ভবঘুরেকথা
আমি দাসের দাস যোগ্য নই ফকির লালন সাঁইজি

আমি দাসের দাস যোগ্য নই

-মূর্শেদূল মেরাজ

মাই ডিভাইন জার্নি : উনিশ

কথায় কথায় রেফারেন্স, বিদেশী ভাষার প্রয়োগ, টিকা-টিপ্পুনির ব্যবহারে সকলকে বেশ শিক্ষিত বলেই মনে হচ্ছিল। চলন-বলনে শহুরে ভাব তো রয়েছেই। পোশাক-আশাকও বলছে তাদের মধ্যবিত্তের উপরের সারিতেই রাখতে হবে।

তর্কটা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে-কোনো সময় সেটা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যেতে পারে। হাতাহাতিটা এই শুরু হয় হয় করে, আবার থেমে যায়। আধঘণ্টা ধরে এমনটাই চলছে। কোনো পক্ষই কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। গলা চড়িয়েই যাচ্ছে।

বিষয়টা বিরক্তির পর্যায়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কিন্তু এমন একটা সময়ের মধ্যে আছি যে, না যাচ্ছে ঘর ত্যাগ করা। না যাচ্ছে বসে থাকা। অগত্যা এই ঘটনার সাক্ষী হতেই হচ্ছে। কিঞ্চিৎ শুনতেও হচ্ছে। অনাকাঙ্খিত এই কাণ্ডটি যারা চোখের সামনে ঘটাচ্ছেন তাদের কাউকেই বিশেষভাবে চিনি না।

সম্ভবত ঘরটি আজকের অনুষ্ঠানে আগত বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু বৃষ্টির দাপটে আমরা কিছু অবাঞ্চিত মানুষ ঢুকে পরেছি। ঘরে অবস্থানরত প্রায় কারো সাথেই আলাপচারিতা নেই। তার উপর বিদ্যুৎ নাই। চারদিক অন্ধকার। ভক্তরা ফরাশের উপর থালা পেতে কয়েকখানা মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে গেছে।

তবে তর্কের মধ্যমণি কেউকেটা পর্যায়ের যারা আছেন তাদের অনেকেই মুখ চেনা। বিশিষ্টজন বলা চলে। এমনটা তাদের কাছ থেকে আশা করা যায় না। তর্কে না নিয়ে গিয়ে একটা নান্দনিক আলোচনা তারা করতেই পারতো। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতামত তুলে ধরতে পারতো।

বিনয়ের সাথে… মিষ্টত্বের সাথে… নম্রতার সাথে… আলোচনা এগিয়ে যেতে পারতো। এটা হচ্ছিল না বলেই হয়তো তাদের কথাবার্তা শোনার রুচি হচ্ছিল না। তবে সবচেয়ে পীড়াদায়ক বিষয় হলো তর্কের বিষয়বস্তু হলো- ‘ফকির লালন’।

আরো বিস্তারে বলতে গেলে- সাঁইজি ‘বস্তুবাদী’ নাকি ‘ভাববাদী’! এটাই ছিল আলোচনার বিষয়। আফসোস একটাই, যে মানুষটাকে বুঝবার জন্য এই আলোচনার সূচনা। সেই মানুষটির প্রধান শিক্ষাই হলো বিনয়-ভক্তি-সমর্পণ। আর তাঁকে বুঝতে গিয়েই কিনা এত্তো হট্টগোল! এত্তো ক্রোধ!! এত্তো উগ্রতা!!!

কিছুই করার উপায় নেই। বাইরে তুমুল বেগে বৃষ্টি। আখড়াঘরের বাইরে উঠান পেরিয়ে সদর দরজার পাশের বৈঠকখানা ঘরে আটকা পরে গেছি; অনেকের সাথে। বিশাল বৈঠকখানা ঘরের কেন্দ্রে তোশকপাতা ফরাশের ধবধবে সাদা চাদরের উপর বসে মধ্যমণিরা তর্ক জুড়ে দিয়েছেন।

আমরা কয়েকজন ছাপোসা মানুষ বেড়ার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। তর্কে যারা অংশ নিয়েছেন এই আখড়ায় তাদের বেশ প্রভাব আছে বলেই মনে হচ্ছে। নইলে এই ঝড়-বৃষ্টির মাঝেও তাদের জন্য দফায় দফায় চা-জল-খাবার আসে?

তাদের ঘিরে অতি উৎসাহী একদল ভক্তশ্রেণীও জড়ো হয়েছে। তারা অনেকটা ফেসবুকের সহমত ভাই টাইপ। তর্কে যে পক্ষ যখন ভারী হয় তখন তারা সেই পক্ষের হয়ে হই হই করে। আর আমরা যারা অনাকাঙ্খিত আগন্তুক। তারা মুখ চুন করে এক কোণে বসে আছি।

বিদ্যুৎ চলে গেছে প্রথম বজ্রপাতের সাথে সাথেই; সেই সন্ধ্যায়। তারপরই আকাশ ভেঙ্গে ঝুম বৃষ্টি। ততক্ষণে আর এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে আখড়াঘরে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। তড়িঘড়ি করে এই ঘরেই ঢুকে পরতে হয়েছে।

সম্ভবত ঘরটি আজকের অনুষ্ঠানে আগত বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু বৃষ্টির দাপটে আমরা কিছু অবাঞ্চিত মানুষ ঢুকে পরেছি। ঘরে অবস্থানরত প্রায় কারো সাথেই আলাপচারিতা নেই। তার উপর বিদ্যুৎ নাই। চারদিক অন্ধকার। ভক্তরা ফরাশের উপর থালা পেতে কয়েকখানা মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে গেছে।

অবশ্য মোমবাতির নরম আলো এই বিশাল ঘরের অন্ধকারকে গিলে খেতে পারেনি। অন্যদিকে উঠান জুড়ে পানি জমে জমে ঘরে ঢোকার পায়তারা করছে। বৃষ্টিরও থামবার কোনো নাম নেই। এই অবসরে মুড়ি-চানাচুর খেতে খেতেই শুরু হয়ে গেছে এই তর্ক, বিতর্ক কিংবা কুতর্ক।

অথচ আমরা ধরেই নেই অশিক্ষিত-গণ্ডমূর্খরাই কেবল অযাচিত তর্কে জড়ায়। কিন্তু ঘটনার পালাবদলে এখন দেখা যায় প্রথাগত শিক্ষিত সমাজই বেশি তর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। এর দায় অবশ্য কেবল শিক্ষিত জনগোষ্ঠির উপর এককভাবে চাপিয়ে দিলেই হবে না। এর অনেকটাই দায় চলে যায় শিক্ষাব্যবস্থার উপরও।

যা ক্রমশ মারমুখি হয়ে উঠছে। কেউ কারো কথা শুনতে আর রাজি নয়। সকলে সকলের কথা বলে চলেছে। প্রথমে এমনটা ছিল যে, একজন বলেছে অন্যরা শুনেছে। এখন অবশ্য পরিস্থিতি পাল্টে গেছে; এখন সকলেই বলছে। কেউ কারো কথা শুনছে না। কেউ থামছেও না।

তরিকাপন্থী মানুষ হয়েও মনের মাঝে এতোটা উগ্রতা কেমন করে ধরে রাখে; সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অত্যন্ত লালন মতের মানুষগুলোর কাছে তো কিছুটা বিনয় আশা করতেই পারি। তাই না? নাকি বেশি বেশি আশা করছি!! প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত মানুষ তর্কে জয়ী হওয়ার জন্য লড়বেই সেটাই কি স্বাভাবিক?

ঢাকাইয়া সেই কৌতুকটার কথা মনে পরছিল বারবার, ছোট ছেলে গালি দিয়েছে এই কথা কাঁদতে কাঁদতে মা বড় ছেলেকে বলার পর। বড় ছেলে ছোটভাইকে উদ্দেশ্য করে মা-বাবার চোদ্দগুষ্টির ষষ্ঠী পূজা করে যে গালাগালি শুরু করে দিলো।

তা শুনে আপসোস করতে করতে অসহায় মা বলতে লাগলো, তোর ছোটভাই তো আমারে একটা গালি দিয়েছিল। তুই তো পুরা গুষ্টিই উদ্ধার কইরা ফেললি।

যে ক্রোধ-উগ্রতা-কট্টরতা থেকে দূরে থাকতে এমন মানুষের সাথে সঙ্গ করতে আসি। তারাও যদি এমন আচরণ করে গো সাঁই। তাহলে কই যাই! কাদের সাথে মিশি!!

যাক সে কথা। আসলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপর সবটা নির্ভর করে না। এর অনেকটাই নির্ভর করে পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক শিক্ষার ভেতর দিয়ে নিজের বোধ-বিবেচনা-বিবেককে মানুষ কতটা জাগ্রত করতে পারলো তার উপর।

অথচ আমরা ধরেই নেই অশিক্ষিত-গণ্ডমূর্খরাই কেবল অযাচিত তর্কে জড়ায়। কিন্তু ঘটনার পালাবদলে এখন দেখা যায় প্রথাগত শিক্ষিত সমাজই বেশি তর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। এর দায় অবশ্য কেবল শিক্ষিত জনগোষ্ঠির উপর এককভাবে চাপিয়ে দিলেই হবে না। এর অনেকটাই দায় চলে যায় শিক্ষাব্যবস্থার উপরও।

আসলে এখন এমন শিক্ষাই প্রদান করা হয়। যেখানে শিক্ষা পণ্য ভিন্ন আর কিছু নয়। তা বিক্রি করে দোকানি। খরিদ করে ক্রেতা। এতে শিক্ষার সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে কেবল কেনা-বেচায়।

তাই এরূপ শিক্ষায় যে শিক্ষিত আমরা হয়ে উঠছি, তাতে করে নিজেরা আর যথার্থ আলো জ্বালতে পারছি কই? নিজেদেরই তো বাস অন্ধকারে। সেই অন্ধকার আড়াল করতে অন্যের ভুল ধরে ধরে সুখে জীবনটা কাটিয়ে দেই। দেখিয়ে বেড়াই আমরা কতই না জানি।

আর যেখানে কেনাবেচার সম্পর্ক বর্তমান সেখানে বিক্রেতা তার পণ্যকে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের মোড়কে মুড়ে সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণে ব্যস্ত থাকবে; সেটাই তো স্বাভাবিক। তা যতই পচাগলা-নষ্ট-বাতিল হোক না কেনো। কারণ দিন শেষে তাকে লাভ বুঝে নিতে হবে।

আর সময়টাও এমন ইঁদুর দৌড়ের যে, সকলেই ছুটছে অর্থের পেছনে। সেই ধারায় ব্যবসায়ীরাও এখন সততা থেকে মুনাফাতেই বেশি মনোযোগী হয়েছে। এখন ব্যবসায়, বিশেষ করে আমাদের দেশে সততার তেমন মূল্যায়ণও নাই।

আছে উৎকৃষ্ট-লোভনীয় মোড়কের আর বিজ্ঞাপনের চাহিদা। পণ্যের মান নিয়ে এখন কেউ মাথা ঘামায় না। তাকে কত দামী-সুন্দর-আকর্ষণীয় মোড়কে ঢাকা হয়েছে গুরুত্ব তাতেই নির্ভর করে। অন্যদিকে ক্রেতারাও তেমনি।

আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবৃত্তের মানুষ চায় সবচেয়ে কমদামে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পণ্য খরিদ করতে। যদিও জানি সস্তার তিন অবস্থা। তারপরও চাই কিনে জিতে জেতে। কারণ আমরা ভালোই জানি। বর্তমানের কোনো পণ্যই আগের মতো লাইফটাইম চলবে না।

সব কিছুই মাস বা মৌসুম ঘুরবার আগেই নষ্ট বা বাতিল হয়ে যাবে। তাই চকচকে জিনিসটাই আমরা কিনতে চাই। যাতে নিজে সুখ না পেলেও, লোককে দেখিয়ে সুখ পাই।

আর যাদের কাছে হিসেবের বাইরের অর্থ আছে পকেট ভরা। তারা এমন পণ্য কিনতে চায় যা দেখে সকলের মাথা নষ্ট হয়ে যায়। পণ্যের মান এখানেও কোনো গুরুত্ব বহন করে না। লোকে এসব দেখে জ্বলে-পুড়ে মরলেই আমরা খুশি। মহাখুশি। আমরা দামী-চোখ ধাঁধানো পণ্য কিনতে পারি। সেটা প্রমাণ করাই মুখ্য।

তাই এরূপ শিক্ষায় যে শিক্ষিত আমরা হয়ে উঠছি, তাতে করে নিজেরা আর যথার্থ আলো জ্বালতে পারছি কই? নিজেদেরই তো বাস অন্ধকারে। সেই অন্ধকার আড়াল করতে অন্যের ভুল ধরে ধরে সুখে জীবনটা কাটিয়ে দেই। দেখিয়ে বেড়াই আমরা কতই না জানি।

তখন এসবের মানে কিছুই বুঝি নাই। অথচ এতো বছর পর সেই সব মনে পড়লে মনে হয়। আমাদের সামনে যে ঘটনা ঘটে তা থেকে তাৎক্ষণাৎই নয় বহু বহুদিন পরও শিক্ষা নেয়াই যায়। যদি তাতে যথার্থ শিক্ষা লুকায়িত থাকে। তবেই মিলিয়ে নেয়া যায় অনেক কিছু।

আর দেখাতে দেখাতে বিশ্বাস করতেও শুরু করে দেই, আমরা আসলেই অনেক জানি। এই বাহাদুরিতে আমাদের মাটিতে পা’ই পড়ে না।

যতই সময় গড়াচ্ছে তর্কটা আরো উত্তাপ ছড়াচ্ছে। উভয়পক্ষ যুক্তি হারিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যদিও শুরুটা বেশ যুক্তিপূর্ণ আলোচনা দিয়েই শুরু হয়েছিল।

মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমাকে এক পণ্ডিত মশাই পড়াতে আসতেন। তিনি প্রচণ্ড রেগে গেলে বলে উঠতেন- ‘ইডিয়েট’। এটাই ছিল স্যারের দেয়া সর্বোচ্চ গালি। উত্তেজনার বশে ‘ইডিয়েট’ শব্দটা উচ্চারণ করলে ফেললেও। পর মুহূর্তেই মারাত্মক অনুতপ্ত হতেন।

যদিও তিনি রাগে কাঁপতে থাকতেন। কিন্তু গালি দিয়ে ফেলেছেন এই বিষয়টা সম্ভবত কিছুতেই মানতে পারতেন না। এখনো আমার মনে পড়ে সেই মুর্হূতে তিনি তার মোটা ফ্রেমের চশমাটা নামিয়ে রেখে। এক হাত কপালে দিয়ে মাথা নিচু করে বলতেন, জানো আমরা ইংরেজিতে গালি দেই কেনো?

বৃটিশটা যখন ভারতবর্ষ শাসন করতো। যখন আমাদের পূর্বপুরুষদের তারা নির্যাতন করতো। তখন তারা ইংরেজিতে গালাগালি করতো। আমাদের কাছে নির্যাতনের থেকে সেই ইংরেজিতে গালাগাল বেশি গায়ে লাগতো। আমরাও যখন প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিলাম। আমরাও যখন বিপ্লবী হয়ে উঠছিলাম।

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তাদেরকে ইংরেজিতে গালাগালি দিতো। সেই অপমানটার প্রতিশোধ নিতে। সে থেকেই সম্ভবত আমাদের ভেতর এই বীজটা বপন হয়ে গেছে। চরম রেগে গেলে আমরা এতো বছর পরও ইংরেজিতে গালাগালি দিয়ে বসি। উত্তরাধিকার সূত্রে হয়তো আমরা এটা পেয়েছি।”

পণ্ডিত মশাইয়ের গলা ধরে আসতো। তিনি সেদিন আর পড়াতেন না। চলে যেতেন। আমি খুশি হয়ে যেতাম তাড়াতাড়ি ছুটি পাওয়াতে।

তখন এসবের মানে কিছুই বুঝি নাই। অথচ এতো বছর পর সেই সব মনে পড়লে মনে হয়। আমাদের সামনে যে ঘটনা ঘটে তা থেকে তাৎক্ষণাৎই নয় বহু বহুদিন পরও শিক্ষা নেয়াই যায়। যদি তাতে যথার্থ শিক্ষা লুকায়িত থাকে। তবেই মিলিয়ে নেয়া যায় অনেক কিছু।

বিনয় হারিয়ে ফেললে যে অনুতপ্ত হতে হয় সেই বোধটা মনে হয় আমরা অনেক আগেই হারিয়েছি। তথাকথিত শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলেই আজ এক কাতারে এসেছি। সকলেই ব্যস্ত নিজেকে প্রমাণ করতে। নিজের যুক্তিকেই একমাত্র যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে।

কিন্তু শ্রদ্ধবোধ হারিয়ে কেবল জয়ী হওয়ার জন্য কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা। কাউকে অপমান করা। কাউকে ছোট করা। নিজে বড় হওয়ার জন্য। নিজের মতকে মহান প্রমাণ করার জন্য ক্রোধ প্রদর্শন করে প্রভাব বিস্তার করাটা সম্ভবত বোকামী। অভদ্রতা।

এসব দেখে মৌলবাদীদেরও একচেটিয়া দোষ দিতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, তারাও তো আমাদের মতোই ‘চার অক্ষর’ বা ‘পাঁচ অক্ষর’। আমরা সকলেই নিজেদেরটাই প্রতিষ্ঠা করতে চাই। নিজেদের মতকেই একমাত্র মত মানি। তার জন্য তর্ক-হাতাহাতি করতেও পিছপা হই না।

অন্যদিকে মৌলবাদীরা হাতাহাতি-মারামারিকে স্বাভাবিক জ্ঞান করে। প্রায়শই তারা আরো এগিয়ে গিয়ে জীবন নাশ পর্যন্ত করে ফেলে। পার্থক্য কেবল কোনো কোনো ক্ষেত্রে এইটুকুই। একজন উগ্রতাকে একটা সীমার মধ্যে রাখে। আরেকজন উগ্রতাকেই সক্ষমতা মনে করে।

তাহলে আমাদের শিক্ষাটা কোথায়? গুরুর হাতে হাত দিয়ে, নিজেকে সমর্পণ করে আমরা নিজেদের কতটা পাল্টাতে পেরেছি? কতটা পাল্টাতে পারছি?? যখন অধিকারের প্রশ্ন আসে। সত্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন আসে। বাউল-ফকিরদের পাশে দাঁড়ানোর প্রশ্ন আসে তখন আমরা কোথায় হারাই। এই সব উত্তেজনা তখন কোথায় যায়?

অথচ সমমনাভাবাপন্ন কেউ কোনো একটা কথা বললে, তা যদি আমার মনের মতো না হয়। তা যুক্তি দিয়ে বা সুন্দর করে গুছিয়ে পর্যন্ত কথা বলা শিখে উঠতে পারি নি আমরা। রেগে ফেটে আগুন হয়ে ঝগড়া জুড়ে দেই। যদিও সত্য প্রতিষ্ঠায় ক্রোধের স্থান থাকতে পারে বলেও কেউ কেউ উল্লেখ করেন।

কিন্তু শ্রদ্ধবোধ হারিয়ে কেবল জয়ী হওয়ার জন্য কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা। কাউকে অপমান করা। কাউকে ছোট করা। নিজে বড় হওয়ার জন্য। নিজের মতকে মহান প্রমাণ করার জন্য ক্রোধ প্রদর্শন করে প্রভাব বিস্তার করাটা সম্ভবত বোকামী। অভদ্রতা।

আর সেটা ফকির লালন সাঁইজি, লালন সাঁইজির মতবাদ শেখায় না। অন্ত্যত আমার তো তাই মনে হয়। আমি বা আমরা সকল সময় হয়তো তা পেরে উঠি না। ক্রোধ প্রকাশ করে ফেলি। কিন্তু করে উঠতে পরার চেষ্টাটা করি কিনা সেটাই প্রশ্ন।

আর যখন বিবেক জেগে উঠে, তারপরও জয়ী হওয়ার জন্য তর্ক চালিয়েই যাই সেটা দু:খজনক। হেরে গেলে ক্ষতি কি? জয়ী হওয়ার জন্য জেনে শুনে কুতর্কে মাতা’টা, অন্যের জন্য যতটা না নিজের জন্য-নিজের সাধন-ভজনের জন্য অধিক ক্ষতি। এখানে মনে পড়ে সাঁইজির পদ

বুঝবিরে গৌর প্রেমের কালে
আমার মত প্রাণ কাঁদিলে,
দেখা দিয়ে গৌর ভবের শহর
আড়ালে লুকালে।।

যেদিন হতে গৌর হেরেছি
আমাতে কি আমি আছি,
কী যেন কী হয়ে গেছি
প্রন কাঁদে গৌর বলে।।

তোমরা থাক জাত কূল লয়ে
আমি যাই চাঁদ গৌর বলে,
আমার দু:খ বুঝলি না রে
এক মরনে না মরিলে।।

চাঁদ মুখেতে মধুর হসি
আমি ঐ রূপ ভালোবাসি,
লোকে করে দ্বেষাদ্বেষী
গৌর বলে যাই গো চলে।।

একা গৌর নয় গৌরঙ্গ
নয় বাঁকা শ্যাম ত্রিভঙ্গ,
এমনই তার অঙ্গ গন্ধ
লালন কয় জগত মাতালে।।

ফকির শাহ্ আলম সাঁইজির সাধনসঙ্গীনি মা জননী যখন বললেন, বাবা একসময় সবাই বলতো। এই কয়জন সাদা পোশাকধারী সাধুগুরু চইলে গেলে সব ফুরায়ে যাবে। সব শেষ হয়ে যাবে। আমারো তাই মনে হতো। কিন্তু তোমাদের দেখলে মনে হয় ফকিরি শেষ হবার নয়।

তোমরা সাদা পোশাক পরো নাই। গুরুর কাছে হাত দাও নাই। কিন্তু আমার মনে হয় তোমরাও ফকির। তোমরাই ফকিরি ধইরা রাখবা। পোশাক পরলেই সবাই ফকির হইতে পারে নারে বাপ। আবার পোশাক না পরলেও অনেকে ফকির হয়।

তোমরা ঠিকঠাক মতো সাঁঁইজিরে প্রচার-প্রসার করবা। যাতে ভুল-ত্রুটি না হয়। সেই কামনাই করি। ফকিরি কোনদিন হারাবে না। তোমদের মতো ছেলেপেলেদের দেখলে সাহস পাই। তোমাদের হাত ধরে ফকিরি টিকে থাকবে বাপ। এই কামনাই করি।”

ধরে আসা কণ্ঠে মা জননী যখন কথাগুলো বলছিলেন। তখন আমারো মন ছলছল করছিল। মা জননী অধিক আবেগে এমন কথা বলেছেন। আমাদের মতো নগন্য মানুষ এই কথার ভার বহন করার যোগ্যতা রাখে না। তারপরও মা জননী যখন হাত ধরে কথাগুলো বলছিলেন। তখন চোখে জল আটকে রাখা মুশকিল ছিল।

আমার কাছে, লালন ফকির ভাববাদী না বস্তুবাদী এই তর্ক থেকে; অনেক বেশি জরুরী এটা বোঝা যে। লালন ফকিরকে কোনো গণ্ডিতে আটকে রাখা চেষ্টা করাটাই বোকামি। কোথাও তাকে নির্দিষ্ট করার কোনো যুক্তি নেই। কে তাঁকে কোন মতে বুঝবে এটা নিতান্তই ভক্ত-শিষ্য-পাগলের একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধি।

আসলে আধ্যাত্মপথে ভাববাদ-বস্তুবাদকে পৃথক করা চাট্টিখানি কথা তো নয়। যেমন ধরো, তোমার মাঝে যদি রোমান্টিসিজম না থাকে তাহলে তুমি যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণাই হয়তো পাবে কিনা সন্দেহ। আবার যুদ্ধে যাওয়ার পর আর রোমান্টিসিজমের তেমন কোনো সুযোগ নেই। জায়গা নেই।

এসব কোনো গুণই আমার মধ্যে নেই তাই হয়তো এমন মানুষের খোঁজেই থাকি। যেখানে গেলে, যাদের সংস্পর্শে গেলে এর সন্ধান মেলে। আসলে বিষয়টা তো তেমনই; যার যাতে ঘাঁটতি সে তো তাই খুঁজবে। তাই নতশিরে বারবার বলি, “ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই।”

আবার যুদ্ধ জয়ের পর রোমান্টিসিজমই দৃশ্যমান হয়। তাই বস্তুবাদকে বুঝতে গেলেও ভাববাদের প্রয়োজন। ভাববাদকে বুঝতে গেলেও বস্তুবাদের প্রয়োজন। আবার বস্তুবাদ বুঝে গেলেও শেষে দেখা যাবে ভাববাদ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

আসলে বস্তুবাদ-ভাববাদ একটা চক্রাকার বৃত্তের ঘুরে বেড়ানো দুটি বিন্দু। যা পরিধি ধরে আপন কক্ষধরে আবর্ত হয়ে চলে মাত্র।

তাই লালনকে শাস্ত্র-বিধি-বিধানে আটকাতে চাইলে আখেরে তাঁকে কেবল সংকুচিতই করা হবে। এর বেশি কিছু হবে না। তিনি মহাসাগর। তার থেকে এক বিন্দু জল নিয়ে তাকে বুঝে ফেলিছে জ্ঞান করা সহজ নয়। যদিও এক বিন্দু জলে গোটা জলতত্ত্বই বিরাজ করে।

তারপরও তাঁকে অল্প জ্ঞানে বুঝে ফেলেছি বলাটা ধৃষ্টতা। যিনি নিজেই বলেছেন, “বেদ-বিধির পর শাস্ত্র কানা। আরেক কানা মন আমার। এসব দেখি কানার হাটবাজার।”

তাই আর কানার হাটবাজারে থাকতে মন চাইলো না। তখনো বৃষ্টি পরছে। তবে বেগ অনেকটা ধরে এসেছে। সেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে উঠানে পা রাখলাম। সেখানে ভক্তকুল জমা পানি বেড়িয়ে যাওয়ার পথ করবার তুমুল চেষ্টা চাল্লাচ্ছে। তাদের সাথে হাত লাগালাম।

যদিও তারা আমাকে প্রায় কিছুই করতে দিলো না। তাও তাদের সাথে। তাদের হাসি মুখের কাছে। বন্ধি হয়ে গেলাম। মনে হলো, আমি আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে ভুল দরজায় প্রবেশ করে ফেলেছিলাম। সেটা আমার স্থান নয়। আমার স্থান এখানে। যেখানে যুক্তি-তর্ক, জ্ঞান-গড়িমার ঊর্দ্ধে থাকে ‘প্রেম-ভক্তি-বিনয়’।

এসব কোনো গুণই আমার মধ্যে নেই তাই হয়তো এমন মানুষের খোঁজেই থাকি। যেখানে গেলে, যাদের সংস্পর্শে গেলে এর সন্ধান মেলে। আসলে বিষয়টা তো তেমনই; যার যাতে ঘাঁটতি সে তো তাই খুঁজবে। তাই নতশিরে বারবার বলি, “ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই।”

আচ্ছা ফকির লালন সাঁইজিও কি ভক্ত-অনুসারী-অনুরাগীদের পেলে এমনই আমোদে মেতে উঠতেন! চোখেমুখে এমন খুশি ঝলক দিয়ে উঠতো? আবেগের প্রেমের রসে মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন?? গেয়ে উঠতেন একের পর এক পদ!!

এই তো সেবার আমরা সাঁইজির ধাম থেকে বেড়িয়ে রওনা দিলাম শাওতার উদ্দেশ্যে। আরেকটু সময় সাঁইজির ধামে থাকাই যেত। মনও চাইছিল। কিন্তু সঙ্গীদের এক কথা। সন্ধ্যাটা একটু ঘন হলে অটো বা সিএনজি নাও পাওয়া যেতে পারে।

নিয়মিত পরিবহন না পাওয়া গেলে শাওতায় বাজানের আখড়ায় যেতে জটিলতা দেখা দিতে পারে। কোনো যানবাহন পাওয়াও যায় না। আর দুই-একটাকে হাতে পায়ে ধরে রাজি করানো গেলেও কয়েকগুণ ভাড়া গুণতে হয়। অভিজ্ঞতা আমাদের এমনই।

তাই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে রিকসা চেপে চললাম লাহিনীর দিকে। সেখান থেকে অটোতে করে শাওতা। উদ্দেশ্য বাজান সাত্তার ফকিরের আখড়া।

সে রাতে বাজান আমাদের দেখে খুশি হলেন বটে কিন্তু আড্ডা-আলাপন তেমন জমলো না। মায়ের শরীরটা খারাপ। বাজান তা নিয়ে একটু চিন্তিত। আমরাও সেবা নিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম আগেভাগেই। ঘুমটাও হলো বেশ। ঘুম থেকে উঠে আমরাও প্রস্তুত নতুন গন্তব্যে রওনা দেবার জন্য।

সকালের সেবা নিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে যেই না বের হবো হবো ভাব ধরেছি। তখন সাত্তার ফকির প্রেমে-রসে মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন। একের পর এক পদ শোনাতেই লাগলেন স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে। তার আনন্দচিত্ত দেখে পাশের ঘর থেকে মা জননীও এসে যোগ দিলেন।

আমরাও ভুলে গেলাম আমাদের কোথায় যাবার কথা। কখন যাবার কথা। মেতে উঠলাম, ডুবে গেলাম ভাবের নিখাদ জলে। বাজানের উৎফুল্ল রূপ দেখে পরান শান্ত ও শাস্তিতে ভরে উঠছিল। পাশাপাশি একটা কথা মনের মাঝে ঝিলিক দিয়ে উঠছিল।

আচ্ছা ফকির লালন সাঁইজিও কি ভক্ত-অনুসারী-অনুরাগীদের পেলে এমনই আমোদে মেতে উঠতেন! চোখেমুখে এমন খুশি ঝলক দিয়ে উঠতো? আবেগের প্রেমের রসে মাতোয়ারা হয়ে উঠতেন?? গেয়ে উঠতেন একের পর এক পদ!!

ইস্ একবার যদি সেই মহা-সৌভাগ্য এই পাপীর ভাগ্যে হতো। এইবার যদি সেই রূপের ঝলক দেখতে পেতাম। তাহলে শত-হাজার-লক্ষ-কোটি জন্মের যাত্রা সফল হতো। তেমন একটি দৃশ্য দেখবার জন্য শত-হাজার-লক্ষ-কোটিবার জন্মাতে বা মরতে আপত্তি নেই। সাঁইজি তোমার কথা সাঁইজিই বলি-

জানবো এই পাপী হতে।
যদি এসেছো হে গৌর জীব তরাতে।।

নদীয়া নগরে ছিলো যতজন
সবারে বিলালে প্রেমরত্ন ধন,
আমি নরাধম, না জানি মরম
চাইলে না হে গৌর আমা পানেতে।।

তোমার সুপ্রেমেরই হাওয়ায়
কাষ্ঠের পুতুল নলিন হয়,
আমি দীনহীন, ভজনবিহীন
অপার হয়ে পড়ে আছি কূপেতে।।

মলয় পর্বতের উপর
যতো বৃক্ষ সকলই হয় সার,
কেবল গেলো জানা, বাঁশে সার হয় না
লালন প’ল তেমনি প্রেমশূন্য চিতে।।

কথা প্রসঙ্গে সাধুগুরু হুমায়ুন ফকিরের ভক্ত ছেলে ছোটভাই রকিব বলছিল, একবার হুমায়ুন সাধুকে জিজ্ঞাসা করেছিল- “আপনার গুরু করে।” উত্তরে হুমায়ুন সাধু বলেছিল। সাঁইজের আখড়ায় যেয়ে দেখো, সাঁইজির রওজার পাশে আমার গুরু বসে আছে।

রকিব খুঁজতে খুঁজতে পেয়েছিল হুমায়ুন সাধুর গুরু মেহেরপুরের দৌলত ফকিরকে। কথা প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিল, আপনি কার গুরু? দৌলত সাঁইজি বলেছিলেন, “ভক্তই জানে আমি কার গুরু।” কথার ছলে কথাগুলো বলে গেলেও। এই শব্দ কয়টি মাথার মাঝে কোড হয়ে রইলো।

“ভক্তই জানে আমি কার গুরু।” আসলেই তো তাই। এতো ঘটা করে ঢাকঢোল পেটালেই কি সব হয়? যে প্রেমে পড়ে সেইই তো জানে প্রেমটা কতটুকু জমলো। লোকে মানুক বা না মানুক, গুরু-শিষ্যের এই অদৃশ্য বন্ধনের লতা দেখতে পায় না প্রেমিক বিনা।

মনে পড়ে গেলো তৌহিদের পাঠশালার আরিফ আলী আকবর সাধুর কথা। তিনি কথায় কথায় তার গুরু কাশেম বাবার একটা বাণী শুনিয়েছিলেন। কাশেম বাবা বলেছেন, “কাউরে ভক্ত বানানো যায় না। ভক্ত নিজে নিজে অইতে অয়।”

এই তো সেবার আমরা দলেবলে খুলনা, বাগেরহাট, মোংলা ঘুরে যখন সাঁইজির ধামে প্রবেশ করলাম। তখন ধাম প্রায় ফাঁকা। আমরা ছাড়া আর বিশেষ মানুষজন নেই। বহুদিন পর সাঁইজির ধামে প্রবেশ করছি। মনটাই ফুরফুরা হয়ে গেলো।

উৎফুল্ল মনে ভক্তি দিয়ে উঠেই সাঁইজির রওজার উপর শুকিয়ে যাওয়া ফুলগুলো দেখে মনে একটা ভাবের উদয় হলো। বহু বহুদিনের বাসনা ছিল। সাঁইজির রওজা ফুল দিয়ে একটু সাজিয়ে দেয়ার। সেই খেয়ালটা আবার জেগে উঠলো। পাশাপাশি মনে একটা সংশয়ও কাজ করতে লাগলো।

সাঁইজি কি আমাদের ফুল গ্রহণ করবেন? আসলেই কি সেই স্বপ্ন পূরণ হবে?? এইসব ভাবতে ভাবতে বাকিদের সাথে কথাটা তুল্লাম। সকলেই রাজি। মহা আনন্দে ছুটলাম মজমপুরের দিকে ফুলের দোকানে। সাধ-সাধ্যের সীমানার হিসেব কষে বস্তাবন্দি ফুল নিয়ে যখন সাঁইজির ধামে প্রবেশ করছিলাম।

মিথ্যা বলবো না, এতো প্রশান্তি জীবনে খুব কমই লেগেছে। জীবনে বহুজনের জন্য। বহুরকমের ফুল কিনেছি। কিন্তু এই অল্প কিছু ফুল কিনে যে আনন্দ আজ পেলাম তার হিসেব মেলা কঠিন। আসলেই সুখ থেকে সোয়াস্তি ভালো গো সাঁই। কি করে যে বোঝাই-

আর কি বসবো এমন সাধুর সাধবাজারে।
না জানি কোন সময় কোন দশা
ঘটে আমারে।।

সাধুর বাজার কি আনন্দময়
অমাবস্যায় পূর্ণ চন্দ্র উদয়,
আছে ভক্তির নয়ন যাঁর সে চাঁদ দৃষ্ট হয় তাঁর
ভব বন্ধন জ্বালা যায় গো দূরে।।

দেবের দুর্লভ পদ সে
সাধু নাম তাঁর শাস্ত্রে ভাসে,
ওসে গঙ্গা জননী পতিত পাবনি
সাধুর চরণ সেও বাঞ্ছা করে।।

আমি দাসের দাস যোগ্য নই
কোন ভাগ্যে এলাম এই সাধু সাধসভায়,
ফকির লালন কয় মোর ভক্তিহীন অন্তর
এবার বুঝি প’লাম কদাচারে।।

একটা সময় ছিল যখন তর্ক করতে বেশ লাগতো। সেই সবে যখন কৈশোর পেরুচ্ছি তখনকার কথা। তর্ক করা-জয়ী হওয়া। তর্কের খাতিরে কত কি যুক্তি দেয়া। সেই যুক্তির তথ্য সংগ্রহের জন্য কত কি পড়া। সেই ছিল আড্ডার বিষয়বস্তু।

জীবনে এমন একটা সময় হয়তো অনেকেরই আসে। অত:পর বুঝ হওয়ার পর তা থেকে বেড়িয়েও আসতে হয়। কোনো কিছুতে আটকে গেলেই হয়তো জীবন ফ্রেমে বন্দী হয়ে যায়। চোখে লেগে যায় টিনের চশমা। তারপর তা দিয়েই সব বিচার করতে হয়।

প্রতিনিয়তই নিজেকে… নিজের ভাবনাকে… নিজের বিবেচনাবোধকে… যাচাই-বাছাই করে সংস্কারের ভেতর দিয়ে চলাই সাধনায় এগিয়ে যাওয়া। একটা একটা করে দরজা খুলে খুলে দেখে দেখে এগিয়ে যাওয়া। কোনো একটা প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে সেখানেই আজন্ম থেকে যাওয়াটা অনেকক্ষেত্রেই বোকামি।

যদি না সেখানে কোনো বিকার থাকে, প্রশ্ন থাকে, সংশয় থাকে, যাচাই-বাচাই করার প্রবণতা থাকে। যেখানে গেলে পূর্ণ লীন হয়ে যাওয়া যায়। সেখানে চাইলে থেকে যাওয়াও যায়। তবে ডুবে গেলেই তো শেষ হয়ে যায় না। ডুবে ডুবেও অনেকটা দূরে যেতে হয়।

তবেই না পাতালপুরীর সন্ধান মেলে। সেখান থেকে শুরু হয় আবার নতুন যাত্রা। এই যাত্রাটাই তো জীবন। অনন্ত জীবন। কখনো সেটা এক জীবনের মাঝেই ভ্রমণ করে। আবার কখনো সেটা ভ্রমণ করায় জীবন থেকে জীবনে। দেহ থেকে দেহে। জন্ম থেকে জন্মান্তরে।

দেশের পূর্বদিকের এক অলির দরবারে ওরশ শুরু হবে। যাওয়ার ইচ্ছে মনে নিয়ে ঘুরছি। কিন্তু সমস্যা হলো পরদিন আরেকটা বিশাল যাত্রার বের হতে হবে। এক কুল রক্ষা করতে গিয়ে, অন্য কুল রাখা যাচ্ছে না। কি যে করি। দুইটাতেই যাওয়ার ইচ্ছে মনে মনে।

এমন সময় সদ্য পরিচিত এক ভদ্রলোক ফোনে জানালেন, ভাই আমি আগামীকাল কয়েকঘণ্টার জন্য সেই দরবারে যাচ্ছি। আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন। সকালে রওনা হয়ে সন্ধ্যায় ফিরবো। প্রস্তুবটা মনে ধরলো। আমি একা যদি রওনা দেই তাহলে আর দিনে দিনে গিয়ে, দিনে দিনে আর ফিরে আসা সম্ভব না।

উনি ধ্যান সম্পর্কিত সে সকল কোর্স করেছেন। যে সকল শিক্ষা নিয়েছেন। যে সকল পুস্তকাদি পাঠ করেছেন। যে সকল গান শুনেছেন। যে সকল গুরুর সান্নিধ্য পেয়েছেন। তা ভিন্ন অন্য কোনো ভাবেই জ্ঞানের বিকাশ সম্ভব নয়। অন্ত্যত আধ্যাত্ম বিদ্যায় তো নয়ই।

একবার গিয়ে পৌঁছালে কমপক্ষে দুই-তিনটা দিন তো কাটাতেই হবে। যাক সাঁই ব্যবস্থা করে দিয়েছে ভেবে ঝুলে পরলাম ভদ্রলোকের সাথে। সকাল সকাল উঠে বসলাম তার গাড়িতে। গাড়ি যতটা ঢাকা ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে লাগলো। ভদ্রলোক সম্পর্কে আমার ধারণা তত স্পষ্ট হতে লাগলো।

যদিও আমি কিছু কথা, কিছু আলাপচারিতা, ঘটনাকে কেন্দ্র করে কাউকে বিচার করতে চাই না। কিন্তু কেউ কেউ থাকেন। যারা চান। তাদের জাজ করা হোক। তাদের বিচার করা হোক। কতটা জানেন সেই সব ডিগ্রির সনদ দেখিয়ে হলেও তারা সম্মান আদায় করেই নিতে চান।

নিত্যনতুন চরিত্রের মানুষের সাথে মিশতে আমার মন্দ লাগে না। তবে অহং পুষে রাখা মানুষের সাথে বেশি সময় কাটাতে পারি না। বেশ কষ্ট হয়ে যায়। আর যাদের ভাষা ও ব্যবহার কর্কশ বা কাঠিন্যময়। তাদের থেকেও খানিকটা দূরেই থাকতে চাই।

অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে লাগলেন। জানা গেল, আধ্যাত্মবাদের সন্ধানে তিনি তিন দশকের বেশি সময় ধরে। শুধু দেশে নয় ভারত সহ বিশ্বের বহুদেশ ঘুরেছেন। বহু কিছু জেনেছেন। তার নিজের গুরুও এই দেশের নন। তিনি ভারতের কোন এক প্রদেশের।

উনার কথা মতো, আধ্যাত্মবাদ, ধ্যান, যোগ সহ নানাবিধ বিষয়ে তিনি যে সকল কোর্স করেছেন। তা এই দেশের অনেক গুরুও করেন নি। তাই এই দেশে আধ্যাত্মবাদের পেছনে ঘুরাফেরা মানে সময় নষ্ট। উনি এখন আর ঘুরেন না। যা পাওয়ার তা পেয়ে গেছেন। যা বোঝার তা বুঝে গেছেন।

আর তার প্রেক্ষিতে তিনি বারংবার প্রমাণ করার চেষ্টা চালাতে লাগলেন- আমার ভাব-ভাবনা-ভাবের ভুবন সবই অলীক চিন্তা। সে সব সস্তা দরের নিচু শ্রেণীর কল্পনা বিলাশ মাত্র। এভাবে ঘুরে কিছুই হবে না। এদেশে কেউ কিছুই জানে না। এখানে কোনো সিদ্ধি সাধুগুরুই নেই। আদতে এদেশে সাধুগুরুই নেই।

উনি ধ্যান সম্পর্কিত সে সকল কোর্স করেছেন। যে সকল শিক্ষা নিয়েছেন। যে সকল পুস্তকাদি পাঠ করেছেন। যে সকল গান শুনেছেন। যে সকল গুরুর সান্নিধ্য পেয়েছেন। তা ভিন্ন অন্য কোনো ভাবেই জ্ঞানের বিকাশ সম্ভব নয়। অন্ত্যত আধ্যাত্ম বিদ্যায় তো নয়ই।

কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক এমন জোশে উঠে গেলেন যে, তার কথায় মূর্ত হতে লাগলো। জগতের কেউ তার ভাবনার সমকক্ষ নন। তার বা তাদের ধারেকাছে কেউ হতেও পারে না। এখানে ‘তাদের’ শব্দটা ব্যবহার করলাম। কারণ তিনি প্রথমেই বলেছেন, তিনি ধ্যান-যোগ-ক্রিয়া সম্পর্কিত যে সকল প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

আধ্যাত্ম জ্ঞান লাভ করতে হলে অবশ্যই তিনি যা যা করেছেন; তাই একমাত্র পথ। এবং তাই তাই করতে হবে। এবং এবং এবং যারা এ সকল কিছু করে নাই। তাদের কোনো যোগ্যতাই রাখে না আধ্যাত্ম বিষয়ে কথা বলতে। ভাবতে। জানতে। বুঝতে।

অন্যদিকে আমি ক্রমাগত নিজেকে… নিজের বিচার বিবেচনাকে… নিজের ভাবনাকে… নিজের বিবেক বোধকে… যে সংস্কারের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষীণ চেষ্টা চালাচ্ছি। তার মধ্যে একটা বড় অংশ জুড়ে আছে ‘সহ্য শক্তি’ আর ‘ধৈর্য্য শক্তি’ বৃদ্ধির পরীক্ষা।

এই দুইটাই আমার পক্ষে… আমার চরিত্রের পক্ষে… বড্ড বেমানান। তারপরও একটা নিরব চেষ্টা চলতেই থাকে। গত বেশ কিছুদিন ধরে এর চূড়ান্ত চেষ্টা চলছে। তবে সব সময়… সকল সময়… সকলের সাথে… সকল পরিস্থিতিতে যে এই দুই শক্তির সাথে পেরে উঠি তা তো নয়।

অনেক সময় শেষ মুর্হূতে বাঁধ ভেঙ্গে যায়। অনেক সময় বাঁধ ভাঙ্গার শেষ মুর্হূতে ভাঙ্গন আটকে দেয়ার চেষ্টা করি। অনেক সময় ভাঙ্গন ধরা দেয়ার পরও যখন বোধ হয়। তখন ফিরে আসবার চেষ্টা করি। এভাবেই খেলাটা চলে নিজের সাথে… নিজের মতো করে…।

যেখানে জয়ী হওয়ার কোনো দায় নেই… পরাজয়ে লজ্জা নেই…। কেবল চেষ্টা করে যাওয়া। যতটা পারা যায়। সেটাই যাত্রার অর্জন। এর বেশি কিছু নয়।

ভদ্রলোক সর্বক্ষণ তার ড্রাইভারকে নিদের্শনা দিয়েই চলেছেন। ডানে যাও, বামে যাও, আস্তে যাও, জোরে যাও, এসি বাড়াও, এসি কমাও। তারই ফাঁকে ফাঁকে উনি নানাভাবে আমাকে চেপে ধরবার চেষ্টা করতে লাগলেন। আমার ভাব-ভাবনার সাগরে বারংবার হানা দিতেই লাগলেন।

কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক এমন জোশে উঠে গেলেন যে, তার কথায় মূর্ত হতে লাগলো। জগতের কেউ তার ভাবনার সমকক্ষ নন। তার বা তাদের ধারেকাছে কেউ হতেও পারে না। এখানে ‘তাদের’ শব্দটা ব্যবহার করলাম। কারণ তিনি প্রথমেই বলেছেন, তিনি ধ্যান-যোগ-ক্রিয়া সম্পর্কিত যে সকল প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

যে সকল স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে সেগুলো নিয়েছেন। যে সকল সাধুগুরুরা তা পরিচালনা করছেন। বা যাদের ধারায় সেগুলো পরিচালনা হয়েছে বা হচ্ছে। এবং তিনি যে সকল ধ্যান-জ্ঞান করেন। আর সে সমস্ত যারা করেন নি তারা সাধনায় কোনো যোগ্যতা রাখেন না বলেই তার বিশ্বাস। আর যারা করেন তারাই হলো এখানে ‘তাদের’।

আমিও তাকে বারবার তাই বলছিলাম, আদৌতে আমি কিছুই বুঝি না। এতশত বোঝার সাধ্যও আমার নেই। এতে উনি আরো উত্তেজিত হয়ে উঠেন। আসলে হয়তো উনি চাইছিলেন একটা জোড়দার তর্ক করতে। কিন্তু আমার সহজভাবে মেনে নেয়ার প্রবণতা উনাকে বিরক্ত করে তুলছিল।

সাধুগুরুদের বেশিভাগকেই নাম ধরে অবজ্ঞার সুরে ডাকতে উনি বিশেষ পছন্দ করেন। উনার মতে, তারা তো কেউ সিদ্ধ পুরুষ নন। তাদের সম্মান দেখাতে হবে কেনো?

উনার কথা শুনে মনে হলো, তারা রাস্তার পারের টোকাই ছেলেটার মতোই নগন্য। যাকে সবাই দেখে কিন্তু কেউ পাত্তা দেয়া না। যারা পাত্তা দেয় তারাও তাদের সমকক্ষ। অর্থাৎ তারাও টোকাই বা নগন্য শ্রেণীর।

চাইলে তর্ক করা যেত হয়তো। তারপরও আমি নিজের ধৈর্য্য পরীক্ষা দিতেই লাগলাম। এরমাঝেও যে দু-চার কথা বলতে চাইলাম। তাতেও তার ঘোরতর আপত্তি। তিনি সেই কথার সূত্র ধরেই উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন বারবার।

আমি যতই কোমল স্বরে বিনীতভাবে বলতে চাই মাঝে মধ্যে দুই এক কথা। উনি আরো রেগে যান। উনি ইনিয়ে বিনিয়ে এটাই বলতে চাইছেন। আমি কিচ্ছুটি বুঝি না।

আমিও তাকে বারবার তাই বলছিলাম, আদৌতে আমি কিছুই বুঝি না। এতশত বোঝার সাধ্যও আমার নেই। এতে উনি আরো উত্তেজিত হয়ে উঠেন। আসলে হয়তো উনি চাইছিলেন একটা জোড়দার তর্ক করতে। কিন্তু আমার সহজভাবে মেনে নেয়ার প্রবণতা উনাকে বিরক্ত করে তুলছিল।

উনি ভেতরের বুনো মহিষটাকে আটকে রাখতে পারছিলেন না। এতো ধ্যান-জ্ঞান করেও কেনো উনি যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বা করার চেষ্টাটা করে উঠতে পারেন নি; সেটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না। সাঁইজি কথাই মনে পড়ছিল বারবার-

গুণে পড়ে সারলি দফা
করলি রফা গোলেমালে,
ভাবলিনে মন কোথা সে ধন
ভাজলি বেগুন পরের তেলে।।

করলি বহু পড়াশোনা
কাজে কামে ঝলসে কানা,
কথায় তো চিড়ে ভেজে না
জল কিংবা দুধ না দিলে।।

আর কি হবে এমন জনম
লুটবি মজা মনের মতন,
বাবার হোটেল ভাঙবে যখন
খাবি তখন কার বা শালে।।

হায়রে মজা তিলে খাজা
খেয়ে দেখলিনে মন কেমন মজা,
লালন কয় বেজাতের রাজা
হয়ে রইলাম একই কালে।।

আমাকে রাগিয়ে দেয়ার ব্রহ্মাস্ত্রটিও তিনি ব্যবহার করতে ছাড়লেন না। ফকিরকুলের শিরোমণি লালন সাঁইজিকে নিয়েও এমনসব কথা বলতে লাগলেন। যা আমার অনুভূতিকে আঘাত করতে বাধ্য। তারপরও আমি নিরবে শুনে যেতে লাগলাম।

আসলে যারা মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে আধ্যাত্মবাদ, ভাববাদ বুঝতে চায়। বা বুঝে গেছে ভেবে নেয়। তাদের সাথে তর্ক চলে না। আলাপও চলে না। তারা আসলে নিজেরাই নিজেদের জন্য সযত্নে বানিয়ে নিজেদের চোখে টিনের চশমা পরে থাকেন।

যাদের টিনের চশমা পরিয়ে দেয়া হয়। তারা জানে তারা যা দেখছে তার চেয়ে অনেক অনেক অনেক কিছু দেখবার বাকি আছে। তাই তাদের দেখবার আকাঙ্খাটা থেকেই যায়। আর যারা নিজেরাই টিনের চশমা পরে থাকে।

তারা তা পরার পর যতটুকু দেখতে পায়। তারা ভেবেই নেয় এরচেয়ে বেশি কিছু দেখবার নেই ব্রহ্মাণ্ডে। তারা অন্ধের হাতি দেখবার মতো নিশ্চিত থাকে। তারা যে অংশটা ধরে দেখেছে সেটাই হাতির গঠন।

তাকে অবশ্য দোষ দেয়া যায় না। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা তো শিক্ষা-জ্ঞান-মেধার বিচার-বিবেচনা এভাবেই করে থাকে। এভাবেই তো বেশিভাগ ক্ষেত্রে নাম্বারিং করা হয়। রোল নাম্বারে এভাবেই শিক্ষার্থীরা এগিয়ে থাকে। এভাবেই শিক্ষার মান নির্ণয় করা হয়।

একটা মানুষ এতো দীর্ঘ সময় ব্যায় করে। এতো ঘোরাঘুরি করেও বিনয় শিখতে পারলো না বিষয়টাই ভাবাচ্ছিল আমাকে।

তিনি বলেই চলেছেন। বলেই চলেছেন। বুঝিয়েই যাচ্ছেন বুঝিয়েই যাচ্ছেন; এভাবে কিছুই হবে না। আমি কাতর স্বরে একসময় বললাম, আমি কিছু হতেও চাই। কোনো কিছু হওয়া আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। তা হওয়ার কোনোরূপ যোগ্যতাও আমার নেই।

যা হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। ইচ্ছেও নেই। সেসব নিয়ে আমি মেতে থাকি না। আমাকে তাতে মাতানো যাবেও না। আমি কেবলই একজন যাত্রী। যাত্রা পথে যা কিছু দেখি তাই আমার সম্বল। এর বেশি কিছু না। কিন্তু কে শোনে কার কথা।

ভদ্রলোককে দেখে বারবার আমার ‘থ্রি ইডিয়েটস’ নামক হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রের ‘চতুর’ চরিত্রটার কথাই মনে পড়ছিল। যে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য যার পর নাই সবই করতে পারে।

তাকে অবশ্য দোষ দেয়া যায় না। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা তো শিক্ষা-জ্ঞান-মেধার বিচার-বিবেচনা এভাবেই করে থাকে। এভাবেই তো বেশিভাগ ক্ষেত্রে নাম্বারিং করা হয়। রোল নাম্বারে এভাবেই শিক্ষার্থীরা এগিয়ে থাকে। এভাবেই শিক্ষার মান নির্ণয় করা হয়।

জগতের প্রথাগত মানুষের কাছে এটাই মানদণ্ড। কিন্তু মুশকিল হলো, আমরা আলাপ করছিলাম এমন এক প্রথার ধারার কথা। যা কিনা প্রথা বিরোধী। তাই প্রথা বিরোধের মাঝে প্রথার আলাপ করতে গেলে তো একটু গণ্ডগোল বাঁধেই। তাই সাঁইজির কথাই মনে পরছিল বারংবার-

পড়ে ভূত আর হসনে মনরায়।।
কোন হরফে কি ভেদ আছে; লেহাজ করে জানতে হয়।।

আলেফ-হে-আর মিম দালেতে, আহাম্মদ নাম লেখা যায়,
মিম হরফটি নফি করে, দেখনা খোদা কারে কয়।।

আকার ছেড়ে নিরাকারে ভজলিরে আধেঁলা প্রায়,
আহাদে আহাম্মদ হল, করলিনে তার পরিচয়।।

জাতে ছেফাত ছেফাতে জাত, দরবেশে তাই জানতে পায়,
লালন বলে কাট মোল্লাজী ভেদ না জেনে গোল বাধায়।।

লেখালিখিতে শিক্ষিত মানুষের সুবিধা অনেক বেশি। তারা আগে থেকেই অনেক নিয়ম কানুন, বিধি-বিধান জানেন। কি কি লিখতে হবে। কিভাবে লিখতে হবে। কিভাবে লিখতে হয়? শব্দে গঠন। বাক্যের বিন্যাস।

কারক, বিভক্তি, সমাস, সন্ধি কোথায় কোনটা হবে। তাৎপর্য, সারমর্ম কি হবে। কোন শব্দের পর কোন শব্দ বসবে। ভাষার গাঁথুনি কি হবে? ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু আমার মতো মূর্খরা সেইসব কোনো কিছুই না বুঝে, না জেনে, না মেনে, না শিখে ধৃষ্ঠতা করে বসে। আপন খেয়ালে লিখতে বসে যায়। সেগুলো আদৌ লেখা হচ্ছে কিনা। এসব আদৌ পাঠকের পাতে দেয়া যায় কিনা।

এসব জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনাও আমরা করতে পারি না। তাই এই লেখা পড়তেই হবে এমন কোন দায় কারো উপর চাপাতে পারি না। তারপরও কেনো লিখি এ প্রশ্ন আমার নিজের কাছে নিজের প্রতিই।

প্রতিটা লেখা লিখবার পরই মনে হয় কিছুই তো হলো না। যা লিখতে চাই তার কিছুটাও তো প্রকাশ পেল না। বা প্রকাশ করতে পারলাম না। তারপরও লিখি। প্রতিদিনই লিখি। আরো বিস্তারে বলতে গেলে বলতে হয় প্রতি মুর্হূতেই লিখি। মাথার ভেতর লেখটা চলতেই থাকে।

শুরুতেই যে কথা বলছিলাম। আমার শিক্ষা-দীক্ষা নাই। তাই জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ-শাস্ত্র-কিতাব যে রাশি রাশি পড়ে ফেলেছি, সে দাবী করলেই মানবে কে? মহাজনদের রচনা পড়ে ফেলেছি বললেও মিথ্যাই বলা হবে।

আমার জ্ঞান অতীব অল্প। আর মেধার কথা নাই বা বললাম। তাই এই স্বল্পজ্ঞান-মেধাহীন বোধ-বিচার-বিবেচনা-বিবেক নিয়ে লিখতে লিখতে মনে হয়- আদৌ কি আমি লিখি? নাকি আমায় লেখায়?

যে লেখায়, তিনিই ত্বারনা দেন! তাঁতিয়ে তুলেন!! না লিখে তখন উপায় থাকে না!!! এটা কি প্রকৃতির খেয়াল? যেমন প্রকৃতি আপন মনে রিপিটেশন করেই চলে- পলক, মুর্হূত, ঘণ্টা, প্রহর, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, দশক, যুগ, শতাব্দী, সহস্রাব্দীর বিবেচনায়!

যদিও সেই রিপিটেশনে সকল সময়ই থাকে নতুনত্ব। অভিনবত্ব। তারপরও। একই কাজ প্রকৃতি করে চলে সময়ের নির্দিষ্টতা মেনে। আমিও কি সেই লুপে পরে গেছি???

আমি আমার সাথে যে কথা বলে চলি। তাই আসলে লিখার ভাষায় রূপ দেয়ার একটা প্রবণতা মাত্র। এটি হয়তো অনেকে চোখে বদ প্রবণতা। কিন্তু এই অভ্যাসটা গত বেশ কিছু বছর ধরে বহন করে চলেছি। তার প্রেক্ষিতেই যা সব হচ্ছে আর কি।

তাই ভাবি, কে প্রেরণা জোগায় এই লিখে চলার? কেউ এইসব ছাইপাস পড়বে না জেনেও যখন আমার লিখে যেতে বিন্দুমাত্র ক্লান্ত লাগে না; তখন হিসেব মিলে না।

খুব কাছের এক বন্ধুরূপি ভাই বলেছিল, “এসব বাদ দিয়ে কাজ কর। আগের দিন হলে তো পুরানো লেখা সের দরে বিক্রি করতে পারতি; এখন তো লিখিস স্ক্রিনে। সের দরে বিক্রির কায়দাও তো অবশিষ্ট রাখিস নাই।”

আরেক ভদ্রলোক বলেছিল, “আপনার লেখা লিখে না মানুষের কল্যাণ হবে, না আপনার কল্যাণ হচ্ছে। না হবে। শুধু শুধু সময় নষ্ট। এতো সময় নষ্ট করছেন কেনো? ভালো কাজে লাগান। আমিও ভাবি ভালো কাজে লাগাবো সময়।”

ভদ্রলোককে আমি ভীষণ পছন্দ করি। তাই তার কথা মতো মনে মনে ভালো কাজ খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু ভালো কাজটা যে কি তা তো আজও বুঝে উঠতে পারলাম না। খুঁজেও বের করতে পারলাম না। তাই আবারো লিখতে থাকি। আসলে এসব লেখা নয়। এসব হলো কথা।

আমি আমার সাথে যে কথা বলে চলি। তাই আসলে লিখার ভাষায় রূপ দেয়ার একটা প্রবণতা মাত্র। এটি হয়তো অনেকে চোখে বদ প্রবণতা। কিন্তু এই অভ্যাসটা গত বেশ কিছু বছর ধরে বহন করে চলেছি। তার প্রেক্ষিতেই যা সব হচ্ছে আর কি।

আবার সেই সব কথা যা প্রকাশ পায় লেখার ভাষায় তা গোটা কয়েক মানুষ পড়ে। তারা কেনো পড়ে? মাঝে মধ্যে ভাবি তাদের সাথে সময় করে কথা বলবো এই বিষয়ে। সময় করে। সময় নিয়ে। কিন্তু তাও হয় না।

আমি আসলে আমার গণ্ডির মধ্যেই থাকি। তাই তাদের সাথে তাদের দেখাও হয় না। কথাও বলা হয় না। কেবল নিজের সাথেই কথা বলে যাই। সেই ভরসায় লিখে চলি, এইভাবে যদি তাদের সাথে লিখে লিখে কথা বলাটা শুরু হয়। মালিক ভরসা। সাঁইজি তো বলেছেনই-

কাজ কি আমার এ ছার কুলে।
যদি গৌরচাঁদ মেলে।।

মনচোরা নাগরা রাই
অকুলের কুল জগৎ গোঁসাই,
সব কুল আশায়, সেই কুল দোহাই
বিপদ ঘটালে তার কপালে।।

কুলে কালি দিয়ে ভজিব সই
অন্তিমকালের বন্ধু যে ওই,
ভব বন্ধুজন, কী করিবে তখন
দীনবন্ধু দয়া না করিলে।।

কুলের গৌরবী যারা
গৌর গৌরব কি জানে তারা,
যে ভাবে সে লাভ, জানা যাবে সব
লালন বলে অন্তিম হিসাব কালে।।

(চলবে…)

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………………..
আরো পড়ুন:
মাই ডিভাইন জার্নি : এক :: মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
মাই ডিভাইন জার্নি : দুই :: কবে সাধুর চরণ ধুলি মোর লাগবে গায়
মাই ডিভাইন জার্নি : তিন :: কোন মানুষের বাস কোন দলে
মাই ডিভাইন জার্নি : চার :: গুরু পদে মতি আমার কৈ হল
মাই ডিভাইন জার্নি : পাঁচ :: পাপীর ভাগ্যে এমন দিন কি আর হবে রে
মাই ডিভাইন জার্নি : ছয় :: সোনার মানুষ ভাসছে রসে
মাই ডিভাইন জার্নি : সাত :: ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়
মাই ডিভাইন জার্নি : আট :: আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে
মাই ডিভাইন জার্নি : নয় :: কেন ডুবলি না মন গুরুর চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি : দশ :: যে নাম স্মরণে যাবে জঠর যন্ত্রণা
মাই ডিভাইন জার্নি : এগারো :: ত্বরাও গুরু নিজগুণে
মাই ডিভাইন জার্নি : বারো :: তোমার দয়া বিনে চরণ সাধবো কি মতে
মাই ডিভাইন জার্নি : তেরো :: দাসের যোগ্য নই চরণে
মাই ডিভাইন জার্নি :চৌদ্দ :: ভক্তি দাও হে যেন চরণ পাই

মাই ডিভাইন জার্নি: পনের:: ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
মাই ডিভাইন জার্নি : ষোল:: ধর মানুষ রূপ নেহারে
মাই ডিভাইন জার্নি : সতের:: গুরুপদে ভক্তিহীন হয়ে
মাই ডিভাইন জার্নি : আঠার:: রাখিলেন সাঁই কূপজল করে
মাই ডিভাইন জার্নি :উনিশ :: আমি দাসের দাস যোগ্য নই
মাই ডিভাইন জার্নি : বিশ :: কোন মানুষের করি ভজনা
মাই ডিভাইন জার্নি : একুশ :: এসব দেখি কানার হাটবাজার

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!