-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: রস : রসের ভুবন: তৃতীয় পর্ব
৩. করুণরস (the pathetic):
আকাঙ্ক্ষা নষ্ট হলে, অকল্যাণ হলে, প্রিয়জন বিয়োগ বা অপ্রিয়সংযোগে যে শোকসঞ্চার ইত্যাদিতে এই রসের সৃষ্টি হয়। এ রসের ভুবনে বেদনা, বিষন্নতার উদ্রেক হয়। শোক ভাব থেকে করুণ রসের উদ্ভব। অর্থাৎ ‘শোক’ করুণ রসের স্থায়ীভাব। শৃঙ্গার এবং হাস্যরস এর বিরোধী।
করুণরসের উদাহরণ-
কাঁদিলা রাক্ষসবধূ তিতি অশ্রুনীরে
শোকাকুলা। ভবতলে মূর্ত্তিমতী দয়া
সীতারূপে, পরদুঃখে কাতর সতত,
কহিলা- সজল আঁখি সখীরে;
কুক্ষণে জনম মম, সরমা রাক্ষসি!
-মেঘনাদ বধ, নবম সর্গ। মধুসূদন
জসীম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতায়-
‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।’
ভাষা বিজ্ঞান নামক বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ গ্রন্থে উল্লেখ আছে- ‘করুণ রস দয়া এবং শোক উত্তেজক। নির্দোষীর কষ্ট বা অপমান, শোক ও দুঃখ জনক ঘটনা বর্ণনা করাই ইহার উদ্দেশ্য।’
৪. রৌদ্র রস (the terrible):
ক্রোধ থেকে এই রসের উৎপত্তি হয়। এই রসে প্রচণ্ডতা, ভয়াবহতা, নির্মমতা বর্তমান। ক্রোধের উগ্রতা ও ভয়ঙ্কর রূপ হলো এই রস। এ কারণে ক্রোধকে এর স্থায়ীভাব হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অলঙ্কার শাস্ত্রে একে রক্তবর্ণ ও রুদ্রদৈবত নামে অভিহিত করা হয়েছে।
অন্যায়কারীর প্রতি যে ক্রোধ, ক্ষোভ প্রজ্বলিত হয়, মনের ভেতরে যে আগুন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে, তারই কাব্যরূপ রৌদ্র রস। ক্রোধ ভাব থেকে রৌদ্র রসের উদ্ভব। যেমন-
সুকান্ত ভট্টাচার্য্য বলেছেন-
প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
ভেঙেছিল ঘরবাড়ি,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
কখনো ভুলিতে পারি?
আদিম হিংস্র মানবিকতার
যদি আমি কেউ হই
স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই।
৫. অদ্ভুত রস (the surprising):
আশ্চর্যজনক কোনো বিষয় থেকে উদ্ভুত বিস্ময়কর ভাবই অদ্ভুত রস। অদ্ভুত রসের স্থায়ী ভাব ‘বিস্ময়’। সাধারণ অলৌকিক কোনো বিষয়কে এই রসকে উজ্জীবিত করা হয়। যে রসে বিস্ময়কর, আশ্চর্যজনক, চমৎকার বিষয় থাকে। বিস্ময় ভাব থেকে অদ্ভুত রসের উদ্ভব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কর্ণকুন্তী সংবাদে’ কর্ণের বিস্ময় জননী কন্তুীকে ঘিরে অদ্ভুত রসের সৃষ্টি করেছে-
সেই স্বপ্ন আজি
এছেসে কি পা-বজননী রূপে সাজি
সন্ধ্যাকালে, রণক্ষেত্র, ভাগীরথীর তীরে।
৬. ভয় রস (the disgustful):
ভয় ভাব থেকে ভয় বা ভয়ানক রসের উদ্ভব। বিপদজনক বা ভীতিপ্রত কোনো বিষয় থেকে মনে যে ভাবের সঞ্চার হয়। মৃত্যু হয় বা অস্তিত্বের সংকটাপন্ন অবস্থায় ভয় রস জাগ্রত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-
এই পথে ধেয়ে এসেছে কাল বৈশাখীর ঝড়
গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে
‘হায় হায়’রব তুলেছে, বাঁশের বনে
কলাবাগানে করেছে দুঃশাসনের দৌরাত্ম্য।
৭. বীভৎস রস (the surprising):
কোনো কুৎসিৎ বিষয়ের প্রতি ঘৃণা থেকে বীভৎস রসের সৃষ্টি হয়। যে রসে নিন্দা, কুৎসা, অপবাদ, ঘৃণা প্রভৃতি উৎপাদন হয়। জুগুন্সা ভাব থেকে বীভৎস রসের উদ্ভব। মাইকেল মধুসূদন রচিত ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে বীভৎস রস-
অদূরে হেরিলা রক্ষঃপতি
রণক্ষেত্র। শিবাকূল, গৃহিণী, শকুনি,
কুক্কুর, পিশাচ দলে ফেরে কোলাহলে।
কেউ উঠে, কেহ বসে, কেহ বা বিবাদে,
পাকশাট মারি, কেহ খেদাইছে দূরে
সমলোভী জীবে, কেহ গরজি উল্লাসে,
