জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য: তৃতীয় পর্ব
সাধককুল বলে, আগে নিজেকে জানো। নিজের রূপের রহস্য অবগত হও। অর্থাৎ স্বরূপ দর্শনের সাধান কর। যদি তুমি নিজেকে জানাতে পারো তবেই তুমি সঠিকভাবে ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করতে পারবে। নইলে ধোঁকায় পরবে। এ প্রসঙ্গে মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান লিখেছেন-
ভোগলা বাজীর ধোকায় পড়ে, বে-সুরে বাজালি তাল,
ঘুম দিয়া কাটালি মনা, চিরকাল।
যৌবন কাল গিয়াছে মিছে, করে যৌন অত্যাচার,
বুড়া কালে নামাজ পড়লে, যম বুঝি দেখেনা তার,
কেহ্ কয় মক্কা যাইতে, বেশী সময় নাই হাতে,
মাত্র দুই দিন তাবলিগেতে, কলেমা পড়ে নাজেহাল।
ঘুম দিয়া কাটালি মনা, চিরকাল।
টুপি জুব্বা লম্বা দাড়ি, রাখিয়া মুসলমানী,
বনের পশু জবাই করে, নাম ফালালি কুরবানি,
ছিলো কোরানের বচন, দিও প্রাণ প্রিয় ধন,
গরু কি তোর এতই আপন, যে রক্তে হইলি লাল।
ঘুম দিয়া কাটালি মনা, চিরকাল।
বড় গরু জবাই করে, বিয়াই বাড়ি দিলি রান
এক টুকরা মাংসের লাগি, কান্দে গরীব পোলাপান,
ঐ মাংস ফ্রিজে থুইয়া, খাইলি বছর ভরিয়া,
গেছে পাপে পাপে বোঝাই হইয়া, মরা গাছের শুকনা ডাল।
ঘুম দিয়া কাটালি মনা, চিরকাল।
রসে-বাতে শর্দি-কাশে, ধরে গেছে হাঁপানী,
জীবন খাতার শূন্য পাতায়, লাইগাছে টানাটানি,
দিয়া ইসলামের দোহাই, শুধু বেকার গুরি খাই,
দাড়ি টানি তজবি ঝুলাই, আল্লাহ কই? ফুলাইয়া গাল।
ঘুম দিয়া কাটালি মনা, চিরকাল।
মাতাল রাজ্জাকে কয় সারা জীবন, লুইটা খাইলি পরের মাল,
তাই দেখিয়া পিছন হইতে, চোখ রাঙ্গাইছে মহাকাল,
জালাল/মাতাল ছেড়ে দে খেলা, আমার ডুইবাছে বেলা,
ঐ চেয়ে দেখ ঘোলা ঘোলা, দোজখের আগুন বড় লাল।
ঘুম দিয়া কাটালি মনা, চিরকাল।।
পৃথিবীতে আমরা কেনো এসেছি? আমাদের প্রকৃত কাজ কি? আমরা কোথায় ফিরে যাব? সর্বোপরি ‘আমি কে’? এই সব মৌলিক প্রশ্নের উত্তরের অন্বেষণের বদলে মানুষ জড়িয়ে পরে নানা ভোগ বিলাশে। আর ভোগ বিলাশ মানুষের চোখের সামনে এমন এক চাহিদার চিত্র তৈরি করে যে, মানুষ চাইলেও আর তা থেকে সহজে বের হতে পারে না।
ইন্দ্রিয় ‘রূপ’ অর্থাৎ চোখ দিয়ে আমরা যা দেখি তাই নিজের করে পাওয়ার স্বপ্নও দেখি। অর্থাৎ এখানেও কামনা-বাসনার সৃষ্টি হয়। রূপ দেখে আমরা পাগল হয়ে যাই। নিজের করে পাওয়ার এই যে চাহিদা তা আমাদের এমনি মোহে আভীষ্ট করে যে, আমরা স্বরূপ ভুলে প্রেমে পাগল হয়ে যাই।
রূপ দেখে প্রেমে পাগল হওয়ার কথা-কাহিনী-কাব্যের শেষ নেই। তবে হেলেনের কাহিনী অনেক কাহিনীকেই পেছনে ফেলে দেয়। হেলেনের রূপে মগ্ধ হয়ে যে প্রেমের জন্ম তার জন্য ধ্বংস হয় সমৃদ্ধ নগরী ট্রয়। প্রেমের অমর কাহিনীকে ঘিরে চলা দীর্ঘ এক যুগের এই যুদ্ধের কাহিনী অমর হয়ে আছে হোমারের ‘ইলিয়াড ও ওডিসি’ মহাকাব্যে।
জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ১২৩০ সালের দিকে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস ও হেক্টর ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি করার জন্য স্পার্টায় আসেন। স্পার্টার রাজা মেনেলাউস এই দুই রাজপুত্রকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বরণ করে নেন। নৈশভোজের সময় যুবরাজ প্যারিসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী অনিন্দ্য সুন্দরী হেলেনের সঙ্গে।
