-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
‘জাতিস্মর’
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, “হ্যাঁ, আমি শুনেছি জন্মান্তর আছে। ঈশ্বরের কার্য আমরা ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে কি বুঝব? অনেকে বলে গেছে, তাই অবিশ্বাস করতে পারি না। ভীষ্মদেব দেহত্যাগ করবেন, ‘শরশয্যায় শুয়ে আছেন, পাণ্ডবরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সব দাঁড়িয়ে। তাঁরা দেখলেন যে, ভীষ্মদেবের চক্ষু দিয়ে জল পরছে।
অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ভাই, কি অশ্চর্য! পিতামহ, যিনি স্বয়ং ভীষ্মদেব, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানী, অষ্টবসুর এক বসু, তিনিও দেহত্যাগের সময় মায়াতে কাঁদছেন।’ শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মদেবকে এ-কথা বলাতে তিনি বললেন, ‘কৃষ্ণ, তুমি বেশ জানো, আমি সেজন্য কাঁদছি না! যখন ভাবছি যে, যে পাণ্ডবদের স্বয়ং ভগবান নিজে সারথি, তাদেরও দুঃখ-বিপদের শেষ নাই, তখন এই মনে করে কাঁদছি যে, ভগবানের কার্য কিছুই বুঝতে পারলাম না।”
‘ভগবানের কার্য কিছুই বুঝতে পারলাম না’- রামকৃষ্ণদেবের এ কথা দিয়েই শুরু করছি আজকের পর্ব। প্রকৃতপক্ষেই এই অনন্ত রহস্যমণ্ডিত সৃষ্টিজগতকে বোঝা মোটেও সহজ কাজ নয়। সাধককুল বলেন, সৃষ্টি নিজেই তার রহস্য সংরক্ষণ করে। সকলের চোখে তা ধরা পরে না। সকলের মনে তা প্রশ্ন হয়েও উদয় হয় না।
আর এই রহস্যের গুপ্ত জ্ঞানকে আড়াল করতে, সৃষ্টির অনন্তজগৎ তার প্রতি পরতে পরতে রহস্যের এমন সব অদৃশ্য পর্দা দিয়ে রেখেছে যে; এই পর্দা যত সরানো যায়। রহস্য ততই ঘনীভূত হয়। তাই এই সীমাহীন রহস্যজগতকে বুঝতে গেলে সযত্নে পর্যায়ক্রমে একের পর এক পর্দা সরিয়ে দেখতে হয়। তাড়াহুড়ো করলেই বাঁধে বিপত্তি। ঘটে গণ্ডগোল।
সৃষ্টিজগতের মতো ‘জন্মান্তর’ বিষয়টাও অনেকটা এমনি একটা তত্ত্ব। যাকে বুঝতে গেলেও পর্যায়ক্রমে বোঝার চেষ্টা করলেই এই জটিল এবং আপাত অবিশ্বাস্য বিষয়টি বোঝা কিছুটা সহজ হয়। সেকারণেই এর সাথে যুক্ত সাধারণ বিষয়গুলো আগে বুঝে নেয়া দরকার।
বরাবরের মতো এ পর্বেও জন্মান্তরের সাথে সম্পর্কিত শব্দগুলো বোঝার চেষ্টা করবো; পাশাপাশি জন্মান্তর নিয়ে কিছু আলোচনা। এভাবে এই অনুসন্ধানের যাত্রা চলতে থাকলে একসময় লেখার ধারাবাহিকতায় হয়তো পুরো বিষয়টা সম্পর্কে একটা সাম্যক ধারণা পাওয়া যাবে-
সেই ধারাবাহিকতায় জন্মান্তরের এবারের শব্দ ‘জাতিস্মর’। সাধারণভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, যারা পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পারে বা পূর্বজন্মের কথা যাদের স্মরণে চলে আসে তারাই জাতিস্মর। তবে বেশিভাগ মানুষই এসব কথায় বিশ্বাস রাখেন না।
তাদের চোখে এসবই গাঁজাখুরি গালগল্প মাত্র। বেশিভাগ মানুষই শুধু জাতিস্মরকে নয়, যারা জাতিস্মর বিশ্বাস করে তাদেরকেও অসুস্থ বা অতি কাল্পনিক মানুষ হিসেবেই মনে করে। অনেকে আবার বলেছেন, ‘জাতিস্মররা হয় মানসিক রােগী, নয় প্রতারক।’
সাধুগুরুরা বলেন, পূর্বজন্মের স্মৃতি সাধারণের স্মরণ করার চেষ্টা না করাই উত্তম। এতে জীবনে জটিলতা বাড়বে বই কমবে না। সাধক চাইলে সাধনবলে তা আয়ত্ত করতে পারে বটে। কিন্তু প্রকৃত সাধকের কাছে এটা বিশেষ কোনো ঘটনা নয়।
