ভবঘুরেকথা
আর্যপূর্ব ও আর্যদের ধর্ম

স্বাধীন গ্রাম্যজীবন

-লুৎফর রহমান

রোমান সেনাপতি সিন-সি-নিটাস সমস্ত জগতের কাছে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান জাতির কাছে আদর্শ মহাপুরুষের স্মৃতি হয়ে মানব ইতিহাসে বেঁচে আছে।

চাকরি ছাড়া মানুষের জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়- এ ধারণা বাঙালি মুসলমান ছাড়া আর · কারো নেই। ইসলাম ধর্মের প্রথম বিশ্বাস মন্ত্র (কলেমা শাহাদাত) মানুষের জীবনে কতখানি স্বাধীনতার ভক্ত করেছে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। অথচ বাঙালি মুসলমান জীবনের স্বাধীনতাকে কতখানি অমর্যাদা করে, তা বলা যায় না।

আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ মানুষের নমস্য ও ভক্তির যোগ্য নয়- এই হচ্ছে মুসলমানের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ ধর্মবিশ্বাস। সত্য জীবনযাপনেই যে মানুষের গৌরব বেশি, মুসলমানের সে মহাচিন্তাধারা প্রাণে আজ জাগে না, তার কারণ সে প্রকৃত মুসলমান নয়। সে নিজের ধর্মের ভাব ও রস গ্রহণ করতে পারে।

না। না বুঝে সে কোরান পড়ে এবং স্বর্গের আশা করে। তার জীবনের মহৎ ভাব, গৌরবের ধারণা কোনোমতে আসে না। গ্রামের দারোগা ফকু মিয়া ছুটি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি আসেন, সাধারণকে ধরে এনে গালি দেন, অপমান করেন- তা দেখে অশিক্ষিত প্রতিবেশী মুসলমান মনে করে এই উচ্ছল প্রতাপের জীবনই হচ্ছে গৌরবের জীবন।

কুকথায়, অশ্লীলতায় ভরা। তার জীবনে বিবেকের কোনো আসন নেই। তার জীবনে কোনো লজ্জা নেই। যা ইচ্ছা বলে, যা ইচ্ছা গায়ের জোরে করে। তার কথার কোনো ঠিক নেই। তার মহত্ত্বের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। যা আছে তা মৌখিক। তার গোপন জীবনে অসত্য, মিথ্যা ও অন্যায়ের পূর্ণ প্রভাব।

অনেক বছর আগে কলকাতার কোনো ছাত্রাবাসে যশোহরের কোনো জাম্বিল-পরা কাজী সাহেব একদিন গল্প করছিলেন আমার বাপ-দাদা গ্রামের কৃষকদের বাড়িতে ধরে এনে জুতা মারেন, এমনই সম্ভ্রান্ত আমরা। আমরা মাঠে গরু-ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে শস্য নষ্ট করলে কারো সাহস হয় না প্রতিবাদ করে। জীবনের গৌরব সম্বন্ধে বাঙালি মুসলমানের ধারণা কত ছোট, তারই নমুনা মাত্র এই একটি।

চাকরি করা, অত্যাচার করা, অসাধু পথে অর্থ উপার্জন করা আমাদের বাপ-মা ভাই বোনের কাছে একমাত্র গৌরবের জীবন। সত্য স্বাধীন জীবনে আর মনুষ্যত্বেই যে মানুষের গৌরব, একথা জগতের সকল জাতিই বুঝেছেন, বোঝেন নাই বাঙালি মুসলমানেরা।

যদিও এরা দিনের মধ্যে শতবার আল্লাহর কাছে মাথা নত করছেন। প্রকৃত সত্যজীবনের সঙ্গে বা ধর্মের সঙ্গে এদের জীবনের গভীর যোগ নেই। কোন্ জাতি থেকে এঁরা মুসলমান হয়েছে কে জানে! নইলে জীবন সম্বন্ধে এদের ধারণা এত কদর্য কেন? ধর্মজীবন এত সংকীর্ণ কেন? জীবনে এরা শ্রেষ্ঠ এবং সুন্দর হতে চায় না।

