পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত
-মূর্শেদূল মেরাজ
বায়ুর সাথেই জীবনের সম্পর্ক। বায়ু যত শুদ্ধ দেহ তত সুস্থ্য। বায়ু যত স্থির, জীব তত স্থির। যে জীবের বায়ুর গতি দ্রুত তার জীবনকাল তত কম। অন্যদিকে যাদের বায়ুর গতি যত ধীর, তাদের জীবনকাল তত বেশি। তাই ভারতীয় যোগী সাধকরা নি:শ্বাস নেয়ার নানা কৌশলের কথা বলে গেছেন। ফকির লালন সাঁইজি বলেছেন-
ধরো চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে।
সেকি সামান্য চোরা
ধরবি কোণা কানচিতে।।
পাতালে চোরের বহর
দেখায় আসমানের উপর,
তিন তারের হচ্ছে খবর
শুভা শুভ যোগ মতে।।
কোথা ঘর কেবা সেনা
কে করে ঠিকঠিকানা,
হাওয়ায় তার লেনাদেনা
হাওয়ায় মুলাধার তাতে।।
চোর ধরে রাখবি যদি
হৃদ গারদ করগে খাঁটি,
লালন কয় খুঁটিনাটি
থাকতে কি চোর দেয় ছুঁতে।।
দেহে পাঁচ প্রকার বায়ু থাকে-
- প্রাণ বায়ু-
- প্রাণ বায়ুর বিস্তার হৃদয়ে।
- প্রাণবায়ুর কাজ শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করা।
- হৃদযন্ত্র পরিচালনা ও খাদ্যবস্তু পাকস্থলীতে পাঠানো।
- প্রাণ বায়ুতেই পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি আপন আপন কর্ম করতে সক্ষম হয়।
- অপান বায়ু-
- অপান বায়ুর বিস্তার গুহ্যদেশে।
- মল, মূত্র, শ্বাস-প্রশ্বাস নিঃসরণ করে।
- সমান বায়ু-
- সমান বায়ুর বিস্তার নাভিদেশে।
- প্রাণবায়ু ও অপান বায়ুর মধ্যদেশে সমান বায়ুর স্থান।
- প্রাণবায়ুর কার্য এগিয়ে নেয় সামান বায়ু।
- উদান বায়ু-
- উদান বায়ুর বিস্তার গলদেশে।
- উদানবায়ু ঊর্ধ্বদিকে বিচরণ করে।
- উদান বায়ুর সূক্ষ্মাংশ বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তিকে পুষ্ট করে।
- ব্যান বায়ু-
- ব্যান বায়ুর বিস্তার দেহের সর্বত্র।
- ব্যানবায়ু পেশি সংকোচন ও প্রসারণে সাহায্য করে, ঘর্ম নিঃসরণ করে।
বায়ুতত্ত্বের উপাদান মোট সাত ভাগে বিভক্ত। আবার এই সাত ভাগের প্রত্যেকটি ৭টি করে মোট ৪৯ মরুৎ অবস্থান করেন। এরা হলেন-
আবহ- গন্ধবহ ত্রিশক্র, অশুগ শৈঘ্রন অদৃক্ষ, মারুত ভিত্তরের অপাৎ, পবন পবন অপরাজিত, ফনিপ্রিয় উরদ্ধ গতি ধৃব, নিঃশ্বাসক ত্যাগিন্দ্রীয় যুতির্গ, উদান উদ্গীরন সকৃৎ।
প্রবহ- শ্বাসিনী টানা মহাবল, শ্বসন শ্বাস প্রশ্বাসাদি ইন্দ্র, সদাগতি গমনাদৌগতি, প্রব্দশ্য স্পর্শশক্তি অদ্রুস্যগতি, গন্ধবাহ ইদৃক্ষ, বাহ চলন বৃতিন, বেগিঙ্কৎভোগকাম।
বেবহ- বাতব্যাক্ সংভব, প্রণতি ধারণা অনমিত্র, প্রঙ্কপন কম্পন ভীম, সমান পোষণ একজ্যোতিঃ, স্পর্শন স্পর্শ, তির্যক গমন, প্রভঞ্জন মন পৃথক সুমিত।
পরাবহ- অনু সত্যজিৎ, জগৎ প্রাণ ব্রহ্মঋৎ, পওমান ক্রিয়ার পরাবস্থ, নবপ্রাণ রূপো চিত্তহিত, মোক্ষ অস্তিমিত্র, সারড় নিত্য প্রতিবাস, স্তম্ভন সর্বব্যাপীমিত।
উদ্বহ- আকুঞ্চন প্রসারণ, উত্তরদিগের বায়ুসেনাজিৎ, নাভস্থান অপঙ্কজ অভিযুক্ত, ধুনীধ্বজ অদিমিত, কম্পনা সেচনা দর্তা, বাসদেহব্যাপী বিধারন, মৃগবাহন বিদ্যুৎ বরণ।
সম্বহ- চঞ্চল উৎক্ষেপণ দবিজ্যোতি, পৃষতাংপতি বলঙ মহাবল, ক্ষুধাকর অধগমন, অজগৎ প্রাণ জন্ম মরণ অদৃশ্য, অবাক্ ফেলা পুরিমিত্র, সমীর প্রাতঃ কালের বায়ুসত্বমিত, প্রকম্পন গন্ধের অনুকে আনে মিতাশন।
পরিবহ- বিহগ উডডীয়ান ঋতবাহ, সপ্তস্বর শব্দস্থিতি, প্রাণ বহির্গমন ত্রিশক্র, অনিল অনুস্প অশীত অক্ষয়, সমীরণ পশ্চিমের বায়ুসুসেন, অনুস্প শীতস্পর্শ পসদীক্ষ, সুখাস সুখদা দেবদেব।
