ভবঘুরেকথা

-স্বামী জয়ানন্দ মহারাজ

একটি আসন্ন প্রসবা সিংহী একবার শিকার-অন্বেষণে বাহির হইয়াছিল। সে দূরে একদল মেষ চরিতেছে দেখিয়া যেমন তাহাদিগকে আক্রমণ করিবার জন্য লাফ দিল, অমনি তাহার মৃত্যু হইল, একটি মাতৃহীন সিংহশাবক জন্মগ্রহণ করিল।

মেষদল তাহার রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল, সে-ও মেষগণের সহিত একত্র বড় হইতে লাগিল, মেষগণের ন্যায় ঘাস খাইয়া প্রাণ ধারণ করিতে লাগিল, মেষের ন্যায় চিৎকার করিতে লাগিল; যদিও সে রীতিমত একটি সিংহ হইয়া দাঁড়াইল, তথাপি সে নিজেকে মেষ বলিয়া ভাবিতে লাগিল।

এইরূপে দিন যায়, এমন সময় আর একটি প্রকাণ্ডকায় সিংহ শিকার-অন্বেষণে সেখানে উপস্থিত হইল, কিন্তু সে দেখিয়াই আশ্চর্য হইল যে, ঐ মেষদলের মধ্যে একটি সিংহ রহিয়াছে, আর সে মেষধর্মী হইয়া বিপদের সম্ভাবনা-মাত্রেই পলাইয়া যাইতেছে। সিংহ উহার নিকট গিয়া বুঝাইয়া দিবার চেষ্টা করিল যে, সে সিংহ! মেষ নহে; কিন্তু যেমনি সে অগ্রসর হয়, অমনি মেষপাল পলাইয়া যায়-তাহাদের সঙ্গে মেষ-সিংহটিও পলায়।

যাহা হউক, ঐ সিংহ মেষ-সিংহটিকে তাহার যথার্থ স্বরূপ বুঝাইয়া দিবার সঙ্কল্প ত্যাগ করিল না। সে ঐ মেষ-সিংহটি কোথায় থাকে, কি করে, লক্ষ্য করিতে লাগিল। একদিন দেখিল, সে এক জায়গায় পড়িয়া ঘুমাইতেছে; দেখিয়াই সে তাহার উপর লাফাইয়া পড়িয়া বলিল, ‘ওহে! তুমি মেষপালের সঙ্গে থাকিয়া আপন স্বভাব ভুলিলে কেন? তুমি তো মেষ নও, তুমি যে সিংহ।’

মেষ-সিংহটি বলিয়া উঠিল, ‘কি বলিতেছ, আমি যে মেষ, সিংহ হইব কিরূপে?’ সে কোনমতে বিশ্বাস করিবে না যে, সে সিংহ, বরং সে মেষের মত চিৎকার করিতে লাগিল। সিংহ তাহাকে টানিয়া একটা হ্রদের দিকে লইয়া গেল, বলিল, ‘এই দেখ তোমার প্রতিবিম্ব, এই দেখ আমার প্রতিবিম্ব।’

তখন সে সেই দুইটির তুলনা করিতে লাগিল। সে একবার সেই সিংহের দিকে, একবার নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিল। মুহূর্তের মধ্যে তাহার এই জ্ঞানোদয় হইল যে, সত্যই তো আমি সিংহ। তখন সে সিংহ-গর্জন করিতে লাগিল,তাহার মেষবৎ চিৎকার কোথায় চলিয়া গেল!

আমরা সিংহ-স্বরূপ-আমাদের আত্মা, শুদ্ধস্বরূপ অনন্ত ও পূর্ণ। জগতের মহাশক্তি আমাদের ভিতর। অতএব কান্নাকাটি করার, দুঃখ করার কোনো কারণ নেই। কারণ আত্মার জন্ম-মৃত্যু নাই। আত্মা অমর। আত্মার রোগ-দুঃখ কিছুই নাই; আত্মা অনন্ত-আকাশস্বরূপ, নানাবর্ণের মেঘ উহার উপর আসিতেছে, এক মুহূর্ত খেলা করিয়া আবার কোথায় অন্তর্হিত হইতেছে; কিন্তু আকাশ যে নীলবর্ণ, সেই নীলবর্ণই রহিয়াছে। এইরূপ জ্ঞানের অভ্যাস আমাদের করিতে হইবে এই কথা স্বামীজী বলেছেন।

মূল ভাবনাটি মাথায় রাখিতে হইবে- সিংহ হইয়া মেষেদের দলে থাকিলে চলিবে না। সিংহ মেষেদের দলে থাকিলে সে আপন সত্তা ভুলিয়া যাইয়া মেষবৎ চিৎকার করিতে থাকিবে। মেষেরা মেষের দলে থাকুক আর সিংহরা সিংহের দলে।

