-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয়: রস : রসের ভুবন: পঞ্চম পর্ব
আবার রসের ভুবনে ব্যক্তির মনস্থিতি-পরিস্থিতিতে রসের পরিবর্তন হতে পারে। বা এমনটাও হতে পারে যে, যেই রস থেকে যে রাসাদ্ধান হবার কথা তা না হয়ে, ভিন্ন রস নিঃসৃত হতে পারে।
সে কথা বলতে গেলে বলতে হয়, স্বাদ হিসেবে যে রস মধুর। তা অন্য কোনো শারীরিক স্থিতিতে মধুর নাও ঠেকতে পারে। এতে অনেকেই তর্ক করে বলবেন যে, এতে মিষ্টতার তার তারতম্য হচ্ছে না। তা মধুর রসই থাকছে, ভিন্নতা পাচ্ছে কেবল স্বাদ নেয়ার স্থিতিতে।
কথা মিথ্যা নয়। আবার এ কথাও সত্য যে আমরা এখানে ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি নিয়ে আলোচনা করে, সে সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বুঝবার চেষ্টা করছি। তাই এই বিভ্রান্তিগুলো সম্পর্কে ধারণা না থাকলে। একটা কট্টরবাদিতা বা নির্দিষ্টতা নিয়ে এগিয়ে গেলে ইন্দ্রিয়ের অর্ন্তদর্শনটা ঠিক ঠাহর করা যাবে না।
এতে একটা প্রশ্নের উদ্রেক হয়, তবে রস কি তার মৌলিকত্ব হারায়? এর সরাসরি উত্তর দেয়া শক্ত। তবে আলোচনাটা একটু ঘুরিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়- রসকে এক এক দর্শনে এক এক ভাবে বা প্রকারে বা সংখ্যায় চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
কখনো কখনো তা একক কোনো রসকে ভেঙে নতুন নতুন রসের বিন্যাস করা হয়েছে। কখনো কখনো বহু রসকে সন্নিবেশিত করে একক রস হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে এক দর্শন অন্য দর্শনের রসকে অনেকক্ষেত্রে না মানলেও তা মিথ্যা হয়ে যায় না। আবার কোনো কোনো দর্শনে একই রসকে নানা উপ’রসে চিহ্নিত করার চেষ্টারও কমতি দেখা যায় না।
স্বাদেন্দ্রিয়কে জিহ্বা দ্বারা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তা এক প্রকারে ভাগ করা হয়েছে। আবার স্বাদেন্দ্রিয়কে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সমন্বেয়ে যে অনুভূতির উপলব্দির জন্ম দেয়, তার ভিত্তিতে ভিন্নভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
তাহলে দুটি রস এখানে মুখোমুখি হচ্ছে শৃঙ্গার আর করুণ। আর এই শৃঙ্গার আর করুণ রসের ভিত্তিতে আপনার মাঝে নতুন এক রসের জন্ম দেবে। সেই রস নবরসের যে কোনো রসই হতে পারে।
আবার ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি মন কি করে সাড়া দেয় তার ভিত্তিতেও রসকে ভাগ করা হয়েছে। এই সকল ভাগ নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করা হলেও এই যাত্রায় যেহেতু মন নিয়ে বিশদে আলোচনা বলা হচ্ছে না। তাই মন কি করে প্রতিকৃয়া দেয় তা নিয়ে বিস্তারিত লিখছি না। যতটা প্রাসঙ্গিক তাই লিখবার চেষ্টা করছি।
প্রতিকৃয়ায় যে রস ভাবের উদয় হয় সে সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়- প্রতিকৃয়ার ভিত্তিতে স্বাদেন্দ্রিয়কে ধরা বেশ দুরূহ একটি ব্যাপার। কারণ একই গান শুনে বা কবিতা পাঠে কখনো মনে হতে পারে একটি করুণ রস। কখনো মনে হতে পারে বীভসৎ রস। কখনো মনে হতে পারে শান্ত বা শৃঙ্গার রস।
