তরিকায় জাকাত
-আবুতালেব পলাশ আল্লী
আল্লাহ জাকাতের মাধ্যমে মানবজাতিকে দানের দিকে ধাবিত করেছেন। যাতে করে সমাজের দারিদ্র দূরীকরণ হয়। তাই স্থায়ীভাবে শান্তি(ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করতে কোরানে যতগুলো নির্দেশনা আছে জাকাত তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফরজ।
শরিয়তের জাকাত হল, মানুষের পার্থিব ধন-সম্পদ নির্দিষ্ট পরিমাণ অতিক্রম করলে, তার উপর জাকাত আদায় করা ফরজ হয়ে যায়। তাকে প্রত্যেক বছর নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত পরিমাণ জাকাতের হকদারকে তা প্রদান করতে হয়।
তরিকতের জাকাত হল, আখিরাতের উপার্জন থেকে দ্বীন ও ঈমানের দারিদ্র এবং নিঃস্বদের মাঝে বণ্টন করতে হয়। অর্থাৎ সৎ ও পূর্ণময় আমলের প্রচার, যাদের নিকট পরকালের পাথেয় নেই তাদেরকে সৎ আমলের দিশা দিয়ে পরকালীন পুঁজি সঞ্চয়ে সহায়তা করা।
হজরত রাবেয়া বসরি বলেন, ‘হে আল্লাহ! দুনিয়াতে আমার জন্য নির্ধারিত অংশ কাফেরদের আর পরকালের অংশ ঈমানদারদের দান করে দাও। আমি দুনিয়াতে তোমার জিকির ও স্মরণ ছাড়া কিছু চাই না। আর আখিরাতে তোমার দিদার ও দর্শন ব্যতিত অন্য কিছুর আমার প্রয়োজন নেই।’
কোরানে জাকাতকে সদকা নামে অবহিত করা হয়েছে- ‘ইন্নামাসসাদকা-তুলিলফুকার ই ওয়ালা মাছা-কীনি ওয়াল আ-মিলীনা আলাইহা-ওয়াল মুআল্লাফাতি কুলূবুহুম ওয়া ফিররিকা-বি ওয়াল গা-রিমীনা ওয়া ফী ছাবীলিল্লা-হি ওয়াবনিছ ছাবীলি ফারীদাতাম মিনাল্লা-হি; ওয়াল্লা-হু আলীমুন হাকীম।’ (সুরা আত-তাওবাহ্, ৬০)
অর্থাৎ ‘সদকা (জাকাত) হল কেবল ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্যে-ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরদের জন্যে, এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ বলা হয়, যে ব্যক্তি সদকা নিঃস্বদের প্রদানে হাত প্রসারিত করে আল্লাহ তা কবুল করে নেন।
তরিকতের জাকাত সার্বক্ষনিক দিতে হয়। এটার কোন সময় নির্ধারিত নেই। যখন ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির অভিপ্রায়ে স্বীয় সদকার সাওয়াব গুনাহগারদের আত্মার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে, তখন আল্লাহ তাঁর অপরাধ মার্জনা করে দেন।
তখন সে এমন পর্যায় উপনীত হন যে, অন্যদের সাওয়াব প্রদান করতে করতে সে নিজেই নিঃস্ব হয়ে পরে। আর আল্লাহ এরূপ দানশীলতা ও নিঃস্বকে পছন্দ করেন। যেমন নবীজী বলেছেন- ‘নিঃস্বরা আল্লাহর জিম্মায় রয়েছেন।’
হজরত রাবেয়া বসরি বলেন-
‘হে আল্লাহ! দুনিয়াতে আমার জন্য নির্ধারিত অংশ কাফেরদের আর পরকালের অংশ ঈমানদারদের দান করে দাও। আমি দুনিয়াতে তোমার জিকির ও স্মরণ ছাড়া কিছু চাই না। আর আখিরাতে তোমার দিদার ও দর্শন ব্যতিত অন্য কিছুর আমার প্রয়োজন নেই।’
যিনি তার জীবন ও সম্পদ স্রষ্টার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করতে পারে আল্লাহ তাকে শেষ বিচারের দিন একটি পুণ্যের বিনিময়ে দশটি পুণ্য দান করবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন-
‘মান জাআ বিল হাছানাতি ফালাহূ আশরু আমছা-লিহা-ওয়ামান জাআ বিছছাইয়িআতি ফালা-ইউজঝা ইল্লা-মিছলাহা-ওয়া হুম লা-ইউজলামূন।’ (সুরা আনআম, ১৬০)
অর্থাৎ ‘যে একটি সৎকর্ম করবে, সে তার দশগুণ পাবে এবং যে একটি মন্দ কাজ করবে, সে তার সমান শাস্তিই পাবে। বস্তুতঃ তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’
তরিকতের জাকাতের অর্থই হল, আত্মাকে প্রবৃত্তির তাড়না থেকে পবিত্র রাখা। আল্লাহর ফরমান-
‘মান যাল্লাযী ইউকরিদুল্লা-হা কারদান হাছানান ফাইউদা-ইফাহূলাহুআদ‘আ ফান কাছীরাতাওঁ ওয়াল্লা-হু ইয়াকবিদুওয়া ইয়াবছুতুওয়াইলাইহি তুরজাঊন।’ (সুরা বাকারা, ২৪৫)
