চাতক বাঁচে কেমনে
-আনান বাউল
“চাতক বাঁচে কেমনে,
মেঘের বরিষণ বিনে”
চাকত পাখিকে নিয়ে নানা মতবাদ প্রচলিত আছে। অনেকেই ভাবন চাতক একটি কাল্পনিক পাখি। রূপকথার পাতা থেকে উঠে এসেছে। তবে মজার বিষয় হলো, চাতক পাখি কোনো কাল্পনিক পাখি নয়। বাস্তবেও এই পাখির অস্তিত্ব রয়েছে।
চাতক পাখি বাংলা লোক-সংগীত এবং লোক-সাহিত্যে বেশ পরিচিত একটি নাম। মহাত্মা ফকির লালন সাঁই সহ অসংখ্য গীতিকবিদের রচনায় অসংখ্যবার এই পাখির কথা উল্লেখ হয়েছে। বিশেষ করে গুরু এবং শিষ্যের প্রেমভক্তি বা প্রেমিক যুগলের বিরহের উপমা দিতে এই পাখির নাম ব্যবহৃত হয়। বাউল ফকিররা হয়তো এ কারণেই চাতক পাখিকে ভক্তপাখি বলে ডাকে। যতদূর জানা যায়- এটি পাকড়া, পাপিয়া বা বুলবুলি (Cuculidae) পাখিদের পরিবারের অন্তর্গত একটি পাখি। এর বৈজ্ঞানিক নাম: Clamator jacobinus.
এটি একটি পরজীবী পাখি। এরা বড় করে বাসা বানায়। চাতক পাখি মুলত সমুদ্রের কিনারা অথবা বড় জলাশয়ের আশে পাশে বাস করে। ফকির লালন সাঁই লিখেছেন-
সমুদ্রের কিনারায় থেকে জল বিনে চাতকী মলো।
হায় রে বিধি ওরে বিধি তোর মনে কি ইহাই ছিল।।
নবঘন বিনে বারি
খায় না চাতক অন্য বারি
চাতকের প্রতিজ্ঞা ভারি
যায় যাবে প্রাণ সেও ভাল।।
চাতক থাকে মেঘের আশে
মেঘ বরিষে অন্য দেশে
বলো চাতক বাঁচে কিসে
ওষ্ঠাগত প্রাণ হলো।।
লালন ফকির বলে রে মন
হলো না মোর ভজন-সাধন
ভুলে সিরাজ সাঁইয়ের চরণ
মানবজনম বৃথা গেল।।
বৈশিষ্ট্য:
চাতক পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো; এরা বৃষ্টির জল ছাড়া অন্যকোনো জল পান করে না। এমনকি তৃষ্ণায় মরে গেলেও এরা অন্য জল পান করে না। এই পাখিকে খাঁচায় পুষে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে এরা আসলেই বৃষ্টির জল ছাড়া অন্য জল পান করে না। তবে কেউ কেউ বলেন যে; অন্য কোনো জল উপর থেকে ছিটিয়ে বা স্প্রে করে দিলে এরা বৃষ্টির জল ভেবে পান করে থাকে।
চাতক পাখি মৃত্যুর সময় পিঠ মাটিতে ঠেকিয়ে, পাদুটো উপর দিকে তুলে, ঠোঁট হা করে এবং চোখ খোলা অবস্থায় আকাশের দিকে তাকিয়ে মারা যায়। লালন সাঁইজি বলেছেন-
অমৃত মেঘের বারি
মুখের কথায় কি মেলে।
চাতক স্বভাব না হলে।।
মেঘে কত দেয় গো ফাঁকি
তবু চাতক মেঘের ভুখী।
অমনি নিরিখ রাখলে আঁখি
তারে সাধক বলে।।
চাতক পাখির এমনি ধারা
তৃষ্ণায় জীবন যায় গো মারা।
অন্য বারি খায় না তারা
মেঘের জল বিনে।।
মন হয়েছে পবন গতি
উড়ে বেড়ায় দিবারাতি।
ফকির লালন বলে গুরুর প্রতি
মন রয় না সুহালে।।
চাতক পাখি সম্বন্ধে লোকবিশ্বাস:
অনেক সময় দেখা যায় বৃষ্টির মৌসুম ছাড়াই শীতকালে বা অসময়ে আকাশে কোনো রকম মেঘ ছাড়াই হঠাৎ একপশলা বৃষ্টি নামে। এরকম হঠাৎ বৃষ্টি হলে গ্রামের মুরুব্বীরা বলে যে চাতক পাখির আর্তনাদ আর প্রার্থনায় মেঘদেবতা বা মিকাইল ফেরেস্তা বৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়েছে। সেই বিশ্বাস থেকেই আগের দিনে গ্রামবাংলায় চৈত্র-বৈশাখে অনাবৃষ্টি আর খরা দেখা দিলে, খড়কুটো দিয়ে প্রতীকী চাতক পাখি বা চাতকমূর্তি বানিয়ে আকাশের দিকে উঁচু করে তুলে ধরা হতো। আর আর্তনাদের সুরে কর্কশ গলায় গাওয়া হতো-
চাতক মরে ম্যাগ বিনে
দ্যাউয়ে দিলো হিপি কানে।
হিপি খোলো দোরি পাও
দোহাই নাগে ম্যাগ দ্যাও।।
চাতক পাখির বিস্তৃতি:
চাতক পাখি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। সাবসাহারান আফ্রিকার দক্ষিণ থেকে তাঞ্জানিয়া ও জাম্বিয়া পর্যন্ত; উত্তর পশ্চিম ভারত থেকে নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত। কখনও কখনও হিমালয়ের পাদদেশে তিব্বতেও দেখা যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আসে গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী হিসেবে।
আবাস ও সংরক্ষণ:
সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস, প্রায় ৩৬ লক্ষ ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের আবাস। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা স্থির রয়েছে, আশঙ্কাজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেনি। সেকারণে IUCN এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
