ভবঘুরেকথা
রূপের রহস্য ইন্দ্রিয়

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য: প্রথম পর্ব

পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের ধারাবাহিক আলোচনায় এবারের বিষয় ‘রূপ ইন্দ্রিয়’ অর্থাৎ রূপের রহস্য। আর এই রূপ ইন্দ্রিয় দর্শন হয় চোখ দ্বারা। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মতো এরও কাজ অনুভবের অভিজ্ঞতা অর্জন করা। একই সাথে যা কিছু দেখা সবই স্মৃতি পটের সংস্কারে সঞ্চিত করে রাখা।

কথায় বলে ‘চোখ হলো দেহের দরজা’। সেই দরজা দিয়ে যেমন মানুষের ভেতরে প্রবেশ করে তার সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তেমনি সেই চোখ দিয়ে জগৎ দেখে জগৎ সম্পর্কেও ধারণা নেয়া যায়। এই রূপ ইন্দ্রিয় জীবকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে।

জীব কোনো কিছু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে চোখে দেখাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মানুষ কথায় কথায় বলে, নিজের চোখে না দেখে মশাই আমি কিছুই বিশ্বাস করি না। আবার চলচ্চিত্রে আদালতে দাঁড়িয়ে উকিল সাক্ষীকে বারবার প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন?’

ঘটনার যদি প্রত্যক্ষ সাক্ষী অর্থাৎ নিজ চোখে অবলোকন করেছেন এমন কাউকে পাওয়া যায়, তাহলে আসামীর পক্ষে খালাস পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। কারণ এখনো বহুদেশে তথ্য প্রমাণের চেয়ে প্রত্যক্ষ সাক্ষীর গুরুত্ব অনেক বেশি। বিচারের রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে।

প্রায় সকল বিচার-আচারেই সেই সাক্ষীকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় যে নিজ চোখে ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। পৃথিবীতে বহু দেশে এখনো প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকলে আসামীর দোষ আদালত গ্রহণই করে না। অনেক দেশে কোনো অপরাধকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার জন্য দুই জন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ সাক্ষীর উপস্থিতি অত্যাবশ্যক।

নয়তো একজন পুরুষের বিপরীতে দুই জন নারী সাক্ষী হতে হবে। অর্থাৎ পুরুষ সাক্ষী না থাকলে অপরাধ প্রমাণ করার জন্য চারজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী সাক্ষীর প্রয়োজন পরে। আবার যে দেশে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্ত রায় দেয়া হয় সেখানেও প্রত্যক্ষ সাক্ষীর কোনো ভূমিকা নেই এমনটি নয়।

প্রত্যক্ষ সাক্ষীর ভূমিকা সর্বক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। নিজের চোখে দেখা বলে একটা ব্যাপার থেকেই যায়। চোখে দেখবার মাঝে অনুভূতির যে পূর্ণতা তা অন্যকিছুতে পাওয়া দুষ্কর। যদিও প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিই আপন আপন ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ও গুরুত্ববহ। এবং ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির উপলব্ধি ঘটায়।

আবার যারা দেখতে পায় সব ঠিকঠাক তারাও কতটা দেখতে পায় সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আমরা চোখে যা দেখি প্রকৃতিতে আরো অনেক বেশি কিছু বিরাজ করে। না, অলৌকিক কোনো কিছুর কথাই বলছি না। সামান্য অণুবীক্ষণ যন্ত্রে যা ধরা পরে মানুষ তা দেখতে পায় না।

তারপরও চোখ একটি বিশেষ ইন্দ্রিয় বলেই গুরুত্ব পায়। কারণ চোখে দেখে যে অনুভূতি হয় তা হয় সরাসরি। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য থাকলেও সরাসরি অনুভূতির উপলব্ধি দেয়ায় চোখ অন্যান্য ইন্দ্রিয় থেকে এগিয়ে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

