-মূর্শেদূল মেরাজ
সোহরাওয়ার্দির ‘লাল বুদ্ধিবৃত্তি’
সোহরাওয়ার্দির ‘আকলে সোর্খ’ বা ‘লাল বুদ্ধিবৃত্তি’ গল্পের প্রধান দুই চরিত্র হল বাজ পাখি ও লাল চুলের বৃদ্ধ। গল্পে বাজ হচ্ছে এমন মানুষের প্রতীক যে তার আসল দেশ থেকে বহুদূরে আটকা আছে মাটির পৃথিবীতে। আর বৃদ্ধ হচ্ছে বিবেকের প্রতীক। যে না চরম আলোকিত না সম্পূর্ণ অন্ধকার।
অতীত কালে মনে করা হতো, সাদা আর কালো অর্থাৎ আলো ও অন্ধকারের মিশ্রণে হয় লাল। তাই এ দুই রংয়ের মিশ্রণ ‘লাল’ উপমারূপে বৃদ্ধের চুলের রঙে ব্যবহার করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দির দর্শনে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি হল সাদা বা আলোকিত।
আর দেহ হচ্ছে আঁধারে পরিপূর্ণ অর্থাৎ অন্ধকার। যখন সাদা ও স্বচ্ছ বুদ্ধিবৃত্তিতে অন্ধকার স্থান করে নেয় তখন তা হয়ে পড়ে লাল। বৃদ্ধ বহু বছর অন্ধকার কুয়ায় অর্থাৎ মাটির পৃথিবীতে থাকায় তার সাদা চুল লাল হয়ে গেছে।
গল্পে বাজ পাখি বৃদ্ধের কাছে তার অতীত দিনের অস্পষ্ট স্মৃতিচারণ করে। নানা প্রশ্ন করে। এসব শুনে সবজান্তা বৃদ্ধ বলেন প্রশ্নের জবাব পেতে হলে বাজকে দুঃসাহসিক এক অভিযানে যেতে হবে। কোন পথে কিভাবে যেতে হবে তাও বাজকে বলেন বৃদ্ধ। তবে সে অভিযান মোটেও সহজ নয়।
বাজ বৃদ্ধকে প্রশ্ন করে তিনি কোথা হতে এসেছেন। বৃদ্ধ বলে, কুহেকাফ পাহাড়ের অপর পাশ থেকে। যেখানে তোমারও নীড় ছিল যা তুমি ভুলে গেছ। বাজ বলল, সেখানে কি করতেন? বৃদ্ধ বলে, আমি ছিলাম ভ্রমণকারী। পৃথিবীময় ঘুরে বিস্ময়কর বিষয়গুলো দেখতাম।
বাজ বলল, বিস্ময়ের মধ্যে কি দেখেছেন? তিনি বলেন, বিশ্বে সাতটি বিস্ময়কর বস্তু দেখেছি। সেগুলো হলো- কাফ পাহাড়, রাতে জ্বলা দামী পাথর, তুবা গাছ, ১২টি কারখানা, দাউদের বর্ম, খরগোশের ক্ষুর এবং জীবন প্রস্রবণ।
এরপর বৃদ্ধ সাতজন গুরু ও তাদের শিষ্যদের কথা বলেন। যারা দিবা নামের এক ধরনের সূক্ষ্ম রেশমি কাপড় বোনে। সে কাপড় আসলে দাউদ নবীর বর্ম যা লোহার অসংখ্য আংটির মতো জাল। যে জাল দিয়ে বাজ পাখিকে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। চোখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এ জন্যই বাজ পাখি ওড়ার শক্তি হারিয়েছে।
বৃদ্ধ বলে, তার লক্ষ্য হল বাজ পাখির দেহে আবন্ধ বর্মের আংটির রিংগুলো খুলে তাকে মুক্তি দেয়া। কিন্তু বর্মের সুতোর জটা এতোই মজবুত যে তা ছিন্ন করা কষ্টসাধ্য। কেবল খরগোশের ক্ষুর দিয়েই তা কাটা সম্ভব। এই ক্ষুর দেয়া আছে জল্লাদের হাতে। সেই জল্লাদই কেবল জানে বর্মের আয়ু সম্পর্কে। যথাসময়ে সে একে ছিন্ন করবে।