তার উৎসাহেই কলকাতায় গড়ে উঠে প্যারাসাইকোলজি সোসাইটি। সেখানে আজীবন সদস্য ছিলেন সত্যজিৎ রায়। বলা হয়ে থাকে, হেমেন্দ্রনাথকেই তিনি ফেলুদা গল্পে ডক্টর হাজরা চরিত্রে উপস্থাপন করেন। আর ১৯৭৪ সালে যখন সত্যজিৎ রায় ‘সোনার কেল্লা’কে সেলুলয়েডে দৃশ্যায়ন করেন।
পাশাপাশি গুরুর আদেশ ব্যতীত সাধনালব্ধ কোনো উপলব্ধি প্রকাশের অনুমতি রাখে না বলে সাধকের এ সকল কথা প্রকাশ্যে আসে না। তবে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এ রকম কিছু যখন হঠাৎ ঘটে যায়; তখন তা জনসম্মুখে প্রকাশ পেয়ে যায়।
বলা হয়ে থাকে, পূর্বজন্মের স্মৃতি সাধারণত শিশুদেরই মনে করবার সক্ষমতা থাকে। তারা যে সব কথা বলে বা ভাবে তা যদি বর্তমান জীবনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবেই আশপাশের মানুষ তা মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং বোঝার চেষ্টা করে।
বড়দের ক্ষেত্রে এটা প্রকাশ পাওয়া একটু জটিল। কারণ বড়রা নিজেরাই এসবকে ভ্রান্ত বা অলিক ভাবনা বলে উড়িয়ে দেয় বেশিভাগ ক্ষেত্রে। তাই তারা এর গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ পায় কম।
জাতিস্মর বিষয়ক গবেষকরা নানা গবেষণাপত্র-কেসস্টাডির মধ্য দিয়ে ‘জাতিস্মর’কে সত্য প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। পূর্বজন্ম গবেষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম আমেরিকার ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড ইয়ান স্টিভেনসন।
তিনি এ বিষয়ে পঞ্চাশের দশক থেকে গবেষণা শুরু করেন। শেষ বয়সে এসে তিনি বলেন, ‘সমস্ত তথ্যপ্রমাণ যাচাই করে মনে হচ্ছে পুনর্জন্ম সত্য, মনে হয় মানুষ আগেও জন্মেছে এবং মৃত্যুর পরে আবার জন্মাবে।’
জাতিস্মরের বাস্তবতা নিয়ে মতভেদ থাকলেও সাহিত্যে এর সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অনেক সাহিত্যিক এ বিষয় নিয়ে লিখলেও উপমহাদেশের অন্যতম চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক সত্যজিৎ রায় সোনার কেল্লায় ফেলুদার মতো বিচক্ষণ গোয়েন্দা গল্পে যখন ‘জাতিস্মর’ চরিত্রকে কেন্দ্র করে কাহিনী বুনেন; তখন বাঙালী পাঠকের কাছে নতুন করে জাতিস্মর বিষয়টি নাড়া দেয়।
ষাটের দশকে কলকাতার ছেলে হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জাতিস্মর নিয়ে গবেষণা করে খবরের শিরোনাম হয়ে উঠেন। হেমেন্দ্রনাথ দাবী করেছিলেন তিনি পুনর্জন্মের প্রমাণ অন্বেষণে ৬৮বার বিশ্ব পরিক্রমা করেছিলেন। এমনকি সবদেশেই তিনি জাতিস্মর খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন।
তার উৎসাহেই কলকাতায় গড়ে উঠে প্যারাসাইকোলজি সোসাইটি। সেখানে আজীবন সদস্য ছিলেন সত্যজিৎ রায়। বলা হয়ে থাকে, হেমেন্দ্রনাথকেই তিনি ফেলুদা গল্পে ডক্টর হাজরা চরিত্রে উপস্থাপন করেন। আর ১৯৭৪ সালে যখন সত্যজিৎ রায় ‘সোনার কেল্লা’কে সেলুলয়েডে দৃশ্যায়ন করেন।
তখন বাঙালী দর্শক জাতিস্মর বিশ্বাস করুক বা না করুক সোনার কেল্লার মুকুলকে অবিশ্বাস করতে পারেনি। সত্যজিতের মতো মানুষকে তো অবজ্ঞা করা চাট্টিখানি কথা নয়। তার উপর বাঙালীর অন্যতম নায়ক চরিত্র, প্রদোষ চন্দ্র মিত্র অর্থাৎ ফেলুদা স্বয়ং যখন এর পক্ষে বলছেন।
হেমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে জাতিস্মরের ঘটনা হল আদতে ‘এক্সট্রা-সেরিব্রাল মেমরি’ বা মস্তিষ্কাতিরিক্ত স্মৃতির ঘটনা। ‘আত্মা অবিনশ্বর’ ইত্যাদি ধর্মীয় চিন্তার সঙ্গে এই মস্তিষ্কাতিরিক্ত স্মৃতির কোনও সম্বন্ধ তো নেই-ই, বরং বৈজ্ঞানিক কাজে এ সব শব্দ আরও জটিলতা সৃষ্টি করে।
সত্যজিতের আগে, তার সময়কালে এবং পরবর্তীতে শুধু বাংলা সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে নয়। বিশ্ব শিল্পেও বারবার ফিরে ফিরে এসেছে জাতিস্মর বিষয়টি। বিশ্ব ইতিহাসে জাতিস্মরকে নিয়ে অনেক কাজ হলেও বাঙালীর কাছে এই শব্দটিকে আবারো জীবন্ত করে তোলেন নতুন বাংলা গানের অগ্রপ্রথিক কবীর সুমন। কবীর সুমন লিখেছেন-
অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবি দাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া
মুহূর্ত যায় জন্মের মতো, অন্ধ জাতিস্মর
গত জন্মের ভুলে যাওয়া স্মৃতি বিস্মৃত অক্ষর
ছেঁড়া তাল পাতা পুঁথির পাতায় নি:স্বাস ফেলে হাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া
কালকেউটের ফনায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি
বেহুলা কখনো বিধবা হয় না, এটা বাংলার রীতি
ভেসে যায় ভেলা এবেলা ওবেলা একই শবদেহ নিয়ে
আগেও মরেছি আবার মরব প্রেমের দিব্যি দিয়ে।।
জন্মেছি আমি আগেও অনেক মরেছি তোমারি কোলে
মুক্তি পাই নি শুধু তোমাকেই আবার দেখব বলে
বার বার ফিরে এসেছি আমরা এই পৃথিবীর টানে
কখনো গাঙ্গর, কখনো কোপাই, কপোতাক্ষর গানে
গাঙ্গর হয়েছে কখনো কাবেরী কখনো বা মিসিসিপি
কখনো রাইন কখনো কঙ্গো নদীদের স্বরলিপি
স্বরলিপি আমি আগেও লিখিনি, এখনো লিখি না তাই
মুখে মুখে ঘেরা মানুষের ভীড়ে শুধু তোমাকেই চাই।।
তোমাকে চেয়েছি ছিলাম যখন অনেক জন্ম আগে
তথাগততার নি:সঙ্গতা দিনের অস্তরাগে
তাঁরই করুনায় ভিখারিনী তুমি হয়েছিলে একা একা
আমিও কাঙ্গাল হলাম আর এক কাঙালের থেকে দেখা
নতজানু হয়ে ছিলাম তখনো, এখনো যেমন আছি
মাধুকরী হও নয়নমোহিনী স্বপ্নের কাছাকাছি
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড করো প্রেমের পদ্যটাই
বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি শুধু তোমাকেই চাই।।
আমার স্বপ্নে বিভোর হয়ে জন্মেছ বহুবার
আমি ই ছিলাম তোমার কামনা বিদ্রোহ চিৎকার
দুঃখ পেয়েছ যতবার, জেনো আমায় পেয়েছ তুমি
আমি ই তোমার পুরুষ আমি তোমার জন্মভূমি
যতবার তুমি জননী হয়েছ ততবার আমি পিতা
কত সন্তান জ্বালালো প্রেয়সী তোমার আমার চিতা
বার বার আসি আমরা দুজন বার বার ফিরে চাই
আবার আসব আবার বলব শুধু তোমাকেই চাই।।
পরবর্তীতে এই গানের ‘জাতিস্মর’ শব্দটিকে নিয়ে গোটা একটা চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। জাতিস্মর নিয়ে শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয় বিশ্ব চলচ্চিত্রে অগণিত চলচ্চিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়; বিভিন্ন ভাষায়। মোটকথা জাতিস্মর তত্ত্বটি বিশ্বাস করতে কষ্টকর হলেও; এটি ভূতের গল্পের মতোই রোমাঞ্চকর। তাই জাতিস্মর সাধারণের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় তত্ত্ব।
