ভবঘুরেকথা
রসের ভুবন

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: রস : রসের ভুবন: ষষ্ঠ পর্ব

মোদ্দা কথা হলো আপনি যে রসের ভুবনে রস নিতে চান সেই রসের মানুষিকতার মানুষ-পরিবেশ-প্রকৃতির যত কাছাকাছি যাবেন ততই তা আপনার জন্য স্পষ্ট হবে। যখন আপনি বিশেষ কোনো সাধনে আছেন। আবার সাধনে না থাকলে বা সাধন পূর্ণ হলে এই নিয়ম বহাল নাও থাকতে পারে।

সাধারণ ভাবে তাই বলে রসকে বুঝতে গেলে রসিক হতে হয়। কারণ রসিকের কাছেই রস ধরা দেয়। রসিকজনই সেই রসের সন্ধান পায়। আর রসিক জনের সাথেই সেই রস ভাগাভাগি করে নেয়া যায়।

তাই বলা হয়, যে জন রসে ডুবতে পারে সেই তো রসিক। তবে এই রসিকের সংজ্ঞাও আবার নানা ভাবে সঙ্গায়িত করা হয়। কেউ হাস্যরসকেই রসিক মনে করেন। কেউ শান্ত রসকে রসিক মানেন। কেউ বা কোনো মতে আবার শৃঙ্গার রসে সিক্ত হলেই তাকে কেবল রসিক বলা হয়।

আবার অনেকে বিষয়টাকে আরো জটিল করে বলেন, সর্ব রসেই রসিক হওয়া সম্ভব। এমনকি ভয়, বীর, করুণ ও রৌদ্র, বীভৎস রসেও রসিক হতে পারে জীব। কারণ আগেই বলেছি রস দেখে কি রস নিঃসৃত হচ্ছে-আবার যে রস দিচ্ছে তার কি রস নিঃসৃত হচ্ছে সবগুলো মিলিয়ে এক বা একাধিক নতুন রসের সন্ধান পাওয়া যায়।

আসলে কে কোন রসে আনন্দিত হবে তা বলা যায় না সঠিক করে। তবে সাধককুল বলে, আগে শুদ্ধ হও তাহলেও শুদ্ধ রস নি:সৃত হবে। নইলে বারবার বিভ্রান্ত হবে সম্পর্কের পারস্পরিক মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে।

কারণ মানুষ একই সাথে কোনো কিছু যেই সময়ে ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করে, ঠিক সেই সময় মনে ভিন্ন কিছু ভাবতে শুরু করে। আবার অনেক সময় পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে একই সময় ভিন্ন ভিন্ন কাজ করতে গিয়ে কোনোটাতেই নির্দিষ্ট রসাস্বাদন করতে পারে না।

আবার অনেক সময় এক ইন্দ্রিয়ের কোনো ক্রিয়া পঞ্চেন্দ্রিয় নিয়ে গভীরভাবে অনুভব করার চেষ্টা করে। যাতে মনও স্থির হয় সঠিক রস জাগ্রত করতে পারে। ভবা পাগলা এই ‘এক মন’-এর প্রতি জোড় দিয়ে বলছেন-

আমার নিতাই চাঁদের দরবারে,
আমার গৌর চাঁদের বাজারে,
এক মন যার সেই যেতে পারে
আবার দু’মন হলে পরবি ফেঁড়ে
ওরে পারবি না পারে যেতে।।

চার দশে চল্লিশ সেরে মন,
আরে রতি মাশা কম হলে, নেয় না মহাজন
বলি আরেক হাকিম বসে আছে,
রোজে রাধা রানী পার করে।।

আরে কাঁঠুরিয়া মানিক চিনে না,
চিনির বলদ বয় যে চিনির স্বাদ তো পেল না।
যেমন স্বর্ণকারে সোনে চিনে,
আবার নেয় সেথায় পরখ করে।।

যে জন চাকা গুড়ের ভিত্তি জানে না
ওলার আশ বাঁধবি কি করে
ভবা পাগলার রসের তত্ত্ব, জীবে জানবে কি করে।
এক মন যার সেই যেতে পারে।।

