সাধক ভবা পাগলা
-মাসফিক সোয়াদ
এসেছি হেথায় তোমারি আজ্ঞায়,
আদেশ করিবা মাত্র যাবো চলিয়া।
পরমে পরম জানিয়া…
এই পদটিতে সুর লাগালে মরমী অনুরাগীদের হৃদয়ে যে নামটি নাড়া দেয় তিনি ভবা পাগলা। প্রকৃত নাম ভবেন্দ্র মোহন চৌধুরী। তার পিতা শ্রী গজেন্দ্রমোহন রায় চৌধুরী আর মাতা শ্রী গয়াসুন্দরী দেবী চৌধুরানী। ঢাকার অদূরেই ধামরাই থানার আমতা গ্রামে এই মহান সাধকের জন্ম। কোনো এক ভক্ত আসরে নিজের পরিচয় প্রদান করে ভবা পাগলা বলেছিলেন –
“পূর্ব বঙ্গের ঢাকার গর্ভে গর্বিত গ্রাম আমতা।
সেই গায়ে জনম মোর, পিতা গজেন্দ্র , গয়ামাতা।
বাঁচন মরণ এই দুই কূল, সমাজ অমর ধাম।
সেই সমাজের অধিকারী মুই, ভবা পাগলা মোর নাম।”
আমতা গ্রামের সাহা চৌধুরীরা ছিলেন সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবার। কৃষঙ্কান্ত সাহা চৌধুরীর তিন পুত্রের মধ্যে মেজো ছিলেন গজেন্দ্রমোহন রায় চৌধুরী। গজেন্দ্রমোহন রায় চৌধুরী এবং গয়াসুন্দরী দেবীর সাত সন্তান।
গয়াসুন্দরী দেবী প্রথম এক পুত্রসন্তান ও তিন কন্যা সন্তান জন্মদেবার পর পুনঃবার অন্তঃসত্ত্বা হন। সেবার আশ্বিন মাসের এক শুভলগ্নে পরপর দুটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। প্রথমজনের নাম দেবেন্দ্র আর দ্বিতীয় জনের নাম রাখা হয় ভবেন্দ্র। এই ভবেন্দ্রই আজকের মহাসাধক ও মরমী গুরু ভবা পাগলা।
ধারণা করা হয়, তার জন্ম ৩১ আশ্বিন ১৩০৭ বঙ্গাব্দে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমা তিথিতে, ইংরেজিতে ১৯০০ সালের অক্টোবর মাসে। ভবা পাগলা দেখতে ছিলেন চিকন-পাতলা গড়নের মানুষ, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা, মাথায় বড়বড় চুল আর থুঁতনিতে একগোছা দাঁড়ি। পোশাকআশাক বলতে একটি লালবস্ত্র সর্বদা পরিধান করতেন। মাঝে মাঝে একটি নীলবস্ত্রও গায়ে চাপাতেন। হাতে থাকতো সোনায় মোড়ানো লাঠি। ভক্তরা তাতে নানা ধরনের অলঙ্কার জুড়ে দিতেন।
ভবা পাগলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ জন্মস্থান আমতা গ্রামেরই ‘আমতা এমই’ স্কুলে। বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তিনি পড়ালেখায় খুব একটা উদ্যোগী ছিলেন না। তিনি বিরাজ করতেন তার নিজস্ব ভাবজগতে। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় ভবা অংকে শুন্য পান। পরবর্তিকালে তার একটি গানে বিদ্যালয়ের এই অংক বিষয়ে শুন্য পাবার ভাবনাকে তার চিন্তার ব্যাকুলতায় প্রকাশ করেন–
“মন তুমি অঙ্কে করিলে ভুল।
যোগাশনে বসে যোগ শিখে নাও,
যোগেশ্বরী যোগের মূল।।
বিয়োগ হইবে বিষয় বাসনা,
বিয়োগ শিখতে কষ্ট পাবেনা।
বিয়োগ শিখাবে অনুরাগে গোনা,
আপনি ফুটিবে পুরনেরই ফুল।।”
