ভবঘুরেকথা
রসের ভুবন

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয়: রস : রসের ভুবন: প্রথম পর্ব

সোনার মানুষ ভাসছে রসে।
যে জেনেছে রসপান্তি
সেই দেখিতে পায় অনাসে।।

তিনশো ষাট রসের নদী
বেগে ধায় ব্রহ্মাণ্ড ভেদি,
তার মাঝে রূপ নিরবধি
ঝলক দিচ্ছে এই মানুষে।।

মাতাপিতার নাই ঠিকানা
অচিন দেশে বসতখানা,
আজগুবি তার আওনা-যাওনা
কারণবারির যোগ বিশেষে।।

অমাবস্যায় চন্দ্র উদয়
দেখিতে যার বাসনা হৃদয়,
লালন বলে, থেকো সদাই
ত্রিবেনীর ঘাটে বসে।।

ফকির লালন সাঁইজির এই পদটা দিয়েই শুরু করছি এবারের ইন্দ্রিয়ের আলোচনা ‘রস’। রস ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি মানুষ নিয়ে থাকে জিহ্বা দ্বারা। যখন জিহ্বা কোনো কিছুর সংস্পর্শে আসে তখন আমরা স্বাদের অনুভূতি নিতে পারি। সহাজ ভাষায় বলতে গেলে, জিহ্বা দিয়েই আমরা স্বাদ আস্বাদন করে থাকি।

রসের ভুবনে জিহ্বা মূলত আমাদের স্বাদেন্দ্রিয়। আভিধানিক অর্থে স্বাদ অর্থ আস্বাদ, রসনা দ্বারা স্পর্শ করে অনুভূতি, আস্বাদন, খাদ্য বস্তুর তার বা তিক্ত-কটু-কষায়-মধুরাদি গুণের অবধারণ, মর্মগ্রহণ, রসগ্রহণ প্রভৃতি।

আলংকারিক বিশ্বনাথ কবিরাজ বলছেন-

রস্যতে ইতি রস। (সাহিত্যদর্পণ- ১/৩)

অর্থাৎ যা আস্বাদন করা যায় তাই-ই রস।

নগেন্দ্রনাথ বসুও তার ‘বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে রস প্রসঙ্গ লিখেছেন- ‘রসেন্দ্রিয় দ্বারা যে বস্তুর আস্বাদ গ্রহণ করা যায় তাহার নাম রস।’

‘শব্দসমর্প্যমাণ হৃদয়সংবাদ সুন্দরবিভাবানুভাব সমুদিত প্রাঙনিবিষ্টরত্যা দিবাসনানুরাগসুকুমার স্বয়ং বিদানন্দ চর্বণব্যাপার-রমনীয় রূপো রস:।’ (ধ্বন্যালোক, লোচন ১/৪)

অর্থাৎ রস হচ্ছে নিজের আনন্দময় সম্বিতের আস্বাদরূপ একটি ব্যাপার। মনের পূর্ব নির্দিষ্ট রতি প্রভৃতি ভাবের বাসনা দ্বারা অনুরঞ্চিত সমবিত আনন্দময় সৌকুমার্য প্রাপ্ত হয়।’

প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে স্বাদ হলো ৬টি- অম্ল, মধুর, তিক্ত, লবণাত্মক, কষায় এবং কটু। তবে জানা যায়, গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল দাবি করেছিলেন- সকল স্বাদই মিষ্ট ও তিক্ত দুইটি মৌলিক স্বাদ দিয়েই তৈরি।

তবে বিজ্ঞান মৌলিক স্বাদ হিসেবে মিষ্ট, টক, নোনতা ও তিতা এই চার পদের স্বাদকে উল্লেখ করে থাকে। পরবর্তীতে অবশ্য পঞ্চম স্বাদ হিসাবে স্বীকৃতি পায় উমামি নামক স্বাদ।

আমরা পেট পুজার জন্য মজাদার সব আহার গ্রহণ করলেও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো স্বাদ আমরা কেবল জিহ্বা পর্যন্তই পাই। জিহ্বা অতিক্রম করে খাবার গ্রহণ গলা হয়ে খাদ্যনালীতে নামতে শুরু করে তার আর কোন স্বাদ সেভাবে আমরা বুঝতে পারি না।