ইন্দ্রিয় সম্পর্কে সাধারণভাবে বলতে গেলে, পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জীব যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসে। বা একটা মতামত তৈরি করে। তা সে তার সঞ্চিত সংস্কারে ভিত্তিতেই করুক বা উপলব্ধির ভিত্তিতেই করুক। আর এই পঞ্চেন্দ্রিয়ের মধ্যে রূপ অর্থাৎ দৃষ্টি দ্বারা জীব সবচেয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তে চলে আসতে পারে।

শব্দ, স্পর্শ, রসগন্ধ ইন্দ্রিয় দিয়ে জীবকে সিদ্ধান্ত নিতে যতটা সময় ভাবতে হয়। তার অনেক অনেক কম সময়ে জীব দৃষ্টি দ্বারা সিদ্ধান্তে চলে আসে। তাই ইন্দ্রিয় হিসেবে চোখ বা দৃষ্টি যেমন গুরুত্ববহ। তেমনি এর ভুল ব্যবহারে জটিলতাও মারাত্মক।

কারণ মানুষ চোখ দিয়ে যা দেখে সে সম্পর্কে সে অন্য যে কোনো ইন্দ্রিয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্য থেকে অনেক বেশি ভরসা রাখে। অবশ্য দেখা মানে কেবল তাকিয়ে থাকা নয়। আবার দেখা মানেই চোখ দিয়ে দেখতে হবে তাও নয়। আসলে জীব সকল জ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারাই দেখে। কিন্তু চোখ হলো দরজা।

যা দিয়ে দৃশ্যমান বাস্তবতা দৃষ্ট হয়। তবে দৃষ্টিরও অনেক রকমফের আছে। অনেক জীবের চোখ নেই। তারপরও তারা প্রকাশ্য জগতে সাচ্ছন্ধে চলাচল করছে। আবার অনেক জীবের দৃষ্টি মানুষের মতো স্বচ্ছ নয়। তারা ঝিরঝির টিভির পর্দার মতো দেখতে পায়।

আবার মানুষ যেমন অন্ধকারে দেখতে পায় না। কিন্তু অনেক ক্ষুদ্র প্রাণীও অন্ধকারেও দিব্বি দেখে বেড়ায়। আবার মানুষের মধ্যে যারা দৃষ্টিহীন তারাও অন্য ইন্দ্রিয় দ্বারা তার অভাব পূরণ করবার চেষ্টা করে।

কিন্তু একই জিনিস একজন শিল্প বোদ্ধা দেখবেন অন্যভাবে। তিনি শিল্পের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে লক্ষ্য রেখে পুরো বিষয়টি দেখবার চেষ্টা করবেন হয়তো। আবার তিনি কোন দর্শনে বিশ্বাস করেন তার উপরও নির্ভর করবে তিনি কি দেখতে চাচ্ছেন।

আবার যারা দেখতে পায় সব ঠিকঠাক তারাও কতটা দেখতে পায় সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আমরা চোখে যা দেখি প্রকৃতিতে আরো অনেক বেশি কিছু বিরাজ করে। না, অলৌকিক কোনো কিছুর কথাই বলছি না। সামান্য অণুবীক্ষণ যন্ত্রে যা ধরা পরে মানুষ তা দেখতে পায় না।

আবার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হলে চশমা ব্যবহার করে মানুষ সমতায় এনে দৃষ্টির ভারসাম্য ঠিক রাখার চেষ্টা করে। আবার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার সবটা সকলের চোখে ধরা পরে না। গল্প-উপন্যাসের গোয়েন্দা চরিত্র যে ভাবে ঘটনার অন্তরালের ঘটনা দেখতে পায় তা অনেক জাঁদরেল চরিত্র দেখতে পায় না।

এটা গল্প-কাল্পনিকতার কথা হলেও বাস্তবও কিন্তু তাই। কারণ দেখা মানে কেবল দেখা নয়। এর সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করা। যেমন একজন চিত্রশিল্পী ক্যানভাসে তুলে ধরবার জন্য যদি কিছু দেখবার চেষ্টা করেন। তাহলে তা সাধারণ দেখা থেকে হবে ভিন্ন।

