-মূর্শেদূল মেরাজ
স্থূলদেহের পাঁচ তত্ত্বের পঞ্চিকরণ –
পঞ্চভূতের প্রত্যেক তত্ত্বে আবার আছে পাঁচটি করে প্রতিক্রিয়া। এর একটি তার নিজস্ব বা মুখ্য বা মূল প্রতিক্রিয়া। আর অন্য চারটি হলো তার সাথে মিশে অন্য চার তত্ত্বের যৌথ প্রতিক্রিয়া। অর্থাৎ পঞ্চভূত থেকে সৃষ্টি হয় পঁচিশ তত্ত্ব। পাঁচ তত্ত্ব থেকে পঁচিশ তত্ত্বের এই যাত্রা ব্রহ্মাণ্ডেও বিরাজ করলেও তা জীব দেহে বেশি দৃষ্ট হয়-
- আকাশ তত্ত্বের পঞ্চিকরণ –
- শোক
- আকাশের মুখ্য প্রতিক্রিয়া হলো ‘শোক’।
- শোকে জীবের মন খালি বা শূন্য হয়ে যায়।
- কাম
- আকাশ আর বায়ু তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘কাম’।
- আকাশের সাথে বায়ুর চঞ্চলতা মিলে অর্থাৎ ইচ্ছার সাথে বায়ুর চলমানতা উত্তেজনা তৈরি করে।
- ক্রোধ
- আকাশ ও আগুন তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘ক্রোধ’।
- আকাশের সাথে আগুন বা তেজ মিলে অর্থাৎ বিশালতার বা শূন্যতার সাথে তেজ মিশে জন্ম নেয় ক্রোধ।
- মোহ
- আকাশ ও জল তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘মোহ’।
- কেউ কেউ মোহ বা লোভকে আকাশের মুখ্যভাগ বলে থাকেন।
- আকাশের সাথে জল মিলে অর্থাৎ আকাশের সাথে জল মিলে প্রসারিত হয়। অর্থাৎ মোহ বা লোভ প্রসারিত থেকেই থাকে। একে থামানো জলকে থামানোর মতোই কষ্টকর।
- ভয়
- আকাশ ও মাটি তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ভয়।
- আকাশের সাথে মাটির ভাগ মিলে। অর্থাৎ আকাশের সাথে মাটি মিলে জড়তা/স্থিরতা তৈরি করে। মাটি জড়তা স্বভাবের। ভয় মনে আসলেও দেহে জড়তা তৈরি করে।
- শোক
- বায়ু তত্ত্বের পঞ্চিকরণ –
- চলন
- বায়ু ও জল তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘চলন’।
- বায়ুর সাথে জল মিশে গেলে বায়ু চলতে শুরু করে।
- বলন
- বায়ু ও আগুন তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘বলন’।
- বলন মুড়ে যাওয়া। গতি পথ পরিবর্তন করা।
- ধাবন
- বায়ুর মুখ্য তত্ত্ব হলো ‘ধাবন’।
- রক্ত যেমন ধমনীতে দৌড়ে বেড়ায়।
- প্রসারণ
- বায়ু ও আকাশ তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘প্রসারণ’।
- হৃদপিণ্ডে রক্ত প্রশারিত হয়। বায়ুর সাথে আকাশ মিশে গেলে এর প্রশারতায় কোনা বাঁধা থাকে না।
- আকুঞ্চন/সঙ্কুচণ
- বায়ু ও মাটি তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘আকুঞ্চন’।
- হৃদপিণ্ডে রক্ত সঙ্কুচিত হয়। বায়ুর সাথে মাটি তত্ত্ব মিশে গেলে সঙ্কুচনের সৃষ্টি হয়। মাটি যেহেতু স্থির তাই বায়ুকে টেনে নেয়।
- চলন
- আগুন তত্ত্বের পঞ্চিকরণ –
- ক্ষুধা
- আগুন মুখ্য তত্ত্ব হলো ‘ক্ষুধা’।
- আহার যখন আগুন বা জঠর অগ্নিতে পঁচে ভষ্ম হয়। তখন নতুন খাবারের প্রয়োজনে দেহে ক্ষুধার জন্ম হয়।
- তৃষ্ণা
- আগুন ও বায়ু তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘তৃষ্ণা’।
- আগুন বায়ুতে মিশে বাষ্প হয়ে গেলে দেহে তৃষ্ণার সৃষ্টি হয়।
- অলসতা
- আগুন ও মাটি তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘অলসতা’।
- আগুনের সাথে মাটি মিশলে দেহে মনে অলসতা জন্ম নেয়।
- নিদ্রা
- আগুন ও আকাশ তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘নিদ্রা’।
- ঘুম আসলে দেহে শূন্যতা আসে। আগুনকে শান্ত করে আকাশ শূন্যতা সৃষ্টি করে।
- যখন নিদ্রা আসে তখন মন দেহ বুঝতে পারে নিদ্রা আসছে।
- যখন নিদ্রায় থাকে তখন দেহ বুঝতে পারে না মন বুঝতে পারে।
- আবার যখন নিদ্রা থেকে জাগরণ হয় তখন নিদ্রার অবস্থা দেহ মন দুইটাই বুঝতে পারে।
- কিন্তু নিদ্রাকালীন সময়ের কথা মন পুরোপুরি মনে করতে পারে না।
- কান্তি/এনার্জি/ইউমিউনিটি
- আগুন ও জল তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘কান্তি’।
- আগুনের সাথে জল তত্ত্ব মিশে নতুন করে জেগে উঠার প্রেরণা দেয়।
- জল তত্ত্বের পঞ্চিকরণ –
- শুক্র/ধাতু/বীর্য
- জলের মুখ্য তত্ত্ব ‘শুক্র’।
- দেহে জলের শেষ পরিণতি হলো ধাতু।
- রুধির/রক্ত
- জল ও মাটি তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো রক্ত।
- মাটি তত্ত্ব থাকায় রক্তের রং লাল।
- লার/লালা
- জল ও আকাশ তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘লালা’।
- এটা শুধু মুখের লালা নয়। দেহের সমস্ত লালা অর্থাৎ হাড়ের সংযোগের গ্লু বা জেলি সহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বা তন্ত্রের চারপাশে জেলির আবরণে বিভিন্ন ধরনের জেলী থাকে।
- মূত্র
- জল ও আগুন তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘মূত্র’।
- সাধারণত মূত্র গরম থাকে যখন দেহ থেকে বের হয়। মূত্রপথে সমস্যা হলে তখন জ্বালাপোরা করে। বা এসিটিক লেভেল বেড়ে গেলেও জ্বালাপোরা করে। এর আগুনের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
- স্রেদ/ঘাম
- জল ও বায়ু তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘ঘাম’।
- ঘাম হলে তা শুকিয়ে দ্রুত উড়ে যায় অর্থাৎ বায়বীয় হয়ে যায়।
- এই জলে বায়ুর উপস্থিতি বিদ্যমান।
- মাটি তত্ত্বের পঞ্চিকরণ –
- অস্থি/হাড়
- মাটির মূল তত্ত্ব ‘অস্থি’।
- দেহের সবচেয়ে কঠিন উপাদান হলো অস্থি বা হাড়।
- দেহে এটি মাটির সবচেয়ে কঠিনত্বের স্বরূপ।
- মাস/পেশী
- মাটি ও জল তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘পেশী’।
- মাস বা কোষ ভেজা থাকে তাই এতে জলের উপস্থিতি রয়েছে।
- দেহে জলের উপস্থিতি কমে গেলে চামড়ায় খসখসে হয়ে যায়।
- জল বেড়ে গেলে পাশে বা লিভারে যেমন পানি চলে আসে তেমনি বাইরে থেকে চামড়া বা ত্বকে তা বোঝা যায়।
- নাড়ী
- মাটি ও আগুন তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘নাড়ী’।
- নাড়ী দিয়ে তাপ নির্ণয় করা হয়। এতে এর আগুনের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এ্যালোপ্যাথিতে নাড়ীর বিট দেখা হলেও; আয়ুর্বেদে নাড়ীর তাপমাত্রাও দেখা হয়।
- ত্বক/চামড়া
- মাটি ও বায়ু তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘ত্বক’।
- ত্বক দ্বারা আমরা অনুভূতি পাই। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা অনুভূত হয় ত্বকে।