পূর্বজন্মের কথা স্মরণ সম্পর্কিত কাহিনী নিয়ে বহু পৌরাণিক কাহিনী পাওয়া যায়। এদের বেশিভাগই দেব-দেবী, মুনি-ঋষি, অবতার-সাধু-সন্ন্যাসী-অলি-আউলিয়া-পীর-পয়গম্বদের জীবনকে ঘিরে। তবে পূর্বজন্মের কাহিনী নিয়ে রচিত অধিক প্রচলিত সংকলন হলো ‘জাতক’। গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন জন্মের কাহিনী নিয়ে এই সংকলন। জাতকের গল্পের সংখ্যা ৫৪৭টি। যদিও সূত্তপিটক মতে, বুদ্ধ ৫৫০ বার জন্ম নিয়েছিলেন।
নানাভাবে নানা মুনি এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইতিহাসের বিভিন্ন সময় বহু মানুষ দাবী করেছেন যে তারা জাতিস্মর। এই নিয়ে কিছুদিন মাতামাতি হয়েছে। আবার সবাই ভুলে গেছে তাদের কথা। তবে সাহিত্য, নাটক বিশেষ করে চলচ্চিত্রে এটি ফিরে এসেছে বারবার।
সাম্প্রতিক সময়েও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কিছু গুণীজনও পূর্বজন্মের স্মরণের কথা উল্লেখ করে খবরে এসেছেন। তবে খবরে আসার জন্যই তারা সেসব কাল্পনিক গল্প ফেঁদেছিলেন বলেই লোকে মনে করেন।
পূর্বজন্মের কথা স্মরণ সম্পর্কিত কাহিনী নিয়ে বহু পৌরাণিক কাহিনী পাওয়া যায়। এদের বেশিভাগই দেব-দেবী, মুনি-ঋষি, অবতার-সাধু-সন্ন্যাসী-অলি-আউলিয়া-পীর-পয়গম্বদের জীবনকে ঘিরে। তবে পূর্বজন্মের কাহিনী নিয়ে রচিত অধিক প্রচলিত সংকলন হলো ‘জাতক’। গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন জন্মের কাহিনী নিয়ে এই সংকলন। জাতকের গল্পের সংখ্যা ৫৪৭টি। যদিও সূত্তপিটক মতে, বুদ্ধ ৫৫০ বার জন্ম নিয়েছিলেন।
বুদ্ধত্ব লাভের পর গৌতম বুদ্ধ তাঁর পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করার ক্ষমতা অর্জন করেন। তিনি বিভিন্ন উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তাঁর বিভিন্ন জন্মের কাহিনী শিষ্যদের শুনিয়েছিলেন। সেগুলোই পরবর্তীতে একসাথে ‘জাতক’ নামে সংকলন করা হয়। পূর্বের জন্মে বুদ্ধ কখনো মানুষ, কখনো পশু, কখনো বা পাখি হয়ে জন্মেছেন।
মহাভারতের অন্যতম চরিত্র দানবীর কর্ণ পূর্বজন্মে ‘দাম্বোদভব’ নামে মহা শক্তিধর এক রাক্ষস ছিলেন। সূর্যের একনিষ্ঠ ভক্ত দাম্বোদভব সূর্যের বরে এক হাজার কবচ লাভ করেছিলেন। এই কবচ ধ্বংস না করে দাম্বোদভবর প্রাণ নেওয়া সম্ভব ছিল না। কবচগুলির বিশেষত্ব ছিল যে একবারে একটির বেশি কবচ ধ্বংস করা যাবে না।
মহাভারতে পূর্বজন্মে শিখণ্ডী ছিলেন কাশীরাজার বড় মেয়ে অম্বা। ভীষ্ম পূর্বজন্মে ছিলেন দ্যু বা প্রভব, যিনি অষ্টবসু দেবতাদের একজন। পূর্বজন্মে শল্য ছিলেন হিরণ্যকশিপুর পুত্র সংহলাদ।
রামায়নে সীতা ছিলেন পূর্বজন্মে এক ঋষিকন্যা। নাম তাঁর বেদবতী। শ্রবণ কুমার পূর্বজন্মে রাজকুমার ছিলেন। অভিশাপের ফলে তিনি অন্ধমুনির পুত্র হয়ে জন্ম নেন। ইন্দুমতী তার পূর্বজন্মে ‘হরিনি’ নামক এক অপ্সরা ছিল।
যমদূতকে ফাঁকি দিয়ে সে নিজেই বিশাল এক ঘর বানায়। তারপর ঘরখানায় নিজেই আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আর নিজের বিশাল পাখা দিয়ে আগুনে বাতাস দিতে থাকে। দাউদাউ করে আগুন যখন জ্বলে থাকে তখন পাখিটি বিষাদের সুর গাইতে থাকে। এভাবেই সে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই ছাই থেকে সে নতুন করে পুনরায় জন্ম নেয়। এভাবেই জীবান্তর ঘটে চলে ফিনিক্স পাখির।