চাতক কেনো সাধক পাখি:
চাতক পাখিকে নিয়ে চমৎকার একটি লোককাহিনী প্রচলিত আছে। সেটি হচ্ছে; এক মৃত্যুপথযাত্রী ‘মুমূর্ষু মা’ তার কিশোর ছেলের কাছে জলপান করতে চাইলেন। ছেলে মায়ের আকুতি ভুলে গিয়ে খেলায় মেতে রইল। ইতিমধ্যে মা জলের তৃষ্ণায় কাতর হয়ে স্বর্গে চলে গেছেন। ছেলে বাড়ি ফিরে দেখলো তার মা মরে গেছে। ছেলেটা কান্নায় ভেঙে পড়লো এবং অনুশোচনায় পরে গেলো।
জল জল করে চেঁচিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে লাগল। এমনকি মায়ের কাছে জল পৌঁছে দিতে স্বর্গে যেতে চাইল। কিন্তু স্বর্গ তো অনেক দূর, আকাশের ওপারে। তাই দূরের পথ পাড়ি দিতে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করল তাকে পাখি বানিয়ে দিতে, যাতে সে মায়ের কাছে যেতে পারে। সৃষ্টিকর্তা ছেলেটির আবেদন মঞ্জুর করলেন, আর ছেলেটিও পাখি হয়ে গেলো। ছেলেটি মনে মনে আরো প্রতিজ্ঞা করলো যে; মায়ের মুখে জল না দিয়ে সে একফোঁটা জলও পান করবেন না।
তাতে তার প্রতিজ্ঞা ক্ষীণ হয়ে যেতে পারে। আর যদিও পান করে, তবে মায়ের কাছে পৌছানোর আগে বৃষ্টির জল ছাড়া, পৃথিবীর কোন জলাশয়ের জল পান করবে না। কারণ মায়ের কাছে পৌঁছানোই তার মূল সাধনা। লোকের বিশ্বাস; ওই কিশোর ছেলেটি আজও পাখি হয়ে উড়ে উড়ে স্রষ্টার কাছে জল প্রার্থনা করছে।
চাতক বাঁচে কেমনে
মেঘের বরিষণ বিনে।।
তুমি হে নব জলধর
চাতকিনী ম’লো এবার।
ঐ নামের ফল সুফল এবার
রাখ ভুবনে।।
তুমি দাতার শিরোমণি
আমি চাতক অভাগিনী।
তোমা ভিন্ন আর না জানি
রাখ চরণে।।
চাতক ম’লে যাবে জানা
ঐ নামের গৌরব রবে না
জল দিয়ে কর সান্তনা
অবোধ লালনে।।
…………………………………
বি:দ্র:
গুগল ইমেজ বা ইন্টারনেটে চাতক পাখি লিখে সার্চ করলে, একটি বিশালাকৃতির বক সদৃশ পাখির ছবি দেখা যায়। ঐ ছবিতে দেখা যায় পাখিটি কোন এক সাগর সৈকতে পানির খুবই নিকটে তার বিশাল ঠোঁট দুটি প্রসারিত করে অর্থাৎ হা করে বসে রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন পাখিটি হা করে পানির অপেক্ষায় রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এটি চাতক পাখি বলে ভুল প্রচার হচ্ছে। বাস্তবে এটি চাতক পাখি নয় (ভুল ছবিটির সাথে সঠিক চাতকের ২ টি ছবি দেয়া হলো)। চাতক মূলত বিশাল আকৃতির কোনো পাখি নয়। যে ছবিটি দেয়া হয়েছে এটি হলো- গগণবেড় বা এক জাতীয় সারস পাখির ছবি।
…………………………………
সূত্র:
গুরুমা সুরুপা ফকিরানি,
গুগল, উইকিপিডিয়া
………………………..
আরো পড়ুন:
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: এক
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: দুই
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: তিন
…
লালন ফকিরের নববিধান: এক
লালন ফকিরের নববিধান: দুই
লালন ফকিরের নববিধান: তিন
…
লালন সাঁইজির খোঁজে: এক
লালন সাঁইজির খোঁজে: দুই
…
লালন সাধনায় গুরু : এক
লালন সাধনায় গুরু : দুই
লালন সাধনায় গুরু : তিন
…
লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: এক
লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: দুই
…
ফকির লালন সাঁই
ফকির লালনের ফকিরি
ফকির লালন সাঁইজি
চাতক বাঁচে কেমনে
কে বলে রে আমি আমি
বিশ্ববাঙালি লালন শাহ্ফকির লালন সাঁইজির শ্রীরূপ
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন
বিকৃত হচ্ছে লালনের বাণী?
লালন ফকিরের আজব কারখানা
মহাত্মা লালন সাঁইজির দোলপূর্ণিমা
লালন ফকির ও একটি আক্ষেপের আখ্যান
লালন আখড়ায় মেলা নয় হোক সাধুসঙ্গ
লালন অক্ষ কিংবা দ্রাঘিমা বিচ্ছিন্ন এক নক্ষত্র!
লালনের গান কেন শুনতে হবে? কেন শোনাতে হবে?
লালন গানের ‘বাজার বেড়েছে গুরুবাদ গুরুত্ব পায়নি’
‘গুরু দোহাই তোমার মনকে আমার লওগো সুপথে’
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির স্মরণে বিশ্ব লালন দিবস
2 Comments