ভবঘুরেকথা
স্বামী বিবেকানন্দ

-শংকর

তবে যদি তোমার সুবিধা হয়, ৫০ টাকা টেলিগ্রাম করিয়া ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, চিফ জজ, কাশ্মীর স্টেট, শ্রীনগর এঁর নামে পাঠাইলে অনেক উপকার হইবে। কারণ সম্প্রতি ব্যারামে পড়িয়া বাজে খরচ কিছু হইয়াছে এবং সর্বদা বিদেশী শিষ্যদের নিকট টাকা ভিক্ষা করিতে লজ্জা করে।”

একই দিনে চিঠির মাধ্যমে খেতড়ির মহারাজা অজিত সিং-এর শরণাপন্ন হয়েছে স্বামীজি।”এখানে আমি দু’সপ্তাহ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।… আমার কিছু টাকার টান পড়েছে।..অসুখ করলে খরচের বহর অনেক বেড়ে যায়। এই জগতে শুধু একজনের কাছেই আমার কিছু চাইতে লজ্জা হয় না এবং তিনি হলেন আপনি।”

ডায়াবিটিস, বিনিদ্রা এবং হার্টের ট্রাবল নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে স্বামীজিকে বড় ডাক্তারের শরণ নিতে হলো। তার আর্থিক অবস্থা তখন কেমন তা আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি।

স্বামী ব্রহ্মানন্দ যে খ্যাতনামা ডাক্তার কে এল দত্তর চেম্বারে গেলেন ব্যবস্থার জন্য তা আমরা তার ডায়রি থেকে জানতে পারছি। ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসীকে সে যুগের বড় ডাক্তারকে কত দিতে হল তা সকলের জেনে রাখা ভাল। ওষুধের খরচ দশ টাকা, কিন্তু ফি বাবদ চল্লিশ টাকা! ১৮৯৮ সালের অক্টোবর মাসের চল্লিশ টাকা আজকের মূল্যায়নে কত টাকা তা আন্দাজ করতে অনুরোধ জানাই পাঠক-পাঠিকাদের।

স্বামীজির স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রিয় গুরুভাইরা হাতগুটিয়ে বসে থাকতে মোটেই রাজি নন। তারা বড় ডাক্তারের বড় কড়ি জমা দিয়ে, কবিরাজেরও ব্যবস্থা করেছিলেন।

কিন্তু ডাক্তারের বড় চিকিৎসাতে স্বাস্থ্যের উন্নতি না হওয়ায়, বায়ু পরিবর্তনের জন্য স্বামীজি ১৯ ডিসেম্বর ১৮৯৮ ব্রহ্মচারী হরেনকে নিয়ে দেওঘরে গেলেন। কলকাতায় ফিরে আসেন ২২ জানুয়ারি ১৮৯৯। দেওঘরে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ভবনে হাঁপানির প্রবল আক্রমণে স্বামীজির জীবন সংকটাপন্ন।

যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দের সংযোজন- “সময় সময় এত শ্বাসকষ্ট হইত যে মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিত, সর্বাঙ্গে আক্ষেপ হইত এবং উপস্থিত সকলে মনে করিতেন, বুঝিবা প্রাণবায়ু নির্গত হইয়া যাইবে। স্বামীজি বলিতেন, এইসময় একটি উঁচু তাকিয়ার উপর ভর দিয়া বসিয়া মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিতেন।”

বেলুড় থেকে আমেরিকান শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে (২৬ জানুয়ারি ১৮৯৯) স্বামীজি মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি হবার খবর দিচ্ছেন। “ডায়াবিটিস উধাও, কিন্তু পরিবর্তে যা এসেছে তাকে কোনো কোনো ডাক্তার অ্যাজমা, আবার কেউ কেউ ডিসপেপসিয়া বলেন। দুশ্চিন্তা ঘটাবার মতন অসুখ, দিনের পর দিন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার মতন অবস্থা। যদি মার্চের মধ্যে সুস্থ হই তাহলে ইউরোপে যাব।”

