ভবঘুরেকথা
রসের ভুবন

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: রস : রসের ভুবন: অষ্টম পর্ব

রসের ভুবনে বর্তমানে অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে কোনো নির্মাণে অযাচিতভাবে বা দেয়া প্রয়োজন বলে একটু হাস্যরস যোগ করে দেয়া হয়। কিন্তু উপযুক্ত নির্মাতার হাতে এবং যথাযথ শিল্পীর মাধ্যমে হাস্যরস কতটা গুরুত্ব বহন করে তার একটা ছোট্ট উদাহরণ পাওয়া যায় সত্যজিৎ রায়ের কথায়।

দুটির পর ফেলুদা গল্প নিয়ে আরো চলচ্চিত্র করবেন কিনা সেই প্রশ্নের জবাবে ফেলুদা গোয়েন্দা চরিত্রের স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন- ‘…সন্তোষ দত্ত আর নেই কাজেই আমি আর ফেলুদা করবো না। সন্তোষকে ছাড়া জটায়ু হয় না। আর জটায়ু ছাড়া ফেলুদা ছবি হয় না।’

অন্যদিকে রসিকতার জন্য ঢাকাইয়া কুট্টি বা আদিবাসীদের বিশেষ সুনাম আছে। খুব সাধারণ কথাবর্তার ভেতর রসিকতা ঢুকিয়ে তাকে অসাধারণ করে তোলার এই অসামান্য দক্ষতা ছিল কুট্টিদের। আর এই রসবোধের জন্যই তারা চিরস্বরণীয়। তাদের রসিকতার একটা ছোট্ট উদাহরণ হলো-

এক ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেড়িয়েছেন কিন্তু ভুল করে জামাটা পরেছেন উল্টো করে। তাকে দেখে রাস্তায় থাকা পরিচিত একজন বলে উঠলো, ‘তা ঠাকুর মশাই আপনে আইবার লাগছেন? না যাইবার লাগছেন?”

আভিধানিক ভাষায় বলে, রসিকতা হলো কোন বক্তব্য, উচ্চারণ বা অঙ্গভঙ্গি যা মানুষের মনে হাস্য রসের সঞ্চার করে। ব্যঙ্গ আরেক ধরনের রসিকতা যার উদ্দেশ্য অবমাননাকরা।

আবার বৈষ্ণব ও বাউলদের অনেকে রস সাধনা করে বলে লোকে রসিকতা করে তাদেরকে বলে ‘রসের ফকির’। রসের রসিক প্রসঙ্গে ফকির লালন বলছেন-

রসের রসিক না হলে কে গো জানতে পায়।
কোথা সে অটল রূপে বারাম দেয়।।

শূন্য ভরে শয্যা করে
পাতাল পুরে
শয়ন দেয়;
অরসিক বেড়ায় ঘুরে
ঘোর ধাঁধায়।।

মনচোরা চোর সেই যে নাগর
তলে আসে তলে যায়
উপর উপর খুঁজে জীব সবাই;
মাটি ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে
আসমানে গিয়ে হাত বাড়ায়।।

পড়ে সে ফাঁকে ঘরে
শেষ খানায় তলে পরে তলে ঢুঁড়ে
তবে সে ফল প্রাপ্ত হয়;
লালন কয়
উচ্চ মানের কার্য নয়।।

সাঁইজি অন্য পদে বলছেন-

যেরূপে সাঁই আছে মানুষে।
রসের রসিক না হলে
খুঁজে পাবে না দিশে।।

বেদী ভাই বেদ পড়ে সদাই
আসলে গোলমাল বাঁধায়,
রসিক ভেয়ে ডুবে হৃদয়
রতন পায় রসে।।

তালার উপরে তালা
তাহার ভিতরে কালা,
ঝলক দেয় সে দিনের বেলা
রসেতে ভেসে।।

লা-মোকামে আছে নূরী
একলা অকৈতব ভারি,
লালন কয় তাঁর দ্বারে দ্বারী
আদ্যমাতা সে।।

আবার সাধকের কাছে পরমই হলো সেই রসিক জন। যাকে জানবার জন্যই রসিক হওয়ার এই লীলা। সে প্রসঙ্গে সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ লিখেছেন-

সোনার ময়না ঘরে থুইয়া বাইরে তালা লাগাইছে
রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিঞ্জর বানাইছে
রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিঞ্জর বানাইছে।।

দিন হীন মুর্শিদে কয়
মাটির বাসন ভাইঙ্গা গেলে আর কি জোড়া লয়
দয়াল চাইলে লইব জোড়া
মুর্শিদ চাইলে লইব জোড়া
এমন দয়াল কে আছে
রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিঞ্জর বানাইছে
রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিঞ্জর বানাইছে।।

