পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চোদ্দ
-মূর্শেদূল মেরাজ
পঞ্চভূতের গুণের বিকার –
দৃষ্ট জগতে পঞ্চভূতের যে প্রকাশ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তার গুণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অর্থাৎ জ্ঞানেন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আর এই জ্ঞানেন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেহ ও মনে নানা বিকারের জন্ম নেয়।
শব্দের বিকার
আকাশের গুণ শব্দ নিয়ন্ত্রিত থাকলে যেমন জীব হয় মিষ্ট-স্বল্প ভাষী। আর এই স্বভাব ধারণ করতে পারলে জীব তার ক্রোধকে অনেকটাই নিজের বশে রাখতে সক্ষম হয়। আর যদি এর উল্টো হয়। অর্থাৎ শব্দ জীবের নিয়ন্ত্রণ হারায়।
তখন জীব আকাশের গুণ শব্দ দ্বারা পরনিন্দা, পরচর্চা, কর্কশ-অশ্লীল-রুষ্ঠ শব্দ যেমন নিজে করে তেমনি অন্যে করলে তাতেও আকৃষ্ট হয়।
বায়ুর বিকার
বায়ুর গুণ স্পর্শ। এই স্পর্শের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে বা শুদ্ধ হলে জীব দেহ ও মনের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারায়। স্পর্শ দ্বারা কাম-ক্রোধ উদয় হয়, গরম-ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। বায়ুর বিকারে জীব
আগুনের বিকার
আগুনের মূল গুণ রূপ। শুদ্ধরূপ দর্শনে জীব যেমন প্রেমময়। তেমনি বিকৃত রূপ দর্শন প্রত্যাশী জীব মত্ত হয় কামনার মোহ-মায়ায়।
জলের বিকার
জলের গুণ রস। জিহ্বা একাধারে স্বাদ গ্রহণ ও কথা বলায় ভূমিকা রাখে। আর রস এই দুইতেই থাকে। কথা অর্থাৎ শব্দে যেমন রস নিহিত। তেমনি স্বাদ গ্রহণের আছে রস। শুদ্ধ রস সাধক জীব কাটায় স্বাতিকতায়। কিন্তু রসের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে।
অর্থাৎ রসনায় ডুবে থাকলে জীব হয় লোভী। কোনো কিছুতেই আর তৃপ্ত হয় না। সকল সময়ই প্রাপ্তির বিচার মনে ক্রিয়া করে।
মাটির বিকার
মাটির গুণ গন্ধ। এই গন্ধ জীব নেয় শ্বাসের মধ্য দিয়ে। আর যার শ্বাস শুদ্ধ তার দেহ মনও হয় শুদ্ধ। কিন্তু শ্বাস শুদ্ধ না হলে জীবের জীবন হয় সংক্ষিপ্ত।
ভূতশুদ্ধি-
ভূতশুদ্ধি হলো পঞ্চভূত জয়ের পন্থা। এই পন্থা সহজ না হলেও অসম্ভব নয়। সাধক পঞ্চভূতের উপর সচেতনভাবে দক্ষতা অর্জনে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। যোগ, ধ্যান, তন্ত্র, মন্ত্র নানা পথেই সাধক ধরতে চায় পঞ্চভূতকে। নিয়ন্ত্রণে আনতে চায় জ্ঞানেন্দ্রিয়কে।
আবার সহজপথে সাধক ব্রহ্মাণ্ডের মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তাদের বুঝবার চেষ্টা নেয়। পঞ্চভূতের সাথে সাধকের সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হলে তার ভাষা বুঝতে সহজ হয়। আর ভাষা বোঝা গেলে তবেই না ডুব দেয়া যায় অতলে।
এজন্য অনেক ধারায় দেখা যায় নবীন সাধকদের নিত্যকর্মে পঞ্চভূতের সাথে সম্পর্কযুক্ত কার্য রাখা হয়। সেটা যেমন খালি পায়ে মাটিতে হাঁটা, জল বিহার করা, প্রথম প্রভাতের সূর্য্যের আলো গায়ে লাগানো, প্রাণায়াম করা ও আকাশের দিয়ে তাকিয়ে তার রং ও শব্দ শুনবার-বুঝবার চেষ্টা করা।
এতো গেলো প্রাথমিক আলাপ। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা অন্য কোনো লেখায় করা যাবে। নয়তো মূল আলোচনা থেকে সরে যেতে হবে।
সাধারণ অর্থে ভূতশুদ্ধি অর্থ ‘দেহ-শুদ্ধি সংস্কার’। পঞ্চভৌতিক দেহের পরিশুদ্ধি দ্বারাই দেহ শুদ্ধ হয় বলেই একে ‘ভূতশুদ্ধি’ বলে।