প্রথম দেখাতেই হেলেনের রূপে প্রেমে পাগল হয়ে যায় প্যারিস। বড়ভাই হেক্টর যখন বাণিজ্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল। সে সময় প্যারিস গোপনে দেখা করতেন হেলেনের সঙ্গে। প্রথমে আপত্তি থাকলেও হেলেনও অল্প সময়েই প্রেমে পরে যায় প্যারিসের।
শেক্সপিয়র বলেছেন, ‘পুরো দুনিয়াটাই একটা রঙ্গমঞ্চ, আর প্রতিটি নারী ও পুরুষ সে মঞ্চের অভিনেতা; এই মঞ্চে প্রবেশ পথও আছে আবার বহির্গমণ পথও আছে, জীবনে একজন মানুষ এই মঞ্চে অসংখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন।’
সেই প্রেম এমনই প্রেম, ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা থাকা সত্বেও প্যারিসের আহ্বানে সাড়া দেয় হেলেন। মেনেলাউসের চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্যারিস গোপনে স্পার্টা থেকে বিদায়ের সময় হেলেনকে নিলেন সাথে। এ ঘটনা তার বড় ভাই হেক্টরও ক্ষুণাক্ষরে জানতে পারেনি তখনো।
যখন স্পার্টায় ছড়িয়ে পড়ে প্যারিস হেলেনকে অপহরণ করে ট্রয়ে নিয়ে গেছেন। মেনেলাউস পাগলের মতো হয়ে সাহায্যের আহ্বান জানান তার আপন ভাই আর্পসের রাজা আগামেননের। আগামেনন গ্রিসের সম্মান ফিরিয়ে আনার জন্য গ্রিসের সব রাজাকে অনুরোধ জানান।
তার আহ্ববানে সারা দিয়ে প্রায় এক হাজার জাহাজ নিয়ে ট্রয়ের উদ্দেশে রওনা দেয় গ্রিসবাসী। তারপরের সেই দীর্ঘ যুদ্ধের কাহিনী তো সকলেরই জানা।
কথায় বলে, ‘আগে দর্শনদারী পরে গুণ বিচারী’। এই দৃষ্টিদর্শনে বা দেখে কোনো কিছু সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়াও যে অনেক সময় বিভ্রান্তি হতে পারে, সে কথাও অস্বীকার করার আর উপায় থাকে না।
বেশিভাগ সময়ই দৃশ্যমান সত্য প্রকৃত সত্য হয় না। প্রকৃত সত্য নিজেকে আড়াল করে রাখে মায়াজালের আবরণে। যেমন এই বিশ্বসংসার।
শেক্সপিয়র বলেছেন, ‘পুরো দুনিয়াটাই একটা রঙ্গমঞ্চ, আর প্রতিটি নারী ও পুরুষ সে মঞ্চের অভিনেতা; এই মঞ্চে প্রবেশ পথও আছে আবার বহির্গমণ পথও আছে, জীবনে একজন মানুষ এই মঞ্চে অসংখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন।’
তবে আধুনিক সভ্যতা হলো চাকচিক্কতার পূজারী। এখানে সবাই রূপকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। আর এই রূপকে অর্থাৎ দৃশ্যমানতাকে সত্য প্রমাণের জন্য একটা কৃত্রিম সাজানো জগৎ গড়ে তুলবার জন্য সকলে ছুটে বেড়াচ্ছে।
তাতে অনেক সময়ই জীবনের গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশ না পেয়ে একটা মনগড়া মেকি চিত্র ফুটে উঠে। হয়ে উঠে একটা পোশাকী সমাজব্যবস্থা। যাতে খোলশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে রূঢ় বাস্তবতা। আর পোশাকী মূল্যায়নের কথা উঠলে পারস্যের বিখ্যাত কবি শেখ সাদীর কথা চলে আসে।
অনেকের কাছে কাঙ্খিত গুরুর স্বশরীরের সাক্ষাৎ বা রূপ দর্শনই জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। আবার অনেক সাধনে ধ্যানবলে গুরুকে দৃষ্ট করতে পারলেই সাধক ধন্য হয়ে উঠে। আবার অনেকে প্রতি নি:শ্বাসে গুরুকে স্মরণ বা গুরুরূপ দেখাকে মনে করেন চূড়ান্ত সাধন।
বলে হয়ে থাকে, শেখ সাদী একবার অভিজাত এক ব্যক্তির বাড়িতে সাদাসিধে পোশাকে উপস্থিত হন। তার মলিন পোশাক দেখে তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হলো না। সাধারণ মুড়ি-মুড়কিতে আপ্যায়িত করা হলো খ্যাতিমান কবি শেখ সাদীকে।