এঁদের ধর্ম শুধু মুখে, কেতাবে- “জীবনে নয়। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ। কী আমাদের অভাব? এমন সোনার দেশ জগতে আর কোথায়? এমন অহিংসার দেশ আর কোথায়? খ্রিষ্টের জন্মের বহু বছর আগে এখানে অহিংসা ও প্রেমের মন্ত্র প্রচারিত হয়েছে। প্রত্যেক গৃহই আমাদের এক একটি পোবন, এক একটি ঋষির আশ্রয়।

মাঠ ভরা শ্যামল শস্য, বাড়ি ভরা খাদ্যদ্রব্য, নদী ভরা মাছ- এত আশীর্বাদ জগতের বুকে আর কারা পেয়েছে? তবুও আমাদের অভাব গেল না। রত্নভাণ্ডার ফেলে আমরা পরপদ লেহন, অত্যাচার, মিথ্যা প্রচারণার জীবনযাপন করতে ছুটেছি। ভ্রান্ত : দেশকে নমস্কার কর, মাঠের দিকে ফিরে চাও, লাঙ্গল আর কোদাল ঘাড়ে কর, গাভীর পরিচর্যা কর। বুকভরা স্বাস্থ্য জেগে উঠুক। জীবনে যথার্থ গৌরব সম্বন্ধে তোমরা চিন্তা করতে শেখ।

লেখাপড়া, বিদ্যাচর্চা, ধর্মজীবন, কোরানপাঠ, রোজা-নামাজ এগুলোর উদ্দেশ্য মানুষকে শুদ্ধ ও সুন্দর করে তোলা। মুসলমানের জীবনে বিদ্যা এবং ধর্মের কোনো প্রভাব দেখি না- এ আমাদের গভীর লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়! মহজ্জীবনের কথা দূরে থাক, মুসলমানের পল্লীজীবন, তার পারিবারিক জীবন ভয়ানক গ্লানিপূর্ণ।

কুকথায়, অশ্লীলতায় ভরা। তার জীবনে বিবেকের কোনো আসন নেই। তার জীবনে কোনো লজ্জা নেই। যা ইচ্ছা বলে, যা ইচ্ছা গায়ের জোরে করে। তার কথার কোনো ঠিক নেই। তার মহত্ত্বের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। যা আছে তা মৌখিক। তার গোপন জীবনে অসত্য, মিথ্যা ও অন্যায়ের পূর্ণ প্রভাব।

অবস্থা সচ্ছল হলে, গায়ে জোর থাকলে, একটা বন্দুক বা ভালো ঘোড়া কিনতে পারলে তার দাম্ভিকতার অন্ত নেই। জাল টাকার মতো জাল মুসলমানে দেশ ছেয়ে গেছে। হায়, কবে এদের ভালোর দিকে যাত্রা শুরু হবে!

রোমের দেশপতি (Consul) মিনিউনিয়াজ একোয়ানদের হাতে বন্দি হয়েছেন। রোমীয় সৈন্যদল পরাজিত, বন্দি। শত্রুর গৌরব গর্বের সীমা নেই। রোমের নরনারী সর্বদা ভীত, তটস্থ। এ অবস্থায় রোমবাসীকে রক্ষা করবার ক্ষমতা মাত্র একজনের ছিল। জাতির মান-সম্মান এবং জীবন ছিল একজন কৃষকের হাতে।

তিনি স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ না করে বলেন, যাদের স্বর্ণমুদ্রা আছে তাদের উপর কর্তৃত্ব করাই বেশি সম্মানজনক। উন্নতির সময় জন্মভূমির প্রতি রোমবাসীদের প্রেম ছিল অফুরন্ত। সমস্ত জাতিটা ছিল যেন এক বিরাট দেহ। হিন্দু মুসলমান সমস্ত বৈষম্য ভুলে যেদিন আমরা একদেহ হতে পারব, সেদিনই আমাদের উন্নতির যাত্রা হবে, তার আগে নয়। স্বাধীন সত্যানুরাগী জীবনে তোমরা গৌরব বোধ কর- দাসের চাকচিক্যভরা মিথ্যা জীবনে নয়।

