ভবঘুরেকথা
সুফি সাধক

সালমান আল-ফারেসী: তিন

আমি তাঁদেরকে গুরু-ছাগলগুলো দিয়ে দিলাম। তাঁরা আমাকে সঙ্গে নিয়ে চললেন। যখন আমরা মদীনা ও শামে’র মধ্যবর্তী ‘ওয়াদী আল-কুরা’ নামক স্থানে পৌঁছলাম। তখন তাঁরা আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে এক ইহুদীর কাছে আমাকে বিক্রি করে দিল। আমি তার দাসত্ব শুরু করে দিলাম।

অল্পদিনের মধ্যেই বনী কুরাইজা গোত্রের তার এক চাচাতো ভাই আমাকে কিনে নেয় এবং আমাকে ‘ইয়াসরিবে’ (মদীনা) নিয়ে আসে। এখানে আমি আম্মুরিয়ার বন্ধুটির বর্ণিত সেই খেজুর গাছ দেখতে পেলাম এবং তিনি স্থানটির যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, সে অনুযায়ী শহরটিকে চিনতে পারলাম। এখানে আমি আমার মনিবের কাছে কাটাতে লাগলাম।

নবীজী তখন মক্কায় দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। কিন্তু দাস হিসেবে সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর সম্পর্কে কোন কথা বা আলোচনা আমার কানে পৌঁছেনি। কিছুদিনের মধ্যে নবীজী মক্কা থেকে হিজরত করে ইয়াসরিবে এলেন।

আমি তখন একটি খেজুর গাছের মাথায় উঠে কি যেন কাজ করছিলাম, আমার মনিব গাছের নীচেই বসে ছিল এমন সময় তার এক ভাতিজা এসে তাকে বললো-

আল্লাহ বনী কায়লাকে (আউস ও খাজরাজ গোত্র) ধ্বংস করুন। কসম খোদার, তারা এখন কুবাতে মক্কা থেকে আজই আগত এক ব্যক্তির কাছে সমবেত হয়েছে, যে কিনা নিজেকে নবী বলে মনে করে।

তার কথাগুলো আমার কানে যেতেই আমার গায়ে যেন জ্বর এসে গেল। আমি ভীষণভাবে কাঁপতে শুরু করলাম। আমার ভয় হলো, গাছের নীচে বসা আমার মনিবের ঘাড়ের ওপর ধপাস করে পড়ে না যাই। তাড়াতাড়ি আমি গাছ থেকে নেমে এলাম এবং সেই লোকটিকে বললাম-

-তুমি কি বললে? কথাগুলো আমার কাছে আবার বলো তো।

আমার কথা শুনে আমার মনিব রেগে ফেটে পড়লো এবং আমার গালে সজোরে এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললো-

-এর সাথে তোমার সম্পর্ক কি? যাও, তুমি যা করছিলে তাই কর।

তারপর অন্য একদিন আমি নবীজীর কাছে গেলাম। তিনি তখন ‘বাকী আল-গারকাদ’ গোরস্থানে তাঁর এক সঙ্গীকে দাফন করছিলেন। আমি দেখলাম, তিনি গায়ে ‘শামলা’ (এক ধরণের ঢিলা পোশাক) জড়িয়ে বসে আছেন।

সেদিন সন্ধ্যায় আমার সংগৃহীত খেজুর থেকে কিছু খেজুর নিয়ে নবীজী যেখানে অবস্থান করছিলেন সেদিকে রওয়ানা হলাম। নবীজীর কাছে পৌঁছে তাঁকে বললাম-

-আমি শুনেছি আপনি একজন পূর্ণবান ব্যক্তি। আপনার কিছু সহায়-সম্বলহীন সঙ্গী-সাথী আছেন। এ সামান্য কিছু জিনিস সদকার উদ্দেশ্যে আমার কাছে জমা ছিল। আমি দেখলাম অন্যদের তুলনায় আপনারাই এগুলো পাওয়ার অধিক উপযুক্ত।

এ কথা বলে খেজুরগুলো তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি সঙ্গীদের বললেন- তোমরা খাও। কিন্তু তিনি নিজের হাতটি গুটিয়ে নিলেন। কিছুই খেলেন না।

