-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: রস : রসের ভুবন: চতুর্থ পর্ব
গ. দাস্যরস
মানুষ পিতামাতাকে যে স্থরের প্রেম করে তাতে যে রসের উদ্ভব হয়; রসের ভুবনে তার পরের স্থরের প্রেমের রসই হলো দাস্য বা দাসত্ব্যের প্রেম। এই রস উদ্ভুত হয় মূলত গুরু শিষ্যের মাঝে। শিষ্য যখন গুরু ভজে তখন তাকে দাস হয়ে গুরুকে পরম জ্ঞানে ভজন-সাধন করতে হয়।
গুরু যা বলবেন বা করতে বলবেন সেটাই শেষ কথা জ্ঞান করে ভক্তকে তা পালন করতে হয়। আর গুরু যা বলবেন তাও নিজ জ্ঞানে বুঝে নিয়ে তা পালনের জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হয় সাধককে। তাই বলা হয় শিষ্যকে দাসত্ব্য প্রেম করতে হয় অর্থাৎ তার নিজের কোনো আর চলন-বলন অবশিষ্ট থাকে না গুরু যা বলেন তাই করতে বাধ্য থাকে।
ঘ. বাৎসল্যরস
পিতামাতা সন্তানকে যে প্রেম প্রদান করে তাতে যে রসের উৎপন্ন হয় তই বাৎসল্য রস। নিজের সন্তান বা সন্তানতুল্য বা সন্তান জ্ঞান করা কাউকে যখন পিতামাতারূপে প্রেম করে তা দাসত্ব প্রেমকেও ছাড়িয়ে যায়। তাকে সার্বক্ষণীক সেবা-ভালবাসা-জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে যে লালন পালন তাই বাৎসল্য রস।
ঙ. মধুররস
জগতের সকল প্রেম অর্থাৎ পঞ্চপ্রেমের সর্বোৎকৃষ্ট প্রেম বলা হয় মধুর প্রেমকে। প্রেমিক-প্রেমিকার বা সখা-সখির মিলনে যে মধুর রস উৎপত্তি হয় তাই মধুর রস। অনেকে একে রাধাকৃষ্ণের প্রেমর রসও বলে থাকে।
সাধুগুরুরা বলেন, মধুর প্রেমময় ভাবরস থাকলে সাধুত্ব অর্জন হয়; ফলে দেবতারা ভক্তি দেয়! মনের সকল পাপাচার ত্যাগ করে সাধক যখন মধুর প্রেমে লীন হয় তখনই দর্শন পায়।
প্রকৃত ভক্ত কখনো বৎস, কখনো দাস্য, কখনো শান্ত স্নিগ্ধতার মাধ্যমে, আবার কখনো মধুর রসের মাধ্যমে ভক্তি করে থাকে। অর্থাৎ গুরু-শিষ্যের মাঝে পঞ্চপ্রেমই বিরাজিত। মনিন্দ্র চাঁন দরবেশের ভাষায়-
শান্ত রসের সাধন করে রোগ ব্যাধিতে
পায়না তারে-
একশ বছর বাঁচার পরে দেহে
যৌবন উজান ধরে!
নিত্য নতুন জোয়ার বয়রে
প্রেম খেলে চমৎকারে-?
দাস্য রসে সাধন করে নতুন রুপের
আকার ধরে!
যোগাযোগ হইতে পারে
ব্রক্ষ বিষ্ণু নয় দূর-
চন্দ্র কায়া সংগে করে খাওয়া
খাদ্য তার ভিতরে-?
সখ্য রসের সাধন করে
মুখের ভাষা মিষ্টি করে-
নতুন জোয়ার দেহে বয়রে
যুগল রুপ দেখতে পারে,
ব্রক্ষ জ্যাতি দেহে ধরে
বিজলীর চমক মারে-?
বাৎসল্য রসের সাধন করে
দিনের তারা দেখতে পারে-
শ্রবণ শক্তি অনির্বারে জীবের
কথা বুঝতে পারে,
ব্রক্ষ বিষ্ণু একই ঘরে তিন
জন এক আকার ধরে-?
মধুর রসের সাধন করে সব
দেবতায় ভক্তি করে-
মনিন্দ্র চাঁন দরবেশ কয়রে
শোন ইসমাইল কই তোমারে,
পঞ্চ রসের সাধন করে
মহা মানব হইতে পারে-?
