-নূর মোহাম্মদ মিলু
হজরত রাসূলে কারীমের (সা) নবুওয়াত লাভের পাঁচ বছর পূর্বে উম্মুল কুরা তথা মক্কা নগরীতে হজরত ফাতেমা (রা) জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সায়্যিদুল কাওনায়ন রাসূলু রাব্বিল আলামীন আবুল কাসিম মুহাম্মাদ ইবন আবদিল্লাহ ইবন আব্দুল মাত্তালিব এবং মাতা সারা বিশ্বের নারী জাতির নেত্রী, প্রথম মুসলমান উম্মুল ম‘মিনীন খাদিজা বিনত খুয়ায়লিদ (রা)।
ফাতেমার যখন জন্ম হয় তখন মক্কার কুরায়শরা পবিত্র কা‘বা ঘরের সংস্কার কাজ চালচ্ছে। সেটা ছিল নবীজীর নবুওয়াত লাভের পাঁচ বছর পূর্বের ঘটনা। ফাতেমার জন্মগ্রহণে তার মহান পিতা-মাতা দারুণ খুশী হন। (সিয়ারু আ‘লাম আন-নুবালা-২/১১৯) ফাতেমা ছিলেন কনিষ্ঠা মেয়ে।
মা খাদিজা তাঁর অন্য সন্তানদের জন্য ধাত্রী রাখলেও ফাতেমাকে ধাত্রীর হাতে ছেড়ে দেননি। তিনি তার অতি আদরের ছোট মেয়েকে নিজে দুধ পান করান। এভাবে ফাতেমা একটি পূতঃপবিত্র গৃহে তাঁর মহান পিতা-মাতার তত্ত্বাধানে লালিত-পালিত হয়ে বেড়ে ওঠেন এবং নবুওয়াতের স্বচ্ছ ঝর্ণাধারায় স্নাত হন।
শ্রেষ্ঠত্বের কারণ
ফাতেমার মহত্ব, মর্যাদা, আভিজাত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের যেসব কথা বলা হয় তা সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়-
১. তাঁর পিতা মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদমের শ্রেষ্ঠ সন্তান রাহমাতুল্লিল আলামীন আমাদের মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।
২. মা বিশ্বের নারী জাতির নেত্রী, সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী উম্মুল মু’মিনীন খাদিজা বিনত খুওয়ায়লিদ (রা)।
৩. স্বামী দুনিয়া ও আখিরাতের নেতা আমীরুল মু’মিনীন হজরত আলী (রা)।
৪. দুই পুত্র-আল-হাসান ও আল-হুসায়ন (রা) জান্নাতের যুবকদের দুই মহান নেতা এবং রাসূলুল্লাহর (রা) সুগন্ধি।
৫. এক দাদা শহীদদের মহান নেতা হজরত হামযা (রা)।
৬. অন্য এক দাদা প্রতিবেশীর মান-মর্যাদার রক্ষক, বিপদ-আপদে মানুষের জন্য নিজের অর্থ-সম্পদ খরচকারী, উলঙ্গ ব্যক্তিকে বস্ত্র দানকারী, অভুক্ত ও অনাহার-ক্লিষ্টকে খাদ্য দানকারী হজরত আল-আব্বাস ইবন আবদিল মুত্তালিব (রা)।
৭. চাচা মহান শহীদ নেতা ও সেনানায়ক হজরত জা‘ফার ইবন আবী তালিব (রা)।
উল্লেখিত গৌরবের অধিকারী বিশ্বের নারী জাতির মধ্যে আর কেউ কি আছে?