ফেব্রুয়ারির গোড়ায় মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে স্বামীজির চিঠি, “বৈদ্যনাথে বায়ু পরিবর্তনে কোন ফল হয়নি। সেখানে আটদিন আট রাত্রি শ্বাসকষ্টে প্রাণ যায় যায়। মৃতকল্প অবস্থায় আমাকে ফিরিয়ে আনা হয়। এখানে এসে বেঁচে উঠবার লড়াই শুরু করেছি।”

সেপ্টেম্বর মাসে রিজলি ম্যানর থেকে স্বামীজি তাঁর স্নেহের মেরী হেলকে লিখছেন, “তোমার চিকিৎসা (ক্রিশ্চান সায়ান্স) দিয়ে আমাকে ভাল করতে পারলে না। তোমার রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা সম্বন্ধে আমার আস্থা বেশ কিছুটা কমে যাচ্ছে।

ডাক্তার সরকার যে এইসময় তার চিকিৎসা করছেন তাও মিস ম্যাকলাউডকে জানিয়েছেন তিনি। “আগের মতো হতাশ ভাব আর নেই অদৃষ্টের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। এটা আমাদের পক্ষে বড় দুর্বৎসর।”

“দু’বৎসরের শারীরিক কষ্ট আমার বিশবছরের আয়ু হরণ করেছে,” স্বামীজি এক চিঠিতে লিখেছিলেন ১৮৯৯ এপ্রিল মাসে। “ভাল কথা, কিন্তু এতে আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না। হয় কি? সেই আপনভোলা আত্মা একই ভাবে বিভোর হয়ে তীব্র একাগ্রতা ও আকুলতা নিয়ে ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে আছে।”

এই সময়ে স্বামীজির কোষ্ঠী পরীক্ষা করিয়ে প্রবল বকুনি খেয়েছিলেন নিবেদিতা। কোষ্ঠীর ভাষ্য- স্বামীজির লগ্নে বৃহস্পতি, অতএব নয় বছর কোন ভয় নেই, তবে শরীর অসুস্থ থাকবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীকে স্বামীজি কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

২০ জুন ১৮৯৯। স্বামী তুরীয়ানন্দ ও মানসকন্যা নিবেদিতাকে নিয়ে বিবেকানন্দ বিদেশের উদ্দেশে গোলকুন্ডা জাহাজে উঠলেন কলকাতা বন্দর থেকে। যাঁরা তাঁকে জাহাজে তুলে দিতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন শচীন্দ্রনাথ বসু। তাঁর মতে, “সত্যি কথা বলতে কি তাকে মোটেই সুস্থ দেখাচ্ছিল না।”

জাহাজে ধূমপান, জলপান, ইত্যাদি কমিয়ে দিয়ে স্বামীজি বেশ ভাল ছিলেন। নিবেদিতাকে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার মতন মানুষেরা চরমের সমষ্টি, আমি প্রচুর খেতে পারি, একেবারে না খেয়ে থাকতে পারি; অবিরাম ধূমপান করি, আবার তাতে সম্পূর্ণ বিরত থাকি। ইন্দ্রিয় দমনে আমার ক্ষমতা অথচ ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যেও থাকি। নাহলে দমনের মূল্য কোথায়?”

৩১ জুলাই ১৮৯৯ লন্ডনের টিলবেরি ডকে স্বামীজিকে জাহাজ থেকে নামতে দেখে জনৈকা ভক্তিমতী লিখলেন, “তিনি খুব রোগা হয়ে গিয়েছিলেন, তাকে দেখে মনে হল যেন ঠিক একটি বালক।”

সমুদ্রগামী জাহাজে স্বামীজির শরীর ভাল ছিল। কিন্তু ডাঙায় নামার সঙ্গে সঙ্গে পেটে বায়ুর প্রকোপ।

স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি লিখলেন (১০ আগস্ট) “একজন বড় ডাক্তার বললে, নিরামিষ খাও, আর ডাল ছুঁয়ো না। ইনি এখানকার একজন মুরুব্বি ডাক্তার। এঁর মতে ইউরিক এসিড-গোলমালে যত ব্যারাম হয়। মাংস এবং ডাল ইউরিক এসিড বানায়; অতএব ত্যাজ্যং ব্রহ্মপদং’ ইত্যাদি।

