লালন শাহ সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেও সংস্কারসাধনে চৈতন্য-অনুসারী আর সাধনমার্গের ক্ষেত্রনির্মাণে তিনি গ্রহণ করেছিলেন সুফিধর্মের রীতি-প্রকরণ। বৌদ্ধ সহজিয়াদের দেহকেন্দ্রিক সাধনা, সনাতন ধর্মের ঐকান্তিক বিশ্বাস, ত্যাগ ও ঔদার্যের মেলবন্ধনে ধর্ম-বর্ণের প্রাকার অতিক্রম করে সমন্বয়বাদের সংজ্ঞাকে ভিন্ন মাত্রা দান করেছে লালন-প্রভাবিত ‘বাউল’ নামক লোকধর্ম।
সাগ্নিক মহামানব চৈতন্যদেব সমকালীন বৈষ্ণবীয়-রীতির খোলনলচে পাল্টে উদার বৈষ্ণববাদের নান্দীপাঠ শুরু করেছিলেন। লালনও তেমনই লোকায়তিক সংস্কারসাধনে ব্রতী হয়ে এক সর্বাত্মক রেনেসাঁর পরিপ্লাবনে বাউলকে বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মভাবনার পাশ কাটিয়ে মানবতাবাদের প্রশান্ত পথে সমাজের প্রত্যন্ত শ্রেণির মানুষের নিশ্চিন্তে জিরিয়ে নেওয়ার ভিত্তিভূমি সূচিত হয়েছিল তাঁর হাতেই।
এক দিকে মেঘের আঁচল জুড়ে মন-কেমন-করা বৃষ্টির শব্দের মতো বাচনিক রহস্যময়তা, অন্য দিকে প্রতীক্ষার দীর্ঘায়িত শব্দাবলির ঘনীভূত হতে চাওয়া উদাসী সুরের নিটোল আলিঙ্গন। বাউল প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বিশ্বমানবের প্রশস্ত আধারে।
‘বাউল’ আচরিক ধর্মে বিশ্বাসী নয়। স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালবেসে অর্থাৎ প্রেমধর্মকে অঙ্গীবদ্ধ করে বাউল ‘ভবপার’ হতে চায়। চৈতন্যদেব-প্রভাবিত মানবতাবাদী বৈষ্ণবধর্মের প্রেম ও বর্ণপ্রথাবিরোধী মনোভাব বাউল গ্রহণ করেছে জীবনে ও দর্শনে। বৈষ্ণব ও বাউলের মূল্যবোধে ‘কুল’ বলতে বংশমর্যাদা, ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সাংসারিক ভোগবিলাসকে ধরা হয়।
‘কুল-গৌরব’-রূপ অহমিকা সাধন-ভজনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বৈষ্ণবরা বিশ্বাস করেন, গৌরচাঁদের যুগল-রূপ দর্শন করলে অহমিকার মুক্তি ঘটে এবং ‘ভববন্ধন দশা’ বিলীন হয়। লালন সেই তত্ত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন-
‘কাজ কি আমার এ ছার কুলে
আমার গৌরচাঁদ যদি মেলে।’
বৈষ্ণব-কাঙ্ক্ষিত যুগলরূপের রাধা জীবাত্মার প্রতীক আর কৃষ্ণ পরমাত্মার প্রতীক। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনেই জীবের সার্থকতা। সে মিলন শুধু প্রভুর ইচ্ছাতেই সম্ভব। সাধন -ভজন দ্বারা সেই মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে না। লালনও সেই চৈতন্য পাদপদ্মের জন্য আকুল হয়েছেন—
‘চরণ পাই যেন অন্তিম কালে
ফেলোনা নরাধম বলে।
সাধনে পাইব তোমার
সে ক্ষমতা নেই যে আমার
দয়াল নাম শুনিয়ে আশায়
চেয়ে আছি কাঙালে।’
লালনের চারণভূমি নদিয়ার বৈষ্ণববাদে বাউল-দর্শন এই ভাবেই প্রভাবিত হয়েছিল।
ইমাম গজ্জালির সুফিতত্ত্বের দার্শনিক বিশ্লেষণই প্রমাণ করে দিয়েছে, সুফি মতবাদের আকর নিহিত আছে কোরাণের মধ্যেই। আনুমানিক পঞ্চদশ শতকের তৃতীয় দশকের দিকে সুফি মতবাদের প্রসারণ ঘটতে শুরু করে। কারণ, আরবি ভাষার প্রামাণ্য অভিধান ‘সিহাহ-সিত্তা’ (নবম ও দশম শতাব্দীতে সঙ্কলিত), ‘কাসুম’ (১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে সঙ্কলিত) গ্রন্থ দু’টিতে ‘সুফি’ শব্দটির উল্লেখ নেই।
সুফিতত্ত্ব নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে বাউল-সাধনক্ষেত্রে। বাউলরা যে অজ্ঞাতমর্ম, দরদী সাঁই, অচিন পাখি বা মনের মানুষের সন্ধানে পাগল হয়, তা সুফিদের ‘ঘয়ব্’ বা অজ্ঞাতবস্তুর সন্ধান ছাড়া আর কিছুই নয়। বাঞ্ছিতের জন্য পিপাসা-পোষণে সুফি ও বাউলের মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। দুই সম্প্রদায়ই সংসার-বিবাগী। স্রষ্টা ও সৃষ্টি দুই ক্ষেত্রেই একাকার হয়ে গিয়েছে। লালন বলেছেন-