- ত্বক ও বায়ু স্পর্শ গুণ সম্পন্ন।
- লোম
- মাটি ও আকাশ তত্ত্ব মিলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা হলো ‘লোম’।
- আকাশ শূন্য তাই লোম কাটলে ব্যাথা লাগে না।
- তাই এটাতে শূন্যতা লক্ষণীয়।
- ক্ষুধা
পঞ্চতত্ত্বের প্রত্যেক তত্ত্ব নিজের পাঁচ তত্ত্বের এক তত্ত্ব নিজে রেখে বাকি চারটি তত্ত্ব অপর চার তত্ত্বকে দিয়ে দেয়। এতেই পঞ্চতত্ত্ব ২৫তত্ত্বে পরিণত হয়।
সূক্ষ্মদেহে পাঁচ তত্ত্বের পঞ্চিকরণ-
জীবদেহের সূক্ষ্মাবস্থায় পঞ্চভূত বিরাজ করে সূক্ষ্মরূপে।
আগুন
সূক্ষ্মদেহে আগুন অবস্থান করে ১৩ রূপে। তেরোটি আগুন দেহে বিরাজ করে-
- উদান বায়ুর আগুন
- কণ্ঠ থেকে মাথার উপরে ভাগের শেষ পর্যন্ত জায়গায় বিস্তৃত।
- প্রাণ বায়ুর আগুন
- কণ্ঠ থেকে বুকের পাজরের খাঁচা অর্থাৎ যকৃতের উপর পর্যন্ত জায়গায় বিস্তৃত।
- সামান বায়ুর আগুন
- যকৃতের উপর থেকে গুহ্দ্বার পর্যন্ত জায়গায় বিস্তৃত।
- অপ্রাণ বায়ুর আগুন
- গুহদ্বার থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত জায়গায় বিস্তৃত।
- বিহান বায়ুর আগুন
- সমগ্র দেহে বিস্তৃত।
- রস এর আগুন
- আহার দেহে প্রবেশ করে রসে পরিণত হয়। আর এই রস হয় রসের আগুনের তেজে।
- রক্তের আগুন
- দেহে রক্তের যে চলমানতা তা ঘটে রক্তের আগুনের গুণে।
- মাস বা পেশীর আগুন
- দেহে মাস বা পেশীর যে বৃদ্ধিতে কাজ করে পেশীর আগুন।
- মেদের আগুন
- দেহের মেদের যে তেজ তার মাঝে ক্রিয়া করে মেদের আগুন।
- হাড়ের আগুন
- হাড়ের বৃদ্ধি ও ক্ষয়রোধে কাজ করে হাড়ের আগুন।
- মজ্জার আগুন
- মজ্জার তরলতা ও তার বৈশিষ্ট ধরে রাখে মজ্জার আগুন।
- রতির আগুন
- রতির যে প্রবাহ, গতি তাতে থাকে রতির আগুন।
- জঠরঅগ্নি
- দেহের সকল খাদ্য পরিপাক করে জঠরঅগ্নি।
(চলবে…)
<<পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট ।। পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ>>
………………….
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
পুরোহিত দর্পন।
উইকিপিডিয়া।
বাংলাপিডিয়া।
শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন।
পঞ্চভূত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাতাসের শেষ কোথায় : ইমরুল ইউসুফ।
ন্যায় পরিচয় -মহামহোপাধ্যায় ফনিভূষণ তর্কবাগীশ।
পঞ্চভূত স্থলম ও পঞ্চভূত লিঙ্গম- দেবাদিদেব শিবঠাকুরের খোঁজে: আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়ের।
…………………………..
আরো পড়ুন-
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এক
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দুই
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তিন
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব নয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব বারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তেরো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চোদ্দ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পনের