মনে মনে আমি বললাম- এ হলো একটি।

সেদিন আমি ফিরে এলাম। আমি আবারও কিছু খেজুর জমা করতে লাগলাম। নবীজী কুবা থেকে মদীনায় এলেন। আমি একদিন খেজুরগুলো নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বললাম- ‘আমি দেখেছি, আপনি সদকার জিনিস খান না।

তাই এবার কিছু হাদিয়া নিয়ে এসেছি, আপনাকে দেয়ার উদ্দেশ্যে।’ এবার তিনি নিজে খেলেন এবং সঙ্গীদের আহ্‌বান জানালেন তাঁরাও তাঁর সাথে খেলেন।

আমি মনে মনে বললাম- এ হলো দ্বিতীয়টি।

তারপর অন্য একদিন আমি নবীজীর কাছে গেলাম। তিনি তখন ‘বাকী আল-গারকাদ’ গোরস্থানে তাঁর এক সঙ্গীকে দাফন করছিলেন। আমি দেখলাম, তিনি গায়ে ‘শামলা’ (এক ধরণের ঢিলা পোশাক) জড়িয়ে বসে আছেন।

আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তারপর আমি তাঁর পেছনের দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে লাগলাম। আমি খুঁজতে লাগলাম, আমার সেই আম্মুরিয়ার বন্ধুটির বর্ণিত নবুওয়াতের মোহরটি।

আমি নবীজী এ চুক্তির কথা অবহিত করলাম। তিনি সাহাবীদেরকে ডেকে বললেন- তোমরা তোমাদের এ ভাইকে সাহায্য কর। তারা প্রত্যেকেই আমাকে পাঁচ, দশ, বিশ, ত্রিশটি করে যে যা পারলেন চারা দিলেন। এভাবে আমার তিনশ’ চারা সংগ্রহ হয়ে গেল।

নবীজী আমাকে তাঁর পিঠের দিকে ঘন ঘন তাকাতে দেখে আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তিনি তাঁর পিঠের চাদরটি সরিয়ে নিলেন এবং আমি মোহরটি স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

আমি তখন পরিস্কারভাবে তাঁকে চিনতে পারলাম এবং হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁকে চুমুতে ভরে দিলাম ও কেঁদে চোখের পানিতে বুক ভাসালাম। আমার এ অবস্থা দেখে নবীজী জিজ্ঞেস করলেন-

-তোমার খবর কি?

আমি সব কাহিনী খুলে বললাম। তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন এবং আমার মুখ দিয়েই এ কাহিনীটা তাঁর সঙ্গীদের শোনাতে চাইলেন। আমি তাঁদেরকে শোনালাম। তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন, খুবই আনন্দিত হলেন।

দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার কারণে হজরত সালমান নবীজীর সাথে বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিতে পারেন নি। ফলে তিনি খুবই মর্মজ্বালা ভোগ করতে থাকেন।

সালমান বলেন- ‘একদিন নবীজী আমাকে ডেকে বললেন- ‍তুমি তোমার মনিবের সাথে মুকাতাবা (চুক্তি)কর।

আমি চুক্তি করলাম, তাকে আমি তিনশ’ খেজুরের চারা লাগিয়ে দেব এবং সেই সাথে চল্লিশ ‘উকিয়া স্বর্ণও দেব। আর বিনিময়ে আমি মুক্তি লাভ করবো।

আমি নবীজী এ চুক্তির কথা অবহিত করলাম। তিনি সাহাবীদেরকে ডেকে বললেন- তোমরা তোমাদের এ ভাইকে সাহায্য কর। তারা প্রত্যেকেই আমাকে পাঁচ, দশ, বিশ, ত্রিশটি করে যে যা পারলেন চারা দিলেন। এভাবে আমার তিনশ’ চারা সংগ্রহ হয়ে গেল।

(চলবে…)

সালমান আল-ফারেসী: চার>>

……………………………….
আরো পড়ুন:
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই

সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

……………………………….
স্থিরচিত্র: সংগ্রহ

** সালমান আল-ফারেসীর কোনো ছবি পাওয়া যায় না। লেখায় ব্যবহৃত ছবির সাথে ফারেসীর কোনো সম্পর্ক নেই।

………………….
পুন:প্রচারে বিনীত : নূর মোহাম্মদ

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!