‘এই মানুষে আছেরে মন
যারে বলে মানুষ রতন
লালন বলে পেয়ে সে ধন,
পারলাম না চিনিতে।’
সুফিরা অজ্ঞাত বস্তুতে বিশ্বাস করে ‘পাগল’, আর বাউলরা অজ্ঞাত মর্মে বিশ্বাস করে ‘বাতুল’। সুফি এবং বৈষ্ণবধর্ম বিশ্ব-ব্যাপৃত বলেই সেই ভাবধারাপুষ্ট বাউল আন্তর্জাতিকতায় সংযুক্ত হয়েছে। কিন্তু হাতে-কলমে বাউলকে বিশ্বের দরবারে প্রথম পৌঁছে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
১৮৯১ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনার জন্য শিলাইদহ, সাজাদপুর, পাতিসর অঞ্চলে ছিলেন। এখানেই কবি লালনের শিষ্য পাঞ্জু শাহ, ভোলাই শাহ, মলম শাহ, শীতল শাহ, মনিরুদ্দিন ছাড়াও গগন হরকরা, কাঙাল হরিনাথ, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী প্রমুখ লোকগায়কদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং বাউল ও সহজিয়া সাধকদের জীবন, সংস্কৃতি ও লোকায়ত ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হন।
সর্বক্ষেপী বোষ্টমী কবিকে ডাকতেন ‘গৌরসুন্দর আমার’ বলে এবং তিনি প্রতিদিন ফুলের মালা গেঁথে কবিকে দিয়ে যেতেন। ফ্রান্সে প্রদত্ত ‘An Indian folk religion’ শীর্ষক বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ সর্বক্ষেপী বোষ্টমীকে উদ্ধৃত করেছিলেন।
১৯২৫-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন মহাসভায় সভাপতির অভিভাষণে ‘Philosophy of our people’ বিষয়ে এবং ১৯৩০-এ ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালের হিবার্ট বক্তৃতায় ‘Religion of man’ বিষয়ে বলতে গিয়ে বাউল ধর্ম, দর্শন ও গান সম্পর্কে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেন কবি।
রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন- ‘‘আমার অনেক গানে আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। …. বাউলের সুর ও বাণী কোনো এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।’’ গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে/আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুর রবীন্দ্রনাথ অবিকলভাবে ব্যবহার করেছেন তাঁরই লেখা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটিতে। এ-ও এক আন্তর্জাতিকতা।
নদিয়ার গোরভাঙার ফকির সম্প্রদায় এখনও প্রকৃত লালন-অনুসারী গায়কগোষ্ঠী হিসাবে বিদিত। প্রখ্যাত বাউল মনসুর ফকিরের ঠাকুরদা মাতব্বর খান আফগানিস্তান থেকে বাস গুটিয়ে অখণ্ড বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় এসে বসবাসকালে লালন ফকিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং ‘খান’ উপাধি পরিত্যাগ ‘ফকির’ উপাধি নেন।
তাঁর উত্তরসূরী মনসুর ফকির, গোলাম ফকির, আরমান ফকির, খৈবর ফকির, আমিরুল ফকির প্রমুখ সহ সিদ্দিক খান, আকবর খান, আসরাখ খান মিলে বর্তমানে গোরভাঙাতে অন্তত ৫টি আখড়া তৈরি করে বাউলের চর্চা যেমন করে চলেছেন, তেমনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাউলের প্রচার ও প্রসার করে চলেছেন সঙ্গীত উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে। বাবু ফকির নিজস্ব উদ্যোগে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বাউলের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বিনা পারিশ্রমিকে।