যা হোক আমি তাকে সেলাম করে চলে এলাম।… এগজামিন করে বললে চিনি-ফিনি নেই-আলবুমেন আছে। যাক! নাড়ী খুব জোর, বুকটাও দুর্বল বটে। মন্দ কি, দিনকতক হবিষ্যাশী হওয়া ভাল।”

দু’চারদিনের মধ্যেই আমেরিকা-যাত্রার ইঙ্গিত রয়েছে স্বামীজির এই চিঠিতে। বিবেকানন্দ সেবার নিউ ইয়র্কে পৌঁছলেন ২৬ আগস্ট ১৮৯৯।

স্বামীজির স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য মার্কিনী ভক্তরা বড় ডাক্তারের সঙ্গে হাতুড়ে ডাক্তারদের খোঁজখবর করতেও অনুৎসাহিত নন।

সেপ্টেম্বর মাসে রিজলি ম্যানর থেকে স্বামীজি তাঁর স্নেহের মেরী হেলকে লিখছেন, “তোমার চিকিৎসা (ক্রিশ্চান সায়ান্স) দিয়ে আমাকে ভাল করতে পারলে না। তোমার রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা সম্বন্ধে আমার আস্থা বেশ কিছুটা কমে যাচ্ছে।

এ একবার হলে বৎসর কতক থাকে। তবেদু’চার বৎসর একদম রেস্টহলে সেরে যায়।..এদেশ এই রোগের ঘর। এইখান থেকেই উনি ঘাড়ে চড়েছে। তবে উনি মারাত্মক হওয়া দুরে থাকুক, দীর্ঘ জীবন দেন। আমার জন্য ভেবো না। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে যাব।”

…আমার চুল তাড়াতাড়ি পেকে যাচ্ছিল, এখন কোনক্রমে তা বন্ধ হয়েছে। দুঃখের বিষয় এখন সবেমাত্র কয়েকটি পাকা চুল আছে; অবশ্য ভাল করে সন্ধান করলে আরও অনেক বেরিয়ে পড়বে। শুভ্র কেশ আমার বেশ পছন্দ।”

একই চিঠিতে স্বামীজি সরসভাবে মিস মেরী হেলকে লিখছেন, “তুমি কি অস্থিবিজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু জানো? নিউ ইয়র্কে একজন এসে বাস্তবিক অবাক কাণ্ড করছে। এক সপ্তাহ পরে তাকে দিয়ে আমার হাড়গোড় দেখানো হবে।”

২২ ডিসেম্বর তার ধীরামাতা মিসেস সারা বুলকে চৌম্বক-চিকিৎসার খবর দিচ্ছেন স্বামীজি। “সম্প্রতি আমার আবার শরীর খারাপ হয়েছিল। তাই চিকিৎসক রগড়ে রগড়ে আমার ইঞ্চি কয়েক চামড়া তুলে ফেলেছে। এখন আমি তার যন্ত্রণা বোধ করছি।”

পরের দিন সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজির রিপোর্ট, “সত্যি আমি চৌম্বক চিকিৎসা-প্রণালীতে ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছি।…আমার শরীরের কোন যন্ত্র কোনকালেই বিগড়ায়নি-স্নায়বিক দৌর্বল্য ও অজীর্ণতাই আমার দেহে যা-কিছু গোল বাধিয়েছিল।”

ম্যাগনেটিক হাতঘসার মহিলা চিকিৎসকটি জুটিয়েছিলেন মিস। জোসেফিন ম্যাকলাউড।”হাতঘসা চিকিৎসার ফলেই হোক, ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ওজোন’ বাষ্পের ফলেই হোক, অথবা বর্তমান কর্মের দশা কেটে যাবার ফলেই হোক, আমি সেরে উঠছি। পেটভরা খাবার পরে তিনমাইল হাঁটতে পারা একটা বিরাট ব্যাপার নিশ্চয়।” এই রিপোর্ট স্বামীজি স্বয়ং দিচ্ছেন তাঁর ধীরামাতা মিসেস বুলকে লস্ এঞ্জেলেস থেকে ২৭ ডিসেম্বর ১৮৯৯।