যদিও ব্যকরণগতভাবে তার ভাব নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মন তো ব্যকরণের দাসত্ব করে না। তাই সে নিয়মের ধার ধারে না। সে তার নিজের মতো করেই প্রতিকৃয়া দেয়।
প্রতিকৃয়া যেমন আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের জন্মজন্মান্তরের সঞ্চিত সংস্কার এবং বর্তমানের সংগৃহীত সংস্কারের উপর নির্ভর করে। তাই তা কতখানি বাস্তব আর কতখানি কল্পনার ভিত্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে, তা পৃথক করা কঠিন হয়ে যায়।
রস ইন্দ্রিয়টি এমনই এক ইন্দ্রিয় যা একই সাথে অনেক দিক থেকে ক্রিয়া করে। বিষয়টি যদি প্রতিকৃয়ার উদাহরণ দিয়ে বলি তাহলে বলতে হয়- ধরুন একটি চিত্রকর্ম যা শৃঙ্গার রসের। কিন্তু আপনি যখন তা দেখছেন তখন আপনার মাঝে করুণ রস ক্রিয়া করছিল।
তাহলে দুটি রস এখানে মুখোমুখি হচ্ছে শৃঙ্গার আর করুণ। আর এই শৃঙ্গার আর করুণ রসের ভিত্তিতে আপনার মাঝে নতুন এক রসের জন্ম দেবে। সেই রস নবরসের যে কোনো রসই হতে পারে।
আবার যে শিল্পকর্ম দেখে আপনার মাঝে রসের উদ্রেক হলো; সেই শিল্পকর্মটি সৃষ্টির সময় শিল্পীর মনে কি রস বিরাজ করছিল সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই ব্যাপারটি বেশ ঘোলাটে।
যে সময়কালে তার আর অন্য কোনো জ্ঞান থাকে না। আর এই মহারসের স্বাদ যে একবার পায় তা তার সারাজীবন মনে ছাপা থেকে যায়। আরেকটু গভীরে বলতে গেলে বলতে হয়- এই রসের অভিজ্ঞতা চলে জন্মজন্মান্তর ধরে। আরো ডুবলে বলা যায়, এই সেই রস; যা নিঃসৃত হয়ে চলেছে স্রষ্টা থেকে সৃষ্টিতে।
স্বাদের ব্যাপারেও তাই। জ্বরের মুখে যে স্বাদ আপনার কাছে বিষাদ মনে হবে। সুস্থদেহে তা ভিন্ন স্বাদের উদ্রেক ঘটাতে পারে। আবার যে তেতো স্বাদ আপনি এক সময় মুখেই তুলতে পারতেন না। পরে অভ্যাসবশত তা ততটা তিক্ততার স্বাদ না দিয়ে মধুর স্বাদও দিতে পারে।
সংগীত হতে পারে এই পর্যায়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। বিশেষ করে ধ্রুপদী সংগীত। কারণ এ সংগীত একটা আবহ যেমন তৈরি করে, তেমনি সে তার শ্রোতাকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যায়।
এখানে এই সংগীতের যেমন একটা রস থাকে। সেই রসকে শিল্পী তার নিজের রসের সাথে মিশিয়ে শ্রোতাদের সামনে যেমন উপস্থাপন করেন। তেমনি তার প্রতিকৃয়াতে শ্রোতাদের মাঝে কি রস উৎপন্ন হবে সেটা অনেক সময় তার সংগীতের দৃঢ়তায় শিল্পী নিজেই নির্দিষ্ট করেন।
অনেকটা মায়াজালের মতো শ্রোতারা তখন শিল্পী-সংগীত-বাদ্যযন্ত্রর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যদি আয়োজন যথাযথ হয়। শিল্পীর সৃষ্টি পূর্ণতা পায়। শিল্পী-শিল্প-শ্রোতা যদি সত্যি সত্যি এক তালে বইতে শুরু করে। তাহলে অনুষ্ঠানে চূড়ান্ত পর্যায়ে সর্বত্র একই রস বইতে শুরু করে।