ডাক্তারি ভাষায়, জিহ্বার রং দেখে চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যগত কিছু তথ্য বলে থাকে। জিহ্বার রঙের পরিবর্তন দেখে দেহের কোথায় সমস্যা হয়েছে ভেষজবিদরাও তা বুঝবার চেষ্টা করেন অনেক ক্ষেত্রে।

জিহ্বার সাহায্যে আমরা প্রধানত স্বাদ গ্রহণ করলেও, এখানেই তার কার্য শেষ হয় না। এই স্বাদেন্দ্রিয়ের সাহায্যে স্বাদ ছাড়াও ঠাণ্ডা, গরম, চাপ ও স্পর্শ অনুভূত হয়। এছাড়াও জিহ্বা কথা বলা, খাদ্য চর্বণ এবং খাদ্য গলাধঃকরণে সহায়তা করে।

মানুষের মুখবিবরের মাঝে অবস্থিত জিহ্বা ঐচ্ছিক পেশি দ্বারা গঠিত। এর উপরি তল কর্কশ আর তলদেশ মসৃণ। এটি একটি পাতলা শ্লৈষ্মিক ঝিল্লি দ্বারা আবৃত। বিজ্ঞানের হিসাব মতে, মানুষের জিহ্বার উপরিভাগে স্বাদ গ্রহণকারী প্রায় দশ সহস্রাধিকের বেশি স্বাদকোরক থাকে।

এই স্বাদকোরকের মধ্যে থাকে স্বাদগ্রাহী ও ধারক কোষ। আর এর সাহায্যে আমরা জিহ্বার অগ্রভাগে মিষ্ট, পশ্চাদভাগে তিক্ত স্বাদ; অগ্রভাগের কিছুটা ভেতরে ও মধ্যখানে নোনতা এবং দুই পাশে অম্ল স্বাদ ইত্যাদি গ্রহণ করে থাকি।

কোনও কিছু যখন জিহ্বার নির্দিষ্ট স্বাদকোরকের সংস্পর্শে আসে তখন তা সেই স্বাদের রসকে উদ্দীপ্ত করে। আর সে একটি বার্তা স্নায়ুপথে মস্তিষ্কের স্বাদ কেন্দ্রে পাঠায়। এর ফলে স্বাদটি অনুভূত হয়।

বলা হয়ে থাকে, মানুষের জিহ্বার গড় দৈর্ঘ্য ১০ সেন্টিমিটার। আর এর স্বাদগ্রন্থিগুলো প্রতি সপ্তাহ দুয়েক অন্তর অন্তর মরে গিয়ে আবার নতুন করে গজায়। সাধারণত স্বাস্থ্যকর জিহ্বায় দারুণ গোলাপী আভা থাকে।

ডাক্তারি ভাষায়, জিহ্বার রং দেখে চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যগত কিছু তথ্য বলে থাকে। জিহ্বার রঙের পরিবর্তন দেখে দেহের কোথায় সমস্যা হয়েছে ভেষজবিদরাও তা বুঝবার চেষ্টা করেন অনেক ক্ষেত্রে।

রসের আক্ষরিক অর্থ ‘আস্বাদনীয়’ বা ‘রসনাগ্রাহ্য’ গুণবিশেষ। এই বিচারে রস ছয় প্রকার। একে একসাথে ষড়রস বলা হয়। এগুলো হলো-

১. মধুর (মিষ্ট): মধুর রস সাধারণ বিচারে তৃপ্তিকর সংবেদন স্বাদ। এই রস চিনিসহ কয়েকটি পদার্থের সমন্বয়ে উৎপাদিত। প্রকৃতিক বিভিন্ন খাবার থেকে এই রস পাওয়া যায়। আবার প্রকৃতি থেকে এর সার সংগ্রহ করে প্রস্তুতকৃত নানা খাবারে তা ব্যবহৃত হয়। খাবারের মধ্যে মধুর রসের খাবারের চাহিদা ব্যাপক।

প্রকৃতি থেকে আহরিত মধুর খাবারের মধ্যে- মধু, আখ, তালের রস, খেজুরের রস উল্লেখযোগ্য। আবার প্রস্তৃতকৃত খাবারের মধ্যে বাঙালীদের মাঝে নানা প্রকারের মিষ্টান্ন বেশ ঐতিহ্যবাহী। এর মধ্যে পায়েস, ক্ষীর, পিঠার কথা না বললেই নয়। আর অনবদ্য সৃষ্টি রসগোল্লা তো রয়েছেই।

