ভবঘুরেকথা
রূপের রহস্য ইন্দ্রিয়

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য: নবম পর্ব

খুব সহজভাবে বলতে গেলে পরাবাস্তবতা হলো এমন একটা অবস্থা যা সম্পূর্ণ বাস্তবও নয়। আবার সম্পূর্ণ স্বপ্নও নয়। স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝের একটা গ্রে টোন হচ্ছে এই পরাবাস্তবতা। এটা আসলে একটা ভাবনার প্যাটার্ন। রূপের রহস্যে এটি দেখবার বিভিন্ন পর্যায়ও বলা যায়।

আর কোন একটা ভাবনার প্যাটার্ন যদি অনেক মানুষ একই সাথে একই সময় ভাবতে শুরু করে বা আরো আরো অনেককে ভাবাতে সমর্থ হয় তখন সেটা ‘বাদ’, ‘ইজম’ বা ‘মতবাদ’ মানে প্রতিষ্ঠা পায়। এই বাদ বা মতবাদের সহজ অর্থ হলো দৃষ্টিভঙ্গী।

পৃথিবীর ইতিহাসে কত ধরনের মতবাদ জন্ম নিয়েছে। কত মতবাদ টিকে আছে। কত মতবাদ একে অন্যকে গলা টিপে মেরেছে। কত শত মতবাদ একটি অপরটিকে এগিয়ে নিয়েছে। কত মতবাদ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে অসংখ্যা নতুন মতবাদের জন্ম দিয়েছে সেই ফিরিস্তি দিতে গেলে গোটা আরব্য রজনীর ব্যাপ্তি পাবে।

সেই প্রয়াস না করাই ভালো। তবে শিল্পে সময়ের হিসেবে বেশকিছু ‘ইজম’ বিভিন্ন সময় মানুষকে বেশ প্রভাবিত করেছে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাদের কয়েকটা নাম বলতে গেলে বলতে হয়-

প্রিহিস্টোরিক আর্ট (৪০০০০-৪০০০ খৃষ্টাব্দ পূর্ব), এনসিয়েন্ট আর্ট (৩০০০০-৪০০ খৃস্টাব্দ), মধ্যযুগীয় শিল্প (৫০০-১৪০০), রেনেসাঁস (১৪০০-১৬০০), ম্যানারিজম (১৫২৭-১৫৮০), বারোক (১৬০০-১৭৫০), রকোক্কো ১৬৯৯-১৭৮০), নিউক্লাসিজম (১৭৫০-১৮৫০), রোমান্টিসিজম (১৭৮০-১৮৫০)।

রিয়েলিজম (১৮৪৮-১৯০০), ইম্প্রেশনিজম (১৮৬৫-১৮৮৫), পোস্ট ইমপ্রেশনিজম (১৮৮৫-১৯১০), এক্সপ্রেশনিজম (১৯০৫-১৯২০), কিউবিজম (১৯০৭-১৯১৪), দাদাইজম (১৯১৬-১৯২০), সুররিয়ালিজম (১৯১৭-১৯৫০), এবস্ট্রাকট এক্সপ্রেশনিজম (১৯৪০-১৯৫০)।

পপ আর্ট (১৯৫০-১৯৬০), মিনিমালিজম (১৯৬০-১৯৭০), কন্সেপচুয়াল ১৯৬০-১৯৭০), কনটেম্পোরারি (১৯৭০- বর্তমান)।

প্রতিটা ইজমের পেছনে সেই সময় কালের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় প্রবণতা প্রভৃতি বিশেষ ভূমিকা রাখে।

আসলে দৃষ্টির সাথে জড়িয়ে আছে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি যেমন আপনার কাছে দৃশ্যের তাৎপর্যও তেমন। একপক্ষ হয়তো মানেন অস্ত্রের ভয় দেখিয়েই আসলে অধিকার আদায় করার এক ও অন্যতম উপায়। আরেক পক্ষ হয়তো ভাবেন প্রেমেই সব কিছুর অধিকার করে নেয়া সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে মাওলানা রুমির একটা অসাধারণ উক্তি আছে, ‘স্রষ্টাকে পাবার অনেক পথ আছে, আমি ভালবাসার পথকে বেঁছে নিয়েছি।’

মোটা দাগে মানুষ তিনটি অবস্থায় থাকে। জাগ্রত, ঘুমন্ত ও সুষপ্তী। জেগে থাকা, ঘুমিয়ে থাকা আর জেগে ও ঘুমিয়ে থাকার মধ্যবর্তী অবস্থা। মজার বিষয় হলো মানুষ এই তিন অবস্থাতেই দেখে। জাগ্রত অবস্থায় যে দেখা তা নিয়ে তো এতো কথা হলো। এবার একটু ঘুমিয়ে দেখার কথা বলা যাক।