নাশে ক্ষুধা- অগি্ন, কেহ
শোষে রক্তস্রোতে।
৮. হাস্যরস (the comic):
কৌতুকজনক বাক্য বা আচরণ, বিকৃত আকার, বাক্য ও চেষ্টা দ্বারা এই রসের উদ্ভব হয়। যে রসে হাসির উদ্রেক করে। হাস ভাব থেকে হাস্য রসের উদ্ভব। কাজী নজরুল ইসলামের ‘খাদু-দাদু’ কাব্যে হাস্যরস-
অমা। তোমার বাবা নাকে কে মেরেছে ল্যাং।
খাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা-নাক, ডেঙাডেং ড্যাং।
ওর নাকটাকে কে করলো খাঁদা রাঁদা বুলিয়ে।
চামচিকে ছা বসে যেন নেজুড় ঝুলিয়ে।
বুড়ো গরুর পিঠে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং।
অ-মা আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং।
৯. শান্ত রস (the quietistic):
চিত্তকে প্রশান্তি দেয় এমন ভাব থেকে শান্ত রসের উদ্ভব হয়। চিত্তের আবেগবর্জিত যে রস। ‘শম’ ভাব হতে শান্ত রসের উৎপত্তি। শম অর্থ শান্তি, নির্বেদ, স্থিরতা, বীতরাগ, উদাসীন ইত্যাদি।
জাগতিক জীবনে প্রতিটি বস্তুর চরম নশ্বরতা প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করে মানস চিত্তে এক বৈরাগ্য ভাবের সৃষ্টি হয়।
‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ শান্ত রস-
‘কিন্তু চিরস্থায়ী কিছু নহে এ সংসারে।
এ যায় আর আসে, জগতের রীতি
সাগর তরঙ্গ যথা।’
ভাষা বিজ্ঞান নামক বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ গ্রন্থে উল্লেখ আছে- ‘শাস্ত রস মনের শাস্তি জনক এবং ভক্তি উদ্ভাবক। আলোচনা। আদিরস শান্তরস এবং বীর রসই কাব্যের প্রধান অঙ্গ। অদ্যান্য রস কেবল আনুসঙ্গিকরূপে ব্যবহৃত হইতে পারে। কেবল ঐ সকল রসঘটিত কোন কাব্য হইলে তাহ বিশেষ হৃদয়গ্রাহী হয় না।’
আবার এই ষড়-অষ্ট-নব প্রভৃতি রস বৈষ্ণব, ফকিরি, বাউল, সুফিবাদে রূপ নিয়েছে ‘ভক্তিরসে’। শ্রীরূপ তার ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে বলতে চেয়েছেন, ‘ভক্তিরসই একমাত্র রস অন্য রসগুলি ইহারই অবান্তর ভেদমাত্র।’
বৈষ্ণব তত্ত্বে এই শান্তরসকে আবার পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এইগুলো হলো- সখ্যরস, শান্তরস, দাস্যরস, বাৎসল্যরস ও মধুরসর।
ক. সখ্যরস
সখ্য রস মূলত বন্ধুতের প্রেম অর্থাৎ বন্ধুর প্রতি বন্ধুর যে প্রেম তাকেই সখ্য রস হিসেবে ধরা হয়। কথায় বলা হয় পরস্পারিক সখ্যতা সেই সখ্যতা মূলত এই সখ্য রসকে নির্দেশ করে।
খ. শান্তরস
সাধুগুরুরা বলেন, তুমি যদি স্থির হতে চাও তাহলে তোমার চারপাশকে আগে স্থির করো। চারপাশের মানুষকে আগে স্থির করো। একটা অস্থির পরিবেশে তুমি স্থির বা শান্ত হতে পারবে না। তাই তোমার ভেতরের যে প্রেম তা তুমি ছড়িয়ে দাও তোমার চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষজনের প্রতি।
এতে তারা যেমন তোমার প্রতি স্নেহভাজন হবেন তেমনি তোমার ভেতরেও তাদের প্রতি জাগবে ভক্তিভাব। আর এই কাজ শুরু হয় পরিবারের সবচেয়ে আপন মানুষ অর্থাৎ পিতামাতার সাথে সন্তানের আচরণের মধ্য দিয়ে। সন্তান পিতামাতাকে যে স্থরের প্রেম করে তাতে যে রসের উদ্ভব হয় তাকে সাধুগুরুরা চিহ্নিত করেছেন শান্ত রস নামে।
(চলবে…)
……………………..
আরো পড়ুন:
রসের ভুবন: পর্ব-১
রসের ভুবন: পর্ব-২
রসের ভুবন: পর্ব-৩
রসের ভুবন: পর্ব-৪
রসের ভুবন: পর্ব-৫
রসের ভুবন: পর্ব-৬
রসের ভুবন: পর্ব-৭
রসের ভুবন: পর্ব-৮
রসের ভুবন: পর্ব-৯
রসের ভুবন: পর্ব-১০
………………………………
তথ্যসূত্র
কাব্যতত্ত্বঅন্বেষণা-নরেন বিশ্বাস।
সাহিত্য সন্দর্শন-শ্রীশ চন্দ্র দাশ।
বৈষ্ণব রস-প্রকাশ: ক্ষুদিরাম দাস।
বিশ্বকোষ : নগেন্দ্রনাথ বসু।
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড): আশুতোষ ভট্টাচার্য।
উইকিপিডিয়াসমূহ