এই পঞ্চরসকে অনেক জায়গায় পঞ্চপ্রেম বলেও অবহিত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে এর নাম হচ্ছে- সাখ্য প্রেম, শান্ত প্রেম, দাস্য প্রেম, বাৎসল্য প্রেম ও মধুর প্রেম। ভক্তিবাদে এই পঞ্চপ্রেম বা পঞ্চরসকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। গুরুশিষ্যের মাঝে-স্রষ্টাসৃষ্টির মাঝে কখন কোন স্থিতি চলছে তার উপমারূপেও এর বহুল ব্যবহৃত হয়।
অন্যদিকে বাউল মতবাদের অনুসারে এই পঞ্চরসকে বলা হয়- সরলচাঁদ, গরলচাঁদ, রোহানী চন্দ্র, ধারাচাঁদ ও আদিচাঁদ ইত্যাদি। তবে এই চাঁদ কখনো চন্দ্র কখনো চাঁন কখনো বা ভিন্ন কোনো শব্দে উল্লেখ পাওয়া যায়।
অনেক সাধনায় মানবদেহের পাঁচটি রসকে চিহ্নিত করা হয় পঞ্চরস হিসেবে। মানবদেহের পঞ্চরস হলো- লালা, দুগ্ধ, শুক্র, সুধা ও মধু রস প্রভৃতি।
১. লালা: মুখ হতে নিঃসৃত রস।
২. দুগ্ধ: স্তন হতে নিঃসৃত শুভ্র রস।
৩. শুক্র: নরদেহে বীর্য রস।
৪. সুধা: নারীদেহের শুভ্র রস।
৫. মধু: নারীদেহের কৃষ্ণ রস।
এই দেহরস নিয়ে শাহ্ আব্দুল করিম বলছেন-
মেয়েরূপি ফুল ফুটেছে বিশ্ব-বাগানে।
ঐ ফুল বেহেস্তে ফুটিয়াছিল কুদরতি শানে।।
ঐ ফুল বেহেস্তে ছিল
ঐ ফুল দুনিয়ায় আইলো,
ফেরেশতা ভুলিয়া গেল
যেই ফুলের ঘ্রাণে।।
ফুটেছে ফুল নানান বেশে
ফুলকে সবাই ভালবাসে,
একটি ফুলের তিনটি রসে
খেলে তিনজনে।।
পুরুষ ভ্রমরা জাতি
দেখিয়া ফুলের জ্যোতি,
কেউ দিতেছে আত্মহুতি
মূল না জেনে।।
প্রেমরস চিনে না যারা
আমার মতো কর্মপোড়া,
এ করিম কয় রসিক ছাড়া
বুঝবে কি অন্যে।।
আসলে কোন রস কোন পরিস্থিতি ও মনস্থিতিতে কার ভালো লাগবে বা ভালো লাগবে না; তা নির্দিষ্ট করে বলা যথেষ্ট কঠিন। কারণ এটি দেশ-কাল-পাত্র ভেদেই শুধু নয় দিন-কাল-ঋতু ও শারীরিক-মানুষিক অবস্থার উপরও অনেকাংশে নির্ভর করে।
একই রস একই মানুষের সকল সময় ভালো বা মন্দ লাগবে এমন কোনো কথাও নেই। কখন কোনো রস কার মাঝে উদ্দীপনা জাগাবে তা পূর্বে হতে স্বয়ং ব্যক্তি নিজেও বলতে পারে না।
যেমন প্রচণ্ড মনখারাপের সময় হয়তো কখনো হাস্যরস আপনাকে শান্ত রসে বা বীর রসে ফিরিয়ে নিতে পারে। আবার একই হাস্যরস একই মনস্থিতিতে কিন্তু ভিন্ন পরিস্থিতিতে আপনাকে ভয় বা করুনা কিংবা রৌদ্র রসেও নিয়ে যেতে পারে।
রস একটি খুবই জটিল ব্যাপার। ইন্দ্রিয় হিসেবে রসকে বোঝা সামান্য নয়। সামান্য জ্ঞানে একে বোঝা বা ধরা প্রায় অসম্ভব। তাকে বোঝার জন্য আমরা বিভিন্ন রসে ভাগ ভাগ করে নতুন নুতন নাম দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি বটে। কিন্তু চিরকাল তা তাতেই নির্দিষ্ট থাকবে সে কথাও নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
একসময়ের জন্য যে কাব্য রস ‘করুনা রস’ হিসেবে সর্বজনে স্বীকৃত হয়। তা সময়ের প্রেক্ষিতে ভয় বা বীভৎস রসে রূপ নিতে পারে, নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা স্থানের মানুষের কাছে। বা ভাষা এমন এক বাঁক নিতে পারে যে অনেক শব্দের অর্থই পাল্টে যেতে পারে।
শব্দ এই খেলাটা খেলে। সময়ের স্রোতে সে তার অর্থ পাল্টে নেয়। এতে মূল রস কি ছিল তা নির্ণয় করাও অনেক সময়ই দুরূহ হয়ে ওঠে। আবার এই যে পরিবর্তন তা সর্বজনের স্বীকৃত নাও হতে পারে। কিন্তু সময় অনেক কিছু সময় নিজেই নির্ধারণ করে নেয়।
(চলবে…)
……………………..
আরো পড়ুন:
রসের ভুবন: পর্ব-১
রসের ভুবন: পর্ব-২
রসের ভুবন: পর্ব-৩
রসের ভুবন: পর্ব-৪
রসের ভুবন: পর্ব-৫
রসের ভুবন: পর্ব-৬
রসের ভুবন: পর্ব-৭
রসের ভুবন: পর্ব-৮
রসের ভুবন: পর্ব-৯
রসের ভুবন: পর্ব-১০
………………………………
তথ্যসূত্র
কাব্যতত্ত্বঅন্বেষণা-নরেন বিশ্বাস।
সাহিত্য সন্দর্শন-শ্রীশ চন্দ্র দাশ।
বৈষ্ণব রস-প্রকাশ: ক্ষুদিরাম দাস।
বিশ্বকোষ : নগেন্দ্রনাথ বসু।
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড): আশুতোষ ভট্টাচার্য।
উইকিপিডিয়াসমূহ