মেষ যদি সিংহ সাজিয়া সিংহদের দলে থাকে, তাহা হইলে সিংহদেরও বিপদ। কারণ মেষ তাহার আপন সত্তার গুণধর্ম অনুযায়ী সে কখনো সিংহের দলে থাকিতে পারিবে না। একদিন না একদিন তাহার আপন স্বরূপ প্রকাশ হইয়া পড়িবেই। আর যখনই তাহার আপন স্বরূপ প্রকাশ হইয়া পড়িবে তখনই সে মেষেদের দলে গিয়াই ভিড়িবে এবং সে সিংহদেরকেও বিপদে ফেলিবার চেষ্টা করিবে।

বয়স ও একস্থানে বেশীদিন থাকিবার কারণে লোকে তাহার কথা বিশ্বাস করিতে লাগিল। চোররূপী ছদ্মবেশী সাধুটি এই ভাবে গোপনে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করিতে লাগিল। কেহ কেহ আবার তাহাকে ডাকাত দলের সর্দারের কাছে যাইয়া সাহায্য প্রার্থনা করিতে পরামর্শ দিল। সে আর কাল বিলম্ব না করিয়া গোপনে ডাকাত রাণীর কাছে যাইয়া কান্নার অভিনয় করিয়া মিথ্যা মিথ্যা করিয়া লোকের কাছে যাহা বলিত তাহারই পুনরাবৃত্তি করিল।

এখন যে গল্পটি বলিব সেটি একটি মেষের সিংহ সাজিয়া সিংহের দলে থাকিবার গল্প! কিছু কাল আগের কথা একটা স্বভাবজাত চোর সাধু সাজিয়া সাধুদের দলে থাকিত। তাহার পরণের পোশাক দেখিয়া লোকে তাহাকে সাধু বলিয়া মনে করিত।

সাধুরাও তাহাকে সাধু বলিয়া ভাবিত। কিন্তু যত দিন অতিবাহিত হইতে লাগিল সাধু রূপী চোরটির আপন স্বভাব প্রকাশিত হইতে লাগিল এবং সাধুরা চোরটিকে ধরিয়া ফেলিল।

সাধুরা বুঝিল তাহাদিগের দলে একটি চোর দীর্ঘকাল সাধু সাজিয়া রহিয়া চুরি করিয়া আসিতেছে। তখন দলের বাকি সাধুরা সকলে মিলিয়া চেষ্টা করিল চোররূপী ছদ্মবেশী সাধুটিকে সৎপথে আনিবার। কিন্তু চোর রূপী ছদ্মবেশী সাধুটি তাহার আপন স্বভাব ছাড়িতে নারাজ। সাধুরা তাহার স্বভাব পরিবর্তনের যতই চেষ্টা করিতে থাকে সে ততবেশী ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিতে থাকে।

বাহিরের লোকেরা তাহাকে সাধু বলিয়াই ভাবিত কিন্তু তাহার চুরির স্বভাবের কথা বাহিরের লোকেরা সকলে জানিত না। সেই সুযোগটাকে সে কাজে লাগাইয়া বাহিরের লোকেদের কাছে কান্নাকাটির অভিনয় করিয়া মিথ্যা মিথ্যা কথা বলিয়া সহানুভূতি কুড়াইবার চেষ্টা করিতে লাগিল এবং বাকি সাধুদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি করিয়া বেড়াইতে লাগিল।

বাহিরের লোকেদের কাছে সে বলিতে লাগিল, তাহাকে তাহার দলের বাকি সাধুরা সকলে মিলিয়া তাহার উপর অত্যাচার ও মানসিক নির্যাতন চালাইতেছে! তাহাকে তাহার ঐরূপ অবস্থা হইতে উদ্ধার করিবার তাহাদিগের নিকট আবেদন নিবেদন করিতে লাগিল।

এবং সে মনে মনে ভাবিল যদি না সে তাহার দলের বাকি সকল সাধুকে মিথ্যা বদনাম দিয়া তাড়াইয়া দিতে না পারে তাহা হইলে তাহার প্রকৃত স্বরূপ- ‘চোররূপী ছদ্মবেশী সাধু’ এই সত্যটি সকলের কাছে একদিন উন্মোচিত হইয়া পড়িবে! এই কথা ভাবিয়া সে আরও বেশী অস্থির হইয়া উঠিল।

