ভবঘুরেকথা
স্পর্শের কাতরতা ইন্দ্রিয়

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: স্পর্শ : স্পর্শের কাতরতা: প্রথম পর্ব

শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের এই ক্রম ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় ইন্দ্রিয় হলো ‘স্পর্শ’। অর্থাৎ স্পর্শের কাতরতা। আভিধানিকভাবে দেহত্বক দ্বারা অনুভব করার গুণই স্পর্শ। আর সহজভাবে বলতে গেলে, স্পর্শ মানে ত্বকের অনুভূতি অর্থাৎ ছোঁয়া। আর ছোঁয়া শব্দটা আসলেই প্রথমে মাথায় যে গানটা গুনগুনিয়ে উঠে তা হলো-

একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি-
তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী।
কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা,
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি।।

যেটুকু কাছেতে আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে
চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে।
যেটুকু যায় রে দূরে ভাবনা কাঁপায় সুরে,
তাই নিয়ে যায় বেলা নূপুরের তাল গুনি।।

শব্দের আলোচনায় আগেই বলেছি কি করে আমরা আমাদের সংস্কার জন্মজন্মান্তর ধরে জমা করে রাখি। স্পর্শও আমাদের একই পথে হাঁটায়। আদতে ইন্দ্রিয়সমূহের প্রাথমিক কাজই তাই। আমরা যা কিছু ছুঁয়ে দেখি তা থেকেই এক ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করা। আর সে অভিজ্ঞতা নিজ নিজ সংস্কারে জমা রাখা।

স্পর্শের এই সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আমাদেরকে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে। যাতে আমরা কোনো ব্যক্তি-বস্তু বা পদার্থকে না দেখে, না গন্ধ নিয়ে, না স্বাদ নিয়েও কেবল ছুঁয়ে এক ধরনের ধারণা করতে পারি।

যদি আমাদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার বাইরের নতুন কোনো ব্যক্তি-বস্তু বা পদার্থকে কেবল ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করি। তখন আমাদের অভিজ্ঞতা এই নতুন ব্যক্তি-বস্তু বা পদার্থটির কাছাকাছি যে অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের পূর্ব থেকেই সঞ্চিত আছে; তার সাথে মেলাতে শুরু করে। আর মন তার ভিত্তিতে একটা প্রতিকৃয়া দেয়ার চেষ্টা করে।

স্পর্শ ইন্দ্রিয়টি আমরা প্রায় সারাক্ষণই ব্যবহার করলেও তাতে আমরা খুব একটা সচেতন থাকি না। তবে যারা দৃষ্টিহীন তাদের এই ইন্দ্রিয়টি দৃষ্টির অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করে। তারা প্রায় সকল কিছুকেই ছুঁয়ে তার অনুভূতি নিয়ে তা থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে রাখে। যা তাদের জীবনযাত্রাকে সহজ করে।

তবে শব্দের মতোই সঞ্চিত সংস্কার আমাদেরকে অনেকাংশেই বিভ্রান্ত করে। আর সে প্রসঙ্গে বলতে গেলে অন্ধের হাতি দেখার গল্পটি সাবার আগে চলে আসে। যদিও গল্পটি সকলেই জানা। তারপরও ঘটনা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে উল্লেখ করছি-

একবার ছয়জন অন্ধ লোক প্রথমবারের মত একটি হাতির সান্নিধ্যে এসেছিল। প্রত্যেকে হাতির দেহের বিভিন্ন অংশ স্পর্শ করতে শুরু করল। হাতিটির যে অংশে যেজন ছিল সে সেই অংশ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সম্পর্কে বর্ণনা করতে লাগলো।

তাদের একজন বললো- ‘হাতি হচ্ছে ভাঙ্গা দেয়ালের মতো। যা যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে।’

যে হাতির দাঁত স্পর্শ করেছিল সে বলল- ‘হাতি হচ্ছে মসৃণ এবং ধারালো তীরের মতো।’

যে হাতির শুঁড় স্পর্শ করেছিল সে বলল- ‘তোমরা কেন বুঝতে পারছ না যে, হাতি হচ্ছে একটি সাপের মতো।’

যে জন হাতির একটি পা ধরেছিল সে বলল- ‘হাতি একটি বৃক্ষের মতো।’