২. অম্ল (টক): টক একটি স্বাদ যাতে অম্লত্ব অনুভূত হয়। কোন বস্তুর টক স্বাদকে পরিমাপ করা হয় লঘু হাইড্রক্লোরিক এসিডের সাপেক্ষে, অম্ল সূচকে যার অবস্থান এক।

টক স্বাদের খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- তেঁতুল, আমড়া, টক বড়ই, জলপাই, করমচা, কামরাঙা, কাঁচা আম প্রভৃতি। তেঁতুল নিয়ে প্রচলিত মত আছে, এর নাম শুনলেই নাকি জিহ্বায় জল চলে আসে।

৩. লবণাক্ত (নোনতা): সোডিয়াম আয়নের উপস্থিতিতে প্রাথমিকভাবে নোনতা স্বাদ অনুভূত হয়। ক্ষার ধাতুর অন্যান্য আয়নেও লবণ স্বাদ আছে, কিন্তু সোডিয়াম থেকে তা কম লবণাক্ত।

একসময় ভারতবর্ষে খনিজ লবণের ব্যবহার অধিক মাত্রায় হলেও বর্তমানে সামুদ্রিক লবণের চাহিদা বেশি।

৪. তিক্ত (তিতা): তিক্ততা অত্যন্ত সংবেদনশীল স্বাদ এবং অনেকে এটাকে অনুপভোগ্য, উৎকট বা অসহনীয় উপলব্ধি করে।

প্রচলিত তিক্ত খাবার ও পানীয়র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চিরতা কাণ্ড, গুলঞ্জ লতা, কুইনাইন, লেবুজাতীয় ফলের খোসা প্রভৃতি।

৫. কষায় (কশ): কশ জাতীয় খাবার। কষায় জাতীয় খাবারের মধ্যে- কলার মোচা, কলার থোড়, কাঁচকলা, ডুমুর প্রভৃতি।

৬. কটু (ঝাল): একসময় ভারতবর্ষে কটু বা ঝাল জাতীয় খাবারের অন্যতম ছিল গোলমরিচ ও পিপুল। পরবর্তী বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নানা প্রকারের মরিচ বা লঙ্কা এই তালিকায় জায়গা করে নেয়। পাশাপাশি ঝাল হিসেবে চুঁইঝাল বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

উমামি স্বাদযুক্ত আরেক ধরনের স্বাদের কথা বিজ্ঞান উল্লেখ করে। যা প্রধানতঃ একটি ক্ষুধাবর্ধক স্বাদ এবং একে সুগন্ধী গন্ধযুক্ত স্বাদ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এই স্বাদ পনির এবং সয়া সসে পাওয়া যায়।

আবার একটি খাবারে যে কেবল একই স্বাদের রস বিরাজ করে তাই নয়। একই সাথে একটি খাবারে একাধিক স্বাদও অনুভূত হতে পারে। যেমন- আমলকী, আম, লটকন প্রভৃতি।

আবার একই খাবার বিভিন্ন বিভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে প্রস্তুত করলে তার স্বাদ পাল্টে নতুন কোনো স্বাদ দিতে পারে।

(চলবে…)

……………………..
আরো পড়ুন:
রসের ভুবন: পর্ব-১
রসের ভুবন: পর্ব-২
রসের ভুবন: পর্ব-৩
রসের ভুবন: পর্ব-৪
রসের ভুবন: পর্ব-৫
রসের ভুবন: পর্ব-৬
রসের ভুবন: পর্ব-৭
রসের ভুবন: পর্ব-৮
রসের ভুবন: পর্ব-৯
রসের ভুবন: পর্ব-১০

………………………………
তথ্যসূত্র
কাব্যতত্ত্বঅন্বেষণা-নরেন বিশ্বাস।
সাহিত্য সন্দর্শন-শ্রীশ চন্দ্র দাশ।
বৈষ্ণব রস-প্রকাশ: ক্ষুদিরাম দাস।
বিশ্বকোষ : নগেন্দ্রনাথ বসু।
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড): আশুতোষ ভট্টাচার্য।
উইকিপিডিয়াসমূহ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!