নবীজীর উপর ওহি নাজিল হবার পর হজরত খাদিজা সর্বপ্রথম তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁর রিসালাতকে সত্য বলে গ্রহণ করেন। আর নবীজীর প্রতি প্রথম পর্বে যেসব নারী ঈমান আনেন তাঁদের পুরো ভাগে ছিলেন তাঁর কন্যারা- যায়নাব, রুকাইয়্যা, উম্মু কুলছূম ও ফাতেমা।
তাঁরা তাঁদের পিতার নবুওয়াত ও রিসালাতের প্রতি ঈমান আনেন তাঁদের মহিয়সী মা খাদিজার সাথে।
ইবন ইসহাক হজরত আয়েশার (রা) সূত্রে বর্ণনা করেছেন- আল্লাহ যখন তাঁর নবীকে নবুওয়াতে ভূষিত করলেন তখন খাদিজা ও তাঁর কন্যারা ইসলাম গ্রহণ করেন। এভাবে নবীজীর কন্যারা তাঁদের মায়ের সাথে প্রথম ভাগেই ইসলামের আঙ্গিনায় প্রবেশ করেন এবং তাঁদের পিতার রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন করেন।
নবুওয়াত লাভের পূর্বেই তাঁরা নৈতিক গুণাবলীতে বিভূষিত হন। ইসলামের পরে তা আরো সুশোভিত ও সুষমামণ্ডিত হয়ে ওঠে।
ইমাম আয-যুরকানী ‘শারহুল মাওয়াহিবৎ গ্রন্থে ফাতেমা ও তাঁর বোনদের প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণের কথা বলেছেন এভাবে- ‘তাঁর মেয়েদের কথা উল্লেখের প্রয়োজন নেই। কারণ, নবুওয়াতের পূর্বেই তাঁদের পিতার জীবন ও আচার-আচরণ দৃঢ়ভাবে অনুসরণ ও শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।’
অন্য এক স্থানে আয্-যুরকানী নবী-দুহিতাদের ইসলাম গ্রহণের অগ্রগামিতা সম্পর্কে বলেছেন- মোটকথা, আগেভাগে তাঁদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কোন প্রমাণের প্রয়োজন নেই। সর্বাধিক সত্য, সর্বাধিক অভিজাত পিতৃত্ব এবং সবচেয়ে ভালো ও সর্বাধিক স্নেহময়ী মাতৃত্বের ক্রোড়ে বেড়ে ওঠার কারণে তাঁরা লাভ করেছিলেন তাঁদের পিতার সর্বোত্তম আখলাক।
তথা নৈতিকতা তারা তাঁদের মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন এমন বুদ্ধিমত্তা যার কোন তুলনা চলে না পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালে কোন নারীর সাথে। সুতরাং নবী পরিবারের তথা তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের ইসলাম ছিল স্বচ্ছ-স্বভাবগত ইসলাম। ঈমান ও নবুওয়াত দ্বারা যার পুষ্টি সাধিত হয়। মহত্ব, মর্যাদা ও উন্নত নৈতিকতার উপর যাঁরা বেড়ে ওঠেন। (তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ-৫৯২)
নবীজীর উপর ওহি নাজিল হলো। তিনি আল্লাহর নির্দেশমত মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানাতে লাগলেন এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন। এজন্য তিনি যত দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ, অত্যাচার নির্যাতন, অস্বীকৃতি, মিথ্যা দোষারোপ ও বাড়াবাড়ির মুখোমুখী হলেন, সবকিছুই তিনি উপেক্ষা করতে লাগলেন।
এক পর্যায়ে কুরায়শরা নবীজীর সাথে চরম শত্রুতা করতে লাগলো। তারা ঠাট্টা বিদ্রূপ করতে লাগলো, মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতে আরম্ভ করলো। ফাতেমা তখন জীবনের শৈশব অবস্থা অতিক্রম করছেন। পিতা যে তাঁর জীবনের একটা কঠিন সময় অতিবাহিত করছেন, মেয়ে ফাতেমা অল্পবয়সেও তা বুঝতে পারতেন।
অনেক সময় তিনি পিতার সাথে ধারে-কাছে এদিক ওদিক যেতেন। একবার দুরাচারী উকবা ইবন আবী মু‘ঈতকে তাঁর পিতার সাথে এমন একটি নিকৃষ্ট আচরণ করতে দেখেন। যা তিনি আজীবন ভুলতে পারেন নি। এই উকবা ছিল মক্কার কুরায়শ বংশের প্রতি আরোপিত।
উকবা তার জন্মের কালিমা ঢাকার জন্য সে সব সময় আগ বাড়িয়ে নানা রকম দুষ্কর্ম করে কুরায়শ নেতৃবৃন্দের প্রীতিভাজন হওয়ার চেষ্টা করতো।
একবার উকবা মক্কার কুরায়শদের একটি বৈঠকে বসা ছিল। কয়েকজন কুরায়শ নেতা বললো- এই যে মোহাম্মদ সেজদায় আছেন। এখানে উপস্থিতদের মধ্যে এমন কে আছে, যে উটের এই পচাগলা নাড়ী-ভুঁড়ি উঠিয়ে নিয়ে তাঁর পিঠে লেলে আসতে পারে?
