ভবঘুরেকথা
জন্মান্তরের লীলা চুরাশির ফেরে

-শংকর চন্দ্র পাল

আমাকে যদি আমার কর্মফল নিজের ভোগের মাধ্যমেই শোধ করতে হবে, তবে ভগবানকে দিয়ে আমার কি প্রয়োজন থাকতে পারে?

সনাতন ধর্মের মতে, জীবজগতে চুরাশি লক্ষ জীবযোনি ভ্রমণরত থাকে। এখানেই জীবের উপার্জিত কর্মফল অনুযায়ী প্রমোশন ও ডিমোশনের হিসাব অনুসারে কেহ অধঃস্তর আবার কেহ উর্দ্ধস্তর গতি লাভ করে। মোদ্দাকথা জীবের আত্মা অণু কীটপতঙ্গের থেকে শুরু করে স্থাবর বৃক্ষাদি পর্যন্ত উন্নত ও অনুন্নত যত প্রকার জীব রয়েছে কর্মফলের দায়ে এক এক করে সে সকল যোনিতে পরিভ্রমণ করে থাকে।

ভব সংসার সমুদ্রে অণ্ডজ, জরায়ুজ, বৃক্ষজ, স্বেদজ, এই চতুর্বিধ জীবের আবাসে বিচরণ করে থাকে একমাত্র নিজের কর্মফলের ক্ষয় করে মুক্তি লাভের জন্য। আমার প্রশ্ন এখানে, জীবের কর্মের দ্বারা উৎপাদিত মন্দ ফলে পাপ সঞ্চয় হয়, সেই পাপ খণ্ডনের জন্য শাস্তি বা নরক অথবা চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমণ যেটাই হোক, ভোগ করেই যদি পাপের ক্ষয় করতে হয়।

তবে ঈশ্বর বা ভগবানের এত প্রকারের আরাধনা বা উপাসনা করার কি আবশ্যকতা থাকতে পারে? আমার দায় বা দেনা আমাকেই শোধ করতে হয় তবে তৃতীয় পক্ষের আর দরকার থাকে না।

যদি বিষয়টি এই ভাবে দেখি তবে জগতে কেহই ঈশ্বরের শরণাপন্ন হত না। ঈশ্বরের প্রয়োজন এ কারণে যে, কোন প্রকারে যদি কোন সৌভাগ্যবান পরমেশ্বর ভগবানের সাক্ষাৎ লাভ বা সান্নিধ্যে আসতে পারে তাহলে তার সমুদয় কর্মই নাশ হয়ে যায়। প্রারদ্ধের দায় মওকুফ হয়ে যায়।

তাই সৃষ্টির প্রথম থেকেই মানুষের এই প্রয়াস। এই আত্মতত্ত্বজ্ঞান লাভ করা বড়ই দুঃসাধ্য। ভ্রমিতে ভ্রমিতে জীব সাধুসঙ্গ পায়, লাভ মাত্র সাধুসঙ্গ সর্বসিদ্ধ হয়। চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমণরত জীব যতক্ষণ পর্যন্ত নিস্কিঞ্চন সাধুর চরণ রজ রেনু দ্বারা পরিপূর্ণভাবে পরিস্নাত না হতে পারে ততক্ষণ তার আত্মতত্ত্ব জ্ঞান লাভ হয় না।

গীতার ভাষ্যানুযায়ী,

‘হুনাং জনমান্তে জ্ঞানবান মাং প্রপদন্তে।’

বাসুদেব সর্বমিতি স মহাত্মা সু-দুর্লভ। অর্থাৎ বহুজনমের পরিভ্রমণ শেষে জ্ঞানবান জীব বুঝতে সক্ষম হয় যে ভগবানই সবকিছুর মূল। এরূপ জেনেও সবাই সে ভগবানের শরণাগত হয় না। কেহ কেহ হয়তো তাকে পাওয়ার চেষ্টা করে, সে চেষ্টাকারীরগনের মধ্যে দু’ একজন ভগবানকে লাভ করে। যিনি ভগবানকে লাভ করেন তারি কর্মের বন্ধন মুক্ত হয়ে যায়।

মুক্তি মানে পুনঃপুন জন্ম ও মরণ থেকে নিস্কৃতি পাওয়া। প্রারদ্ধের দায় ভোগের জন্যই মরজগতে জীবের চির গতায়তের ধারা যা স্রষ্টার সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংস এই ত্রিবিধ প্রক্রিয়া সংগঠিত করে থাকে। সকল জীবাত্মা যদি চতুর্বিধ মুক্তি (সালোক্য, সারূপ্য, সামিপ্য ও সাষ্টি) লাভ করে বৈকুণ্ঠে আশ্রয় লয় তবে জম্বুদ্বীপের কি হবে।

