ভবঘুরেকথা
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব সৃষ্টিতত্ত্ব

পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ

-মূর্শেদূল মেরাজ

প্রাচীনকালে যখন জ্ঞানবিজ্ঞান এত স্তরে স্তরে জমা হয় নাই, মানুষের নিতান্ত শিক্ষণীয় বিষয় যখন যৎসামান্য ছিল, তখন শৌখিন শিক্ষার অবসর ছিল। কিন্তু এখন আর তো সে অবসর নাই। ছোটো ছেলেকে কেবল বিচিত্র বেশবাস এবং অলংকারে আচ্ছন্ন করিলে কোনো ক্ষতি নাই, তাহার খাইয়া দাইয়া আর কোনো কর্ম নাই।

কিন্তু তাই বলিয়া বয়ঃপ্রাপ্ত লোক, যাহাকে করিয়া-কর্মিয়া, নড়িয়া-চড়িয়া, উঠিয়া-হাঁটিয়া ফিরিতে হইবে, তাহাকে পায়ে নূপুর, হাতে কঙ্কণ, শিখায় ময়ূরপুচ্ছ দিয়া সাজাইলে চলিবে কেন? তাহাকে কেবল মালকোঁচা এবং শিরস্ত্রাণ আঁটিয়া দ্রুতপদে অগ্রসর হইতে হইবে।

এই কারণে সভ্যতা হইতে প্রতিদিন অলংকার খসিয়া পড়িতেছে। উন্নতির অর্থই এই, ক্রমশ আবশ্যকের সঞ্চয় এবং অনাবশ্যকের পরিহার।”

জলতত্ত্ব

সূক্ষ্মতার বিচারে পঞ্চভূতের মাটিতত্ত্ব থেকে এক স্তর কম স্থূল হলো জলতত্ত্ব। এই হিসেবে জলতত্ত্বের অবস্থান চতুর্থ। আর স্থূলতার বিচারে দ্বিতীয়।

আগুনের বিপরীত তত্ত্ব হলো জল। আগুন সবচেয়ে তেজময় আর জল সবচেয়ে শীতলতম।

রস, শব্দ, স্পর্শ, রূপ গুণে গুণান্বিত এই জলতত্ত্ব। মাটির মতো জলের আকার না থাকলেও একে ধরা যায়। দেখা যায়। শব্দ শোনা যায়। রস পান করা যায়। কেবল নেয়া যায় না ‘গন্ধ’

অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে জলতত্ত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করেছন- “শীতস্পর্শবত্য আপ:। তা দ্বিবিধা: নিত্যা অনিত্যাশ্চ। নিত্যা: পরমাণুরূপা। অনিত্যা কার্যরূপা:।”

অর্থাৎ- ‘জল হলো সেই দ্রব্য যাতে শীতলস্পর্শ থাকে। নিত্য ও অনিত্য ভেদে জল দ্বিবিধ। পরমাণুরূপ জল নিত্য, কার্যরূপ জল অনিত্য।’

পঞ্চভূতের জলতত্ত্ব মানে শুধু নয় ‘এইচটুও’-র সমীকরণ। ভূততত্ত্বে ‘জল’ ব্যাপক বিষয়। ব্রহ্মাণ্ডের সকল তরলই এখানে জল। তবে এই সকল জলকে বুঝতে গেলে এইচটুও খ্যাত জলকে বোঝা জরুরী। কারণ এই জলই সকল জলের প্রতিনিধিত্ব করে।

এই জলই সকল তরলের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ধারিত্রী এবং মানবদেহের জলের পরিমাণ সমান। ৭৩ ভাগ। দেহের গুরুত্বপূর্ণ সকল অঙ্গই জলে ভাসছে। জল প্রবাহিত হচ্ছে সমগ্র দেহে। জলই দেহকে শীতল রাখছে। সচল রাখছে।

জলের নিজের কোনো আকার নেই। সে যে পাত্রে থাকে। সেই পাত্রের আকার গ্রহণ করে। জল নিজের পথ নিজের তৈরি কর নেয়। এতে বাঁধাবিঘ্ন যাই আসুক গতি থাকলে সে এগিয়েই চলে। প্রয়োজনে সকল কিছু ভেঙ্গেও সে এগিয়ে যায়। এটাই তার চরিত্র।

আর গতি না থাকলে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। স্বভাবে জল নিম্নগামী। সে নিচের দিকে ধাবিত হয়। প্রবাহিত জলকে আটকে রাখতে চাইলেই সে ফুঁসে উঠে। শক্তিশালী হয়ে উঠে। ধ্বংসাত্মকতা প্রকাশ করে।