উকবা অতি উৎসাহ ভরে এই অপকর্মটি করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে বললো- আমি যাচ্ছি। তারপর সে দ্রুত পচা নাড়ী-ভুঁড়ির দিকে চলে গেল এবং সেগুলো উঠিয়ে সেজদারত মুহাম্মাদের পিঠের উপর ফেলে দিল। দূর থেকে কুরায়শ নেতারা এ দৃশ্য দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
নবীজী সেজদা থেকে উঠলেন না। সাথে সাথে এ খবর বাড়িতে ফাতেমার কানে গেল। তিনি ছুটে এলেন, অত্যন্ত দরদের সাথে নিজ হাতে পিতার পিঠ থেকে ময়লা সরিয়ে ফেলেন এবং পানি এনে পিতার দেহে লাগা ময়লা পরিষ্কার করেন। তারপর সেই পাপাচারী দলটির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদেরকে কিছু কটু কথা শুনিয়ে দেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/৪৪; হায়াত আস-সাহাবা-১/২৭১)
নবীজী নামাজ শেষ করে দু‘হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন-
‘হে আল্লাহ! তুমি শায়বা ইবন রাবী’আকে পাকড়াও কর। হে আল্লাহ! তুমি আবু জাহ্ল ইবন হিশামকে ধর। হে আল্লাহ! উকবা ইবন আবী মু’ঈতকে সামাল দাও, হে আল্লাহ! উমাইয়্যা ইবন খালাফের খবর নাও।’
নবীজীকে এভাবে দোয়া করতে দেখে পাষণ্ডদের হাসি থেমে যায়। তারা ভীত-শঙ্কিত হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর দোয়া কবুল করেন। উল্লেখিত চার দুর্বৃত্তের সবাই বদরে নিহত হয়। (আল-বায়হাকী, দালায়িল আন-নুবুওয়াহ্-২/২৭৮, ২৮০; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/৪৪)
উল্লেখ্য যে, উকবা বদরে মুসলমানদের হতে বন্দী হয়। নবীজী তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। তখন সে বলে- মুহাম্মাদ! আমার ছোট্ট মেয়েগুলোর জন্য কে থাকবে? বললেন- জাহান্নাম। তারপর সে বলে, আমি কুরায়শ হওয়া সত্ত্বেও আমাকে তুমি হত্যা করবে? বললেন- হ্যাঁ।
তারপর তিনি সাহাবীদের দিকে ফিরে বলেন- তোমরা কি জান এই লোকটি আমার সাথে কিরূপ আচরণ করেছিল? একদিন আমি মাকামে ইবরাহীমের পিছনে সেজদারত ছিলাম। এমন সময় সে এসে আমার ঘাড়ের উপর পা উঠিয়ে এত জোরে চাপ দেয় যে, আমার চোখ দু’টি বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
আরেকবার আমি সেজদায় আছি। এমন সময় সে কোথা থেকে ছাগলের বর্জ্য এনে আমার মাথায় ঢেলে দেয়। ফাতেমা দৌড়ে এসে তা সরিয়ে আমার মাথা ধইয়ে দেয়। অতপর তার দণ্ড কার্যকর করা হয়। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/৪৪; হায়াত আস-সাহাবা-১/২৭১; নিসা’ মুবাশশারাত বিল জান্নাহ্-২০৬)
সেই কিশোর বয়সে ফাতেমা পিতার হাত ধরে একদিন গেছেন কাবার আঙ্গিনায়। তিনি দেখলেন, পিতা যেই না হাজারে আসওয়াদের কাছাকাছি গেছেন অমনি একদল লোক একযোগে তাঁকে ঘিরে ধরে বলতে লাগলো- আপনি কি সেই ব্যক্তি নন যিনি এমন এমন কথা বলে থাকেন?
(চলবে…)
…………………………………
আরো পড়ুন:
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২