পিতভাবে মারা হলেও কেউ ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করে না। কারণ আমরা প্রতিমুর্হূতে নিজেরাই খেলার ছলে প্রচুর মানুষ মারছি। প্রচুর কিছু ধ্বংস করছি। আমরা শিখছি জয়ী হতে হলে, টিকতে হলে, সাফল্য পেতে হলে এসব করতেই হয়।
আবার আর্ন্তজাতিকভাবে স্লো পয়েজন হিসেবে এরূপ অনেক নির্মিত দৃশ্য মঞ্চায়ন করা হয়। যা আমরা না বুঝে বিনোদনের খোরাক হিসেবে গ্রহণ করে ডুবে থাকি। এতে আমরা সত্য নিয়ে ভাবি না। কারণ আমাদের সত্য থেকে দূরে রাখতেই তো এতো এতো আয়োজন।
আমরা তাদের সাজানো নাটক দেখি। আর ভাবি এটাই সত্য। কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও এমনভাবেই সাজানো হয় যাতে করে সেই নাটকগুলোকে আমরা সত্য মেনে নিজেদেরকে জ্ঞানী ভেবে গর্ব ভরে হাঁটতে পারি। এর খুব সাধারণ একটা উদাহরণ হলো ‘ভিডিও গেমস’ বা হালের ‘মোবাইল গেমস’।
বড় বড় রাষ্ট্র মারণাস্ত্র ব্যবসাকে তাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি করতে চায়। তখন তার বৈধতা প্রয়োজন হয়। একটা সভ্য সমাজে বিশাল বিশাল সব অস্ত্র নিয়ে চারপাশে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষকে পাহারা দেয়ার জন্য দৈত্যাকার সব শমরাস্ত্রের ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হরদম মানুষ মানুষকে মারছে। বিষয়টা যে কারো মনেই ক্রিয়া করতে পারে। যে কেহই ব্যথিত হয়ে উঠতে পারে। মানবিক মানুষ মাত্রই প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম যেন বিষয়গুলোকে খুবই স্বাভাবিক ভাবে নেয় তাই খুবই সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করে খেলার ছলে তৈরি করা হলো ভিডিও গেমস থিউরি।
বিশ্বাসীরা বলেন, তিনি এই জগতকে এমনভাবে পরিচালনা করেন। যাতে সবকিছুই প্রকাশ্যে আছে। সকল সত্যই দৃশ্যমান। কিন্তু কেবলমাত্র যথার্থ সত্যানুসন্ধানী অর্থাৎ প্রজ্ঞাবান সাধকই তা ধরতে পারে। আর বাকিরা বিষয় বাসনার মায়াজালে বন্দি হয়ে জন্মান্তরের খেলায় মত্ত থাকে।
প্রথমে মানুষকে আকৃষ্ট করতে সাধারণ বিষয়ের কিছু খেলা তৈরি করলেও। এর মূল অংশ জুড়ে সব সময়ই স্থান দেয়া হলো মারামারি-কাটাকাটি-যুদ্ধ-হত্যা ইত্যাদিকে ঘিরে। এই বির্ভস্য-মর্মান্তিক-লোমহর্ষক-পৈচাশিক কিন্তু যথেষ্ট আকর্ষণীয় সব খেলায় মত্তা থাকা প্রজন্মের কাছে ধীরে ধীরে বিষয়গুলো স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
পৃথিবীতে স্রেফ ক্ষমতার দখলে প্রতিনিয়ত অগণিত নিরিহ মানুষকে খুব পরিকল্পিতভাবে মারা হলেও কেউ ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করে না। কারণ আমরা প্রতিমুর্হূতে নিজেরাই খেলার ছলে প্রচুর মানুষ মারছি। প্রচুর কিছু ধ্বংস করছি। আমরা শিখছি জয়ী হতে হলে, টিকতে হলে, সাফল্য পেতে হলে এসব করতেই হয়।
এভাবেই আমাদের ‘আই ওয়াস’ করা হচ্ছে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। আর যেহেতু আমরা দৃষ্টিকেই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ইন্দ্রিয় মানি, তাই চোখের দেখাকে অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু ঐ যে টিনের চশমা পড়ে আছি। তাই মূল সত্য দেখতে পাই না। মায়াজালে বন্দি হয়ে থাকি।
এই মায়াজালের-বিষয় বাসনার খেলা যে কেবল আমাদের ঘিরে থাকা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-রাষ্ট্র-বিশ্ব খেলে থাকে তাও কিন্তু নয়। এই মায়াজালের খেলা আমাদের সাথে খেলেন স্বয়ং যিনি এই ব্রহ্মাণ্ড রচনা করেছেন তিনিও। জ্বি আমি সেই পরম, পরমেশ্বরের কথাই বলছি।
বিশ্বাসীরা বলেন, তিনি এই জগতকে এমনভাবে পরিচালনা করেন। যাতে সবকিছুই প্রকাশ্যে আছে। সকল সত্যই দৃশ্যমান। কিন্তু কেবলমাত্র যথার্থ সত্যানুসন্ধানী অর্থাৎ প্রজ্ঞাবান সাধকই তা ধরতে পারে। আর বাকিরা বিষয় বাসনার মায়াজালে বন্দি হয়ে জন্মান্তরের খেলায় মত্ত থাকে।
(চলবে…)
পরবর্তি পর্ব: জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য : তৃতীয় পর্ব >>
…………………………
আরো পড়ুন:
রূপের রহস্য: পর্ব-১
রূপের রহস্য: পর্ব-২
রূপের রহস্য: পর্ব-৩
রূপের রহস্য: পর্ব-৪
রূপের রহস্য: পর্ব-৫
রূপের রহস্য: পর্ব-৬
রূপের রহস্য: পর্ব-৭
রূপের রহস্য: পর্ব-৮
রূপের রহস্য: পর্ব-৯
রূপের রহস্য: পর্ব-১০