বলা হয়ে থাকে, পশ্চিমা ‘রসবোধ মতবাদ’ দার্শনিক প্লেটোর মাধ্যমে শুরু হয় যিনি সক্রেটিসের ফিলেবাসে আলোকপাত করেন যে দুর্বলরা হাস্যকর জিনিসের মর্মার্থ বুঝতে অজ্ঞ এবং সেজন্য যখন তাদের উপহসিত করা হয় তারা পাল্টা কোনও কিছু করতে পারে না।

পরবর্তীতে, গ্রীক দর্শনে, পয়েটিক গ্রন্থে অ্যারিস্টট্ল প্রস্তাব করেন যে বিরক্তির উদ্রেক করে না এমন কদর্য হচ্ছে রসবোধের মৌলিক জিনিস।

সাধারণভাবে রস শব্দটা শুনলেই আমাদের মনে পরে যায় বাহারি সব সব ফলের রসের কথা। আবার এসব মধুর রসের পাশাপাশি বাঙালী ভিন্ন স্বাদের বেশ কিছু রসের সাথেও পরিচিত। এরমধ্যে চিরতা, গুলঞ্চ, ত্রিফলার ভেজানো জল উল্লেখযোগ্য।

ভেষজচিকিৎসায় এমন যেমন নানারূপ রসের ব্যবহার আছে। তেমনি অন্যান্য চিকিৎসা শাস্ত্রেও কিন্তু রসালো সব ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করার বিধি দেখতে পাওয়া যায়। আসলে রস বিষয়টাই এমন যা দ্রুত মিশে যাওয়ার অসামান্য ক্ষমতা বয়ে চলে।

রসের কথা বলতে গেলে আরেকটি রসের কথা বলতেই হয়। যা এখন আমাদের নিত্যদিনের জীবনে জড়িয়ে গেছে। তা হরো চা। যদিও কফিরও প্রচলন আছে। তবে চা একটা বিশেষ স্থান পেয়েছে বাঙালীর সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে। চায়ের স্বাদটা ভালো হলে দিনটা ভালো যায় বলেও অনেকেই আমরা দাবী করি।

রাজশেখর বসু (পরশুরাম) তার লঘুগুরু প্রবন্ধাবলীর ‘সাহিত্যবিচার’-এ উল্লেখ করেছেন- “চা আমরা অনেকেই খাই এবং তার স্বাদ গন্ধ মোটামুটি বিচার করতে পারি। কিন্তু চা বাগানের কর্তারা চায়ের দাম স্থির করেন কোন্ উপায়ে? এখনও এমন যন্ত্র তৈয়ারী হয় নি যাতে চায়ের স্বাদ গন্ধ মাপা যায়।

অগত্যা বিশেষজ্ঞের শরণ নিতে হয়। এই বিশেষজ্ঞ বিশেষ কিছুই জানেন না। এর সম্বল শুধু জিব আর নাক। ইনি গরম জলে চা ভিজিয়ে সেই জল একটু চেখে বলেন–এই চা দু-টাকা পাউন্ড, এটা পাঁচ সিকে, এটা এক টাকা তিন আনা।

তিনি কোন্ উপায়ে এইরকম বিচার করেন। নিজেই বলতে পারেন না। তাঁর ঘ্রাণেন্দ্রিয় ও রসননেন্দ্রিয় অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, অতি অল্প ইতরবিশেষও তাঁর কাছে ধরা পড়ে। এই বিধিদত্ত ক্ষমতার খ্যাতিতে তিনি টি-টেস্টারের পদ লাভ করেন এবং চা-ব্যবসায়ী তার যাচাইকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেয়।

কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন- ‘তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি, তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে আরো কাছে টেনে নেই যতোই তোমার কাছ থেকে আমি দূরে যেতে চাই ততো মিশে যাই নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে।’

তিনি যদি বলেন এই চাএর চেয়ে ঐ চা ঈষৎ ভাল, তবে দু-দশ জন সাধারণ লোক হয়ত অন্য মত দিতে পারে। কিন্তু বহু শত বিলাসী লোক যদি ঐ দুই চা খেয়ে দেখে তবে অধিকাংশের অভিমত টি-টেস্টারের অনুবর্তী হবে।”

অনেক অনেক দামী-মজাদার রসের স্বাদ বাঙালীর জিহ্বা পেলেও তালের রস, খেজুরের রসের কথা বাঙালী ভুলতে পারে না। এই রসের স্বাদ তাকে এমন একটা স্মৃতিকারতায় নিয়ে যায় যা হয়তো সকল সময় ছুঁয়ে আর দেখা হয় না। তাই হয়তো এই সব রস বাঙালীর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।