জল এমনই এক তত্ত্ব। যা একই সাথে কঠিন তরল ও বায়বীয় রূপ নিতে পারে। স্বাভাবিকভাবে জল হয় তরল। একে তাপ দিলে হয় বাষ্প। আর তাপ কমালে জমে হয় বরফ অর্থাৎ কঠিন আকার ধারণ করে।

দেহে জলতত্ত্ব অধিক হলে মানুষের স্বভাব হয়ে উঠে শীতল, তরল, সরল ও কোমল। অন্যদিকে জলের পরিমাণ কম হলে চরিত্র হয় রুক্ষ, উগ্র ইত্যাদি। জল পানে যেমন দেহ শীতল হয়, তেমনি ত্বকে অর্থাৎ বহিরাবণে জল দিলেও দেহ মন শীতল ও শান্ত হয়।

প্রতিনিয়ত আমরা জলকে দেখি তাই ভাবি জলকে আমরা বুঝি। কিন্তু তা মোটেও সহজ নয়। গবেষণাগারে জলকে ভেঙ্গে অক্সিজেন-হাইড্রোজেন বের করলেই জলকে ধরা যায় না।

জল তার রূপ পাল্টে নিতে পটু। গরম, ঠাণ্ডা, নাতিশীতোষ্ণ, কঠিন, বাষ্প, তরল আরো কত কত অবস্থায় যে তার আত্মপ্রকাশ, তার শেষ নেই। জল কোমল-শীতল হলেও সে থেমে থাকে না; সে নিরন্তর।

জল থেকেই জীবনের উৎপত্তি। জলের মাঝেই জীবন প্রবহমান। তাই জলের মাঝে সুপ্ত থাকে অফুরন্ত শক্তি। সৃষ্টির শক্তি। আবার জল যেমন শক্তিশালী তেমনি আবার সে যথেষ্ঠ নমনীয়। জল বিনে জীবন কল্পনা করা যায় না। জলের অভাবে জীবন থেমে যায়। সচলতা হারায়।

দেহে জলতত্ত্ব অধিক হলে মানুষের স্বভাব হয়ে উঠে শীতল, তরল, সরল ও কোমল। অন্যদিকে জলের পরিমাণ কম হলে চরিত্র হয় রুক্ষ, উগ্র ইত্যাদি। জল পানে যেমন দেহ শীতল হয়, তেমনি ত্বকে অর্থাৎ বহিরাবণে জল দিলেও দেহ মন শীতল ও শান্ত হয়।

অধিক মাটিতত্ত্বের কারণে যেমন স্বভাবে আসে অলসতা। সেই অলসতা কাটাতে সহায়তা করে জল। রাগ, ক্রোধ, উগ্রতা কমাতে জল বিশেষ ভূমিকা রাখে। জল মানুষকে দেয় প্রশান্তি। করে শান্ত।

তবে জল বয়ে চলার গুণ স্বভাবে প্রবেশ করিয়ে দেয়। এতে মানুষ অনেকসময়ই হয়ে উঠে সুযোগসন্ধানী ও নিম্নগামী।

জলের শক্তি অসীম। সে শক্তি ধারণ করে রাখে। প্রয়োজনে বিস্ফোরণ ঘটায়। হয় উত্তাল। আবার থাকে শান্ত। আর এই জলকে ঘিরেই জীবনের বিকাশ। জলেই প্রথম প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে ব্রহ্মাণ্ডে।

আবার জলকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে সভ্যতা। জলশূন্যতায় বিনাশ ঘটে জীবনের-জীবের-সভ্যতার। তবে কেবলমাত্র জলতত্ত্বই জীবনকে ধারণ করতে পারে না। তার সাথে প্রয়োজন হয় অন্যান্য তত্ত্বেরও।

সাধকের কাছে দেহ জলের ব্যবহার এক বিশেষ ক্রিয়া। এরজন্য আছে নানাবিধ করণকারণ। সাধন-ভজন-তপস্যা। সাধক ভবা পাগলা দেহ জল নিয়ে বলেছেন-

নদী ভরা ঢেউ বোঝ নাতো কেউ
কেন মায়ার তরী বাও বাও গো,
ভরসা করি এ ভব কাণ্ডারী
অবেলার বেলা পানে চাও চাও রে।।

বাইতে জাননা কেন ধর হাল
মন মাঝিটা তোর হল রে মাতাল
বুঝিয়া বলো তারে, যেতে হবে পারে,
হালটি ছাড়িয়া এখন দাও দাও রে।।

বাইতে ছিল তরী পাগলা ভবা
ভাঙা তরী জলে জলে ডুবা ডুবা,
চুবানি খেয়ে ধরেছে পায়ে
ওরে কাণ্ডারি এখন বাঁচাও বাঁচাও রে।।

অন্যদিকে ফকির লালন সাঁইজি বলছেন-

“নদী কিংবা বিল বাওড় খাল
সর্বস্থলে একই এক জল,
একা মেরে সাঁই ফেরে সর্ব ঠাঁই
মানুষে মিশিয়ে হয় বেদান্তর।।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘পঞ্চভূত’ প্রবন্ধে রূপকের ছলে অপ বা জলের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, “শ্রীমতী অপ্‌ (ইঁহাকে আমরা স্রোতস্বিনী বলিব) ক্ষিতির এ তর্কের কোনো রীতিমত উত্তর করিতে পারেন না। তিনি কেবল মধুর কাকলি ও সুন্দর ভঙ্গিতে ঘুরিয়া ফিরিয়া বলিতে থাকেন- না, না, ও কথা কখনোই সত্য না।

ও আমার মনে লইতেছে না, ও কখনোই সম্পূর্ণ সত্য হইতে পারে না। কেবল বার বার ‘না না, নহে নহে।’ তাহার সহিত আর কোনো যুক্তি নাই; কেবল একটি তরল সংগীতের ধ্বনি, একটি অনুনয়স্বর, একটি তরঙ্গনিন্দিত গ্রীবার আন্দোলন- ‘না, না, নহে নহে।’

আমি অনাবশ্যককে ভালোবাসি, অতএব অনাবশ্যকও আবশ্যক। অনাবশ্যক অনেক সময় আমাদের আর কোনো উপকার করে না- কেবলমাত্র আমাদের স্নেহ, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের করুণা, আমাদের স্বার্থবিসর্জনের স্পৃহা উদ্রেক করে; পৃথিবীতে সেই ভালোবাসার আবশ্যকতা কি নাই?

শ্রীমতী স্রোতস্বিনীর এই অনুনয় প্রবাহে শ্রীযুক্ত ক্ষিতি প্রায় গলিয়া যান, কিন্তু কোনো যুক্তির দ্বারা তাঁহাকে পরাস্ত করিবার সাধ্য কী।”

অগ্নিতত্ত্ব

সূক্ষ্মতার বিচারে পঞ্চভূতের অগ্নিতত্ত্ব অবস্থান করে মধ্যবর্তী স্থানে। এটি না পুরোপুরি সূক্ষ্ম; না স্থূল। এই হিসেবে অগ্নিতত্ত্বের অবস্থান তৃতীয়। পঞ্চভূতের মধ্যে সবচেয়ে তেজময় তত্ত্ব হলো আগুন। আগুনের বিপরীত তত্ত্ব হলো জল। জল নিম্নমুখী আর অগ্নি ঊর্ধ্বমুখী।

শব্দ, স্পর্শ, রূপ এই তিন গুণে গুণান্বিত অগ্নিতত্ত্ব। আগুনের ধর্ম আলো, গরম ও বিস্তার। আগুন সম্প্রসারিত হয়। ছড়িয়ে পরে। বিস্তার লাভ করে। আসলে ভূত যত সূক্ষ্ম তার বিস্তার করার ক্ষমতা তত বেশি। তবে আগুনের প্রধান গুণ হলো ‘রূপ’।

অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অগ্নিতত্ত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করেছন- “উষ্ণ স্পর্শবৎ তেজ:। তৎ চ দ্বিবিধং নিত্যমনিত্যং চ। নিত্যং পরমাণুরূপম্। অনিত্যং কার্যরূপম্।”

অর্থাৎ- ‘তেজ হলো সেই দ্রব্য যাতে উষ্ণ স্পর্শ থাকে। তেজ দ্বিবিধ- নিত্য ও অনিত্য। পরমাণুরূপ তেজ নিত্য, কার্যরূপ তেজ অনিত্য।’

(চলবে…)

<<পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার ।। পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়>>

………………….
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
পুরোহিত দর্পন।
উইকিপিডিয়া।
বাংলাপিডিয়া।
শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন।
পঞ্চভূত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাতাসের শেষ কোথায় : ইমরুল ইউসুফ।
ন্যায় পরিচয় -মহামহোপাধ্যায় ফনিভূষণ তর্কবাগীশ।
পঞ্চভূত স্থলম ও পঞ্চভূত লিঙ্গম- দেবাদিদেব শিবঠাকুরের খোঁজে: আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়ের।

…………………………..
আরো পড়ুন-
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এক
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দুই
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তিন
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব নয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব বারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তেরো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চোদ্দ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পনের

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!