শাস্ত্রে অবশ্য করণীয় পাঁচপ্রকার শুদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এসব শুদ্ধির মধ্যে রয়েছে- আত্মশুদ্ধি, স্থানশুদ্ধি, মন্ত্রশুদ্ধি, দ্রব্যশুদ্ধি এবং দেহশুদ্ধি। কুলার্ণব তন্ত্রে বলা হয়েছে-
আত্মা তু ভূতসংশুদ্ধিপ্রাণায়ামাদিভিঃ প্রিয়ে।
ষড়ঙ্গাদ্যখিলন্যাসৈর্দেহশুদ্ধিরিহোদিতা।
দেহশুদ্ধিং বিধায়েথং ততো বৈ স্থাপয়েদসূন্।।
অর্থাৎ- ভূতশুদ্ধি, প্রাণায়াম প্রভৃতি দ্বারা আত্মশুদ্ধি হয়ে থাকে। করন্যাস, অঙ্গন্যাস প্রভৃতি দেহশুদ্ধির হেতু। দেহশুদ্ধির পরে বিশুদ্ধ প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে।
সূক্ষ্মদেহকে নির্মল করাই ভূতশুদ্ধির উদ্দেশ্য। কিন্তু স্থূল দেহের নির্মলতার দ্বারাই সূক্ষ্মদেহকে শোধন করতে হয়। তন্ত্র পরিচয়ে বলা হয়েছে- ‘সূক্ষ্ম দেহের সপ্তদশ অবয়ব-বিশিষ্ট। পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চবায়ু, মন ও বুদ্ধি- এদেরকে সূক্ষ্মদেহের অবয়ব বলা হয়।’
ভূতশুদ্ধির স্বরূপ জানতে হলে দেহের ষট্চক্র সম্পর্কে জানতে হয়। অর্থাৎ দেহের মূলাধার চক্র থেকে আজ্ঞা চক্র পর্যন্তকে ষটচক্র বলা হয়। এই ছয়চক্র জাগ্রত করা গেলে সপ্তম চক্র আপনাতেই জাগ্রত হয়। তাই এই ষটচক্রকে জানতে হয় ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ীর দ্বারা বায়ুকে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে।
পঞ্চতত্ত্ব বা পঞ্চমকারে সাধনার সম্পর্কে স্বামী নিগমানন্দ বলেছেন-
“পঞ্চমে পঞ্চমাকারঃ পঞ্চাননসমো ভবেৎ।”
অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে পঞ্চমকার সাধনে সাধক স্বয়ং শিব তুল্য হয়ে যান এবং এটিই বিধেয়।
এই পঞ্চভূত ব্রহ্মাণ্ড থেকে দেহ সর্বত্রই বিরাজিত। যাকে জানা গেলে দেহ থেকে ব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছুকেই জানা সহজ হয়। কারণ ব্রহ্মাণ্ডের পঞ্চভূত আর দেহের পঞ্চভূত সর্বক্ষণ একে অপরের সাথে ক্রিয়াশীল থাকে। এই দুই পঞ্চভূতের সাথে সামঞ্জস্য ধরতে পারলেই একে বোঝার পথ পাওয়া যায়।
প্রকৃতির সাথে মানুষের যে সম্পর্ক তার পরস্পরের অবস্থান, আকর্ষণ-বিকর্ষণ ও প্রভাবকে কেন্দ্র করে যেমন জ্যোতিষ শাস্ত্র উদ্ভব হয়েছে। তেমনি উদ্ভব হয়েছে বাস্তুশাস্ত্র। জ্যোতিষ শাস্ত্র যেমন গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবের সাথে জীবের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথা বলে।
তেমনি প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য করে বসতি-জীব-জড়কে অবস্থান করার পথ বাতলে দেয় বাস্তুশাস্ত্র। যাতে জীব প্রকৃতির নিয়মের সাথে নিজের নিয়ম মিলিয়ে বাঁধা-বিপত্তি দূর করে সুস্থ ও সুখে থাকতে পারে।
এই দুই শাস্ত্রেই জীবের সাথে ধারিত্রীর উপর গ্রহ-নক্ষত্র-সৌরশক্তির প্রভাব, ঠিকুজি-কুষ্টি, বায়ুর গতি-প্রকৃতি, দিকের অবস্থান ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে আসা হয়।
মাটিতত্ত্ব লাভের উপায়: চরিত্রে নম্রতা, কোমলতা, বিনয়, ধৈর্য, স্থিরতা, অবিচলতা, মমত্ব আনয়ন করতে পারলেই মাটিতত্ত্বকে অনুভব করা যায়। মাটির মতো আশ্রয় হয়ে উঠতে হয় তবেই মাটির মানুষ হওয়া যায়।
জলতত্ত্ব লাভের উপায়: চরিত্রে জলের মতো চলমানতা, স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তা, সকলের জন্য প্রশান্তি প্রতিষ্ঠা করা, শীতলতা প্রদান ইত্যাদি আনয়ন করা যায় তবেই জলতত্ত্বকে অনুভব করা সহজ হয়।