তিনি অট্টালিকায় বাস করেন না। তার সঙ্গে অগ্রপশ্চাতে শত শত দাস-নফর চলত না। তাঁর সঙ্গে হীরা-মাণিক্যের তারকাচিহ্ন জ্বলজ্বল করত না। তার যাত্রা পথে ব্যাণ্ড বাজত না। সঙ্গীনযুক্ত বন্দুক তার কোমরে সর্বদা ঝুলানো থাকত না। মানুষ তাকে দেখে সভয়ে শংকায় পথ ছেড়ে দিত না।

মুসলিম জগতে আর একজন দেশনায়ক মহামান্য মহামানুষ ছিলেন। তৃণশয্যা ছিল তাঁর সিংহাসন। ক্লান্ত ভৃত্যকে অশ্বে তুলে দিয়ে যিনি নিজে বল্পা ধরে নিয়ে যেতে লজ্জাবোধ করেন নি। আঃ মরি! কী নয়নাভিরাম দৃশ্য! কী স্বর্গীয় মধুর মহাজীবনের ছবি! ইনি হচ্ছেন মহাপ্রতাপান্বিত সম্রাট ওমর।

রোমীয় মহাপুরুষ তখন মাঠে কৃষকরূপে, কৃষক ভ্রাতাদের সঙ্গে হলকর্ষণ করেছিলেন। জাতি তাকে মহামান্যেস্পদ ডিটেটর (রোমীয় গণতন্ত্রের সামরিক দেশপতি বা রাজা) করে ডেকে পাঠিয়েছেন! একোয়ানদের হাত থেকে রোম রক্ষা না করলে আর উপায় নেই। এ কাজ আর কারো যোগ্য নয়- আপনারই যোগ্য।

জাতির এই সমাচার দূতেরা সসম্মানে এই বরেণ্য কৃষককে দিলেন। সিন-সি-নিটাসের আর গৃহে যাওয়া হল না। তিনি স্ত্রীর কাছে তার দীর্ঘ জামাটি চেয়ে পাঠালেন এবং সেখান থেকেই হল ছেড়ে তরবারি ধরে দেশবৈরীর বিরুদ্ধে যাত্রা করলেন।

এঁরাই জেনেছিলেন মানব জীবনের গৌরব কীসে হয়। কাপুরুষ ও দাস শত পোশাক পরলেও তার জীবনের গৌরব নেই। রোমীয় জাতির যখন প্রকৃত মহত্ত্ব ও গৌরবের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল, তখনই তারা আদর্শ জাতি হয়েছিলেন।

পরে যখন তারা বিলাসী হয়ে উঠলেন, দাম্ভিক ও আত্মসর্বস্ব হয়ে উঠলেন, অর্থপ্রতাপই হল তখন তাঁদের গৌরবের আদর্শ, তখন তাঁরা পর্যদস্ত হয়ে জগতে মাটির আসন গ্রহণ করতে বাধ্য হলেন। তাঁদের সমস্ত সম্মান নষ্ট হয়ে গেল।

রোমের আর একজন সেনাপতি (মনিয়াস কিউরিয়াস) নিজ হাতে তাঁর শস্য সংগ্রহের গোলাবাড়িতে একটা মাত্র গাজর পুড়িয়ে খাদ্য তৈরি করছিলেন, পার্শ্বে আবার একখানি মাত্র কাষ্ঠের থালা ছিল। এমন সময় স্বর্ণমুদ্রার ভেট দিয়ে এক বিদেশী দূত সেখানে উপস্থিত হলেন।

তিনি স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ না করে বলেন, যাদের স্বর্ণমুদ্রা আছে তাদের উপর কর্তৃত্ব করাই বেশি সম্মানজনক। উন্নতির সময় জন্মভূমির প্রতি রোমবাসীদের প্রেম ছিল অফুরন্ত। সমস্ত জাতিটা ছিল যেন এক বিরাট দেহ। হিন্দু মুসলমান সমস্ত বৈষম্য ভুলে যেদিন আমরা একদেহ হতে পারব, সেদিনই আমাদের উন্নতির যাত্রা হবে, তার আগে নয়। স্বাধীন সত্যানুরাগী জীবনে তোমরা গৌরব বোধ কর- দাসের চাকচিক্যভরা মিথ্যা জীবনে নয়।

<<যুদ্ধ ।। আত্মীয়-বান্ধব>>

……………………
মহা জীবন -লুৎফর রহমান।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!