ভগ্ন স্বাস্থ্যের কথা স্বামীজি আর কত বলবেন। ১৯০০ সালের মার্চ মাসে স্যানফ্রানসিসকো থেকে মিসেস বুলের কাছে তার দাবি-”সম্ভবতঃ স্বাস্থ্যের উন্নতিই হচ্ছে- যদিও অজ্ঞাতসারে। আমি ৩০০০ শ্রোতাকে শোনাবার মতন উঁচু গলায় বক্তৃতা দিতে পারি; ওকল্যান্ডে আমায় দু’বার তাই করতে হয়েছিল। আর দু’ঘণ্টা বক্তৃতার পরেও আমার সুনিদ্রা হয়।”

ঠিক তিনদিন পরেই (৭ মার্চ) কিন্তু দুঃসংবাদ।”দিনকয়েক যাবৎ আমার শরীর খারাপ হয়েছে এবং বড় বিশ্রী বোধ হচ্ছে। আমার বোধ হয়, রোজ রাত্রে বক্তৃতা দেবার ফলেই এরকম হয়েছে। আমার আশা আছে যে, ওকল্যান্ডের কাজের ফলে অন্তত নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত ফিরে যাবার টাকা সংগ্রহ করতে পারব।” নিউ ইয়র্কে পৌঁছে ভারতে ফেরবার টাকা যোগাড়ের স্বপ্ন দেখছেন আমাদের স্বামীজি।

রোগ-জর্জরিত স্বামীজি স্যানফ্রান্সিস্কো থেকে নিজেকে খুলে ধরেছেন স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে ১২ মার্চের এক চিঠিতে: “শরৎকে বলল যে, আমি বেশি খাটছিনা আর। তবে পেটের খাওয়ার মতো না খাটলে শুকিয়ে মরতে হবে যে।…আমি সত্য সত্য বিরাম চাই, এ রোগের নাম নিউরোসথেনিয়া- এ স্নায়ুরোগ।

এ একবার হলে বৎসর কতক থাকে। তবেদু’চার বৎসর একদম রেস্টহলে সেরে যায়।..এদেশ এই রোগের ঘর। এইখান থেকেই উনি ঘাড়ে চড়েছে। তবে উনি মারাত্মক হওয়া দুরে থাকুক, দীর্ঘ জীবন দেন। আমার জন্য ভেবো না। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে যাব।”

আগস্টের মাঝামাঝি বিবেকানন্দকে আমরা মানুষের মহাতীর্থ প্যারিসে কর্মব্যস্ত দেখছি। স্বামী তুরীয়ানন্দকে তিনি লিখছেন (সেপ্টেম্বর ১৯০০), আগামীকাল যার ফ্ল্যাটে থাকবেন তার বাড়ি দেখে এসেছেন, ছ’তলার ফ্ল্যাট, কিন্তু লিফট নেই। “চড়াই-ওতরাই। ওতে কিন্তু আমার আর কষ্ট হয় না।”

১৮৯৯ নভেম্বর দ্বিতীয় সপ্তাহে স্বামীজি একজন বিখ্যাত ডাক্তার ভক্তর (ডাক্তার এগবার্ট গার্নসি) নিউ ইয়র্কের বাড়িতে চলে আসেন রিজলি ম্যানর থেকে। ডাক্তার গানসির পরামর্শ, অস্টিওপ্যাথ ডাক্তার হেলমারের চিকিৎসায় থাকুন স্বামীজি। ওঁর কথা শোনেন স্বামীজি। কিন্তু ডাক্তারের আতিথেয়তায় থাকতে থাকতেই তাঁর প্রবল সর্দিজ্বর হয়। সে বিবরণ মার্কিনি ভক্তরা সংগ্রহ করেছেন।

হাতুড়ে মিসেস মিল্টনের চৌম্বক চিকিৎসা! ইনি লিখতে পড়তে পারতেন না। কথা বলতেন নিগ্রো ডায়ালেক্টে। তার হাতে রোগীর কি হলো? “আমার বেলায় বুকে অনেকগুলি বড় বড় লাল লাল দাগ ফুটে উঠেছে।” আরোগ্যের ব্যাপারে কতদুর কী হয়, তা পরে বিস্তারিত জানাবার প্রতিশ্রুতি স্বামীজি দিচ্ছেন জননীসমা মিসেস বুলকে।