গজেন্দ্রমোহনের জ্যেষ্ঠ পুত্র গিরীন্দ্রমোহন ব্যবসায়ীক সূত্রে স্বপরিবারে কোলকাতা থাকতেন। গিরীন্দ্রমোহন ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে ভবাকে নিয়ে যান কোলকাতায়। সঙ্গে যান দেবেন্দ্রও। তাদের ভর্তি করানো হয় ‘ক্যালকাটা এরিয়ান্স’ স্কুলে। ভাইদের সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ লক্ষ করে তাদের কীর্তন দলে অন্তর্ভুক্ত করে দেন।
অল্প দিনে তাদের এই কীর্তন দলের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পরতে থাকে। স্বভাবতই কোলকাতার স্কুলেও ভবার পড়াশোনার কোন অগ্রগতি দেখা যায় নি। এই সময় শ্রীক্ষেত্রে তীর্থ পর্যটনে গিয়ে পিতা গজেন্দ্রমোহনের মৃত্যু ঘটে। এরপর ভবার শিক্ষার সুব্যবস্থার জন্য মায়ের পরামর্শ মতে গিরীন্দ্রমোহন তাকে আমতা গ্রামে নিয়ে আসেন।
আমতা থেকে পাঁচমাইল দূরবর্তী পাঁকুটিয়া গ্রামের আবাসিক স্কুলের তাকে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানেও ভবার পড়াশোনা ঠিকঠাক ভাবে আগায়নি। তবে ভবার কোমল ও মধুর ব্যবহার আর গানে শিক্ষকরা মুগ্ধ হতেন। তখনি ভবার নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এরই মাঝে পাঁকুটিয়া স্কুলের পঠনের পর্ব ক্রমশ শিথিল হতে থাকে। আনুমানিক ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে ১৫ বছর বয়সে ভবা পাগলার শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে।
ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে ভবা ছিলেন কালী সাধক। ধামরাইয়ের নিজ বাড়িতে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেখানেই গিয়েছেন সঙ্গে ছিল কালী মা। বাংলাদেশ ও ভারতে মিলে মোট সাতটি কালীমন্দির স্থাপন করেন তিনি।
এরপর আরেক ভক্ত তাকে বর্ধমানের কালনায় নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে জমি কিনে তিনি স্থাপন করেন একটি কালীমূর্তি। এরপর আর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন নি।
পাঁকুটিয়া স্কুলের পড়ার সময়ই ভবা গড়ে তোলেন নিজের গানের দল। তাই নিয়ে বিভিন্ন গানের আসরে মাতাতে থাকেন ভবা। ত্রিশ বছর বয়সে মা গয়াসুন্দরীর আদেশে সংসারী হতে সম্মত হন। বিবাহ করেন দশ বছর বয়সী শৈবলিনীকে। তারই মধ্যে চলে সঙ্গীত রচনা, পরিবেশনা এবং ভক্তবৃন্দের যাতায়াত।
১৯৪৭-এর দেশভাগের পর ভবা পাগলাকেও ভাবতে হয় দেশ ছাড়ার কথা। আনুমানিক ১৩৫৭ সালের আষাঢ় মাসে তিনি গৃহত্যাগ করেন। তারও একমাস আগে স্ত্রী-পুত্রকন্যাকে ভক্তদের সাথে পাঠিয়ে দেন কোলকাতা। এই সময়ে তিনি সঙ্গে নেন তার ঘনিষ্ট ভক্তদের সেই সাথে তার প্রিয় কষ্টি পাথরের কালীমূর্তিটি।
গিয়ে ওঠেন শোভাবাজারে ভক্ত ফটিকের বাড়িতে। এরপর আরেক ভক্ত তাকে বর্ধমানের কালনায় নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে জমি কিনে তিনি স্থাপন করেন একটি কালীমূর্তি। এরপর আর তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন নি।