মানুষ ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে সোলায়মানী খাওয়াবনামা আছে। একসময় যা বাংলার ঘরে ঘরে দেখাও যেত। সেই তর্কে যাচ্ছি না। স্বপ্ন মানুষ যে কারণেই দেখুক বা স্বপ্নের আদৌ কোনো বাস্তবিক অর্থ বহন করে কিনা সেটা এই আলোচনার বিষয় নয়।

ইন্দ্রিয় আদতে পাঁচ ভাগে ভাগ হয়ে একটা পূর্ণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের চেষ্টা করে। পাশাপাশি চূড়ান্ত চেষ্টা করে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে। কিন্তু তার সঞ্চিত সংস্কারের ফলে সেই সত্যে হয়তো শেষ অবধি পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তারপরও ইন্দ্রিয় তার চেষ্টার কমতি করে না। সে লড়ে যায় শেষ পর্যন্ত।

বা স্বপ্ন নিয়ে কত কত গবেষণা হয়েছে। কি কি গবেষণা হয়েছে। স্বপ্নের ব্যাপ্তি আদতে কতটা সময় জুড়ে হয়। স্বপ্নে মানুষ রঙ দেখতে পায় কিনা সেটাও এই লেখার সাথে প্রাসঙ্গিক নয়।

বলা কথা হলো, মানুষ স্বপ্ন দেখে এটা মিথ্যা নয়। ঘুমের মাঝে মানুষ দেখছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ এটা বিরল কোনো অভিজ্ঞতা নয়। এর অল্প-বিস্তর অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই আছে। আর তাতেই এক ধরণের অভিজ্ঞতার জন্ম নেয় যে, রূপ দর্শনের একমাত্র মাধ্যম চোখ এটা সত্য নয় মোটেও।

তাকে সকল সময় উন্মুক্ত রাখলেই দেখা যায়। বা তা বন্ধ করে রাখলেই দেখা যায় না। বিষয়টা তেমন নয়। তার দেখা সে দেখবেই। দৃশ্যের অবতারণা হলে সে না দেখে থাকতে পারে না। যদি তার আওতার মাধ্যে তা পরে।

আর ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি সুষুপ্তী অবস্থায় মানুষ কল্পনাতেও দৃশ্য দেখতে সক্ষম হয়। এতেও চোখ উন্মুক্ত রাখা বা বন্ধ করে রাখা কোনোটাই বিশেষ ভূমিকা রাখেন না।

ইন্দ্রিয় আদতে পাঁচ ভাগে ভাগ হয়ে একটা পূর্ণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের চেষ্টা করে। পাশাপাশি চূড়ান্ত চেষ্টা করে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে। কিন্তু তার সঞ্চিত সংস্কারের ফলে সেই সত্যে হয়তো শেষ অবধি পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তারপরও ইন্দ্রিয় তার চেষ্টার কমতি করে না। সে লড়ে যায় শেষ পর্যন্ত।

সে শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধের ভেতর দিয়ে এমন একটা তথ্য সংগ্রহ করতে চায়। আবার সে একই সাথে অতীতের কোনো অভিজ্ঞতার সাথে যদি মিল পায় তার সাথেও যাচাই করে নেয়। আবার একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা হলে সেটাও যাচাই-বাছাই করে সঞ্চয় করে।

এই সংস্কারের সঞ্চয় কারো কারো কাছে বোঝা। আবার কারো কারো কাছে এটাই সর্বোচ্চ অর্জন। যারা স্থূল দেহকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় দেয় তাদের কাছে সংস্কারের ভাণ্ডার বেশ স্বস্তির বিষয়। এবং সারা জীবন জুড়ে তারা এই সংস্কারের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করাতেই মনোযোগী হন।

অন্যদিকে যারা স্থূলদেহের ঊর্দ্ধে উঠে সূক্ষ্ম বা কারণ বা তারও ঊর্দ্ধ দেহের ভাবনায় ডুবতে চায়। বা সে সকল দেহকে জাগ্রত করতে চায়। তারা এই সঞ্চিত সংস্কারকে মুছে ফেলতে চায়। আবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে নতুন সংস্কার যাতে জমা না হয়।

শেষ বিচারে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ এর কোনো উত্তর হতে পারে না। কারণ সেখানেও আবার উপস্থিত হবে ‘দৃষ্টিভঙ্গি’। অর্থাৎ আপনি কোন মতবাদের বা কোন মতাদর্শে বিশ্বাসী।

আবার আধুনিক সমাজে নতুন একটা কথা বেশি বাজারজাত হচ্ছে। তা হলো- ‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলান জীবন বদলে যাবে’।

এখানেও আছে বিভ্রাট। তা হলো দৃষ্টিভঙ্গি বদলে কোন দৃষ্টিভঙ্গি আমরা গ্রহণ করবো? যদি সেই বোধের রূপ দেখার জায়গা আমাদের থাকেই তবে দৃষ্টিভঙ্গি আর পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি?