কারণ একটা প্রতিরূপ তৈরি করতে তার যা যা প্রয়োজন তার সূক্ষ্মাতীসূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে তার পর্যবেক্ষণ করতে হয়। তাকে তার দেখার প্রতিটি ব্যক্তি-বস্তু-প্রকৃতির গঠন-আকার-আয়তন-বৈশিষ্ট্য-গুণাবলী ইত্যাদি ইত্যাদি সকল কিছু সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে হয়।

অন্যদিকে একজন চলচ্চিত্র শিল্পীও হয়তো বিষয়টা একই ভাবে দেখবে। কিন্তু তাকে তা দেখবার জন্য আরো বেশকিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। কারণ পরবর্তীতে যখন এই দৃশ্যটা নতুন করে দৃশ্যায়ন করবেন তখন সেগুলো না হলে দৃশ্যটা প্রাণ হারাবে।

আবার একজন সাধারণ দর্শক সেই চিত্রশিল্পীর চিত্রপট বা চলচ্চিত্র নির্মিত শিল্পকর্ম দেখে তার ভালো লাগা বা মন্দ লাগার বিষয়টি ব্যক্ত করতে পারবে। কিন্তু ঠিক কি কি কারণে এটি শিল্প হয়ে উঠেছে বা কেনো এটিকে শিল্প বলা যায় না সে বিষয়ে তার মতামত পাওয়া মুশকিল।

কিন্তু একই জিনিস একজন শিল্প বোদ্ধা দেখবেন অন্যভাবে। তিনি শিল্পের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে লক্ষ্য রেখে পুরো বিষয়টি দেখবার চেষ্টা করবেন হয়তো। আবার তিনি কোন দর্শনে বিশ্বাস করেন তার উপরও নির্ভর করবে তিনি কি দেখতে চাচ্ছেন।

সাধারণত মানুষ চোখে দেখে চট্ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে চলে আসে। তাই মানুষের এই দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে যুগে যুগে নানা আয়োজন যেমন করেছে শাসক ও নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠী। তেমনি নানা কলা-কৌশল সৃষ্টি করেছেন বিনোদন শিল্পীরা। আবার বহুবিধ কলা-কৌশল বানিয়েছে ভণ্ড-প্রতারক-জোচ্চরা-জালিয়াতরাও।

একই শিল্প কিছু মানুষের কাছে অসম্ভব ভালো লাগা অনুভূতি দিতে পারে। তারা দেখে তাদের মুগ্ধতা ব্যক্ত করতে পারে। আবার কিছু মানুষ তা দেখে বলতে পারে- এতো একেবারেই অখাদ্য। এসব কিছুই হয়নি। এভাবে বলতে গেলে বলা শেষ হবে না।

মোট কথা তাকিয়ে থাকা মানেই দেখা নয়। বা দেখা মানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাও নয়। আবার কার দৃষ্টিশক্তি কেমন তার উপরও দেখবার ভঙ্গি নির্ভর করে। আবার কার স্থিরতা কতটা তার উপরও দৃষ্টিপাত নির্ভর করে। যেমন গুরু দ্রোণাচার্য যখন বললেন, অর্জুন তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?

শিষ্য অর্জুন বললো, গুরুজী আমি কেবল পাখির চোখ দেখতে পাচ্ছি।

অন্যরা যারা সকলেই দ্রোণাচার্যের শিষ্য সকলেই তুখড় তীরন্দাজ। একই প্রশ্নের জবাবে তাদের উত্তর ছিল ভিন্ন। কেউ কেউ বলেছিল, সে একটা পাখি দেখতে পাচ্ছে। কেউ বলেছিল একটা গাছের শাখায় একটি পাখি বসে আছে প্রভৃতি।