শরীরের অন্য সব সমস্যার সমাধান না হোক, স্বামীজি এই সময় বিনিদ্রার হাত থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়েছিলেন মনে হয়। নিবেদিতাকে তিনি লিখছেন, “আমি এখন সকাল-সন্ধ্যা খুব খাঁটি, যখন যা পাই খাই, রাত্রি বারটায় শুতে যাই, আর কি গভীর নিদ্রা! আগে কখনও আমার এমন ঘুমোবার শক্তি ছিল না।”

শেষ পর্যন্ত চৌম্বক চিকিৎসা যে কিছু করতে পারলো না তা কয়েকদিনের মধ্যেই স্বামীজিকে স্বীকার করতে হলো মিস ম্যাকলাউডকে লেখা চিঠিতে। “যাই হোক আমার চলে যাবে।”

এপ্রিল মাসে আলমেডা থেকে লেখা মিসম্যাকলাউডকে লেখা স্বামীজির আর এক চিঠিতে বিষণ্ণ বিদায়ের সুর, শরীরের চেয়ে মনের শান্তি স্বচ্ছতাই খুব বেশি বোধ করছি, লড়াইয়ে হার-জিত দুই-ই হ’ল- এখন পুটলি-পাঁটলা বেঁধে সেই মহান মুক্তিদাতার অপেক্ষায় যাত্রা করে বসে আছি।”

এপ্রিলের শেষেও স্বামীজির অসুস্থতা ও জ্বর। সেই সঙ্গে স্নায়ুরোগ। ২রা মে ১৯০০ নিবেদিতাকে তিনি লিখছেন, “আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম-মাসখানেক ধরে কঠোর পরিশ্রমের ফলে আবার রোগের আক্রমণ হয়েছিল। যাই হোক, এতে আমি এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে আমার হার্ট বা কিডনিতে কোন রোগ নাই, শুধু অতিরিক্ত পরিশ্রমে স্নায়ুগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।”

স্নেহময় ডাক্তার লোগানের উল্লেখ রয়েছে এই সময়ের চিঠিতে। তার ঠিকানা ৭৭০ ওক স্ট্রিট। ডাক্তার লাগানের নির্দেশ, সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোনো যাত্রার ধকল নয়। এই ডাক্তার আমাকে সবল করে ছাড়বে! আমার পেট ভাল, নার্ভ ফাইন।”

এই সময় আমরা আর এক ডাক্তারের খোঁজ পাচ্ছি। ডাক্তার উইলিয়াম ফস্টার, ঠিকানা ১৫১০ মার্কেট স্ট্রিট, তাঁর কাছেও চিকিৎসা হয়েছিল। অসুস্থ স্বামীজির কিন্তু রসবোধের কোন অভাব নেই। ২৩ জুন মেরি হেলকে নিউইয়র্ক থেকে লিখছেন, “তোমার চিঠিটা হজম করতে পারিনি, কারণ গত কয়েকদিন অজীর্ণতা কিছু বেশীরকম ছিল।”

আগস্টের মাঝামাঝি বিবেকানন্দকে আমরা মানুষের মহাতীর্থ প্যারিসে কর্মব্যস্ত দেখছি। স্বামী তুরীয়ানন্দকে তিনি লিখছেন (সেপ্টেম্বর ১৯০০), আগামীকাল যার ফ্ল্যাটে থাকবেন তার বাড়ি দেখে এসেছেন, ছ’তলার ফ্ল্যাট, কিন্তু লিফট নেই। “চড়াই-ওতরাই। ওতে কিন্তু আমার আর কষ্ট হয় না।”

কনস্টানটিনোপল, অর্থাৎ ইস্তাম্বুলে, ক’দিন থাকা হয়েছিল? কারুর মতে দু’তিন দিন, আর মিস ম্যাকলাউডের স্মৃতি অনুযায়ী নদিন। গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক ন’দিনকেই নির্ভরযোগ্য মনে করেন। এই সময়েই ঘুরতে ঘুরতে এঁরা এক সুফি ফকিরের তাকিয়া দেখেন। এখানকার দরবেশরা রোগ সারায়।

তুরীয়ানন্দকে লেখা আরও এক চিঠি- “শরীর একরকম গড়মড় করে চলছে। খাটলেই খারাপ, না খাটলেই ভাল, আর কি? মা জানেন।”

প্যারিসে একদিন মধ্যাহ্নভোজের সময় কিংবদন্তি গায়িকা মাদাম এমা কালভে তার বান্ধবী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে বললেন, তিনি মিশরে যাচ্ছেন। মিস ম্যাকলাউড যখন বললেন তিনিও সহযোগী হবেন, অমনি মাদাম কালভে স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আমার অতিথি হিসেবে মিশরে যাবেন কি?”

