ভবঘুরেকথা
হাসন রাজা

হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: এক

-জহির আহমেদ

কথিত আছে, বেহেশত থেকে আদি-মানব আদমের অবতরণ হয়েছিল সিংহল দ্বীপ বা বর্তমান শ্রীলঙ্কার একটি পাহাড়ের চূড়ায়। মুসলমানরা পাহাড়টির নাম আদম পাহাড় বা আদম সিঁড়ি বলে জানে। সেখানে পাথরের উপর আদি মানবের পদচিহ্ন আজও রয়ে গেছে।

আবার ভারতীয় উপমহাদেশেই সনাতন হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তি। পরবর্তীতে এ এলাকায় মুসলমান শাসকদের রাজ্য জয়ের আগেই আরব থেকে এসে মঈনউদ্দীন চিশতি (র) মানুষের হৃদয় জয় করে ইসলামি সুফিবাদ প্রচার করেছিলেন।

তারপর তিনশত ঊনষাট জন দরবেশসহ ইয়েমেন থেকে বাংলায় এলেন হজরত শাহজালাল (র)। অতঃপর নদীয়ায় অবতীর্ণ হয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বৈষ্ণব ভাব রসের জোয়ার আনলেন। পরবর্তীতে খ্রিস্টান যাজকরা এসেও এদেশে ইশায়ী মানবতার ধর্ম প্রচার করেছেন।

সামাজিক সম্প্রদায় ভিন্ন হলেও এসব ধর্মগুরু সবারই অন্তরধর্মের নাম ছিল প্রেম ধর্ম।

বাংলার ধর্মীয় ইতিহাস মূলত বৌদ্ধ সহজিয়া, হিন্দু বৈষ্ণব, খ্রিস্টান যাজক ও মুসলমান সুফিদের ঐতিহ্যের ইতিহাস। এভাবেই যুগে-যুগে সকল ধর্মের সারাৎসার সমন্বয়ে আমাদের লোকালয়ের মানুষের মন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে।

অজ্ঞতা ও স্বার্থপরতার কারণে মাঝেমধ্যে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলেও, কট্টরপন্থা ও উগ্রতা এখানে বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। সাময়িক অস্থিরতার পর পরিশেষে সহিষ্ণুতার সুশীতল শান্তির পরিবেশই এখানে বিরাজ করেছে।

আমাদের পুণ্যভূমি বাংলাদেশ যুগে-যুগেই ছিল মরমিয়া সুফি-ফকির-বাউলদের আধ্যাত্মিক সাধন-ভজনের উর্বর চারণভূমি। এসব সুফি-ফকির-বাউলগণ সঙ্গীতকে তাদের ধর্মীয় সাধন-ভজনের একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছে।

তখন নারীসাহচর্য ও গান-বাজনা ছিল তার নেশা। এসব নিয়েই তিনি মত্ত থাকতেন। আর ঘোড়ায় চড়ে দাপিয়ে বেড়াতেন তার জমিদারি অঞ্চল। কোন একদিন তাঁর চোখ পড়লো দিলারাম নামে এক সুন্দরী হিন্দু যুবতীর উপর। মুগ্ধ হয়ে তাকে বিলিয়ে দিলেন গলার মূল্যবান সোনার হার।

বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই, শীতালং শাহ, পাগলা কানাই, রশিদ উদ্দিন, দুদ্দু শাহ, হাসন রাজা, আরকুম শাহ, পাঞ্জু শাহ, রমেশ শীল, মহর্ষি মনোমোহন, কানাই লাল শীল, রাধারমণ, জালাল উদ্দিন খাঁ, দুরবিন শাহ, উকিল মুন্সি, শাহ আব্দুল করিম, মালেক দেওয়ান, খালেক দেওয়ান, হালিম বয়াতি, রজ্জব দেওয়ান, মাতাল রাজ্জাক, ভবা পাগলা, ক্বারি আমির উদ্দিনসহ বহু নন্দিত মরমি বাউল এই প্রাণের বাংলা-গানের বাংলায় জন্ম নিয়েছেন।

রবীন্দ্র-নজরুলের গান বাংলার যে বিপুল জনগোষ্ঠীকে আকর্ষণ করতে পারে না, মরমি সঙ্গীতের এসব পদকর্তাদের রচিত গানই যুগে যুগে তাদের মনের খোরাক জুগিয়ে যাচ্ছে। তাঁরাই বাংলা সঙ্গীতের মূল ধারার ধারক-বাহক।

বাংলায় প্রাকৃত সমাজের ভাবের মানুষ, আত্মার আত্মীয় এই বাউল-ফকিরগণ। তাঁরাই বৃহত্তম বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথপ্রদর্শক বা প্রাণপুরুষ। যুগে-যুগে তাঁদের চর্চা ও অনুসরণ আমাদের মনোজগতকে উদার ও সমৃদ্ধ করছে।