আগুনতত্ত্ব লাভের উপায়: ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ, নিরহংকারী, প্রত্যয়ী ইত্যাদি স্বভাবে আননয় করতে পারলে তবেই আগুনতত্ত্বকে লাভ করা যায়।
বায়ুতত্ত্ব লাভের উপায়: অগ্নি ও জলতত্ত্বের সমন্বয়ে বায়ুতত্ত্ব হওয়ায়। এরমাঝে এর দুই গুণই বিদ্যমান। অর্থাৎ আগুনের উদ্দাম, ক্রোধ আবার জলের মতো কোমল, চলমানতা। তাই স্বভাবে যদি এই দুই গুণের সমন্বয় করা যায় তবেই বায়ুতত্ত্বকে অনুভব করা যায়।
আকাশতত্ত্ব লাভের উপায়: স্বভাবে আকাশের মতো উদারতা, সকল মত-পথ-ব্যক্তির প্রতি সমদৃষ্টি আনয়ন পারলেই আকাশতত্ত্বকে অনুভব করা যায়। আকাশের মতো উদার না হতে পারলে এই বিশালত্বের জ্ঞানকে ধারণ করা যায় না।
ভূতচতুর্দশী-
ভূতচতুর্দশী নিয়ে নানান কথা প্রচলিত থাকলেও আদতে ভূতচতুর্দশী হলো দেহের পঞ্চভূতকে সংশোধন করে নেয়া। ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্র মতে, প্রতি বছর একবার দেহের পঞ্চভূতকে শুদ্ধি করে নিতে হয়। আর এই দিনে দেহের ক্ষয় রোধ করতে বিশেষ ঔষধী গুণযুক্ত চোদ্দটি শাক খাওয়ার কথা শাস্ত্রে বলা আছে।
চোদ্দ শাক হল- গুলঞ্চ, পলতা, ওল, বেতো, কালকাসুন্দি, সর্ষে, জয়ন্তী, শুষুনী, নিম, শালিঞ্চা, ঘেঁটু ও হিঞ্চে। সন্ধ্যায় গৃহস্থ বাড়িতে চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো হয়। পূর্বপুরুষরা এই দিনে মর্ত্যে নেমে এসে দেখে যান তাঁদের বংশধরেরা কেমন আছেন এমনটাও বিশ্বাস করা হয়। পূর্বপুরুষদের সন্তুষ্টির জন্য রাখা হয় জল, বাতাসা, মিষ্টি-মণ্ডা।
ধারণা করা হয়, চোদ্দ বছরের বনবাস শেষে রাম এই দিনে ফিরে এসেছিল। তাকে স্বাগত জানাতে অযোধ্যবাসী প্রদীপ জ্বালিয়ে নগরীকে আলোকিত করেছিল। সেই থেকে এই প্রথার প্রচলন।
পৌরাণিক কাহিনী মতে, স্বর্গ মর্ত্য ও পাতালের অধীশ্বর দানবরাজ বলির অহংকার ছিল দানবীর হিসাবে। এতে দেবতারা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলে দেবগুরু বৃহস্পতি বিষ্ণুকে পরামর্শ দেন, বলির কাছে বামন রূপে তিন পা পরিমাণ জমি ভিক্ষা চাওয়ার জন্য।
বিষ্ণু তেমনটাই করে। তবে বলি ঠিকই বুঝতে পারে স্বয়ং বিষ্ণুই তার কাছে এসেছে। বিষয়টা বুঝতে না দিয়ে বিষ্ণুর কথামতো তিনি রাজি হলেন শুধু মাত্র কথা রাখতে। তখন বামনরূপী বিষ্ণু একটা পা রাখলেন স্বর্গে, আর একটা পা দিলেন মর্তে।
(চলবে…)
পরবর্তী পর্ব : পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পনের>>
………………….
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
পুরোহিত দর্পন।
উইকিপিডিয়া।
বাংলাপিডিয়া।
শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন।
পঞ্চভূত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাতাসের শেষ কোথায় : ইমরুল ইউসুফ।
ন্যায় পরিচয় -মহামহোপাধ্যায় ফনিভূষণ তর্কবাগীশ।
পঞ্চভূত স্থলম ও পঞ্চভূত লিঙ্গম- দেবাদিদেব শিবঠাকুরের খোঁজে: আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়ের।
…………………………..
আরো পড়ুন-
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এক
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দুই
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তিন
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব নয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব বারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তেরো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চোদ্দ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পনের