স্বামীজি সম্মত হলেন। মিশরে কী হয়েছিল তা যথাসময়ে জানা যাবে। মাদাম কালভে স্বামীজিকে বাবা বলতেন।

পূর্ব থেকে পশ্চিম নয়, প্রজ্বলিত সূর্য এবার পশ্চিমে থেকে ফিরে আসছেন পূর্বগগনে।

প্যারিস থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৪ অক্টোবর ১৯০০। ঐদিন মাদাম কালভের বিশিষ্ট অতিথি স্বামী বিবেকানন্দ প্যারিসের রেল স্টেশন থেকে ভুবনবিদিত ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের যাত্রী হলেন। এবারের ভ্রমণপর্ব শেষ হয়েছিল ২৬ নভেম্বর ১৯০০, যেদিন মিশরের পোর্ট তাফিক থেকে বিবেকানন্দ বোম্বাইমুখী ইতালীয় জাহাজ এস এস রুবাত্তিনোতে উঠে বসলেন স্বদেশ ফিরে যাবার ব্যাকুলতা নিয়ে।

এই ভ্রমণের সময় স্বামীজির শারীরিক অসুস্থতার তেমন বহিঃপ্রকাশ ছিল না। বরং তিনি সীমাহীন প্রাণশক্তিতে পূর্ণ। শুধু নব নব দেশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখছেন এবং অবসর সময়ে উদ্বোধন পত্রিকার জন্য পরিব্রাজক’ এর কিস্তি রচনা করছেন তা নয়, স্বামীজি সারাক্ষণ যেখানে যাচ্ছেন সেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং মাতিয়ে রাখছেন যাত্রাসঙ্গিনী ও সঙ্গীদের।

সেসব দিনের হৃদয়গ্রহী বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে মাদা কালভে ও মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউডের স্মৃতিকথায়। পরিব্রাজক-এর পাঠক-পাঠিকারাও তার কিছুটা স্বাদ পেয়েছেন।

একনজরে স্বামীজির ভ্রমণসূচিটি এরকম- ২৪ অক্টোবর ১৯০০ সারারাত ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস দক্ষিণ ফ্রান্স দিয়ে চললো, পরের দিনের বেশির ভাগ সময় দক্ষিণ জার্মানি। ২৫ তারিখে ভিয়েনা পৌঁছে পরের দিন ভিয়েনাদর্শন হলো। এই শহর সম্বন্ধে লেখক বিবেকানন্দর মতামত-

“ভিয়েনায় তিনদিন- দিক করে দিলে! প্যারিসের পর ইউরোপ দেখা চর্ব চূষ্য খেয়ে তেঁতুলের চাটনি চাখা; সেই কাপড়চোপড়, খাওয়া-দাওয়া, সেইসব এক ঢঙ,দুনিয়াসুদ্ধ, সেই এক কিম্ভুত কালো জামা, সেই এক বিকট টুপি।”

৩০ অক্টোবর ১৯০০- স্বামীজির দল কনস্টান্টিনোপল পৌঁছলেন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে। এই ট্রেন বলকান দেশগুলির মধ্য দিয়ে চলে এসেছে। লঙ্কাপ্রেমী স্বামীজির আনন্দের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এখানকার লঙ্কায় এমন ঝাল যে মাদ্রাজীদেরও কঁদিয়ে দেবে!