সে যে আদৌতে এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর বস্তুজগতে আবদ্ধ থার জন্য জন্মায় নি সেটাও সে ভুলে গেছে। কিন্তু বিবেক অর্থাৎ লাল রং যা আলো ও অন্ধকার বা সাদা ও কালর প্রতিনিদ্ধিত্ব করে তা জাগ্রত করে। তাকে প্রশ্ন করে, সে কোথা থেকে এসেছে? সেখানে তার কাজ কি? অর্থাৎ নিজেই নিজের বিবেক কে প্রশ্ন করে।
জল্লাদ যদি বর্মকে তার মতো করে ছিন্ন করে তাহলে তাতে বাজ পাখিরও ক্ষতি হবে। এজন্য বাজপাখি বৃদ্ধের কাছে এমন পন্থা শিখতে চায় যাতে তার দেহের ওপর চাপানো বাঁধগুলো ক্ষতি ছাড়াই ছিন্ন করা যাবে।
বৃদ্ধ বলেন, বাজ যদি ঝর্ণা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে এবং তাতে গোসল করে তাহলে ক্ষতি ছাড়াই বাঁধগুলো খুলে যাবে। এরপর সে খুব সহজেই হাল্কা পাখা নিয়েও সূর্যের দিকে উড়ে গিয়ে মুক্তির পথ অর্জন করতে পারবে।
অস্পষ্ট স্মৃতিতে বাজের মনে পড়ে এক সময় তার পাখা ছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ বন্দি জীবনে সে ভুলেই গেছে উড়বার কথা। একসময় যে পাখি ছিল তাই আর মনে পরে না। চোখ বন্ধ করা শেকলে বাঁধা অবস্থাতেই বাজ অন্ধকার মরুতে সফর শুরু করে। লাল চুলের বৃদ্ধর সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্ব পর্যন্ত এই সফর চলতেই থাকে।
আদৌতে মানুষ যে পরম আলোরই অংশ তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীতে এসে দাউদের বর্ম অর্থাৎ বস্তুজগতের মায়া-মোহে আবদ্ধ হয়ে আছে। তার দৃষ্টিশক্তি লুপ্ত হয়েছে। সে তার প্রকৃত সত্তাকে চিনতে পারছে না। স্রষ্টাপ্রেমে লীন হতে পারছে না।
সে যে আদৌতে এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীর বস্তুজগতে আবদ্ধ থার জন্য জন্মায় নি সেটাও সে ভুলে গেছে। কিন্তু বিবেক অর্থাৎ লাল রং যা আলো ও অন্ধকার বা সাদা ও কালর প্রতিনিদ্ধিত্ব করে তা জাগ্রত করে। তাকে প্রশ্ন করে, সে কোথা থেকে এসেছে? সেখানে তার কাজ কি? অর্থাৎ নিজেই নিজের বিবেক কে প্রশ্ন করে।
তখন মানুষ স্রষ্টাপ্রেমে লীন হওয়ার দীর্ঘ পথের সন্ধান পায় যে পথ পাড়ি দিতে পারলে বস্তুজগতের বন্ধন মুক্ত হয়ে স্রষ্টাপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে তাতে সন্নিবেশিত হতে পারবে। অল্পকথায় এটাই সোহরাওয়ার্দির ইশরাকি বা আলোর দর্শন।
(চলবে…)
<<সোহরাওয়ার্দি: প্রেমের বাস্তবতা ।। সোহরাওয়ার্দি: সী-মোরগের দূত>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………………..
আরো পড়ুন:
সোহরাওয়ার্দি: জীবন ও কর্ম
সোহরাওয়ার্দি: ইশরাকি দর্শন
সোহরাওয়ার্দি: সাহিত্য
সোহরাওয়ার্দি: জিব্রাইলের পালকের শব্দ
সোহরাওয়ার্দি: উইপোকার আলাপচারিতা
সোহরাওয়ার্দি: প্রেমের বাস্তবতা
সোহরাওয়ার্দি: লাল বুদ্ধিবৃত্তি
সোহরাওয়ার্দি: সী-মোরগের দূত