রামায়ন, মহাভারত, পুরাণে বলতে গেলে ভারতবর্ষের প্রাচীন কাহিনীতে এরকম বহু পূর্বজন্ম-জন্মান্তর-জীবান্তর-জাতিস্মরের ঘটনার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেখানে পূর্বজন্মের কথা স্মরণ এতোটাই স্বাভাবিকভাবে দেখানো হয়েছে যে জাতিস্মরের ঘটনা কাহিনীতে তেমন প্রভাবে ফেলেনি। সেটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনার মতোই বর্ণিত হয়েছে।
জন্মান্তর প্রসঙ্গে মানুষের পাশাপাশি কয়েকটি জীবজন্তুও জগৎ বিখ্যাত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি নাম হলো ‘ফিনিক্স পাখি’। এই পাখির কথা মিশরীয়, গ্রিক, চীনা পুরাণে উল্লেখ পাওয়া যায়। মিশরীয়দের পুরাণে এই পাখি সূর্যদেবের অবতার। গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স নবজীবন-অমরত্বের প্রতীক।
বলা হয়ে থাকে, ফিনিক্স বা আগুন থেকে জন্ম নেয়া এই পাখি মূলত একটিই। সেই পাখিটি যতবার মরে যায়, ততবারই নিজ দেহের ছাই থেকে পুনরায় জন্ম হয়ে যায়। প্রতিবারে পাখিটির আয়ু পাঁচ’শ থেকে হাজার বছর। জীবিত অবস্থায় ফিনিক্স যেখানেই থাকুক না কেনো মৃত্যুর সময় হলে সে ঠিকই মধ্যপ্রাচ্যের দিকে চলে আসে।
যমদূতকে ফাঁকি দিয়ে সে নিজেই বিশাল এক ঘর বানায়। তারপর ঘরখানায় নিজেই আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আর নিজের বিশাল পাখা দিয়ে আগুনে বাতাস দিতে থাকে। দাউদাউ করে আগুন যখন জ্বলে থাকে তখন পাখিটি বিষাদের সুর গাইতে থাকে। এভাবেই সে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেই ছাই থেকে সে নতুন করে পুনরায় জন্ম নেয়। এভাবেই জীবান্তর ঘটে চলে ফিনিক্স পাখির।
গবেষকরা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের পুরাণেও ভিন্ন ভিন্ন নামে এই পাখির অস্তিত্ব খুঁজে পান। যেমন হিন্দু পুরাণে গরুড়, পারস্যের হুমা, চাইনিজ পুরাণে ফেংহুয়াং, জাপানি পুরাণে হোও। এই পাখির নানা রং-বর্ণ-বৈচিত্র্যের কথা বিভিন্ন পুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে।
কেউ বলেছে এই পাখি আসলে স্বর্গে বাস করে। পৃথিবীতে সাময়িক সময়ের জন্য আসে স্বর্গের প্রতিনিধিত্ব করতে। আবার কেউ বলে এর বাস আরব অঞ্চলে। তবে প্রায় প্রত্যেকেই একে সূর্যের অবতার বলে মেনেছে। তাই এর সাথে আগুনের সম্পর্কও নিবিড়।
অবিশ্বাসীরা প্রশ্ন করেন, যদি জন্মান্তর থাকতোই। যদি জাতিস্মর হওয়া সম্ভব হয়। তাহলে আমি কেনো পূর্বজন্মের স্মৃতি স্মরণ করতে পারি না? উত্তরে সাধককুল বলেন, সৃষ্টি তার জন্ম-জন্মান্তরের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেই এই স্মৃতি জীবের ভেতরে গুপ্ত অবস্থায় রাখেন। যদি জীব তা স্মরণ করতে পারে তাহলে তার স্বাভাবিক জীবন বিঘ্নিত হবে।
এ প্রসঙ্গে রজনীশ ওশো বলেছেন, ‘…নিশ্চয়ই মানুষ জানতে পারে নিজের পূর্বজন্মকে। কেননা যা একবার চিত্তে স্মৃতিরূপে চিত্রায়িত হয়ে গেছে, তা আর নষ্ট হবার নয়। সবই আমাদের চিত্তের গভীর অংশ অচেতন অংশে মজুদ থেকে যায়। আমরা যা কিছু জানতে পারি তা কখনোই ভুলি না।
যদি আমি আপনার কাছে জানতে চাই ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি মাসে আপনি কি করেছিলেন? তাহলে হয়তো আপনি কিছুই বলতে পারবেন না। আপনি বলবেন, আমার তো কিছুই স্মরণ নেই। …কিন্তু যদি আপনাকে সম্মোহিত করা যায়। আপনাকে অজ্ঞান করে জানতে চাওয়া হয়- ১ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে আপনি কি করেছিলেন?