ঘুরেফিরে মূল কথা একটাই আমরা আমাদের সংস্কারে কি কি সঞ্চিত রেখেছি তার ভিত্তিতেই আমাদের ইন্দ্রিয় অনুভব নিতে অভ্যস্ত। তার জন্য সেটাই সবচেয়ে সহজ পথ।

অর্থাৎ আমরা যে মতাদর্শে নিজেকে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে নিজেদের গড়ে তুলি আমাদের ইন্দ্রিয়ও সেই পথে হেঁটেই তথ্য সংগ্রহ করে। আর মন সেই বিচারেই প্রতিকৃয়া দেয়।

আমরা জানি বিনোদনের জন্যই চলচ্চিত্র বা নাটকটা নির্মিত হয়েছে। তারপরও তা দেখে আবেগে কখনো ডুকরে কেঁদে উঠি। বা ভয়ে কুঁকড়ে যাই। কিংবা আনন্দে উৎফুল্ল হই। আবার চোখের সামনে কোনো মর্মান্তিক বা হৃদয়স্পর্শী ঘটনা দেখেও আমরা ভাবলেশহীন থাকি।

এই অবসরে রূপ দর্শনের যে মাধ্যম অর্থাৎ ‘চোখ’ সে সম্পর্কে বিজ্ঞান কি বলে তার দু-চার কথা জেনে নেয়া যাক-

চোখ মূলত আলোক-সংবেদনশীল দর্শনেন্দ্রিয়। মানুষের চোখ কেবল আলোর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির পার্থক্য করতে পারে। তবে কিছু কিছু প্রাণীর চোখ মানুষের চোখ থেকেও উন্নত। তারা অন্ধকারেও দেখবার সক্ষমতা রাখে।

মানুষের যেহেতু পাশাপাশি একই তলে অবস্থিত তাই মানুষ একটি মাত্র ত্রিমাত্রিক দৃশ্য দেখতে পারে। আবার যে সকল প্রাণী বা পাখির চোখ মুখের দুই পাশে তারা চোখ দিয়ে দুই পাশের দুটি দৃশ্য দেখতে সক্ষম।

যখন কোনো বস্তু থেকে আলোর রশ্মি চোখে পড়ে, তখন সেই সমান্তরাল আলোক রশ্মি কর্ণিয়ার ভেতর দিয়ে লেন্স অতিক্রম করার সময় বিভিন্ন কোণে আপতিত হয় এবং বিভিন্ন দিকে বাঁক নেয়।

লেন্সের মধ্য দিয়ে এই বাঁক নেওয়া আলোক রশ্মি পুনায় রেটিনার নির্দিষ্ট বিন্দুতে একত্রিত হয়ে বস্তুটির একটি উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি করে সেখানে ফোকাস করে।

রেটিনায় দুটি সংবেদী কোষ ‘কোণ’ রঙ বুঝতে সাহায্য করে আর রডস্ কম আলোতে দেখতে সাহায্য করে। এই কোষদ্বয় আলোর ফোটনকে সিগন্যালে পরিণত করে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়। মস্তিষ্কে এই সিগন্যাল উল্টো ছবি হয়ে যায়। আর এভাবেই চোখের সামনে দৃশ্য দৃশ্যমান হয়। আর আমরা দেখতে চাই।

আর পুরো ব্যাপারটাই ঘটে আলোর উপস্থিতিতে। এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করেই ক্যামেরা আবিষ্কার করা হয়েছে। বিষয়টা ক্যামেরার মতো করে ভাবলে সহজে বোঝা যাবে। নইলে চোখের কারিগরি বোঝা একটু জটিলই মনে হতে পারে।

মানুষের চোখের বিভিন্ন অংশের নাম- স্ক্লেরা যা চোখের আচ্ছাদনকারী সাদা অংশ। ‘কর্নিয়া’ যা চোখের সামনের অংশ ঢেকে রাখে গম্বুজাকৃতির স্বচ্ছ পর্দা। ‘অ্যাকুয়াস হিউমার’ যা লেন্স ও কর্নিয়ার মধ্যবর্তী অংশের তরল পদার্থ।

(চলবে…)

পরবর্তি পর্ব: জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য : দশম পর্ব >>

…………………………
আরো পড়ুন:
রূপের রহস্য: পর্ব-১
রূপের রহস্য: পর্ব-২
রূপের রহস্য: পর্ব-৩
রূপের রহস্য: পর্ব-৪
রূপের রহস্য: পর্ব-৫
রূপের রহস্য: পর্ব-৬
রূপের রহস্য: পর্ব-৭
রূপের রহস্য: পর্ব-৮
রূপের রহস্য: পর্ব-৯
রূপের রহস্য: পর্ব-১০

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!