পঞ্চম লোকটি হাতির একটি কান ধরে বলল- ‘যত সব মূর্খের দল! তোমরা কেন বোঝ না যে হাতি একটি কুলোর মতো।’

ষষ্ঠ অন্ধ লোকটি হাতির লেজ ধরে বলল- ‘আরে দূর। হাতি হলো একটা ঝাড়ুর মতো।’

এই ছয় জন অন্ধ ব্যক্তি তাদের স্পর্শের অভিজ্ঞতা থেকে এরূপ সব মন্তব্য করতে থাকেন। তারা হাতি না দেখলেও- ভাঙা দেয়াল, তীর, সাপ, বৃক্ষ, কুলো ও ঝাড়ু ইত্যাদির সাথে সঞ্চিত সংস্কারের দ্বারা প্রভাবিত। তাই স্পর্শ করার সাথে সাথে তারা তাদের সেই সঞ্চিত সংস্কার থেকে সিদ্ধান্তে চলে আসে।

এখানে বুঝতে হবে, অভিজ্ঞতাই কেবল তাদেরকে ভুল পথে নিয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। তারা দ্রুত সিদ্ধান্তে চলে এসেছে সেটা এখানে মূল সমস্যা। যেভাবে আমরা কোনো কিছু সঠিকভাবে বুঝবার আগেই প্রতিকৃয়া দিয়ে থাকি।

এই ছয়জনই যদি আরো ব্যাপ্তি নিয়ে স্পর্শ করে। আরো সময় নিয়ে ভেবে, তারপর পরস্পর আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসতো তাহলে হয়তো ফলাফল ভিন্ন হতো। হয়তো উত্তর পুরোপুরি সঠিক হতো না। কেননা তাদের অভিজ্ঞতার হাতি শব্দটি নেই। তারপরও হয়তো তারা সত্যের আরেকটু কাছাকাছি যেতে পারতো।

এভাবেই আমরা ইন্দ্রিরের দ্বারা সঞ্চিত অভিজ্ঞতায় বিভ্রান্ত হই। কোনোকিছু সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনে বা না জানার চেষ্টা করে এক ঝলক দেখে, শুনে, স্পর্শ করে, গন্ধ নিয়ে বা স্বাদ নিয়ে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষণ করে ফেলি।

অর্থাৎ তাৎক্ষণিক প্রতিকৃয়া জ্ঞাপন করি। যা আমাদেরকে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে দেয় না।

কিন্তু যদি আমরা দ্রুত প্রতিকৃয়া না দিয়ে অনুভূতিকে উপলব্ধিতে পরিণত করার জন্য সময়টুকু দেই তাহলে শব্দের মতো স্পর্শেও গভীরতায় পৌঁছানো সম্ভব। আর সাধুগুরুরা তাই করার প্রয়াস করেন এবং করতে বলেন। এটা অলৌকিক কোনো ক্রিয়া নয়। কেবল সংস্কারের পরিবর্তে উপলব্ধির সত্যকে চিনতে শেখা মাত্র।

এভাবেই অভিজ্ঞতার সঞ্চিত সংস্কারের ফাঁদে পরে আমরা সত্য থেকে অনেক দূরে সরে যাই। কোনো কিছুকে গভীরভাবে বুঝতে যাওয়ার আগেই সেই সংস্কার আমাদের সামনে এমন কিছু উদাহরণ এনে উপস্থিত করে যে আমরা কোনো কিছু ভাববার আগেই সিদ্ধান্তে চলে আসি।

আদতে স্পর্শ ইন্দ্রিয়টি বেশ সংবেদনশীল একটি ইন্দ্রিয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে স্পর্শ ইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা শীতলতা ও উষ্ণতা অনুভূতি করি। তবে স্পর্শের দ্বারা আমাদের কি কি অভিজ্ঞতা হয়, সে কথা এভাবে এক কথায় উত্তর দেয়া বেশ কঠিন।

কারণ স্পর্শে আমরা একই সাথে অনেকগুলো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফেলি। স্পর্শে যেমন আমরা জীব ও জড় ব্যক্তি-বস্তু-পদার্থের তাপ বুঝতে পারি।