এই শিল্পের মূল কথা হলো, ‘মানুষের মস্কিষ্কের গঠন অনুসারে বেশিরভাগ মানুষই সকল বিষয়কে জটিল করে ভাবতে ভালোবাসে। তাই জাদুশিল্পের ভাষা হলো সহজ। কিন্তু মানুষ সেই সহজ পথে না হেঁটে জটিল মনোস্তাত্ত্বিক জটিলতা দিয়ে তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যা ঘটছে তা না দেখে, তাকে যা দেখনো হচ্ছে তা দেখে।

কিন্তু অর্জুনের দৃষ্টি ছিল স্থির। তাই সে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই দেখেছিল। অর্থাৎ তার দৃষ্টি ছিল মূল লক্ষ্যে। কিন্তু অন্যদের সেই দৃষ্টির স্থিরতা ছিল না বিধায় তারা মূল লক্ষ্য ছাড়াও আরো আনেক বিষয়ে মনোযোগী হয়েছিল।

বাস্তবিক জীবনে আমরাও তাই করি। আমরা মূল বিষয়ে ফোকাস করতে পারি না। অর্থাৎ আমরা তাকিয়ে থাকি বটে কিন্তু যা দেখবার তা দেখতে পাই না। আমরা বিভ্রান্ত হই আশপাশের অন্যান্য বিষয় বাসনায় ডুবে। আর সঞ্চিত সংস্কারের বোঝা তো রয়েছেই।

সাধারণত মানুষ চোখে দেখে চট্ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে চলে আসে। তাই মানুষের এই দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে যুগে যুগে নানা আয়োজন যেমন করেছে শাসক ও নিয়ন্ত্রণ গোষ্ঠী। তেমনি নানা কলা-কৌশল সৃষ্টি করেছেন বিনোদন শিল্পীরা। আবার বহুবিধ কলা-কৌশল বানিয়েছে ভণ্ড-প্রতারক-জোচ্চরা-জালিয়াতরাও।

কারণ দৃষ্টি বিভ্রম ঘটিয়ে মানুষকে বোকা বানানো বেশ সহজ।

বিনোদন শিল্পীদের মধ্যে জাদুশিল্প নিয়ে এ প্রসঙ্গে একটু বলতে হয়। আদি সমাজ থেকেই জাদুবিদ্যা বলে একটা কথা চলে আসছে। বিশ্বাসীরা বলে মন্ত্রবলে জাদু করে জাদুকরেরা আশ্চর্য সব কাণ্ড ঘটাতে পারে। তবে পরবর্তীকালে এতে নানাবিধ কলাকৌশল সংযোজন করে একে শিল্পে পরিণত করা হয়।

এই শিল্পের মূল কথা হলো, ‘মানুষের মস্কিষ্কের গঠন অনুসারে বেশিরভাগ মানুষই সকল বিষয়কে জটিল করে ভাবতে ভালোবাসে। তাই জাদুশিল্পের ভাষা হলো সহজ। কিন্তু মানুষ সেই সহজ পথে না হেঁটে জটিল মনোস্তাত্ত্বিক জটিলতা দিয়ে তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যা ঘটছে তা না দেখে, তাকে যা দেখনো হচ্ছে তা দেখে।

অর্থাৎ তার সামনে এমন এক আবহ তৈরি করা হয় যে, মানুষ বোকা হয়েও আনন্দে ফেটে পরে। সে জানে এর পেছনে একটা কৌশল আছে কিন্তু সে তা ধরতে পারে না। অথচ সবই তার চোখের সামনে ঘটছে।

(চলবে…)

পরবর্তি পর্ব: জ্ঞানেন্দ্রিয়: রূপ : রূপের রহস্য : দ্বিতীয় পর্ব >>

…………………………
আরো পড়ুন:
রূপের রহস্য: পর্ব-১
রূপের রহস্য: পর্ব-২
রূপের রহস্য: পর্ব-৩
রূপের রহস্য: পর্ব-৪
রূপের রহস্য: পর্ব-৫
রূপের রহস্য: পর্ব-৬
রূপের রহস্য: পর্ব-৭
রূপের রহস্য: পর্ব-৮
রূপের রহস্য: পর্ব-৯
রূপের রহস্য: পর্ব-১০

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!