এ এক অন্য রকম ভাবনা, এর সঠিক কোন কিনারায় পৌঁছা অতীব দূরহ বিষয়। বিশ্ব সংসার তো অলেক সাঁইয়ের নন্দন কানন। নিজে স্বয়ং আস্বাদন লালসে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি প্রক্রিয়া অব্যাহত না থাকিলে তাঁর কোন কাজ থাকে না।

এখন আমার প্রশ্ন, হেন গতি তার কি করে হল- সুধী পাঠকবৃন্দ ভেবে দেখুন, নামাচার্য ব্হ্ম হরিদাস সারা জনম একান্ত পুণ্য কর্মের জন্য শ্রী গৌরাঙ্গের অমন দয়া লাভ করেছিলেন। তাহলে নরোজী ডাকাতের কথা ভাবুন, সে জীবনভর এহেন পাপাচার করেও কোন জনমের সুকৃতের ফলে গৌরহরির দর্শন লাভ করতে পেরেছিলেন, তাঁকে দর্শন মাত্রই তার সমূদয় কর্মফল নাশ হয়ে যায়।

সুতরাং জীবন এ ভাবেই জীবন থেকে পৃথিবীতে আগমন করে ও করতে থাকবে। আত্মা কর্মফলের বিধানে নব কলেবর ধারণ করে সৃষ্টধারা চির অব্যাহত রেখে চলবে। প্রারদ্ধের দায়ে নির্ধারিত পূর্বজন্মে সংগঠিত কর্মের ফল ভোগ করবে, নতুন কর্মফল রোজগার করবে আবার কালের কবলে পরে নিঃশেষ হয়ে জন্মান্তর গ্রহণ করবে। নিতান্ত ইহাই সংসারের খেলা।

সংসার পূর্ব পূর্বজনমের ঋণ শোধের স্থান। আত্মা সতন্ত্র হলেও ঋণের দায়ে স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে জন্মলাভ করে ভবিতব্যের অধিনস্ত হয়ে কর্মের মাধ্যমে প্রারদ্ধের ঋণ শোধ করে কর্মফল ভোগের শেষ করে এবং নতুন কর্মের মাধ্যমে নিজ ভবিতব্য প্রস্তুত করে। এসব অনেক বৃহৎ কথা। একটি ছোট্ট উদাহরণ টেনে সমাপ্ত করব।

পুরীধামে শ্রী চৈতন্যদেব হরিদাসের মৃতদেহটি কাঁধে নিয়ে নৃত্য করেছিলেন। কারণ তিনি জীবনভর ঈশ্বরের নাম চিন্তা ব্যতীত অন্য কোন কাজ করেন নাই। তার পুত পবিত্র দেহে কোন প্রকার পাপ স্পর্শ করতে পারেনি। প্রভুর চরণের ছোঁয়ায় দেহপাত করেছেন।

তাই প্রভু তার কৃতকর্মের সু-পুরস্কার তাকে প্রদান করেছেন। পক্ষান্তরে দক্ষিনদেশ ভ্রমণকালে এক ভয়ঙ্কর দস্যু নরোজীকে তিনি উদ্ধারের জন্য সেই ডাকাত সর্দারের আস্তানায় গেলেন। ডাকাত সর্দার তার আকর্ষণে অস্ত্র শস্ত্র ফেলে দলের সকলকে ভাল হয়ে ঘরে ফিরে যেতে নির্দেশ দিলেন।

নিজে মহাপ্রভুর চরণে পতিত হয়ে চিরকালের জন্য তার সাথে চলে এলেন। কয়দিনের মধ্যে ডাকাত সর্দার প্রবল জ্বড়ে আক্রান্ত হলে প্রভু স্বহস্তে তার যারপরনাই সেবা প্রদান করলেন। শেষরক্ষা হল না। সহসাই তিনি মহাপ্রভুর কোলে মাথা রেখে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন।

এখন আমার প্রশ্ন, হেন গতি তার কি করে হল- সুধী পাঠকবৃন্দ ভেবে দেখুন, নামাচার্য ব্হ্ম হরিদাস সারা জনম একান্ত পুণ্য কর্মের জন্য শ্রী গৌরাঙ্গের অমন দয়া লাভ করেছিলেন। তাহলে নরোজী ডাকাতের কথা ভাবুন, সে জীবনভর এহেন পাপাচার করেও কোন জনমের সুকৃতের ফলে গৌরহরির দর্শন লাভ করতে পেরেছিলেন, তাঁকে দর্শন মাত্রই তার সমূদয় কর্মফল নাশ হয়ে যায়।

তাই সৎ ও সুবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাবার জন্য নিরন্তর সাধনা করে থাকেন। ঈশ্বরের দর্শন মাত্র প্রারদ্ধের ভোগ সহ সকল কর্মফল নাশ হয়ে যায় ও জন্মান্তর রহিত হয়ে মোক্ষ লাভ হয়।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২

চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চৌদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১

চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি

………………………………….
আরো পড়ুন:

জন্মান্তরের লীলা
মোহন চাঁন বাউল

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!