অর্থাৎ ‘এমন কে আছে যে, আল্লাহকে কর্য দেবে, উত্তম কর্য অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন। আল্লাহই সংকোচিত করেন এবং তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তাঁরই নিকট তোমরা সবাই ফিরে যাবে।’
তিনি আরও বলেন –
‘ইন তুকরিদুল্লা-হা কারদান হাছানাইঁ ইউদা-‘ইফহু লাকুম ওয়া ইয়াগফিরলাকুম ওয়াল্লা-হু শাকূরুন হালীম।’
(সুরা আত-তাগাবুন, ১৭)
অর্থাৎ ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর, তিনি তোমাদের জন্যে তা দ্বিগুণ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী, সহনশীল।’
তিনি আরও বলেন-
‘কাদ আফলাহা মান ঝাক্কা-হা।’
(সুরা আশ-শাম্স, ৯)
অর্থাৎ ‘যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়।’
আয়াতগুলোতে কর্য ও ঋণের উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর রাস্তায় কোন উপকারের আশা ব্যতিত শুধুমাত্র স্রষ্টার সন্তুষ্টির লক্ষে সস্নেহে আপন সৎকর্ম করে আল্লাহ সেই বান্দাকে সওয়াব দান করতে থাকেন।
আল্লাহ বলেন-
‘ইয়া আইয়ুহাল্লাযীনা আ-মানূ লা-তুবতিলূ সাদকা-তিকুম বিলমান্নি ওয়ালআযা-কাল্লাযী ইউনফিকু মা-লাহূ রিআআন্না-ছি ওয়ালা-ইউমিনুবিল্লা-হি ওয়াল ইয়াওমিল আখিরি ফামাছালুহূকামাছালি সাফওয়া-নিন আলাইহি তুরা-বুন ফাআসা-বাহু ওয়া-বিলুন ফাতারাকাহূ সালদান লা-ইয়াকদিরূনা ‘আলা-শাইইম মিম্মা-কাছাবূ ওয়াল্লা-হু লাইয়াহদেল কাওমাল কা-ফিরীন।’ (সুরা বাকারা, ২৬৪)
হে মানব সন্তানরা তোমরা যদি কেউ দানের মাধ্যমে স্রষ্টাকে উত্তম ঋণ দিতে আগ্রহী হও, তবে তোমার নিকট গচ্ছিত ইহকাল ও পরকালের সকল সম্পদই স্রষ্টার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান করে দাও।
অর্থাৎ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান খয়রাত বরবাদ করো না। সে ব্যক্তির মত যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মত যার উপর কিছু মাটি পড়েছিল। অতঃপর এর উপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অনন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিল। তারা ঐ বস্তুর কোন সওয়াব পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ অবিশ্বাসীদের পথ প্রদর্শন করেন না।
…তোমাদের দান সদকা দ্বারা পার্থিব ধন-দৌলত ইত্যাদি আশা করো না, তাহলে তোমাদের এসব দান সদকা বিফলে যাবে।’
আল্লাহ আরও বলেন-
‘লান তানা-লুল বিররা হাত্তা-তুনফিকূমিম্মা-তুহিববূনা ওয়ামা-তুনফিকূমিন শাইইন ফাইন্নাল্লা-হা বিহী আলীম।’
(সুরা ইমরান, ৯২)
অর্থাৎ ‘কস্মিণকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না কর। আর তোমরা যদি কিছু ব্যয় করবে আল্লাহ তা জানেন।’
এ প্রকারের ব্যয় মানে হলো যা আল্লাহর পথে খরচ করা হবে তা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই থেকে হবে। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিজের প্রিয় পছন্দনীয় ও উৎকৃষ্ট বস্তু করতে হবে।
হে মানব সন্তানরা তোমরা যদি কেউ দানের মাধ্যমে স্রষ্টাকে উত্তম ঋণ দিতে আগ্রহী হও, তবে তোমার নিকট গচ্ছিত ইহকাল ও পরকালের সকল সম্পদই স্রষ্টার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান করে দাও।
……………………………
পুনপ্রচারে বিনীত: আবুতালেব পলাশ আল্লী
মা শাহে সেতারার রওজা বা দরবার শরিফ
খুলনা, বাংলাদেশ।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………
আরও পড়ুন-
দোজখ
নফসের সংযম
স্রষ্টা থেকে সৃষ্টির আবির্ভাব
মোরাকাবা-মোশাহেদা
নফসের পঞ্চস্তর
তরিকায় নামাজ রোজা
তরিকায় জাকাত
দেহতত্ত্বে লতিফা ও চক্র ভেদ
সাধনার ধারা