ভবঘুরেকথা
রসের ভুবন

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: রস : রসের ভুবন: নবম পর্ব

আবার রসের ভুবনে কাব্য রসের উৎকর্ষসাধক ধর্মের গুণ তিন প্রকার-

ক. মাধুর্য (elegance): কাব্যের যে গুণ শোনামাত্র চিত্ত ব্যাকুল ও মন বিগলিত হয়, তাই মাধুর্য।
খ. ওজঃ (encitement): যে গুণ দ্বারা চিত্ত উদ্দীপ্ত ও উজ্জ্বীবিত হয়, তাই ওজঃ।
গ. প্রসাদগুণ (perspicuity): যে গুণ থাকলে শোনামাত্র অর্থপূর্ণ হয়, তাকে প্রসাদগুণ বলে।

এই রস যে কেবল শিল্প-সাহিত্যে বা রসালো স্বাদের খাবারে সীমাবদ্ধ থাকে তাতো নয়। এই রস আছে সর্বত্র। ব্রহ্মাণ্ড যেমন রহস্যময় তেমনি রসময়ও। কে কি করে সেই রস নিবে সেটাই বিবেচনার বিষয়। আবার সেই ঘুরেফিরে একই কথা বলতে হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তা আছে দেহ ভাণ্ডে। তা ব্রহ্মাণ্ড যদি রসময় হয় তাহলে দেহও রসময়।

দেহেরও রসময়। কিছু রস নিয়েই আমরা বড় হতে থাকি। আবার কিছু কিছু রস আমরা জীবনের বিভিন্ন সময়ে আবিষ্কার করি। সেই বিশেষ রসগুলো আমাদের চিন্তা-চেতনাতে নানা পরিবর্তন আনে।

তাই দেহে যখন বিশেষ বিশেষ রস আসে তখন মানুষের জীবন পাল্টাতে শুরু করে। মানুষ সংবেদশীল হয়ে উঠতে শুরু করে। মানুষ নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে থাকে। ভাঁজ খুলে খুলে দেখতে পায় নতুন নতুন নিজেকে।

দেহের পঞ্চেন্দ্রিয় সমান তালে তাদের নিজেদের গূঢ় ব্যবহার ও গূঢ় রহস্য গুপ্ত করে রাখলেও। একথা অস্বীকার করার উপায় থাকে না রস ইন্দ্রিয় অন্য সকল ইন্দ্রিয়ের মাঝে নিজেকে ব্যতিক্রমীই করে রেখেছে।

কিন্তু সামাজিক নানা ট্যাবুর কারণে মানুষ, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ এই নিজেকে আবিষ্কারের কথাটা কারো সাথে ভাগাভাগি করে নিতে পারে না।

আর এ কারণেই সে নিজের কিছু সত্য নিজের মতো করে দেখতে শুরু করে। নিজের কিছু ব্যাপার নিজের মতো করে ভাবতে শুরু করে। সকলের মাঝে থেকেও যে একা থাকা যায়। নিজের যে সত্য সত্যই গোপন কিছু থাকতে পারে। এবং সেটাকে সকলের কাছে গোপন করতে হয়।

এই ব্যাপারগুলো জীবনে প্রথমবারের মতো তীব্র আকারে বিকাশ ঘটতে শুরু করে। সেই সময়টা এমন একটা সময় যা অনেককে অনকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শেষ বিচারে ব্যক্ত করা হয় না। বা হয়ে ওঠে না। আবার এই রস যতদিন দেহে থাকে ততদিন দেহে নানান চাহিদার উদ্দীপন হয়।

তাই এই দেহের নতুন পানিকে কি করে কি উপায়ে জমা-খরচ করলে কি হবে। তা নিয়ে কেবল ধর্ম নয়, রাষ্ট্র-সমাজ-দর্শন সকল কিছুতেই আছে অনেক রীতিনীতি বিধিমালা। এমনকি শাস্তিযোগ্য নানা আইনকানুন লিপিবদ্ধ করা হয়। আবার মতোবাদগুলো একে কি করে লালন-পালন করতে হয়। তা নিয়ে দেন বিধিবিধান।