তখন শিল্পী-শিল্প-শ্রোতা পরিবেশ-পরিস্থিতি-মনস্থিতি একই ধারায় বইতে শুরু করে। এই অবিস্বরণীয় ঘটনাটি যদি ঘটেই যায়, তাহলে সকলেই একই রসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে এক মহারসের দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। আর এ মহারস অল্প সময়ের জন্য হলেও মানুষকে নতুন এক জগতে প্রবেশ করায়।
যে সময়কালে তার আর অন্য কোনো জ্ঞান থাকে না। আর এই মহারসের স্বাদ যে একবার পায় তা তার সারাজীবন মনে ছাপা থেকে যায়। আরেকটু গভীরে বলতে গেলে বলতে হয়- এই রসের অভিজ্ঞতা চলে জন্মজন্মান্তর ধরে। আরো ডুবলে বলা যায়, এই সেই রস; যা নিঃসৃত হয়ে চলেছে স্রষ্টা থেকে সৃষ্টিতে।
এই সেই রস, যে রসের অভিজ্ঞতায় ফিরবার জন্য জগতে এতো সাধন-ভজন-তপস্যা। সেই মহারসের মাঝে নিজেকে লীন করে দেয়ার জন্যই তো জগৎ জুড়ে এতো মত-পথ-ধর্ম-দর্শন। তবে শিল্পের মধ্য দিয়ে এই রসে প্রবেশ করলে তার স্থায়িত্ব কাল বেশি সময় হয় না।
আসর ভেঙ্গে গেলে সেই মহাভাবকে ভেবে তৃপ্তি পাওয়া যায় বটে। কিন্তু তার স্বরূপ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা তৈরি হয় না বেশিভাগ ক্ষেত্রে। কেবল একটা ভালোলাগার ছোঁয়ার মতো স্মৃতি হয়ে থাকে।
কেউ কেউ বলেন সেই মহারস অর্থাৎ আদি-অকৃত্রিম রস হলো- সৎচিদানন্দ বা সর্বত্র আনন্দিত থাকবার অনুভূতি। আর জীব তার পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে সেই অনুভূতি উপলব্ধি করতে চায়। যাতে মন বা চিত্ত হয়ে উঠে ‘সৎচিদানন্দরূপ’। অর্থাৎ পরমের রূপ।
আবার কোনো কোনো সময় অনেকে মিলে এক সাথে একেই বিষয়ে বেশ গুরুত্ব দিয়ে তার রস নিতে চাইলে, তখন সম্মিলিত রস একক রসের দিকে ধাবিত হতে থাকে। এতে এক সাথে অনেকের রস একক রসে প্রকাশ পায়। যেমনটা হয় সিনেমা হলে গিয়ে সিঙ্গেল স্ক্রিনে চলচ্চিত্র দেখতে গেলে বা মঞ্চ নাটক দেখতে গেলে।
আর আত্মদর্শনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নিভৃত সাধনাকে। সম্মিলিত সাধনায় মহারসের সাথে পরিচয় হয়। সেটাই সাধককে সাধনায় মনোনিবেশ করতে সহায়তা করে। তাই সাধুগুরুরা সাধুসঙ্গকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। কারণ সাধক সাধুসঙ্গে অংশ নিলে নিজের ওয়েব লেন্থটা জাস্টিফাই করে নিতে পারে।
প্রথম কথা হলো সেখানে বেশিভাগক্ষেত্রে অন্য কোনো উপলক্ষ না থাকলে, পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা আর শব্দ শোনা ছাড়া আর বিশেষ কোনো কাজ থাকে না। আর যদি তখন প্রদর্শিত শিল্পে তার কোনো রস যর্থাথভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে।
তখন অনেকগুলো মানুষ এক সাথে সেই রসে সিক্ত হয়ে উঠে। এতে অনেকে অন্য রসে ভাসলেও অনেকের প্রভাবে সেই একক রসে ঢুকে পরে।