কনস্টানটিনোপল, অর্থাৎ ইস্তাম্বুলে, ক’দিন থাকা হয়েছিল? কারুর মতে দু’তিন দিন, আর মিস ম্যাকলাউডের স্মৃতি অনুযায়ী নদিন। গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক ন’দিনকেই নির্ভরযোগ্য মনে করেন। এই সময়েই ঘুরতে ঘুরতে এঁরা এক সুফি ফকিরের তাকিয়া দেখেন। এখানকার দরবেশরা রোগ সারায়।

মিস ম্যাকলাউড ও এমা কালভে তাদের স্মৃতিকথায় কিছু নতুন খবর দিয়েছেন। কিন্তু এঁদের দুজনের সঙ্গেই কথা বলে মাদাম ভার্দিয়ার যে বিস্তারিত নোট অগ্রন্থিত অবস্থায় রেখে গিয়েছেন তার থেকেই বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

প্রথমে ঝুঁকে পড়ে কলমা পড়ে, তারপর নৃত্য করে; তখন ভাব হয় এবং ভাবাবেশে রোগীর শরীর মাড়িয়ে দিয়ে রোগ আরাম করে। রাস্তায় বেরিয়ে স্বামীজির ছেলেমানুষের স্বভাব সর্বদা ছিল। স্বামী গম্ভীরানন্দের বর্ণনায়- সুতরাং বালকসুলভ ভোলাভাজা দেখিয়া উহা কিনিয়া খাইলেন, সঙ্গীদের সহিত তুর্ক-দেশীয় অন্যান্য সুখাদ্যও আস্বাদন করিলেন।

১০ নভেম্বর কনস্টান্টিনোপল থেকে গ্রীসের উদ্দেশে যাত্রা। সেবার গ্রীসে তিন দিন থেকে ১৩ অথবা ১৪ নভেম্বর মিশরের উদ্দেশে যাত্রা। জাহাজের নাম ‘জার’। সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে দিগ্বিজয়ী বীরের মতন স্বামীজি কিভাবে গ্রীস জয় করে মিশরে উপস্থিত হয়েছিলেন তার বিবরণ বিভিন্ন স্মৃতিকথায় রয়েছে।

মনে রাখা ভাল, ইউরোপের যশস্বিনী মিউজিক বার্ড মাদাম কালভে এক দুঃসময়ে প্রাণঘাতিনী হবার চেষ্টা করেছিলেন, মার্কিন মুলুকে বিবেকানন্দ-সান্নিধ্যে এসে তিনি নবজীবন লাভ করেন।

এবার লক্ষ্যস্থল কায়রো। মিশরীয় সভ্যতার ওপর নতুন আলোকপাত করে সহযাত্রীদের রোমাঞ্চিত করছেন বিবেকানন্দ। এমনই রোমাঞ্চিত তারা, যে কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে তারা ট্রেনও ফেল করছেন! এই কায়রোতেই সবান্ধব বিবেকানন্দ পথ হারিয়ে পতিতাপল্লীতে ঢুকে পড়েছিলেন।

সেখানে অসহায় অর্ধনগ্না রমণীদের দর্শনে যে প্রাণস্পর্শী নাটকের সৃষ্টি হয়েছিল তার বিবরণ বিবেকানন্দ অনুরাগীদের অজানা নয়। নাটকের চরমপর্বে চোখের জল ফেলতে ফেলতে এক ক্রন্দনরতা হতভাগিনী স্পেনীয় ভাষায় বলে উঠেছিল Hombre de Diosঈশ্বরের প্রেরিত মানুষ!

কায়রোপর্ব সম্বন্ধে অনেক কথাই অনেকদিন এদেশে অজানা ছিল। বিবেকানন্দর দেহাবসানের বহু বছর পরে মাদাম এমা কালভে মুখ খুলেছিলেন। পরলোকগত প্রকাশক রঞ্জিত সাহার সঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের নিবিড় যোগাযোগ ছিল দীর্ঘদিন। তিনি নিবেদিতার ইংরিজি পত্রাবলী ও ভূপেন্দ্রনাথ রচিত বিবেকানন্দ জীবনীর প্রকাশকও বটে।