বাঙালির আধ্যাত্মিক মরমি সঙ্গীতের রাজ্যে লালন ফকিরের পর যে নামটি উচ্চারিত হয়, তা হাসন রাজার নাম। এই হাসন রাজা প্রথম জীবনে ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক জমিদার। অত্যন্ত সুদর্শন ও দীর্ঘদেহী ছিলেন তিনি।

লম্বাবাহু, ধারালো নাক, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ ও বাবরি চুল, সব মিলিয়ে ছিলেন বহু লোকের মধ্যে চোখে পড়ার মতো সৌম্যদর্শন ও রমনীমোহন এক পুরুষ।

হাসন রাজা সুনামগঞ্জের রামপাশা ও লক্ষণছিরির প্রায় ৬ লাখ বিঘা জমির জমিদার ছিলেন। বড় ভাই ও বাবার মৃত্যুর পর অল্প বয়সেই বিশাল জমিদারির দায়িত্ব পড়ল তার উপর। জমিদারি পেয়ে হাসন হয়ে গেলেন উদ্দাম ও বিলাসপ্রিয় শাসক।

তখন নারীসাহচর্য ও গান-বাজনা ছিল তার নেশা। এসব নিয়েই তিনি মত্ত থাকতেন। আর ঘোড়ায় চড়ে দাপিয়ে বেড়াতেন তার জমিদারি অঞ্চল। কোন একদিন তাঁর চোখ পড়লো দিলারাম নামে এক সুন্দরী হিন্দু যুবতীর উপর। মুগ্ধ হয়ে তাকে বিলিয়ে দিলেন গলার মূল্যবান সোনার হার।

জমিদারের হাত থেকে অমূল্য উপহার পেয়ে দিলারামও তাঁকে জীবনের সর্বস্ব ভেবে হৃদয় বেদিতে পূজার আসনে বসালেন। আর হাসন রাজাও তাকে সাধনসঙ্গিনী করে নিলেন। দিলারামের প্রেমে মজে, তার জন্য দেওয়ানা হয়ে হাসন রাজা লিখলেন-

“ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর দিলারাম, ধর।
হাসন রাজারে বান্ধিয়া রাখ দিলারাম তোর ঘর।।”

“তোমরা শুনছনি গো সই।
হাসন রাজা দিলারামের মাথার কাঁকই।”…

হাসন রাজা-দিলারামের প্রেম কাহিনী বেশিদূর এগোতে পারলো না। পারিবারিক আভিজাত্য ও বংশগৌরবের কথা ভেবে যুবক জমিদারের মা দিলারামকে গ্রামছাড়া করলেন। দিলারাম হাসন রাজাকে ঠিকই বুঝতেন। তাই যাওয়ার সময় চোখের জলে বলে গিয়েছিলেন-

“আমি চলে গেলে অঘটন ঘটে যাবে মা!”

শেষে তাই হলো। বিচ্ছেদের আগুনে হাসন রাজার নারী আসক্তি আরও বেড়ে গেলো। বাইজি আর শরাবে আকণ্ঠ ডুবে গেলেন তিনি। তখন বজরা নৌকায় বাইজি ও বাদকদল নিয়ে কয়েক দিনের নৌবিহারে সুরমা নদীতে চলে যেতেন।

সেখানে চলত নাচ-গান। হাসন রাজা নিজেও গান লিখতেন ও গাইতেন। শোনা যায়, আবার কখনো নাইওরি নৌকাতেও হামলা চালানো হতো। লোকমুখে প্রচার হতে থাকে জমিদারের এসব কীর্তি কাহিনী। এ ব্যাপারে হাসন রাজা নিজেই লিখেছেন-

“সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া।”

আবার লখনৌ থেকে আসা এক সুন্দরী বাইজি, নাম পিয়ারি। এই পিয়ারির মধ্যেও হাসন রাজা তার মানস পিয়াকে দেখে লিখেছেন-

“নেশা লাগিল রে।
বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে,
হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিলোরে।”

হাসন রাজার অকপট উচ্চারণ ও সরলতার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশকে তাঁর গবেষকগণও সেই ‘সর্বলোকের’ দৃষ্টিতেই দেখেছেন। আসলে লাম্পট্য ছিল হাসন রাজার বাইরের একটি খোলস মাত্র। তাঁর ভেতরে ছিল অন্যরূপ। মূলত জীবনকে উপলব্ধি করা, সৃজনশীলতাকে চাঙ্গা করা, গান লিখা এসব ছিল হাসন রাজার মূল উদ্দেশ্য।

ওদিকে হাসন রাজার মাও ভাবলেন, হাসন যে পথে চলছে, নিজের ধ্বংসই সে ডেকে আনবে। তাই ছেলেকে তিনি ফিরিয়ে আনতে চাইলেন। এ বিষয়ে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে-