বিষয়টি চলচ্চিত্র, নাটক, জাদু, বাদ্যযন্ত্র, উচ্চাঙ্গ সংগীত বা নৃত্য প্রদর্শন ইত্যাদি ইত্যাদিতে যেমন ঘটতে পারে। তেমনি উপাসনা-আরাধনাতেও ঘটতে পারে। তাই মানুষের কাছে কোনো তথ্য পৌঁছাতে গেলে অর্থাৎ মানুষকে কোনো একক রসে জাগ্রত করতে চাইলে মানুষকে একত্রিত করে প্রচার করার বিধি প্রচলিত।
আর এই একত্রিত বা এক সাথে জমায়ত হওয়া লোকের মাঝে কোনো কিছু বললে তখন একটা সম্মিলিত একক রস জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। যা একা একা শুনলে ততটা রস নাও জাগতে পারে। যেমন বক্তব্য দেওয়ার সময় যদি সামনে প্রচুর মানুষ জড়ো হয় তাহলে যেমন বক্তাও তার রস উগ্রে দিতে পারে।
তেমনি শ্রোতাও সেই রস গোগ্রাসে গিলতে পারে। কিন্তু আবার শূন্য স্থানে বক্তারও সেই ভাব না জাগতে পারে আবার একা একা সেই জ্বালাময়ী বক্তব্য শুনেও হয়তো কোনো রসের ক্রিয়া সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে নাও পারে। আবার পুরো ব্যাপারটা উল্টোও হতে পারে। তাই এর নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা সহজ নয়।
সেকারণেই হয়তো বেশিভাগ ধর্ম-মতাদর্শে গণ মানুষের জন্য সম্মিলিত আরাধনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক ধর্মেই দেখা যায় বিশেষ বিশেষ যোগ-লগ্নে সকলকে জড়ো করে স্রষ্টার প্রেমে লীন হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর তাকে উৎযাপন করার নানা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিধিবিধানও দেয়া হয়েছে শাস্ত্রে।
আর আত্মদর্শনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নিভৃত সাধনাকে। সম্মিলিত সাধনায় মহারসের সাথে পরিচয় হয়। সেটাই সাধককে সাধনায় মনোনিবেশ করতে সহায়তা করে। তাই সাধুগুরুরা সাধুসঙ্গকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। কারণ সাধক সাধুসঙ্গে অংশ নিলে নিজের ওয়েব লেন্থটা জাস্টিফাই করে নিতে পারে।
কেবল একক সাধনায় মত্ত থাকলে অনেক সময় সাধক জানতেই পারে না তার কতটা বিকাশ হয়েছে। তাই সাধুসঙ্গ গুরুত্ববহ। তবে সেটা সাধুসঙ্গই যাতে হয় সেটার প্রতিও নজর রাখবার কথা বলা হয়েছে। সাধুসঙ্গে বদলে শয়তান সঙ্গ করলে কাজ হবে না। এখানে শয়তান রূপক অর্থে বলা হয়েছে।
অর্থাৎ অনেক ভাবধারার লোকের সাথে মজলিস জমালে পারস্পরিক যোগযোগ তৈরি হয় বটে কিন্ত তা সাধনে তেমন কাজে লাগে না। বেশিভাগক্ষেত্রেই তা সাধনার ধারাকে পাল্টে দেয়। অবশ্য এসকল কথাই ভক্তিবাদের কথা। জ্ঞানবাদ বা কর্মবাদ তাকে মানতে নাও পারে।
(চলবে…)
……………………..
আরো পড়ুন:
রসের ভুবন: পর্ব-১
রসের ভুবন: পর্ব-২
রসের ভুবন: পর্ব-৩
রসের ভুবন: পর্ব-৪
রসের ভুবন: পর্ব-৫
রসের ভুবন: পর্ব-৬
রসের ভুবন: পর্ব-৭
রসের ভুবন: পর্ব-৮
রসের ভুবন: পর্ব-৯
রসের ভুবন: পর্ব-১০
………………………………
তথ্যসূত্র
কাব্যতত্ত্বঅন্বেষণা-নরেন বিশ্বাস।
সাহিত্য সন্দর্শন-শ্রীশ চন্দ্র দাশ।
বৈষ্ণব রস-প্রকাশ: ক্ষুদিরাম দাস।
বিশ্বকোষ : নগেন্দ্রনাথ বসু।
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড): আশুতোষ ভট্টাচার্য।
উইকিপিডিয়াসমূহ