ওঁর কাছে শুনেছি, বিবেকানন্দর পারিবারিক সূত্রের ধারণা, কায়রোতে স্বামীজিকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। কিন্তু তার কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। আমরা স্বামীজির জীবনীর মাধ্যমে প্রথম দিকে জেনেছি, প্রিয় ভক্ত মৃত্যুপথযাত্রী ক্যাপটেন সেভিয়ারের জন্য ব্যাকুল হয়ে তিনি আচমকা মাঝপথে সব প্রোগ্রাম বাতিল করে দেশে ফিরতে চাইলেন।

কায়রোপর্ব সম্বন্ধে প্রধান প্রধান বিবেকানন্দ-বিশারদরা আজও কিছুটা আলো-আঁধারিতে থেকে গিয়েছেন মনে হয়। বিবেকানন্দ জীবনীকারের মতে, স্বামীজি কায়রোর যাদুঘর, স্ফিংকস (অর্ধনারী-সিংহ মূর্তি) ও পিরামিড দেখলেন। “বিগতগৌরব প্রাণহীন এইসব বিশাল স্মৃতিচিহ্নগুলি তাহার মনে এক অবসাদ আনিয়া দিল এবং তিনি তথা হইতে দূরে- স্বদেশে চলিয়া যাইবার জন্য ব্যগ্র হইয়া পড়িলেন।”

মিস ম্যাকলাউড ও এমা কালভে তাদের স্মৃতিকথায় কিছু নতুন খবর দিয়েছেন। কিন্তু এঁদের দুজনের সঙ্গেই কথা বলে মাদাম ভার্দিয়ার যে বিস্তারিত নোট অগ্রন্থিত অবস্থায় রেখে গিয়েছেন তার থেকেই বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

মাদাম কালভে অন্যত্র গান গাইতে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে মিস ম্যাকলাউডের কাছে শুনলেন, স্বামীজি খুব বিষণ্ণ অবস্থায় রয়েছেন। মাদাম কালভে জানতে চাইলেন, কেন স্বামীজি মাঝপথে যাত্রাভঙ্গ করতে চাইছেন?

বিমর্ষ বিবেকানন্দ বললেন, তিনি তার গুরুভাইদের কাছে ফিরে যেতে চান। তাকে আশ্বস্ত করা হল, টাকা পয়সার জন্যে চিন্তা নেই, প্রয়োজন হলে ফিরে যাবার টিকিট অবশ্যই কিনে দেবেন মাদাম কালভে। কিন্তু কেন আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন?” জিজ্ঞেস করলেন মাদাম কালভে।

বিবেকানন্দর চোখ এবার জলে ভরে উঠলো। মাদাম কালভের ভাষায়, এরপর তিনি বললেন, “আমি দেশে ফিরতে চাই, মরবার জন্য, আমার গুরুভাইদের কাছে যেতে চাই আমি।”

কালভে বললেন, “আপনাকে আমরা মরতে দিতে পারি না, আমাদের প্রয়োজন আপনাকে।”

তারপরেই বিস্ফোরণ! কালভেকে স্বামীজি জানালেন, ৪ঠা জুলাই আমার মৃত্যু হবে।

২৬ নভেম্বর ১৯০০ স্বামীজি মিশর থেকে বোম্বাই বন্দরের উদ্দেশে রুবাত্তিনো জাহাজে চড়লেন একাকী।

তিনদিন পরে মিস ম্যাকলাউডের চিঠি তাঁর বান্ধবী সারাকে: “স্বামীজির খবর ভাল নয়। তার আর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল- এখন ভারতে ফিরে যাচ্ছেন।”

আমাদের প্রশ্ন- “আর একটা কথার মানে কি দ্বিতীয় আক্রমণ? সেক্ষেত্রে বেলুড়ে ৪ জুলাই ১৯০২ সন্ধ্যায় তৃতীয় হার্ট অ্যাটাকেই কি তাঁর মতলীলার অবসান?

বিদেশিনী গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাককে তেমন গুরুত্ব দিতে পারছেন না। কারণ মিশর ভ্রমণপর্বে তাকে কখনও প্রচণ্ড অসুস্থ দেখায়নি।
…………………….
অচেনা অজানা বিবেকানন্দ- শংকর।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………….
আরও পড়ুন-
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি এক
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি দুই
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি তিন
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি চার

…………………..
আরও পড়ুন-
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : এক
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : দুই
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : তিন
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : চার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!