বাইজির ছন্মবেশে হাসন রাজার মা নিজেই একরাতে ছেলের জলসাঘরে গিয়ে হাজির হলে, তারপর থেকেই লজ্জায় ও মনোকষ্টে তিনি নারী ও নেশার পথ থেকে অনেকটাই ফিরে এসেছিলেন।

সামান্য কিছু ধনসম্পদ নিজের এবং পরিবারের জন্য রেখে অধিকাংশই বিলিবণ্টন ও উইল করে দিয়ে দরবেশী জীবন যাপন করতে লাগলেন। তাঁর উদ্যোগে হাসন এম. ই. হাই স্কুল, অনেক ধর্ম প্রতিষ্ঠান, আখড়া স্থাপিত হলো।

নাচ-গান ও ভোগ-বিলাসে মজে থাকলেও, হাসন রাজার ভেতরে ছিল এক অব্যক্ত হাহাকার। এত বিষয়-আসয়ের মাঝে থেকেও তাঁর নিঃসঙ্গতা ও মনোবেদনা দূর হয় না। মনের একান্ত ভাবনা থেকে তাই দোতারা বাজিয়ে তিনি গান করেন। হাসন রাজার মাও ছিলেন জমিদার-কন্যা।

তিনি ছিলেন ছেলের মাথার উপর ছায়ার মতো। একদিন তাঁর মায়েরও মৃত্যু হয়। মায়ের মৃত্যুতে প্রচণ্ড এক শোকে কাতর হয়ে পড়লেন তিনি। তারপর ঘটলো এক অলৌকিক ঘটনা। আধ্যাত্মিক এক স্বপ্ন দর্শন হলো তাঁর। এই ইলহাম বা স্বপ্নদর্শন তার জীবনদর্শনে নিয়ে এলো আমূল পরিবর্তন।

তিনি বিলাসিতা ও জমকালো পোশাক পরা ছেড়ে দিলেন। শুধু বাইরেই নয়, ভেতরেও এলো তাঁর বিরাট পরিবর্তন। এই সত্য স্বপ্ন দেখে তাঁর মনের কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহাদির দুয়ারগুলো খুলে যেতে থাকে। তাঁর স্বভাব-চরিত্রে এলো এক শান্ত-সৌম্যভাব।

এত দিনের যাপিত জীবনের ভুলগুলো শোধরাতে শুরু করলেন তিনি। এক সময়ের ‘চণ্ড হাসন’ হয়ে গেলেন মানবিক ও নম্র হাসন। রাজা হলেন ঋষি। হলেন রাজর্ষি। এবার তিনি আল্লাহর প্রেমে পুরোপুরি মগ্ন হলেন। জাগতিক বিষয়-সম্পদের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে গেলেন।

সামান্য কিছু ধনসম্পদ নিজের এবং পরিবারের জন্য রেখে অধিকাংশই বিলিবণ্টন ও উইল করে দিয়ে দরবেশী জীবন যাপন করতে লাগলেন। তাঁর উদ্যোগে হাসন এম. ই. হাই স্কুল, অনেক ধর্ম প্রতিষ্ঠান, আখড়া স্থাপিত হলো।

তখন সাধারণ মানুষের খোঁজখবর নেয়া হয়ে উঠল তাঁর প্রতিদিনের কাজ। আর সব কাজের ওপর ছিল গান রচনা। ত্যাগকেই করলেন তাঁর সম্পদ। সংসারে থেকেও তিনি এক সংসার-বিরাগী সন্ন্যাসী-

লোকে বলে বলেরে-
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার,
কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার।।

ভালা কইরা ঘর বানাইয়া
কয়দিন থাকমু আর,
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
পাকনা চুল আমার।।

এই ভাবিয়া হাসন রাজা
ঘর-দুয়ার না বান্ধে,
কই নিয়া রাখব আল্লায়
তাই ভাবিয়া কান্দে।।

জানত যদি হাসন রাজা
বাঁচব কতদিন,
বানাইত দালান-কোঠা
করিয়া রঙিন।।

(চলবে…)

হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: দুই>>

……………………..
আরো পড়ুন:
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: এক
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: দুই
হাসন রাজা: বাংলার এক রাজর্ষি বাউলের মর্মপাঠ: তিন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………..
আরও পড়ুন-
সাধক ভবা পাগলা
শাহ্ আব্দুল করিম : জীবনী ও গান
সাধক রাধারমণ দত্ত
মহর্ষি মনোমোহন ও মলয়া সঙ্গীত
মোহন চাঁন বাউল
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-১

জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-২
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৩
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৪
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৫
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৬
জালাল উদ্দীন খাঁর তত্ত্বদর্শন : পর্ব-৭

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!