পাগল জ্বালালে কয়
পিঞ্জর ছাইড়া গেলে ময়না আর কি বন্দী হয়
মুর্শিদ চাইলে হইব বন্দী
দয়াল চাইলে হইব বন্দী
এমন দয়াল কে আছে
রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিঞ্জর বানাইছে
রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিঞ্জর বানাইছে।।

আবার যারা শৃঙ্গার রসে সর্বক্ষণ মত্ত থাকে তাদের ব্যঙ্গ করে অনেকেই বলেন ‘রসের নাগর’। যদিও ব্যাঙ্গাত্মকভাবে- রসের নাগর, রসিক জন, রসিক সুজন, রসের রসিক ইত্যাদি শব্দের বহুল ব্যবহার হয়। তারপরও সাধকের কাছে শেষ বিচারে সেই পরমই সেই রসের ভাণ্ডার। বাউলকবি রাধারমণ বলেছেন-

তারে তারে গো সই খোজ করিও তারে
মনের মানুষ বিরাজ করে হৃদয় মণিপুরে।।
যং রঙ লং বং যং রঙ লং বং
সদাই কংকারে এক তারে বাজাইলে বাজে বাহাত্তর হাজারে।
রসের নাগর সে কালাচাঁন আছে সহস্রারে
পাইলে সুযোগ করিও সংযোগ সে যমুনার পারে
ভাইবে রাধারমণ বলে আমি পাইলাম না রে
বৃথা জীবন কাটাইলাম যমুনারই পারে।।

আভিধানিক ভাষায় রসবোধ সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়- রসবোধ হচ্ছে বিশেষ জ্ঞান সম্বন্ধীয় অভিজ্ঞতার প্রবণতা। যেটা হাসির উদ্রেক করে ও আনন্দ দেয়।

আঠারো শতকের জার্মান গ্রন্থকার জরগ লিচটেনবারগ বলেছিলেন, ‘আপনার যত বেশি রসবোধ থাকবে, তত বেশি সুন্দরের দাবিদার হবেন।’

রসবোধকে অনেকে ‘প্রতারণার শিল্প’ হিসেবেও মনে করেন। অনেকে আবার রসবোধকে বিধ্বংসী ও কুরুচিকর বলে মনে করে। সেকারণেও অনেকে দাবি করে, রসবোধকে ব্যাখ্যা করা যায় না অথবা একে ব্যাখ্যা করা উচিত না।

রস ধাতুর অর্থ স্বাদ গ্রহণ, অর্থাৎ যা আস্বাদ্য তাই রস। রস মানুষকে নৈর্ব্যক্তিক আদর্শ জগতে নিয়ে যায়। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র মতে রসের চারটি পর্যায়। যথা-

১. বিভাব: যে সব কারণে ‘স্থায়ীভাব’ উৎপন্ন হয় তাকে বিভাব বলে। বিভাব দুই রকম- আলম্বন ও উদ্দীপন। যাকে অবলম্বন করে মনে সুখদু:খ ভাব উৎপন্ন হয় তাকে আলম্বন বিভাব বলে। আর যাকে দেখে মনে সুখদু:খ ভাব প্রদীপ্ত হয় তাকে বলে উদ্দীপন বিভাব।

২. অনুভাব: যাকে দিয়ে সুখদু:খের অবস্থা অনুমান করা হয় তাকে অনুভাব বলে।

৩. সঞ্চারীভাব: যে ভাব আমাদের মনে কখনো আসে আবার কখনো চলে যায় তাকে সঞ্চারীভাব বলে।

৪. স্থায়ীভাব: যখন নয়টি ভাব (কাব্যের নয় রস) চিত্তে দৃঢ়ভাবে স্থায়িত্বলাভ করে তখন তাকে স্থায়ীভাব বলে।

(চলবে…)

……………………..
আরো পড়ুন:
রসের ভুবন: পর্ব-১
রসের ভুবন: পর্ব-২
রসের ভুবন: পর্ব-৩
রসের ভুবন: পর্ব-৪
রসের ভুবন: পর্ব-৫
রসের ভুবন: পর্ব-৬
রসের ভুবন: পর্ব-৭
রসের ভুবন: পর্ব-৮
রসের ভুবন: পর্ব-৯
রসের ভুবন: পর্ব-১০

………………………………
তথ্যসূত্র
কাব্যতত্ত্বঅন্বেষণা-নরেন বিশ্বাস।
সাহিত্য সন্দর্শন-শ্রীশ চন্দ্র দাশ।
বৈষ্ণব রস-প্রকাশ: ক্ষুদিরাম দাস।
বিশ্বকোষ : নগেন্দ্রনাথ বসু।
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড): আশুতোষ ভট্টাচার্য।
উইকিপিডিয়াসমূহ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!