তেমনি ব্যক্তি-বস্তু-পদার্থের গঠন-প্রকৃতি-চরিত্র ছাড়াও সূক্ষ্মতা সূক্ষ্ম বিষয়গুলোও অভিজ্ঞতায় জমা করি। যেমন পানিতে হাত দিয়ে আমরা সেটা যে কেবল পানি তাই শুধু টের পাই না। বা সেটা কতটা উষ্ণ বা শীতল তাতেও অনুভূতি সীমিত থাকে না।

পানিটা কি স্থির, নাকি চলমান অর্থাৎ এর গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাই। আরো ভালো করে খেয়াল করলে হয়তো টের পাওয়া সম্ভব পানিটা বদ্ধ জায়গায় আছে নাকি উন্মুক্ত জলাশয়ে আছে। পানির ঘনত্ব অনুভব করে অনেকে হয়তো ধারণা করতে পারবে এটা সাগরের পানি নাকি টিউবয়েল বা টেপের পানি।

যেমন গাছের পাতা না দেখে কেবল ছুঁয়ে আমরা এর তাপ, গঠন, প্রকৃতি, ত্বক, আকার, আকৃতি, আয়তন, স্থায়ীত্বসহ আরো অনেক ধরনের ধারণা করতে পারি। আবার কোনো কঠিন পদার্থকে স্পর্শ করে আমরা এর সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা করতে পারি। বায়বীয় পদার্থের ক্ষেত্রেও তাই। মোট কথা স্পর্শ মূলত বস্তুর বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে সহায়তা করে।

অভিজ্ঞতার বাইরের কোনো কিছু স্পর্শ করলে আমাদের নতুন একধরনের অভিজ্ঞতা হয়। এই নতুন ব্যক্তি-বস্তু-পদার্থের মধ্যে যা কিছু একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা তা সংস্কারে সরাসরি নতুন হিসেবে সঞ্চয় হয়। আর যা কিছুর সাথে সঞ্চিত সঞ্চয়ের নূন্যতম কোনো কিছুর সাথে মিল খুঁজে পায় অভিজ্ঞতা।

তার সাথে সদ্য পাওয়া ধারণাকে সর্বক্ষণ মিলিয়ে এক নতুন ধরনের ধারণা করার চেষ্টা করতে শুরু করে।

ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি আমাদের অভিজ্ঞতাকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে যায়। যা প্রকাশ করা সহজ নয়। এতে আমাদের দেহে থেকে যেমন একটা তরঙ্গ বের হয়ে যা বা যাকে ছোঁয়া হয় তার মধ্যে তরঙ্গায়িত হয়। তেমনি যা বা যাকে ছোঁয়া হচ্ছে তা বা তার থেকেও এক ধরনের তরঙ্গ বের হয়ে একটা যৌথ অনুভূতির জন্ম দেয়।

আর এই স্পর্শ ইন্দ্রিয় স্থূলদেহে বিরাজ করে মানবদেহের সর্ববৃহৎ অঙ্গ ‘ত্বক’ রূপে। সহজ ভাষায় আমরা যাকে বলি ‘চামড়া’। এটিই জীব দেহকে বইরে থেকে মুড়ে রাখে। অর্থাৎ স্থূলদেহে যা কিছু আছে তাকে মুড়ে যে আবরণ তাই ত্বক।

যেহেতু এটি দেহের বাইরের বিশাল অংশ জুড়ে থাকে। তাই এর দ্বারাই আমরা সকল কিছুকে ছুঁয়ে দেখি বা সকল কিছুর ছোঁয়া পেয়ে থাকি।

কোনো কিছুকে ছুঁয়ে দেখবার জন্য আমরা আমাদের দুটি হাত; বিশেষ করে বলতে গেলে হাতের তালু বা আঙ্গুল ব্যবহার সবচেয়ে বেশি করে থাকি। তারপরই পায়ের পাতার ব্যবহার। এছাড়াও সমগ্র দেহ দিয়েই আমরা অনুভূতি লাভ করি। তবে দেহের ত্বকের সর্বত্র অনুভূতির মাত্রা কিন্তু আবার সমান নয়।

(চলবে…)

………………….
আরো পড়ুন:
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-২
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৩
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৪
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৫
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৬
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৭
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৮
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-৯
স্পর্শের কাতরতা: পর্ব-১০

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!