দেহের পঞ্চেন্দ্রিয় সমান তালে তাদের নিজেদের গূঢ় ব্যবহার ও গূঢ় রহস্য গুপ্ত করে রাখলেও। একথা অস্বীকার করার উপায় থাকে না রস ইন্দ্রিয় অন্য সকল ইন্দ্রিয়ের মাঝে নিজেকে ব্যতিক্রমীই করে রেখেছে। যদিও কথাটা অন্য সকল ইন্দ্রিয়ের ক্ষেত্রেও খাটে। কারণ কেউ কারোর চেয়ে কম নয়।

কিন্তু রসের ভুবনে রস একই থাকে যেমন স্থূল তেমনি সে সূক্ষ্ম দুই দেহেই বিরাজ করে। এর একটা ব্যবহারিক দিক যেমন আছে। তেমনি আবার এর একটা মননের দিক আছে। আসলে একে ব্যতিক্রম না বলে বহুমাত্রিক বললে হয়তো একে সঙ্গায়িত করতে সুবিধে হবে।

মনুসংহিতায় বলা হয়েছে-

মহান্তমেব চাত্মানং সর্বাণি ত্রিগুণানি চ ।
বিষযাণাং গ্রহীতৄণি শনৈঃ পঞ্চৈন্দ্রিযাণি চ ।।১৫

অর্থাৎ ব্রহ্মা অহঙ্কারতত্ত্বের সৃষ্টির পূর্ব্বে পরমেশ্বর হইতে মহত্তত্ত্বের সৃষ্টি করিলেন, যে মহত্তত্ব আত্মা হইতে উৎপন্ন বলিয়া আত্মশব্দে কথিত হইয়াছে। আর সত্ত্বরস্তমোগুণযুক্ত অন্য পাদার্থ সকল সৃষ্টি করিলেন, এবং শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধের গ্রাহক শ্রোত্র, ত্বক্‌, চক্ষু, জিহ্বা, নাসিকা এই পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও বাক্‌, পাদ, হস্ত, গুহ্য, উপস্থ এই পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় সৃষ্টি করিলেন।

আসলে একটি ইন্দ্রিয়ের ব্যাপারে যে আলোচনা করা হচ্ছে বা হয়েছে তার মানে কিন্তু এই নয় সেই আলোচনাতেই সেই ইন্দ্রিয় নিয়ে কথাবার্তা সীমাবদ্ধ। আসলে এই পঞ্চেন্দ্রিয়কে কিছুটা বুঝতে গেলেও প্রতিটা ইন্দ্রিয়কেই এক এক ভাবে বুঝে আসতে শুরু করলে। ইন্দ্রিয়ের মূল কথা অর্থকে বুঝে সহজ হয়।

সে কারণে সকল কিছুর বিশ্লেষণ প্রত্যেক ইন্দ্রিয়কে নিয়ে আলোচনা না করে। প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ে আলাদা করে বোঝার চেষ্টা করছি। যাতে এক ইন্দ্রিয়ের বিষয়গুলোকে বুঝে অন্য ইন্দ্রিয়ের উপর সেগুলো ফেলে তাকেও ভাবা যায়। আর যদি তা করতে পারা যায় বা এই লেখা যদি সেই প্রেরণা দেয় তবেই ইন্দ্রিয় বিষয়টাকে বোঝা সহজ হতে পারে।

যাক আবার প্রসঙ্গে ফিরি। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ে রস আসলে কি হয় সে সম্পর্কে খুব খুব সংক্ষেপে দুই-এক কথা বলবার ইচ্ছে জাগছে এই মুর্হূতে। এই বিষয়টি অন্যান্য ইন্দ্রিয় নিয়ে লিখবার সময়ও মনে হয়েছিল। কিন্তু ভেবেছিলাম কয়েকটা ইন্দ্রিয় সম্পর্কে লেখা হয়ে যাক, তারপর এ নিয়ে লিখলে ভালো হয়।