জাত-পাতে অবিশ্বাসী ভবার কাছে অন্তরের শুচিতাই ছিল গানের মূল আলেখ্য। তাইতো অক্লেশে তিনি লিখতে পেরেছেন– “দূর করে দে মনের ময়লা।”
ছেলেবেলা থেকেই পরিবারের সহবতে, ভক্তিভাব ছিল ভবার সঙ্গী। গ্রাম্য ভাষায় মুখে মুখে গান বাধা স্বভাব ছিল ভবার। গানের কথার সাথে সুর মিলতো দুই প্রিয় সহচরীর মতো। গানের স্রোতে তারা খেলে বেড়াতো স্বকীয়তায়। অন্তরের সবচেয়ে গভীর জমিতে গড়ে তুলতো অন্তর্যামীর আশ্রয়। বাংলার সঙ্গীত জগতে তো বটেই, বিশ্বের নিরিখেও ভবা পাগলা এক অনন্য নজির।
তার গান মানিকগঞ্জ জেলাসহ বাংলাদেশ ও ভারতে বিভিন্নস্থানে পরিচিতি লাভ করে ও গীত হয়ে আসছে। তিনি অসংখ্য শ্যামা সঙ্গীত, ভাব, গুরুতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, ও সৃষ্টিতত্ত্বের গান রচনা ও সুর করেছেন। জাত-পাতে অবিশ্বাসী ভবার কাছে অন্তরের শুচিতাই ছিল গানের মূল আলেখ্য। তাইতো অক্লেশে তিনি লিখতে পেরেছেন– “দূর করে দে মনের ময়লা।”
ভবা তার গানের ভনিতায় ‘ভবা পাগলা’ ব্যবহার করলেও অনেক গানে তিনি ভিন্ন ভিন্ন ভনিতা যুক্ত করেছেন। প্রথম দিকের সঙ্গীতে তিনি ভবেন্দ্র, ভবেন, ভবা এই সকল ভনিতা ব্যবহার করতেন। পরবর্তীকালে তিনি ভবা, ভবা পাগলা, পাগলা ভবা এসব ভনিতা ব্যবহার করেন।
পদ্মার এপার আর গঙ্গার ওপারের গান, দুই বাংলার চেতনাকে, একই মালায় বেঁধে রেখেছে। একজন গায় লালন আর একজন শীতল হয় রবীন্দ্রনাথে। ভবার গানেও মিশে যায় বিষাদ-অভিমান। পরিচয় ঘটে নিজের আত্মার সাথে।
পাগল সম্প্রদায়ের প্রবর্তক ভবা কোন পার্থিব গুরু ছিলেন না। ভবার সাধন জীবনে অলৌকিক দীক্ষার কথা লোকমুখে শ্রুত হয়। ঘটনাচক্রে ভবা পাগলা একবার নন্দলাল দাস নামের এক দূরারোগ্য রুগীকে ঠিক করে দেন। এই ঘটনার পরবর্তী সময়ে অনেকেই ভবাকে ঈশ্বররূপে পূজা করতে থাকেন। প্রতিষ্ঠা পায় ভবার হরবোলা মন্দির। ১৯৮৪ সালে মহান এই সাধক দেহত্যাগ করেন। তবে বাংলা লোকসংগীত যতদিন থাকবে ততদিন বারে বারে বলতে হবে –
“বারে বারে আর আশা হবে না।”
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………..
আরও পড়ুন-
সাধক ভবা পাগলা
শাহ্ আব্দুল করিম : জীবনী ও গান
সাধক রাধারমণ দত্ত
মহর্ষি মনোমোহন ও মলয়া সঙ্গীত
মোহন চাঁন বাউল
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: এক
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: দুই
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: তিন
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-১
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-২
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৩
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৪
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৫
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৬
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৭