ভারতীয় পুরাণ মতে, বায়ু হচ্ছে বাতাসের দেবতা, যাকে ইন্দ্রের সঙ্গী বা তার সমকক্ষ হিসেবে মনে করা হয়। তিনি সহস্র অশ্বচালিত একটি রথে আসীন। তবে বেদে বায়ুর মর্যাদা ইন্দ্র বা সূর্যের সমকক্ষ নয়। সেখানে তাকে জলদেবতা বরুণের মিত্র বলা হয়েছে।
অন্যদিকে রামায়ণে বায়ু পবন নামে পরিচিত। রামের ভক্ত হনুমানের পিতা এই পবন। মহাভারতে বায়ু ইন্দ্রের সহযোগী এবং মেনকার সাহায্যকারী। বায়ুকে অনিল (শ্বাস-প্রশ্বাস), স্পর্শন (স্পর্শকারী), গন্ধবহ (ঘ্রাণ বহনকারী), সদাগত (বর্ষব্যাপী প্রবহমান) প্রভৃতি নামেও অভিহিত করা হয়।
বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনানুসারে বায়ু আট দিকপালের একজন এবং উত্তর-পশ্চিম বায়ুকোণের দায়িত্বপ্রাপ্ত। বৌদ্ধদের মতো জৈনরাও বিশ্বাস করে যে, বায়ু একাধিক দিকপালের অন্যতম।
বিজ্ঞান বলে নানারূপ গ্যাসের মিশ্রণে বাতাস গঠিত। বায়ুর প্রধান উপাদান হলো- নাইট্রোজেন ৭৮.০৯%, অক্সিজেন ২০.৯৫%, আর্গন ০.৯৩% এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড ০.০৩%। এছাড়া বাতাসে সামান্য পরিমাণ নিয়ন, হিলিয়াম, মিথেন, ক্রিপটন, হাইড্রোজেন, জেনন এবং ওজন রয়েছে। আছে জলীয়বাষ্প ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড।
প্রবাহিত বাতাসকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা হয়-
- নিয়ত বায়ু-
- আয়ন, প্রত্যয়ন ও মেরুদেশীয় বায়ু সারাবছর একই দিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে এদের বলা হয় নিয়ত বায়ু।
- সাময়িক বায়ু-
- দিন বা বছরের নির্দিষ্ট সময়ে যে বায়ু প্রবাহিত হয় তাকে বলে সাময়িক বায়ু।
- স্থল বায়ু, সমুদ্র বায়ু ও মৌসুমী বায়ুকে একসঙ্গে সাময়িক বায়ু বলে।
- আকস্মিক বায়ু-
- ঘূর্ণবাত, প্রতীপ ঘূর্ণবাত ও টর্নেডো প্রভৃতি বায়ুকে বলে আকস্মিক বায়ু।
- স্থানীয় বায়ু-
- সিরক্কো, খামসিন ও কালবৈশাখীকে বলা হয় স্থানীয় বায়ু।
ভূমণ্ডলের বায়ুমণ্ডলের স্তরকে আবার সাত ভাগে ভাগ করা হয়েছে-
- ট্রপোস্ফিয়ার বা ঘনমণ্ডল-
- বায়ুর সবচেয়ে নিচের স্তর হলো ট্রপোস্ফিয়ার বা ঘনমণ্ডল।
- এই স্তরে জীবের বসবাস।
- এই স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
- মেঘ, বৃষ্টি সব এই স্তরে হয় বলে একে আবহাওয়া স্তরও বলা হয়।
- স্ট্রাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডল-
- ট্রপোস্ফিয়ার ওপরের স্তরের নাম স্ট্রাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডল।
- এই স্তরে মেঘ-ঝড়-বৃষ্টিও নেই।
- সাধারণত এ স্তরে বিমান চলাচল করে।
- ওজোনোস্ফিয়ার বা ওজনমণ্ডল-
- স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ওপরের স্তরের নাম ওজোনোস্ফিয়ার বা ওজনমণ্ডল।
- সূর্যের তাপ ও অতি বেগুনী রশ্মি শোষণ করে পৃথিবীর জীবজগতকে রক্ষা করে এ স্তর।
- স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ঠিক ওপর থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত এই স্তরের অবস্থান।
- মেসোস্ফিয়ার-
- এ স্তর পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫০-৯০ কিমি দূরে অবস্থিত।
- স্তরটি শীতল এবং অত্যন্ত পাতলা বায়ুর ঘনত্ব খুব কম।
- থার্মোস্ফিয়ার-
- এখানেই পৃথিবীর কৃত্রিম উপগ্রহ অবস্থান করে।