নইলে কিছু তাত্ত্বিক বিষয় সম্পর্কে জানা হবে সত্য, কিন্তু ইন্দ্রিয়কে না বুঝে ইন্দ্রজালে আটকে থাকতে হবে। তবে এ কথাও সত্য যে না চাইলেও একই আলোচনার কিছু পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু তা করা হয়েছে মূলত আলোচনাকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থেই।

সেটুকু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে ইন্দ্রিয়কে বুঝতে হলে একটা ইন্দ্রিয়কে বুঝতে সকল ইন্দ্রিয়ের বোঝবার জন্য যে পথগুলো বলবার চেষ্টা করেছি সকল কিছু দিয়েই যাচাই-বাছাই করে নিলে হয়তো সুবিধা হলেও হতে পারে। যাক ফিরি আবার আলোচানায়-

দেহের মতো আবার মনে যখন রস আসে তখনও সব কিছু পাল্টে যায়। এই মনের রস স্থায়ী ও অস্থায়ী ভাবে উদয় হয়। অনেক সময় একটা রস সর্বক্ষণ কড়া নেড়ে যায়। আবার কিছু কিছু রস সময় সময় উঁকি দেয়। কখনো বা চাগাড় দিয়ে উঠে।

কোনো কোনো রস কাজ করিয়ে নিতে যেমন বাধ্য করে। অর্থাৎ উদ্দীপ্ত করে। আবার কোনো কোন রস অবসাদ এনে দেয়। তখন কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না। বিষাদ ছুঁয়ে যায় মনে।

এভাবে বিচিত্র সব পরিস্থিতির মুখোমুখি যেমন আমরা রসের স্বাদ নিতে পাই। তেমনি ভেতরেও কোথাও রসের উপস্থিতি বা বিকাশ আমাদের চিন্তা-চেতনাকেও নাড়া দিয়ে যায়।

দেহের ও মনের রস নিয়ে রাশি রাশি কাব্যি করা যায়। অনেক রগরগে কথাও বলা যায়। সেসবে গেলাম না। যাওয়ার খুব একটা প্রয়োজনও অনুভব করছি না। কারণ আমরা তো রসে ভেসেই থাকি। তাই কোনো উত্তেজক বিশেষ রসের আলোচনা করে এই লেখাটাকে বেশি মানুষকে পড়িয়ে নেয়ার তেমন ইচ্ছে নাই।

যাক আবার প্রসঙ্গে ফিরি। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ে রস আসলে কি হয় সে সম্পর্কে খুব খুব সংক্ষেপে দুই-এক কথা বলবার ইচ্ছে জাগছে এই মুর্হূতে। এই বিষয়টি অন্যান্য ইন্দ্রিয় নিয়ে লিখবার সময়ও মনে হয়েছিল। কিন্তু ভেবেছিলাম কয়েকটা ইন্দ্রিয় সম্পর্কে লেখা হয়ে যাক, তারপর এ নিয়ে লিখলে ভালো হয়।

তাহলে অন্য ইন্দ্রিয় সম্পর্কেও এভাব ভাবার চেষ্টা করার একটা সুযোগ থেকে যায় পাঠকের হাতে। সেকারণে এই তুলনামূলক বিচার প্রথম দিকের ইন্দ্রিয়ের আলোচনায় যাইনি সচেতনভাবেই।

এই আলোচনার শুরুতেই আসি ‘শব্দে’। অর্থাৎ মানুষ তার শব্দে যা বলতে চায়; তা ব্যক্ত বা অব্যক্ত কিংবা উচ্চারিত বা লিখিত হোক তাতে যখন রস আসে। অর্থাৎ যা সে বলতে চাইলো তা (যে রসই হোক) যখন মানুষ নিতে শুরু করে। যারা নিচ্ছে তারা বুঝে বা না বুঝে নিক। কিন্তু যখন মানুষ নিতে শুরু করে।

তখন সেই শব্দের যে রস তা আরো রসময় হতে শুরু করে। এখানে সাধক যদি সেই সব মানুষের রুচিকে মাথায় রেখে তার শব্দের রসকে আরো রসাত্মক করে তুলতে যায়। তখন সে জনপ্রিয় হয়। বহু মানুষের কাছে তা পৌঁছে যায় দ্রুত।

আবার যে নিজের শব্দগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করতে চায়, যাতে সে নিজে একটা শ্রোতা-পাঠক বা দর্শক তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ জনপ্রিয়তার মোহমায়াকে ত্যাগ করে নিজের উপলব্ধিকেই ব্যক্ত করতে চায়। তাহলে তার শব্দগুলো সময়কালে গুরুত্ব না পেলেও দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকে। অর্থাৎ সেই শব্দ রসে মাহাত্ম্য তৈরি হয়।

তেমনি স্পর্শে যখন রস আসে তখন সেই সময় কালের যে স্পর্শ ভিন্নতার অনুভূতি দেয়। কিন্তু যখন রস আসে না। যেমন সারাক্ষণই আমরা কিছু না কিছু স্পর্শ হয়তো করেই চলেছি কিন্তু সে সম্পর্কে সেভাবে সজাগ থাকি না। আবার অনেক যত্নে যে স্পর্শ। যাতে চাতুরি থাকে না।

কেবল শৃঙ্গার রসের স্পর্শই নয় হাস্যরস, শান্তরস বা করুণ রস কিংবা অন্য কোনো রসও হতে পারে। কিন্তু যখন স্পর্শে রস আসে তখনই মানুষ সেই স্পর্শ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। সেই স্পর্শ যুগ যুগ ধরে মনে থাকে। এ প্রসঙ্গে ফকির লালন সাঁইজির একটা পদের দুটি লাইন না বললেই নয়-

“শুনেছি সাধুর করুনা
সাধুর চরণ পরশিলে হয় গো সোনা।।”

আসলেই তাই। সেই স্পর্শই তো স্পর্শ, যে স্পর্শের পরশের জন্য জন্মজন্মান্তরের যাত্রা। কেউ সেই স্পর্শ খুঁজে গুরুর চরণে। কেউ মায়ের আঁচলে, কেউ সন্তানকে ছুঁয়ে, কেউ প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে ইত্যাদি ইত্যাদি। কোন ছোঁয়াই সেই পরমের ছোঁয়ার স্বাদ জীব পাবে তা কি আর নির্দিষ্ট করে বলা যায়?

তারপরও বিভিন্ন মত-পথ-ধর্ম-দর্শন একে নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করে। যাতে সাধারণ চিন্তার মানুষ সে হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পায়। সকলেরই জানা, গল্পের গোয়েন্দা শেষ দৃশ্যে এক এক করে সকল বিষয়ের পর্দা তুলে সত্য প্রতিষ্ঠা করবেই করবে।

কিন্তু আধ্যাত্মবাদের রহস্যে ডুবলে ডুবেই যেতে হয় এর কোনো তল নেই। কেউ এসে বলবে না কোনটা সত্য বা আড়ালে কি সত্য লুকিয়ে আছে। ধর্ম তার একটা দিকনির্দেশনা দেয়। কিন্তু মতাদর্শ একটা সম্ভবনার কথা বলে। যেমনটি বিজ্ঞান বলে থাকে।

(চলবে…)

……………………..
আরো পড়ুন:
রসের ভুবন: পর্ব-১
রসের ভুবন: পর্ব-২
রসের ভুবন: পর্ব-৩
রসের ভুবন: পর্ব-৪
রসের ভুবন: পর্ব-৫
রসের ভুবন: পর্ব-৬
রসের ভুবন: পর্ব-৭
রসের ভুবন: পর্ব-৮
রসের ভুবন: পর্ব-৯
রসের ভুবন: পর্ব-১০

………………………………
তথ্যসূত্র
কাব্যতত্ত্বঅন্বেষণা-নরেন বিশ্বাস।
সাহিত্য সন্দর্শন-শ্রীশ চন্দ্র দাশ।
বৈষ্ণব রস-প্রকাশ: ক্ষুদিরাম দাস।
বিশ্বকোষ : নগেন্দ্রনাথ বসু।
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড): আশুতোষ ভট্টাচার্য।
উইকিপিডিয়াসমূহ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!