আবার রসের কথা বলতে গেলে চলে আসে ‘রসের হাঁড়ি’ শব্দটি। আর রসের হাঁড়ি মানেই ‘মামার বাড়ি রসের হাঁড়ি’। মানুষের জীবনের অনেক ধরনের সম্পর্ক হয়। তার মাঝে মামা ভাগ্নের সম্পর্কটা সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের একটা সম্পর্ক।

লোকে বলে দুই বা মা মা শব্দটা যুক্ত হওয়ার কারণেই নয় মায়ের সাথে মানুষের যেমন সম্পর্ক। সেই সূত্র ধরে মামার সাথেও একটা ভিন্ন আবেগের সম্পর্ক তৈরি হয়। যাতে মা যেমন অনেক বেশি শাসন করে রাখতে চায় সন্তানকে। তেমনি মামা চায় ভাগ্নে-ভাগ্নিকে অনেক বেশি ছাড় দিতে।

তাই মামা বাড়ি যাওয়া মানেই অফুরন্ত ছুটি আর আনন্দ। আর এই উচ্ছ্বসিত আনন্দকে বাঙালী তুলনা করেছে ‘রসের হাঁড়ি’ নামে।

আবার রসের মধ্যে আরেকটা শব্দ চলে আসে তা হলো- ‘আবেগের রস’। কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে কখন আবেগের রস নি:সৃত হতে শুরু করবে আগে থেকে কেউ বলতে পারে না। এ রস এমন রস যাকে অনেক সময় আমরা স্বীকার করতে চাই না আবার অনেক সময় অস্বীকারও করতে পারি না।

কবি মহাদেব সাহা লিখেছেন- ‘তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি, তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে আরো কাছে টেনে নেই যতোই তোমার কাছ থেকে আমি দূরে যেতে চাই ততো মিশে যাই নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে।’

খুব বিস্তারিত না গিয়ে রসের সাথে সম্পর্কিত আরো গুটিকয়েক শব্দ ও তার অর্থ এখানে উল্লেখ করে দিচ্ছি কিছুটা অপ্রাঙ্গিক হলেও-

রস- নির্যাস
রসবোধ- রস উপলব্দি বা রস উপভোগ করার ক্ষমতা।
রসাত্মক- রসযুক্ত বা রসগর্ভ। তরল ও স্বাধু পদার্থে পূর্ণ।
রসরাজ- রসিকশ্রেষ্ঠ- কবিরসরাজ তাকচন্দ্র সরকার
রসালাপ- রসিকতাপূর্ণ কথাবার্তা।
রসন- রস গ্রহণ বা আস্বাদন।
রসনা- জিহ্বা, যে ইন্দ্রিয় রস আস্বাদন করে।
রসা- রসযুক্ত বা ভিজে হওয়া।
রসায়ন- পদার্থের বিভিন্ন উপাদান ও তাদের ধর্ম সম্বন্ধ বিষয়ক বিদ্যা,
রসোদগার- বৈষ্ণব সাহিত্যে: অতৃপ্ত মিলনাকাঙ্খা নিয়ে পূর্ব মিলনের কথা স্মরণ ও বর্ণন।

(চলবে…)

……………………..
আরো পড়ুন:
রসের ভুবন: পর্ব-১
রসের ভুবন: পর্ব-২
রসের ভুবন: পর্ব-৩
রসের ভুবন: পর্ব-৪
রসের ভুবন: পর্ব-৫
রসের ভুবন: পর্ব-৬
রসের ভুবন: পর্ব-৭
রসের ভুবন: পর্ব-৮
রসের ভুবন: পর্ব-৯
রসের ভুবন: পর্ব-১০

………………………………
তথ্যসূত্র
কাব্যতত্ত্বঅন্বেষণা-নরেন বিশ্বাস।
সাহিত্য সন্দর্শন-শ্রীশ চন্দ্র দাশ।
বৈষ্ণব রস-প্রকাশ: ক্ষুদিরাম দাস।
বিশ্বকোষ : নগেন্দ্রনাথ বসু।
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড): আশুতোষ ভট্টাচার্য।
উইকিপিডিয়াসমূহ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!