- আয়রোস্ফিয়ার বা আয়োনমণ্ডল-
- ওজোনোস্ফিয়ার উপরের স্তরের নাম আয়রোস্ফিয়ার বা আয়োনমণ্ডল।
- এই স্তর প্রায় ৩৯৬ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
- এ স্তরে বেতার তরঙ্গ প্রতিফলিত হতে পারে। হয় উল্কাপাত।
- একসোস্ফিয়ার বা বর্হিমণ্ডল-
- সবায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে ওপরের স্তরের নাম একসোস্ফিয়ার বা বর্হিমণ্ডল।
- এর পরেই মহাশূন্যের শুরু।
- ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার ওপর থেকে ৭৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এ স্তর।
- এ স্তরের বায়ু একেবারেই হালকা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘পঞ্চভূত’ প্রবন্ধে রূপকের ছলে বায়ু বা বাতাসের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, “শ্রীযুক্ত বায়ু (ইঁহাকে সমীর বলা যাক) প্রথমটা একবার হাসিয়া সমস্ত উড়াইয়া দিলেন।
তিনি বলিলেন- ক্ষিতির কথা ছাড়িয়া দাও; একটুখানি পিছন হটিয়া, পাশ ফিরিয়া, নড়িয়া-চড়িয়া একটা সত্যকে নানা দিক দিয়া পর্যবেক্ষণ করিতে গেলেই উহার চলৎশক্তিহীন মানসিক রাজ্যে এমনি একটা ভূমিকম্প উপস্থিত হয় যে, বেচারার বহু-যত্ননির্মিত পাকা মতগুলি কোনোটা বিদীর্ণ কোনোটা ভূমিসাৎ হইয়া যায়।
কাজেই ও ব্যক্তি বলে, দেবতা হইতে কীট পর্যন্ত সকলই মাটি হইতে উৎপন্ন; কারণ, মাটির বাহিরে আর-কিছু আছে স্বীকার করিতে গেলে আবার মাটি হইতে অনেকখানি নড়িতে হয়। উহাকে এই কথাটা বুঝানো আবশ্যক যে, মানুষের সহিত জড়ের সম্বন্ধ লইয়াই সংসার নহে, মানুষের সহিত মানুষের সম্বন্ধটাই আসল সংসারের সম্বন্ধ।
কাজেই বস্তুবিজ্ঞান যতই বেশি শেখ না কেন, তাহাতে করিয়া লোকব্যবহার শিক্ষার কোনো সাহায্য করে না। কিন্তু যেগুলি জীবনের অলংকার, যাহা কমনীয়তা, যাহা কাব্য, সেইগুলিই মানুষের মধ্যে যথার্থ বন্ধন স্থাপন করে, পরস্পরের পথের কণ্টক দূর করে, পরস্পরের হৃদয়ের ক্ষত আরোগ্য করে, নয়নের দৃষ্টি খুলিয়া দেয়, এবং জীবনের প্রসার মর্ত হইতে স্বর্গ পর্যন্ত বিস্তারিত করে।”
(চলবে…)
<<পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয় ।। পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট>>
………………….
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
পুরোহিত দর্পন।
উইকিপিডিয়া।
বাংলাপিডিয়া।
শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন।
পঞ্চভূত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাতাসের শেষ কোথায় : ইমরুল ইউসুফ।
ন্যায় পরিচয় -মহামহোপাধ্যায় ফনিভূষণ তর্কবাগীশ।
পঞ্চভূত স্থলম ও পঞ্চভূত লিঙ্গম- দেবাদিদেব শিবঠাকুরের খোঁজে: আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়ের।
…………………………..
আরো পড়ুন-
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এক
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দুই
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তিন
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব নয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব বারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তেরো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চোদ্দ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পনের