যেমন প্রতিটা বাড়িতে একটা গুদাম ঘর থাকে। যেখানে অপ্রয়োজনীয় সকল জিনিস রেখে দরজা বন্ধ করে রাখা হয়। তেমনি স্মৃতির একটা অচেতন ঘর আছে যা স্মৃতির মধ্যে যা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়, চিত্তে যা রাখার প্রয়োজন নেই তা সেখানে জমা রাখা হয়। সেখানে জন্ম-জন্মান্তরের স্মৃতি সংগৃহিত থাকে।
তাহলে আপনি সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা এমনভাবে বর্ণনা করবেন যে, মনে হবে সেই ১ জানুয়ারি এখনি আপনার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। আপনি এটাও বলে দিতে পারবেন যে আমি সেদিন সকালে যে চা পান করেছিলেন তাতে চিনি সামান্য কম ছিল। এমনকি যে ব্যক্তি চা দিয়েছিল তার শরীর থেকে ঘামের কটু গন্ধ আসছিল।
…সম্মোহিত অবস্থায় আপনার ভেতরের স্মৃতিকে বাইরে আনা সম্ভব। যারা সেই পূর্বজন্মের স্মৃতিকে স্মরণ করতে চায় তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু তার আগে এই জন্মের পেছনে যেতে হবে। এই জন্মের স্মৃতির পেছনে ফিরতে হবে। সেই পর্যন্ত পেছনে যেতে হবে, যখন আপনার মায়ের গর্বে গর্বাধারণ হয়েছিল।
তারপর অন্য জন্মের স্মৃতি প্রবেশ করা যেতে পারে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, প্রকৃতি পূর্বজন্মের স্মৃতি ভুলে যাওয়ার বিধান বিনা কারণে হয়নি। এর কারণ অনেক মাহাত্ম্যপূর্ণ। আর পূর্বজন্মতো অনেক দূরের কথা, যদি আপনার এক মাসেরও সকল স্মৃতি স্মরণে থেকে যায়। তাহলে আপনি পাগল হয়ে যাবেন।
একদিনেরও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সকল কথা যদি মনে থেকে যায়। তাহলে আপনি জীবিত থাকতে পারবেন না। প্রকৃতির সকল ব্যবস্থা এমনই- আপনার মন কতটা সহ্য করতে পারে ততটুকুই স্মৃতি আপনার ভেতরে রেখে দেয়া হয়। আর বাকি সব অন্ধকার গর্তে ভরে রাখা হয়।
যেমন প্রতিটা বাড়িতে একটা গুদাম ঘর থাকে। যেখানে অপ্রয়োজনীয় সকল জিনিস রেখে দরজা বন্ধ করে রাখা হয়। তেমনি স্মৃতির একটা অচেতন ঘর আছে যা স্মৃতির মধ্যে যা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়, চিত্তে যা রাখার প্রয়োজন নেই তা সেখানে জমা রাখা হয়। সেখানে জন্ম-জন্মান্তরের স্মৃতি সংগৃহিত থাকে।
কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি অজ্ঞতা প্রসূত বা না বুঝে যদি সেই স্মৃতি কক্ষে প্রবেশ করে ফেলে তাহলে সাথে সাথেই পাগল হয়ে যাবে।”
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………………………..
সূত্র:
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া
…………………………………..
প্রচ্ছদ ছবির কৃতজ্ঞতা:
সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজের চলচ্চিত্র ‘সোনার কেল্লার’ ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২
চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চৌদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১
চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি