-মূর্শেদূল কাইয়ুম মেরাজ
‘ওউজা বোর্ড’
শুধু বাঙালীয় নয় সারা পৃথিবীতেই প্ল্যানচেটকে ঘিরে প্রচলিত আছে অগণিত কাহিনী-গল্প-গাঁথা। শিল্প-সাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্রেও এর প্রভাব কম নয়। প্ল্যানচেট অর্থাৎ আত্মার সাথে যোগাযোগের অনেক পদ্ধতি প্রচলিত আছে। তবে তার মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে ওইজা বোর্ড। কারণ চাইলে এটি সকলেই করতে পারে। এজন্য শুধু বিশেষ আর কিছু জোগাড়যন্ত্র করতে হয় না।
এই প্ল্যানচেট প্রযুক্তিটি পূর্বের সকল আধুনিক উদ্ভাবন থেকে সহজতর ও বহনযোগ্য। এর জন্য অন্ধকার কক্ষ, মোমবাতি, নিশ্চুপ পরিবেশ প্রয়োজন সত্য। তবে অন্য বিশেষ কোনো উপাচার না থাকায় এর জনপ্রিয়তা মৃতের আত্মার সাথে যোগাযোগে কৌতুহলীদের সবচেয়ে পছন্দের। তবে এটি খেলনার আকৃতির হওয়ার কারণে সাধারণত কৈশরেই এর ব্যবহার বেশি করে থাকে মানুষ।
আত্মার সাথে যোগাযোগে ওউজা বোর্ড ছাড়াও বেশকিছু পদ্ধতি প্রচলিত আছে। এরমধ্যে- টেবল টার্নিং, মুদ্রার নকশা, স্ফটিক বল, টর্চবাতি, পেন্টাগ্রাম, আয়না পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য।
ওউজা বোর্ড
প্ল্যানচেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পরিচিত পদ্ধতি হলো ওউজা বোর্ড। এই বোর্ড বাজারে তৈরি অবস্থায় কিনতে পাওয়া যায়। যদিও ‘টকিং বোর্ড’ নামে আত্মার সাথে যোগাযোগের একটা পদ্ধতি বহু আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। অনেকে দাবী করেন, এই বোর্ডের আবির্ভাব হয়েছিল গ্রীক বা রোমান শাসনামলে যীশুর জন্মেরও অনেক আগে।
পরবর্তী ১ জুলাই ১৮৯০ সালে এলিজা বন্ড নামের এক ব্যবসায়ী প্রথম এর বাণিজ্যিক বিপণন শুরু করেন। ওউজা বোর্ডের জনপ্রিয়তা প্ল্যানচেটের আদি সকল পদ্ধতিকে ছাড়িয়ে যায়। যেখানে আগে প্ল্যানচেট বোর্ডের মাথায় পেন্সিল আটকানোর জন্য ছিদ্র থাকত, ওউজাতে তা রূপান্তরিত হয়ে পেন্সিলবিহীন পয়েন্টারের চল শুরু হয়।
ওউজা বোর্ডের নিয়মাবলী-
১. ওউজা কখনও একা খেলা যাবে না।
২. দুষ্ট আত্মাকে পালাতে দেয়া যাবে না।
৩. ওউইজা বোর্ডে রুপার মুদ্রা রাখতে হবে।
৪. কখনও ঈশ্বরের কথা জিজ্ঞাসা করা যাবে না।
৫. বিদায় নিতে ক্রিয়া শেষ করতে হবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে। পার্ল কিউরান নামের জনৈক জ্যোতিষ এই বোর্ড ব্যবহার করে ভবিষৎবাণী করার পর থেকে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধে নিহতদের আত্মার সাথে যোগাযোগের জন্য এর ব্যবহার বাড়তে শুরু করে।
ওউজা শব্দটি এসেছে সম্ভবত এসেছে মিশরীয় ভাষা থেকে, যার অর্থ ‘সৌভাগ্য’। বাণিজ্যিক যাত্রার শুরুতে এর নাম টকিং বোর্ড থাকলেও ওউজা হাসবো কোম্পানি বাজারজাত করায় এটি পরিচিতি পায় ‘ওউজা বোর্ড’ নামে।
একসময় বেশ গুরুত্বের সাথে দেখা হলেও কালের বিবর্তনে এটি কৌতুহলীদের খেলায় রূপ নিয়েছে। তবে একে ঘিরে রহস্য আজো ঘণীভুত হয়। নানা কল্পকাহিনী যেমন আদিতে প্রচারিত ছিল তা এখনো অব্যাহত আছে। তবে বেশিভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনার আড়ালে দেখা যায় খেলায়ারদের কৌশল বা নিছক মজা করার প্রবণতা।
বাজারে নানা ধরনের ওউজা বোর্ড পাওয়া যায়। সাধারণত এই বোর্ডের মাঝামাঝি অংশে প্রথম সারিতে ইংরেজি বর্ণমালা ‘এ থেকে জেড’ পর্যন্ত লেখা থাকে। দ্বিতীয় সারিতে ইংরেজি ‘ওয়ান থেকে নাইন’ নাম্বার। আর উপরের একপাশে ইয়েস অন্য পাশে নো লেখা থাকে। বোর্ডের নিচে মাঝে লেখা থাকে গুডবাই অর্থাৎ বিদায়। আর থাকে বোর্ডের উপরে চলার জন্য হৃদয় চিহ্ন আকৃতির একটি মিডিয়াম পয়েন্টার।
এই মিডিয়াম পয়েন্টার কাঠের বা ক্রিস্টালের হয়ে থাকে। কোনো কোনোটাতে স্বয়ংক্রিয় চাকা যুক্ত থাকে। বোর্ড ব্যবস্থা করতে না পারলে কাগজের উপর লিখে স্বয়ংক্রিয় মিডিয়ামের পরিবর্তে ধাতব মুদ্রা বা কাঠের পাতলা টুকরো দিয়েও এই ক্রিয়া করা যায়।
রাতের বেলা অন্ধকার কক্ষে পিনপতন নিরবতায় মোমবাতির নরম আলোয় এই ক্রিয়া করা হয়। সাধারণভাবে, কয়েকজন গোল হয়ে বসে ওইজা বোর্ডের মিডিয়ামের উপর হাত রেখে আত্মাকে আহ্বান করে।ৱ
এতো গেলো আধুনিক সব পদ্ধতির কথা। মৃতের আত্মার সাথে যোগাযোগের মত-পথ গুণে বলা মুশকিল। এর কতো যে বৈচিত্র্য আছে সারা পৃথিবী জুড়ে; তা জানতে গেলে হতবাক হতে হবে সন্দেহ নেই। মানুষের কি নিদারুণ চেষ্টা মৃত্যুর পর আত্মার কি হয় তা জানাবার-বুঝবার তা সত্যই অবাক করার মতোই।
বলা হয়- এই ঘরে কোনো শুভ শক্তি আছে? থাকলে সাড়া দিন।
আত্মা উপস্থিত হলে মিডিয়াম আপনাআপনি ইয়েস বাটনের উপর চলে যায়। আর আত্মাকে প্রশ্ন করো হলে মিডিয়াম ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন অক্ষরের উপর যেয়ে একটা শব্দ তৈরি করে। যাতে লুকিয়ে থাকে প্রশ্নের উত্তর। আলাপ শেষ হলে গুডবাই লেখার উপর গিয়ে স্থির হয় মিডিয়াম।
ওউজা বোর্ডের মজাদার অভিজ্ঞতার কাহিনী যেমন প্রচারিত আছে। তেমনি আছে লোমহর্ষক নানা কল্পকাহিনী। একে ঘিরে নির্মিত হয়েছে অগণিত সাহিত্য-চলচ্চিত্র-শিল্প। ওউজা বোর্ডের বাকবিতণ্ডা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
এর নেতিবাচক ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় আইন করে এর উপর সাময়িক নিষেধ্জ্ঞাও জারি করা হয়েছিল বহু দেশে। আবার কেস সমাধানের জন্যও ওউজা বোর্ড প্রয়োগের অনুমতি পর্যন্ত দিয়েছিল আদালত।
টেবল টার্নিং
অনেকে প্ল্যানচেটে তেপায়া টেবিল পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। এটি অধিক প্রচলিত ‘টেবল টার্নিং’ নামে। প্ল্যানচেটে আগ্রহীরা অন্ধকার ঘরে মোমবাতি বা স্বল্প আলো জ্বেলে তেপায়া টেবিলের ধার শক্ত করে ধরে বসে। তারপর সকলে চোখ বন্ধ করে যার আত্মাকে ডাকা হবে তাকে স্মরণ করতে থাকে। এরই মাঝে দলপতি আত্মাকে ডাকতে শুরু করে।
আত্মা এলে কেঁপে উঠে টেবিলের পায়া। পায়া কতবার মাটিতে পা ঠুকল, সেই অনুযায়ী ধরা হত আত্মার উত্তর। এ পদ্ধতিও বাঙলা অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় ছিল। অনেকের বাড়িতেই একসময় দেখা যেতো তেপায়া টেবিল।
তেপায়া টেবিলকে ঘিরে ধরে আত্মা নামানোর চক্র বসাতেন কলকাতার আইনজীবী সৌরীন্দ্রমোহন। তার এই আসরে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি হতো বলে জানা যায়।
মুদ্রার নকশা
এ পদ্ধতিতে প্ল্যানচেট বোর্ডে মুদ্রার নকশা আঁকা থাকে। আগরবাতির ধোঁয়ায় পূর্ণ উল্টো করা একটি কাঁচের গ্লাস সেই বোর্ডের উপর রাখতে হয়। জোড়সংখ্যক মানুষ প্রত্যেকের অনামিকা আলতোভাবে বোর্ডের ওপর রাখে। এবার সকলের পরিচিত কোনো মৃত ব্যক্তির আত্মাকে আহ্বান করা হয়।
বোর্ডটি ঘুরতে শুরু করলে ধারণা করা হয় আত্মা উপস্থিত হয়েছে। তখন আত্মাকে প্রশ্ন করলে ওউজা বোর্ডের মতোই বিভিন্ন মুদ্রার নকশার উপর নিদের্শকটি যেয়ে এক ধরণের সাংকেতিক উত্তর দিয়ে থাকে।
টর্চবাতি
আত্মার সাথে যোগাযোগের আরেকটি জনপ্রিয় মাধ্যম হলো আলো পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সাধারণত টর্চলাইট ব্যবহার করা হয়। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার কক্ষে শক্ত-সমতল টেবিল বা মেঝের উপর টর্চলাইট উপুড় করে রেখে আত্মাকে ডাকতে হয়।
আত্মা উপস্থিত হলে টর্চলাইটটি আপনাআপনি জ্বলে উঠে। প্রশ্নের উত্তর হ্যা বা না তে দিয়ে থাকে। উত্তর হ্যা হলে আলো জ্বলে উঠে আর না হলে বন্ধই থাকে। আত্মা বিদায়ের সময় অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকা টর্চটি মাটিতে পরে যায়।
আয়না
এই পদ্ধতিতে আত্মাকে আহ্বান করার জন্য অন্ধকার কক্ষের মেঝেতে গোলাকার একটি আয়না রাখা হয়। আয়নার একপাশে হাঁটুগেড়ে আহ্বানকারী বসেন। অপর সকল পাশে আয়নাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি মোমবাতি জ্বালানো হয়। এরপর একটি বড় জ্বলন্ত মোমবাতি থেকে গলে পড়া মোম দিয়ে আয়নাটি ভরাট করে ফেলা হয়।
মোম ভরে উঠলে তার উপর পানি ছিটিয়ে দিয়ে আয়নার চারপাশে লবণের রেখা টেনে দেয়া হয়। এবার তীক্ষ্ণ ছুরি দিয়ে আয়নার উপরের জমাট মোমের উপর যার আত্মাকে ডাকা হবে তার আকৃতি আঁকা হয়। এবার আহ্বানকারী সেই ছুরি দিয়ে নিজ দেহের অংশ কেটে রক্ত ছিটিয়ে দেয়।
আত্মা উপস্থিত হলে আয়নায় যে ছবি আঁকা হয়েছে তাতে পরিবর্তন দেখা দেয়।
পেন্টাগ্রাম
এই পদ্ধতিতে আত্মার আহ্বনকারীর জন্য একটি আর আত্মার জন্য পৃথক একটি মোট দুটি নয় ফুট ব্যাসের বৃত্ত আঁকা হয়। এই বৃত্তকেই সার্কেল অফ পাওয়ার বলা হয়। সাথে থাকে বেশকিছু সাংকেতিক চিহ্ন। আহ্বানকারী নিজ বৃত্তের মাঝে অবস্থান করে বেশ কিছু আচারের মাধ্যমে আত্মাকে আহ্বান করে থাকে।
আত্মা উপস্থিত হলে অপর বৃত্তটির মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সেই বৃত্তের চারপাশে লাগনো মোমবাতিগুলো জ্বলে উঠে। বা জ্বলন্ত মোমবাতিগুলো নিভে যায়।
স্ফটিক বল
প্রাশ্চাত্যে মৃত ব্যক্তির সাথে যোগাযোগের আরেকটি জনপ্রিয় মাধ্যম হলো স্ফটিক বল। এই বিদ্যায় পারদর্শীরা বলেন, অন্ধকার ঘরে মোমবাতির হালকা আলোতে স্থির হয়ে বসে সামনে স্ফটিক বল রেখে, মন্ত্র-তন্ত্রের মাধ্যমে মিডিয়াম আত্মাকে আহ্বান করলে আত্মা ধরা দেয়।
মিডিয়াম মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বোল আওরাতে আওরাতে আত্মাকে আহ্বান করতে থাকে। আত্মা উপস্থিত হলে সেই স্ফটিক বলে তা দৃশ্যমান হয়।
আধুনিক প্রযুক্তি
এই শতাব্দীতে আত্মার অস্তিত্বকে বোঝার জন্য নানা হাইটেক প্রযুক্তি প্রবর্তন করা হয়েছে। এর বেশিভাগই ডিকেক্টর মেশিন। যা বিভিন্ন অযাচিত তরঙ্গ ধরে তা থেকে সাংকেতিক ভাষা উদ্ধারের চেষ্টা করে থাকে। অপ্রচলিত কোনো তরঙ্গ পেলে ডিকেক্টর সংকেত দিয়ে তা জানান দেয়। আর এ সব সংকেতের অর্থ করে মানুষ বুঝবার চেষ্টা করে আশপাশে কোনো আত্মার অস্তিত্ব আছে কিনা।
এসব যন্ত্রের মধ্যে ইভিপি(ইলেকট্রোনিক ভয়েস ফেনোমিনান) ও ইএমএফ(ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড) উল্লেখযোগ্য। এ দুটি যন্ত্র মূলত বিভিন্ন শব্দ-তরঙ্গ ধরে তার ভাষা উদ্ধার এবং আত্মার অস্তিত্ব বুঝতে সাহায্য করে। এছাড়াও পরিবেশের পরিবর্তন ধরতে যে সকল যন্ত্র ব্যবহার করা হয় তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য- হাইটেক মোশন ডিটেকটর ক্যামেরা, থার্মাল ইমেজিং স্কোপস, ইনফ্রারেড থার্মাল, স্মল উইন্ডকাইমস, রেড সেলোফান ইত্যাদি।
এতো গেলো আধুনিক সব পদ্ধতির কথা। মৃতের আত্মার সাথে যোগাযোগের মত-পথ গুণে বলা মুশকিল। এর কতো যে বৈচিত্র্য আছে সারা পৃথিবী জুড়ে; তা জানতে গেলে হতবাক হতে হবে সন্দেহ নেই। মানুষের কি নিদারুণ চেষ্টা মৃত্যুর পর আত্মার কি হয় তা জানাবার-বুঝবার তা সত্যই অবাক করার মতোই।
কতভাবে কত রকম ফেরে যে মানুষ মৃতের আত্মার সাথে যোগাযোগের এই চেষ্টা চালিয়েছে এবং চালিয়ে যাচ্ছে তার হিসেব মেলা ভার। মানুষের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা লোভী ব্যবসায়ী মহল যেমন ইতিহাসের নানা সময় নানা প্রযুক্তি আবিস্কার করেছে। তেমনি আবার একদল মানুষ সত্যি সত্যি আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যায় কিনা তা নিয়ে গবেষণা করেছে জীবনভর।
আর ধর্ম বা মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে এই পথে যারা পা বাড়ায় তাদের কথা কি আর বলবো। শহুরে শিক্ষিত-প্রগতিশীল মানুষ যেমন মজার ছলে বা শখের বশে এই চর্চা করেছে। তেমনি শ্মশান, চিতা, কবরস্তান, গভীর অরণ্য, পাহাড়-পর্বত, গুহা, নদীর পার, নির্জন স্থান বা পোড়া বাড়িতে বসে যোগী-সাধক-তন্ত্রিকরা কাটিয়ে দিচ্ছে গোটা জীবন।
অনেকে মদও ভোগ দিয়ে থাকে। অশরীরী হওয়ায় প্রেত সরাসরি খাবার গ্রহণ করে না। ভোগ আসলে তাকে আকর্ষণ করার জন্যই দেয়া হয়। শেয়ালের চামড়া, বিভিন্ন পশুপাখির দেহাবশেষ, মরার খুলি ইত্যাদিও সাথে রাখে।
প্রেতচর্চায় আফ্রিকা, লেটিন আমেরিকা, ভারতবর্ষ, রেড ইন্ডিয়ানের সূদীর্ঘকালের ইতিহাস রয়েছে। কেবল প্ল্যানচেটই নয় প্রেতচর্চাও প্রগতিশীল বাঙালী পিছিয়ে ছিল না। শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে এমন বহুনাম ইতিহাসের পাতায় প্রেতচর্চার সাথে জড়িয়ে আছে। কেবল বিনোদনের জন্যই নয়, এর পেছনে ছিল তাদের অন্তর্নিহিত জিজ্ঞাসা। সেসব গল্প তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে লিখিত আলোচনা থেকে জানা যায়।
সনাতন মতে, প্রেত সাধনার ইতিহাস অতি দীর্ঘ। প্রেত সাধনার জন্য আছে পৃথক বিদ্যা, পৃথক শাস্ত্র। অতৃপ্ত আত্মা বলে একটি শব্দও আছে। সাধারণভাবে বলা হয়, মৃত্যুর পরও যে আত্মা পৃথিবীতে থেকে যায় সে আত্মা প্রেতগতি প্রাপ্ত হয়। প্রেতগতি প্রাপ্ত হলে আত্মা দুই জন্মের মর্ধবর্তী স্তরে আটকে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে প্রেতযোনি মুক্ত হয় ততক্ষণ সে নতুন দেহধারণ করতে পারে না। তাই জন্মান্তরও আটকে থাকে।
আর আত্মা প্রেতযোনি থেকে মুক্ত হতে মানুষের সংস্পর্শে আসতে চায়। যদি কোনো কর্ম করে সে নতুন দেহ ধারণ করতে পারে সে চেষ্টায় রত থাকে। আবার অনেক প্রেত তার অতৃপ্ত ইচ্ছা মানুষের সংস্পর্শে এতে পূরণ করতে চায়। প্রেতযোনীতে থাকা আত্মা অনেক সময় মানতেই চায় না সে মারা গেছে, তাই সে মানুষকে নানাভাবে বিপদে ফেলতে চায়।
অপঘাতে মৃত, অপূর্ণ মনোবাসনা, বিষয়বাসনায় আসক্ত, অসম্পূর্ণ কর্ম, অপরাধ বোধে লিপ্ত, আত্মহত্যাকারী, মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ, প্রতিশোধ পরায়ণ মানুষ মৃত্যুর পর প্রেতযোনী প্রাপ্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। প্রেত যেহেতু নিজেই মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের বাসনায় থাকে। তাই তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন অধিকতর সহজ হতে পারে এই ভেবে উৎসাহী মানুষ এবং সাধককুল প্রেতচর্চা করে থাকে।
এই সাধনা করতে সাধক সাধারণত শ্মশান, কবরস্থান, চিতা, ঘনজঙ্গল বা জলাশয়ের পাশে সাধনা করে থাকে। প্রথমে সাধক সকল অশুভ শক্তি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে মন্ত্রবলে নিজ দেহ বন্ধ করে। লোভানের ধোয়া দিয়ে নেয়া হয় চারপাশে। এরপর প্রেতকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভোগ দিয়ে থাকে।
সাধারণত জলে ভেজানো চাল, চিড়া, খৈ, কালো তিল, মাসকলাই ডাল, মধু, কলা, ঘি, দই ইত্যাদি মিশিয়ে মোয়ার মতো পিণ্ড তৈরি করে কলাপাতার উপর রেখে ভোগ দেয়া হয়। ক্ষেত্র বিশেষে তাজা বা শুটকি মাছ পুড়িয়ে নিবেদন করা হয়। মাছ বা শুটকি মাছ পোড়া গন্ধ প্রেতের খুবই পছন্দ বলে বিশ্বাস করা হয়।
অনেকে মদও ভোগ দিয়ে থাকে। অশরীরী হওয়ায় প্রেত সরাসরি খাবার গ্রহণ করে না। ভোগ আসলে তাকে আকর্ষণ করার জন্যই দেয়া হয়। শেয়ালের চামড়া, বিভিন্ন পশুপাখির দেহাবশেষ, মরার খুলি ইত্যাদিও সাথে রাখে।
যারা শুদ্ধ প্রেত সাধনা করে থাকে তারা বলেন, দেহধারী জীব অশরীরী বিষয় সম্পর্কে সরাসরি জানতে পারে না। তার জন্যই অশরীরী আত্মার সাধনা করতে হয়। সাধক যেমন চায় তার সাধনায় আগ্রসর হতে। অন্যদিকে প্রেতও চায় শুদ্ধ সাধকের সংস্পর্শে এসে প্রেতযোনী থেকে উদ্ধার পেতে।
বাঙলা অঞ্চলের তন্ত্র বা প্রেত সাধকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাধকদের নাম বলতে গেলে বলতে হয়- বামাখ্যাপা, তারাখ্যাপা, শংকরাচার্য, ত্রৈলক্য স্বামী, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী নগমানন্দ প্রমুখ।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………………………..
সূত্র:
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া
…………………………………..
আরো পড়ুন:
চুরাশির ফেরে: এক
চুরাশির ফেরে: দুই
চুরাশির ফেরে: তিন : আত্মা-১
চুরাশির ফেরে: চার: আত্মা-২
চুরাশির ফেরে: পাঁচ : সৎকার
চুরাশির ফেরে: ছয় : কর্মফল-১
চুরাশির ফেরে: সাত : কর্মফল-২
চুরাশির ফেরে: আট : পরকাল-১
চুরাশির ফেরে: নয় : পরকাল-২
চুরাশির ফেরে: দশ : জাতিস্মর
চুরাশির ফেরে: এগারো : প্ল্যানচেট
চুরাশির ফেরে: বারো : ওউজা বোর্ড
চুরাশির ফেরে: তেরো : প্রেতযোগ
চুরাশির ফেরে: চৌদ্দ : কালাজাদু
চুরাশির ফেরে: পনের: গুপ্তসংঘ–১
চুরাশির ফেরে: ষোল: গুপ্তসংঘ–২
চুরাশির ফেরে: সতের: ইলুমিনাতি