বয়স ও একস্থানে বেশীদিন থাকিবার কারণে লোকে তাহার কথা বিশ্বাস করিতে লাগিল। চোররূপী ছদ্মবেশী সাধুটি এই ভাবে গোপনে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করিতে লাগিল। কেহ কেহ আবার তাহাকে ডাকাত দলের সর্দারের কাছে যাইয়া সাহায্য প্রার্থনা করিতে পরামর্শ দিল। সে আর কাল বিলম্ব না করিয়া গোপনে ডাকাত রাণীর কাছে যাইয়া কান্নার অভিনয় করিয়া মিথ্যা মিথ্যা করিয়া লোকের কাছে যাহা বলিত তাহারই পুনরাবৃত্তি করিল।

তাই সিংহ হইয়া মেষেদের মধ্যে না থাকিয়া, মেষেদের মতো চিৎকার না করিয়া আপনার প্রকৃত স্বরূপকে জানিতে হইবে, আর ছদ্মবেশীদের নিকট হইতে দূরে থাকিতে হইবে সেই সঙ্গে সর্বদা ভগবানের নাম করিতে হইবে। জয় রামকৃষ্ণ।।

সেসব শুনিয়া ডাকাত রাণীর মন তাহার প্রতি করুণায় আদ্র হইয়া উঠিল। ডাকাত রাণী তাহাকে ডাকাত সর্দারের কাছে লইয়া গিয়া সাক্ষাৎ করাইল। ডাকত সর্দারেরও অনেক দিনের লোভ ছিল সাধুদের আস্তানাটা দখল করিবার। সে মনে মনে ভাবিল; এই সেই সুযোগ! এবং সুযোগটিকে সে কাজে লাগাইতে আর কাল বিলম্ব করিল না।

একদিন আচমকা ডাকাত সর্দার, ডাকাত রাণীর সহিত তাহার লেঠেল বাহিনী পাঠাইয়া সাধুদিগের উপর আক্রমণ করিল। সাধুরা মারধর খাইয়া আস্তানা ছাড়িয়া পলায়ন করিল। তথায় সবকিছু ডাকাত সর্দারের হুকুমে চলে। সকলকেই ডাকাত সর্দারের কথা মানিনা চলিতে হয়।

সেখানে কাহারও ডাকাত সর্দারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার সাহস নাই। যে কেউ ডাকাত সর্দারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবে তাহারও অবস্থা সাধুদিগের মতো বেহাল করিয়া ছাড়িবে। ফলে ভয়ে সকলেই নিশ্চুপ হইয়া থাকে। তাহা ছাড়া তথায় দু-চারজন ছাড়া প্রায় সকলেই ডাকাত সর্দারের অনুগত অনুচর।

তাই বলিতেছি, মেষ যতই সিংহ সাজিয়া সিংহদিগের দলে থাকুক না কেন তাহার আপন স্বভাব কোনো না কোনো সময় উন্মোচিত হইয়া পড়িবেই। আর তাহা বাহির হইয়া পড়িলেই সে তখন মেষের দলে গিয়াই ভিড়িবে। এবং সে যেকোনো সময়ে সিংহদিগকে বিপদের মুখে ফেলিতে চেষ্টা করিবে।

চোররূপী ছদ্মবেশী সাধু যেমন সাধুদিগের দলে থাকিয়া ডাকাত সর্দারের সহায়তায় সাধুদিগের যে বেহাল অবস্থা করিয়া ছাড়িয়া ছিল সেরূপ দুষ্টু লোকের আপন স্বভাব উন্মোচিত হইয়া পড়িলে সেও তদ্রূপ ক্ষতি করিতে চেষ্টা করিবে।

তাই সিংহ হইয়া মেষেদের মধ্যে না থাকিয়া, মেষেদের মতো চিৎকার না করিয়া আপনার প্রকৃত স্বরূপকে জানিতে হইবে, আর ছদ্মবেশীদের নিকট হইতে দূরে থাকিতে হইবে সেই সঙ্গে সর্বদা ভগবানের নাম করিতে হইবে। জয় রামকৃষ্ণ।।

……………………………………
স্বামী জয়ানন্দজীর অন্যান্য লেখা পড়ুন:
আপন স্বরূপ
মানসিক বিপর্যয়ে মুক্তির পথ
সম্পর্ক বিপর্যয়ে মুক্তির পথ

এতো চিন্তা কিসের?

শ্রীকৃষ্ণের মেয়ে-জামাই
শ্রীরাধা’র দুঃখ

…………………………………
আরও পড়ুন-
আধ্যাত্মিক উপলব্ধি
পরমসত্তানুসন্ধানে আত্মোপলব্ধির গুরুত্ব
অলৌকিক ঘটনার নিয়ম
অনুপ্রাণনা কি?
মানবিক জীবন ও আত্মদর্শন
হৃদয়জুড়ে মানবসেবা
উদ্বেগমুক্ত চেতনা
মায়া
আপন স্বরূপ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!