পরবর্তীতে কোনো এক উপলক্ষে সাদী ওই বাড়িতে পুনরায় গেলেন। এবার তার পরনে ঝকঝকে চকচকে মূল্যবান পোশাক। গৃহকর্তা এবার তাকে নিজেই খাবার এগিয়ে দিলেন। সাদী সেই খাবার না খেয়ে সবাইকে হতবাক করে নিজের পোশাকে তা ঘষতে লাগলেন।
বিস্মিত সকলের প্রতি সাদী বললো, ‘যে পোশাককে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তাকেই খাবার খাওয়াচ্ছি।’
সাধনায় ‘রূপ’ দর্শন অর্থাৎ ‘স্বরূপ’ দর্শন একটা অন্যতম অধ্যায়। প্রায় সকল মত-পথের সাধনেই সাধক চায় সেই রূপের দর্শন পেতে। যে রূপ থেকে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড আলোকময়। সেই রূপ যে রূপের সে সাধন করে। সেই রূপ যে রূপ নিয়ে সে ঘোরে ফিরে কিন্তু যাকে জানা হয়নি আজো।
কেউ বলে রূপ দর্শনই সর্বোচ্চ সাধন। আবার কেউ বলে রূপ দর্শন হলো সাধনের শুরু। সেই রূপ দর্শন হলে তবেই না যাত্রা শুরু হয়। পথের দিশা পাওয়া যায়। কোন পথে এগুতে হবে তার প্রকৃত দিকদর্শন পাওয়া যায়।
সেই রূপ দর্শন করে সাধকের জ্ঞান প্রজ্ঞাতে পরিণত হতে থাকে। সেই উপলব্ধিতে পায় সকল অজান খবর। এই দৃশ্যমান জগতের মায়াজালের অন্তরালের মূল রহস্য তার কাছে পরিষ্কার হয়। তাকে আর জগৎ-সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ করে রাখা যায় না।
অনেকের কাছে কাঙ্খিত গুরুর স্বশরীরের সাক্ষাৎ বা রূপ দর্শনই জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। আবার অনেক সাধনে ধ্যানবলে গুরুকে দৃষ্ট করতে পারলেই সাধক ধন্য হয়ে উঠে। আবার অনেকে প্রতি নি:শ্বাসে গুরুকে স্মরণ বা গুরুরূপ দেখাকে মনে করেন চূড়ান্ত সাধন।
মোটকথা যে যেই রূপের সাধন করে সেই রূপকে দর্শন করতে পারলে তৃষ্ণার নিবৃত্তি ঘটে। এই দর্শন যে কিরূপে হবে। বা কি রূপে হয় তার বর্ণনা সেভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বিশ্বাসীরা বলেন, যে দর্শন পায় আর যে দর্শন দেয়। এ দর্শনের মর্ম কেবল তারাই বুঝতে পারে। যা ব্যক্ত করার ভাষা নেই, তা কেবল অনুভবের উপলব্ধি মাত্র।
সাধককুল বলেন, যথার্থ সাধনে আরাধ্য দেবতা এমন কি স্বয়ং স্রষ্টা সৃষ্টির সামনে দৃশ্যমান হন। নিজের রূপ দর্শন করান। সাধক সেই রূপ দেখে জানতে পারে স্রষ্টার প্রকৃত ভাব। সাধকের ভেতর জাগ্রত হয় সেই ব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান। যিনি স্বয়ং ব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করেছেন তার দর্শনে সকল গুপ্ত ও গুঢ় তত্ত্ব উন্মুক্ত হয়ে যায়।
সেই রূপ দর্শন করে সাধকের জ্ঞান প্রজ্ঞাতে পরিণত হতে থাকে। সেই উপলব্ধিতে পায় সকল অজান খবর। এই দৃশ্যমান জগতের মায়াজালের অন্তরালের মূল রহস্য তার কাছে পরিষ্কার হয়। তাকে আর জগৎ-সংসারের মায়াজালে আবদ্ধ করে রাখা যায় না।
সে হয় ব্রহ্মাণ্ড প্রেমের প্রেমিক। হয় ইশকে দেওয়ানা। স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির এই রূপ দর্শনে সকল ভেদ উন্মুক্ত হয়ে যায়। সাধক তখন সেই ভাব আর নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারে না। কারণ স্রষ্টার যেমন সকল সৃষ্টির তেমনি সেই পর্যায়ের সাধকও হয়ে উঠেন সকলের।
(চলবে…)
পরবর্তি পর্ব: জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য : চতুর্থ পর্ব >>
…………………………
আরো পড়ুন:
রূপের রহস্য: পর্ব-১
রূপের রহস্য: পর্ব-২
রূপের রহস্য: পর্ব-৩
রূপের রহস্য: পর্ব-৪
রূপের রহস্য: পর্ব-৫
রূপের রহস্য: পর্ব-৬
রূপের রহস্য: পর্ব-৭
রূপের রহস্য: পর্ব-৮
রূপের রহস্য: পর্ব-৯
রূপের রহস্য: পর্ব-১০