বর্তমানকালের অত্যাধুনিক পরিমণ্ডলে থেকেও তাঁরা কোনও বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেন না। একতারা, দোতারা, বাঁশি, হারমোনিয়াম, ঢোল, খোলই তাঁদের বাদ্যযন্ত্র। সুরের ক্ষেত্রেও তাঁরা সনাতনপন্থী তথা লালন-অনুসারী।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি গোরভাঙাতেই অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝা ও দীনেশচন্দ্র মণ্ডলের বিশেষ উদ্যোগে এবং স্থানীয় ফকির গোষ্ঠীর সহায়তায় পাঁচদিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক বাউল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত সর্ববৃহৎ এই বাউল সম্মেলনে ভারতের বাইরের দশটি দেশ থেকে অন্তত ১৫০ জন লোক-গবেষক, গায়ক ও লোকসঙ্গীতপ্রেমী যোগ দিয়েছিলেন।
অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার ছেউড়িয়ায় লালন শাহের মাজারকে কেন্দ্র করে ১৯৭৬-এ ‘লালন একাডেমি’ তৈরি হয়েছে। সঙ্গে আয়নামহল, লালন জাদুঘর, লালন আশ্রম গড়ে উঠেছে। দেশি-বিদেশি লালন-ভক্তদের ভজন-সাধন যেমন এখানে চলে, তেমনই একাডেমির প্রাজ্ঞ লালন-সঙ্গীত শিল্পী ও সাঁইজির বাণী-প্রচারক বিনা পারিশ্রমিকে সঙ্গীত শিক্ষা দিয়ে চলেছেন। সেখানে বিদেশিদের সংখ্যাও কম নয়। রানাঘাটের ‘বাউল আখড়া-নদিয়া’ও বাউলের চর্চায় ব্যতিক্রমী এক সংস্থা।
বৈষ্ণব-ভাবনা, সুফিতত্ত্ব ও প্রাতিষ্ঠানিক চর্চাকেন্দ্রগুলি বাউলকে বিশ্বস্তরে পৌঁছে দিতে যোগ্য সহবত দিয়েছে। কদমখালির রাজ্য লালন মেলা, কেঁদুলির জয়দেবের মেলা, শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, কল্যাণীর সতীমায়ের মেলার মতো অসংখ্য বাউল মেলায় প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা না হলেও দেশি-বিদেশির এক সুগভীর মেলবন্ধন গড়ে ওঠে।
ধর্ম-বর্ণের ছোঁয়াকে পিছনে ফেলে। লোকায়ত ভাবনার সমান্তরাল বৃত্তগুলি গভীর ভাবে সম্পৃক্ত হয় সহজাত অনুষঙ্গকে কেন্দ্রে রেখে। প্রতিষ্ঠিত হয় বার্তা-
‘নানান বরণ গাভী রে ভাই একই বরণ দুধ
জগৎ ভরমিয়া দেখি একই মায়ের পুত।’
…………………………………..
তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা।
পুণঃপ্রচারে বিনীত – প্রণয় সেন
…………………………………..
চিত্র:
ফকির লালন সাঁইজির প্রকৃত কোনো ছবি নেই। লেখাতে ব্যবহৃত ছবিটি লালন ফকিরের কাল্পনিক একটি ছবি মাত্র। বহুল ব্যবহৃত হলেও এই ছবির সাথে লালন সাঁইজির আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায় না।
………………………..
আরো পড়ুন:
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: এক
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: দুই
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: তিন
…
লালন ফকিরের নববিধান: এক
লালন ফকিরের নববিধান: দুই
লালন ফকিরের নববিধান: তিন
…
লালন সাঁইজির খোঁজে: এক
লালন সাঁইজির খোঁজে: দুই
…
লালন সাধনায় গুরু : এক
লালন সাধনায় গুরু : দুই
লালন সাধনায় গুরু : তিন
…
লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: এক
লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: দুই
…
ফকির লালন সাঁই
ফকির লালনের ফকিরি
ফকির লালন সাঁইজি
চাতক বাঁচে কেমনে
কে বলে রে আমি আমি
বিশ্ববাঙালি লালন শাহ্ফকির লালন সাঁইজির শ্রীরূপ
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন
বিকৃত হচ্ছে লালনের বাণী?
লালন ফকিরের আজব কারখানা
মহাত্মা লালন সাঁইজির দোলপূর্ণিমা
লালন ফকির ও একটি আক্ষেপের আখ্যান
লালন আখড়ায় মেলা নয় হোক সাধুসঙ্গ
লালন অক্ষ কিংবা দ্রাঘিমা বিচ্ছিন্ন এক নক্ষত্র!
লালনের গান কেন শুনতে হবে? কেন শোনাতে হবে?
লালন গানের ‘বাজার বেড়েছে গুরুবাদ গুরুত্ব পায়নি’
‘গুরু দোহাই তোমার মনকে আমার লওগো সুপথে’
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির স্মরণে বিশ্ব লালন দিবস